করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
সাতচল্লিশ পরবর্তীকালে বাঙালি কবিদের মধ্যে নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন যিনি তিনি হলেন কবি শহীদ কাদরী। তিনি আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে তাঁর কবিতায় রূপ দিয়েছেন। দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ববোধ এবং প্রকৃতি ও নগর জীবনের অভিব্যক্তি তার কবিতার ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যেকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেছে। শহর এবং তার সভ্যতার বিকারকে তিনি ব্যবহার করেছেন তার কাব্যে। অনুভূতির গভীরতা, চিন্তার সুক্ষ্ণতা ও রূপগত পরিচর্যার পরিচয় তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠে এসেছে।
লেখাটির অডিও পডকাস্ট শুনুন এখানে
https://www.facebook.com/OngshumaliMagazine/videos/641655002922530/
বাংলা সাহিত্যের কাব্য আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, আড্ডা অন্তপ্রাণ এই কবি অবিভক্ত ভারতের কলকাতার দিলকুশা, পার্ক সার্কাস এলাকায় ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন এবং কলকাতা শহরে তাঁর শৈশব কাটান। তাঁর বাবা খালেদ ইবনে কাদরী ছিলেন ‘দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার সম্পাদক। পরবর্তীতে পত্রিকার চাকরি ছেড়ে তিনি যোগ দেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির ডাইরেক্টর হিসেবে। তাঁর মা ছিলেন ভারতের বর্ধমান জেলার মানুষ।
শহীদ কাদরীর পরিবারের ওপর ১৯৫০ সালে পিতার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে বিপর্যয় নেমে আসে। একদিকে ভয়াবহ দাঙ্গা, জীবনের ঝুঁকি, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে বাবার মৃত্যু; তাঁর পরিবারকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করে। ১৯৫২ সালে কাদরী পরিবার স্থায়ীভাবে পাড়ি জমান পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায়। কবি শহীদ কাদরীর কাছে তখন ঢাকা এক অজানা শহর। প্রিয় জন্মস্থান কলকাতার স্মৃতি হিসেবে সাথে ছিল কার্লটন সিগারেটের টিনের প্যাকেট ভর্তি কিছু পাথর। কিছুদিনের মধ্যে অচেনা ঢাকা শহরেও জুটে গেলো বেশকিছু বন্ধু। বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ান ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে, আর কিনতে থাকেন নানাধরনের বইপত্র। সেসময় কাদরী কবি শেলি, স্পেন্ডার, বাইরনের কবিতার ভক্ত হয়ে ওঠেন। ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি পরিচয় হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডারের সাথেও। পড়তে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, বঙ্কিম, বিষ্ণুদে, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, সুকান্ত প্রভৃতি কবি সাহিত্যিকদের রচনাবলী।
পঞ্চাশের দশকে তিরিশের উত্তরাধিকার এবং সমাজমনস্কতার মিশেলে এ ভূখণ্ডের কবিতায় এক ভিন্নমাত্রার, অথচ স্বতন্ত্র চরিত্র দেখা দিয়েছিল। এসব কবিতার মধ্যে নাগরিক অভিরুচির যে লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছিল সেখানে জীবনের বাস্তব প্রচ্ছদ সমগ্র অবয়বে ধরা পড়েনি। ঔপনিবেশিক সমাজের অপুষ্ট মধ্যবিত্তের চারপাশের বিবর্ণ গতিহীন ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং এক স্বপ্নাচ্ছন্ন অনুভূতিলোক সৃষ্টি করাই ছিল সেসময়কার কবিতার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
কাদরী খুব অল্প বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে চতুরঙ্গ পত্রিকায় ‘জলকন্যার জন্য’ তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। একইবছর পূর্বাশা পত্রিকায় ছাপা হয় ‘গোধূলির গান‘ কবিতা। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত টানা ৬ বছর কবিতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন এই কবি, এই ৬ বছর তিনি একটি কবিতাও লিখেন নি।
সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি, বাংলাদেশের প্রিয় কবি হলেন শহীদ কাদরী। বাংলাদেশের কবিতার ভূমিতল যাদের মননে- বৈদগ্ধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, শহীদ কাদরী তাদের মধ্যে অন্যতম। পঞ্চাশোত্তর বাংলা কবিতাধারায় আধুনিক মানসিকতার জীবনবোধ, বিশ্বনাগরিকবোধ, জীবনের সুখদুঃখ, তীর্যকতা, প্রকরণগত উদ্ভাবনা, শ্লেষ, দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ, রাষ্ট্রযন্ত্রের কুটকৌশল সবকিছুর সংমিশ্রণ এবং এক বিশিষ্ট শিল্পবোধ ও কাব্যভঙ্গি তাঁর কবিতাকে অনন্য করে তুলেছে কাব্যরসিক পাঠকদের কাছে।
যিনি তার কবিতার প্রতিটি শব্দের ভাঁজ খুলে পরখ করে নেন বাক্যের প্রাঞ্জলতা, শব্দের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য। তিনি এমন এক অতৃপ্ত শিল্পীর জীবন কাটিয়েছেন, যেখানে তাঁর বিশ্বাস ছিল আপাতদৃষ্টিতে মানুষ যে জীবন অতিবাহিত করে, তা তার সত্যিকার জীবন নয়। এর বাইরেও রয়েছে আলাদা এক জীবনসত্তা, আর সেই জীবনকে খোঁজার জন্যই মানুষের এই অতৃপ্তি। আর এ কারণেই কবি শহীদ কাদরী বেছে নিয়েছিলেন এক বোহেমিয়ান জীবন, আর সেখান থেকেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন জীবনের প্রকৃত রস।
তাঁর কবিতার আধুনিকতা, কাব্যশক্তি, উন্মুক্ত ভাবনা, বাকভঙ্গির বিশিষ্টতা, গভীর জীবনবোধ, অন্তর্গত বিষাদ ও বৈরাগ্য আমাকে বারবারই তাঁর কবিতার কাছে টেনে নিয়ে গেছে আর ভাবতে বাধ্য করেছে তাঁর কবিতার বিষয়ের নতুনত্ব নিয়ে। শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ে তৃপ্ত হওয়া কঠিন। একটি কবিতা পড়লেই অন্য কবিতা সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে মন। কবিতার রূপনির্মাণের দিক থেকেও তাঁর কবিতা অনন্য দক্ষতার পরিচায়ক। বিষয় নিরূপণের প্রশ্নে তিনি সবসময় প্রচলিত ধারার বিপরীতে অবস্থান করেছেন। কবিতায় নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার, রূপক, চিত্রকল্পের সতর্ক মনোযোগী ব্যবহার, পাঠককে তাঁর কবিতার প্রতি অনুরক্ত করে রেখেছে। কাব্যপ্রেমিদের কাছে আবেগ, রোমান্টিকতা, সংবেদনশীল শব্দমালা, প্রতিটিক্ষেত্রেই তাঁর কবিতা পরিণত শিল্পরুচির পরিচায়ক হিসেবে স্থানলাভ করেছে।
কাদরীর কবিতা পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে তার ব্যাপকতা ও গভীরতায়। ক্লিশে ও অতিরঞ্জিত শব্দপুঞ্জ, উপমা-উৎপ্রেক্ষাকে সদিচ্ছায় এড়িয়ে তিনি ভাষাভঙ্গি ও অনুভবের জাল বিস্তার করেছেন পাঠকের মনোজগতে, তাতে আমরা খুঁজে পাই আধুনিক বিশ্বভাবনার সাথে স্বাদেশিকতার এক অপূর্ব মিশেল। আর তাই তাঁর কবিতার মহিমা পাঠকের চিত্তকে করে আবিষ্ট ও আশ্লিষ্ট।
স্বকীয় বৈশিষ্ট্যময় ধরন ও ভিন্নভঙ্গি শহীদ কাদরীর কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের নান্দনিক কৌশলময় প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুভবের গভীরতা, শৈল্পিক সুক্ষ্ণতা, উপমা ও চিত্রকল্পের নন্দিত বিন্যাস তাঁকে এক অনন্য মৌলিক কবিতে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। তিনি লিখেছেন খুব অল্পই, মাত্র দেড় শতাধিকের মতো। অনেকেই বলেন তাঁর কবিতার সংখ্যা ১২৬টি আর কবিতার বই সর্বসাকুল্যে মাত্র চারটি। শোনা যায় তিনি আরেকটি কবিতার বই প্রকাশ করার জন্য পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন, যা তিনি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ করে যেতে পারেন নি।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ চারটি। গ্রন্থগুলো হচ্ছে, উত্তরাধিকার। উত্তরাধিকার প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। এরপর তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। দীর্ঘবছর পর ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও।
এছাড়া এই কবির লেখা বিভিন্ন কবিতা নিয়ে অসংখ্য সংকলন প্রকাশ হয়েছে বিভিন্নসময়ে। উল্লেখযোগ্য সংকলনগুলোর মধ্যে ‘শহীদ কাদরীর কবিতা’ ‘তোমার জন্যে’ অন্যতম।
শহীদ কাদরী বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন ১৯৭৩ সালে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে একুশে পদক লাভ করেন ২০১১ সালে।
প্রায় তিনদশক ঢাকা শহরে বসবাস করার পর ১৯৭৮ সাল থেকে কবি শহীদ কাদরী প্রবাসজীবন শুরু করেন। একাধারে জার্মানির বার্লিন, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, আমেরিকার বোস্টন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমেরিকার নিউইয়র্কে বসবাস করেছেন। ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে নিউ ইয়র্কের নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই কবি মৃত্যুবরণ করেন।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..