প্রেম এবং অপ্রেমের কাব্য
এ-এক প্রেমের শহর, এ-এক প্রেমের শহর, এখানকার বাতাস প্রেমের সৌরভ বয়ে আনে। হাজারো প্রেমের কলি…..
উৎসর্গ: সেলিম আল দীন স্যারকে।
(স্যার, লেখাটার প্রথম পাঠক ছিলেন। বলেছিলেন, ‘এ কবিতা নাটকের দিকে ধাবমান। তুই নাটক লেখ’। ‘স্যার, নাটক লিখতে বলেছিলেন আমাকে, মনে আছেতো! আপনি না প্রথম পাঠক হবেন!’)
কেউ কেউ অমরত্ব চায়।
বুড়িমার কোলে শুয়ে শৈশবের গল্প শোনা ফুরিয়েছে বহুকাল আগেই তাদের। তারা জেনেছে, শুনেছে অমাবস্যা রাতে তুলে আনা, শ্মশানের চাপামাটি দেয়া মৃতের নাভির মুদ্রা, অমরত্ব কিংবা ঘোড়াসম যৌনক্ষমতা দেয়।
আরাধ্য এ ধন নিতে পারে যারা
ধ্যানবিনে ধনী হয় তারা।
তারপর কেটে গেছে বহুকাল। তারাও পেরিয়েছে অভিজ্ঞতার বহু সেতু। কোন এক তারিখবিহীন রাতে তারা বদখত বুড়ির গল্পের অমোঘ বাণী মনে রেখে অমরত্ব আনতে স্থানকালহীন এক মৃতের নগরাভীমুখে যাবার কেচ্ছা করে।
তারা মানে প্রথম দ্বিতীয় আর তৃতীয় যুবক।
সে রাত্রিতে অমরত্বপ্রার্থী তিনজন ঘোড়সওয়ারের গায়ে অদম্য অদ্ভুত শক্তির উদয় ঘটেছিল। তারা চলতে শুরু করেছিল মৃতের নাভির মুদ্রা তুলে আনবে, আনবেই বলে। পরম শক্তির সন্দর্শন ওই অমোঘ আরাধ্য শবনাভিমুদ্রা অমরত্ব লোভাতুর তিনযুবার সমস্ত রিপু ভক্ষণ করে তাদের ধাবিত করে এক অনন্ত যাত্রায়।
অবিশ্রান্ত ছুটে ছুটে
শ্মশানের ঘাটে আঁধার নামলে
ভয় পেয়ে মরে যায় রক্তকণিকায় বেঁচে থাকা
অ-বিরাম ঘোড়াগুলো,
তিনজন যুবকের গলা শ্মশানের নির্জনতায়
তীব্র অনারাধ্য ভয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে আসে।
তারা আবিষ্কার করে বিশাল এই শবালয়
নদীতীরে একা, দাঁড়িয়ে।
জনশূন্য এবং অসহ্য তীব্রদাহ আগুনে বধীর আর মূক।
তিনজন বেপথু ক্ষমতাকাতর
পরিশ্রান্ত সওয়ার,
শ্মশানের ঠাণ্ডা পেলবতায় ভেসে যাওয়া
উদ্দাম বাতাসে নিজেদের ঠিক নিজেরাই
চিনতে গিয়ে ভিড়মি খায়।
একজন এই অসহ্য নীরব নীরবতায়
হড়হড় করে নিজের বমন ঢেলে দিয়ে নীরবতা ভাঙে।
দখিনা হাওয়ার নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোন শব্দ নাই।
শব্দ নাই চরাচরে; শ্মশানও শব্দহীন।
প্রত্যেকের মগজ তখন স্যাঁতস্যাঁতে পাথরের কঠোর দেয়াল। কোন বোধ নাই। হিমশীতল গুরুভার অনুভব মেরুদণ্ড বরাবর। বমনকারী নিরদ সতীর্থকে ধরতে ভুলে যায় বাকী দুইজন। একজন উদাসের মতো চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। মেঘেরা আগের মতোই আকাশে। বিষণ্নভাবে চলেছে হামাগুড়ি দিয়ে।
অস্ফুট অনুচ্চে বলে ওঠে ‘এতো মেঘ
কোথা থেকে আসে? কোথায়-বা যায়?’
একজনের মনে হয় এ-তো বিষণ্ন সৌন্দর্য। এই বিষণ্ণ নীরবতা ও সৌন্দর্য যেন তাকে পিষে ফেলছে ধীরে ধীরে। মৃত্যুর চেয়েও মন্থর গতিতে।
হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায় তারা। আকাশের কৃপাপ্রার্থী অসংখ্য ভয়ার্ততা-জয়ী শ্মশান-তরু তাদের ঘিরে ধরে অজুতপ্রশ্নজালে।
কেনো তারা এসেছে? এই শবালয়ে?
গভীর ভয়াল অমাবস্যা রাত চরাচর সাক্ষী রেখে
নিজেদের মাথার উপরে?
শত বছরের দীর্ঘ বৃক্ষের উন্মাদ উদ্বায়ী ধাতুরস,
রজঃস্বলা নারীর আরাধ্য ধবল দুধফেনা,
মূর্ত ভাষার বিমূর্ত চিৎকার,স্বরধ্বনি,
জাগতিক কোলাহল,
সব ছেড়েছুড়ে এই তিনজন
কেনো এলো? এলো বিবসন করে নিতে নিজেদের?
কেন এলো?
কেবলি সাহস নিজের সহায় করে?
করাঙ্গুল করপুটে
আপাদমস্তক নিজেদের খোঁজে তিন যুবা—
সেই অমা ভরা রাতে।
দিশেহারা শবালয় শ্মশানের
নির্জন ঘাটে-বুকে।
নিজেদের অচেনা লাগার ভয়ে, সংশয়
সংশয়ে ধুকে।
তিন যুবা তিন মনে ভাবে ।
দেখেনি কেউ দেখেনি কেউ তাকে।
মুখ চায় পরস্পর পরস্পরে।
শুধু সাহসে ভর করে তারা মাটি খোঁড়ে। উচ্চনাদে কবরখোদকের গান গায়। গোঙ্গায়। বুকের বাইরে কোন শব্দ বের হয় না। প্রত্যেকের একাকী চিৎকারে ভারীতর ভারী হয়ে আসে নিজেরাই নিজেদের কাছে। অবিনশ্বরতায়; বিমলীন বোধে।
তারা মাটি খোড়ে তারা ভয়ে খোড়ে
পাছে বন্ধু আরজন ভীতু ভাবে মনে
নিজ সন্দর্শনে
যাঞ্ছাহীন মনে
একজন সাহসিক। বীরের বাসনা মনে পুষে রেখে বলে খনন পূর্বকল্প কথামালা। আরজন হু হা করে সায় দেয়। আরজন চুপ শুধু চুপ থাকে।
তিনজন খুঁড়ে চলে মাটি
ভূমির বিজন ক্ষার
দূরে বাজে রাতপ্রহরীর বাঁশি-ফুৎকার
যুবাদের নখ উঠে ক্ষত বেরোয় নিমিষে
খোঁড়া হয় গোর
সদ্যবিগতদিনে চাপা দেয়া কার না কার কবর
কলাখোলমোড়া কফিন বেরোয়।
পঁচাআঁশ স্তনাভাস দেখে মনে মনে আফসোস হয়
প্রথম যুবার
‘হয়তো-বা হতো এই নারী
উন্মাদ সঙ্গমে মত্ত মাতোয়ারা!’
চাপা আতরের পুরনো গন্ধ
মাংসের পঁচনতীব্রতাকে দূরে ঠেলে
দ্বিতীয় যুবক খুলে ফেলে কলার বাকল কফিন।
যেনো একেবারে মাতোয়ালা; বেবুশ্যে রাত্রির গহ্বরে পাঁড় মাতাল হয়ে গেছে তারা। অমরত্বের লোভে। মৃতের নাভির মুদ্রা কে যে নেবে কার আগে? দৃঢ় ছ’টি হাতে চলে অমলিন দ্রুত নগ্ন করিবার দৌড়।
অবিরাম অবিরাম। কে যে কার আগে? কে যে কার আগে?
কে যে কার আগে
এই দণ্ড ভয়ে তিনজন সকলেই
জড়সড়
মৃতদেহ থেকে সরায় ধুলোর
আস্তরণ
মাটিতে শরীর শরীরে মাটি
গলাদেহ কাদাদেহমাটি
গলে যাওয়া একটা শরীর
উলঙ্গ শরীর গলামাংসে গাঁথা নাকফুল
অচেনা নারীর মথিত উরুতে নাভিমূল
চুল খসে গেছে
মেদ মাংস ধূলোট নাকের বাঁশি
ফুটো দুটো আছে শুধু
হাড়
বেরিয়ে এসেছে
গলে যাওয়া উলঙ্গ শরীর
কোলে তুলে নিল তিন যুবা
পাশেই উঁচু ঢিবির উপত্যকা
শুইয়ে তারা খুঁজবে
শবনাভিমুদ্রা
বয়ে নিয়ে যায় লাশ। এ ওকে শাসায়। ‘কিরে? ঘুমিয়ে গেলিরে?’। তৃতীয় যুবার হাঁকডাক। প্রতিধ্বনিময় উচ্চার তীব্র বয়ে নিয়ে আসে। সে চিৎকার রাতের বাতাস ছাপিয়ে ছলকায়— আঁছড়ে পড়ে শ্মশানের মৃত্যুকুঞ্জবনে, ফাঁসির রজ্জুর মতো বিভীষণ ভয়ার্ততা তাদের ঘিরে ধরলেও তারা তৃতীয় প্রহরের কুহককালবিভ্রমে গির্জার অমোঘ ঘন্টাধ্বনি যতক্ষণ কানের পর্দায় ঢেউঝড় না তোলে ততক্ষণ পর্যন্ত থামে না। থামে না তাদের নিরুত্তর প্রশ্নচিৎকার।
নিস্তার ভুলে সবিস্তারে
তারা ঘাঁটে লাশ, আপাদমস্তক।
খোঁজে নাভি, খোঁজে মুদ্রা।
নাই। নাই। নাই।
তাদের অস্ফুট আর্তনাদে বাজখাঁই
বাতাস আরো ভারী হয়।
শরীরে হাজার ছিদ্রজালময়
ব্যথার বেদনা নিয়ে
সীমাহীন হতাশা আর বেদনায়
তারা তিনজন চারজন হয়ে রাতের পর্দা ছিঁড়েখুঁড়ে শুয়ে থাকে।
গভীর দুঃসহতর আনন্দে শ্মশানের নিঝ্ঝুম নিরালা বাতাসের মীড়ে
গা এলিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে। ধীরে আরো ধীরে।
============================
রচনাকাল: ২০০৬, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ-এক প্রেমের শহর, এ-এক প্রেমের শহর, এখানকার বাতাস প্রেমের সৌরভ বয়ে আনে। হাজারো প্রেমের কলি…..
পতাকায় মিশে যায় ফেলানির নাম উড়তে থাকে কাঁটাতারে; মানুষের মনে জমে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিকল্প মেঘের…..
প্রেমিক হয়তোবা তাকে আমি গড়তে পারতাম তার বুকের ভিতর এপাশ থেকে ওপাশে উল্টে নতুন একটা…..
চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..