শাক্ত নাহার ও তার অক্ষয় তুণির

হামিম কামাল
গল্প
শাক্ত নাহার ও তার অক্ষয় তুণির
        বন্ধ চোখের আড়ালে মণি দুটো স্বস্থানে ফিরে এলো।
এবার শুন্য থেকে পাঁচ।
        আমার কল্পনায় পুরুষের মত পরকাল নেই। নেই
শরাবের ঝর্ণা অথবা রূপসীর সহবাস।
        বন্ধ চোখের আড়ালে মণি দুটো স্বস্থানে ফিরে এলো।
আবার শূন্য থেকে পাঁচ।

একজোড়া পায়ের শব্দ এদিক ওদিক ঘোরাফেরার পর হঠাত সামনে এসে থেমেছে। শব্দকর বুঝি দাঁড়িয়ে পড়লেন।

যখন টের পাওয়া গেল যে সামনে এসে অপর কেউ দাঁড়িয়েছে, তখন চোখ বন্ধ রাখা কঠিন। চোখজোড়া খুলতেই হলো মেয়েটিকে। ভেবেছিল কোনো ভিখারি। কারো ধ্যান ভাঙিয়ে, বিব্রতবিধুর সময়ে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা আদায় করে ওরা খুব আনন্দ পায়। কিন্তু দেখা গেল, এসে যে দাঁড়িয়েছে সে ভিখারি নয়।

ছেলেটির বয়েস খুব কম। একদিকে অর্ধনগ্ন, নোংরা কালো শরীর; অপরদিকে বেমানানরকম নাদুশ নুদুশ। এরকম ছেলে কোনো স্বচ্ছল গাঁয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। হয় গুলতি দিয়ে হলুদ বেনেবৌ শিকার করছে বা নারকেলে শাখার প্রশস্ত ফণায় গাঁট হয়ে বসে আছে, তাকে টানতে গিয়ে কেউ সুবিধা করতে পারছে না।

এমন এক নধরখোকা কোথা থেকে এলো? তারওপর পিঠে একটা ছেঁড়াখোঁড়া থলেও ঝুলিয়েছে বিরাট। নাহার তার পাজোড়া নামিয়ে  ঘাড় খানিকটা বাঁকিয়ে ওই ঝোলার ভেতর তাকাল। ঝোলা বলতে অর্ধ্বস্বচ্ছ ইথিলিনের পলিমার, তাই সম্পদের কোনো রাখঢাক নেই। ভেতরে আম কাঁঠাল বাঁশ ধঞ্চে আকাশমণির শুকনোভগ্ন পাতা, কেমন জড়সড় ভীত। বোধয়  আজ রাতের বহ্নুতসবে ওরা বলি।

‘তোর পিঠে কি রে ওগুলো? বলিনিমিত্তএকদাহরিতশল্ক?’

ছেলেটা হেসে উঠল এ কথায়। কে জানে নাহারকে তার অপ্রকৃতস্থ মনে হয়ে থাকবে কি নয়। ওর দাঁতগুলো দেখে নাহার অবাক হলো। ভাঙা কাঁচা হলুদের ভেতরটার মতন আগুনরঙা। কতদিত পরিষ্কার করে না কে জানে। থাকে কী করে এরা?

‘এই! খুব যে হাসছিস, জানিস তোর দাঁতের কী দশা?’ আঙুল দিয়ে নিজ দাঁত দেখাল নাহার। ছেলেটা এতেও বেশ আমোদ পেয়ে গেল।

‘দেখি বসে পড়, কথা বলি তোর সাথে।’

শহরে এমন অপ্রকৃতস্থ নারী পুরুষ ক্রমে বাড়ছে। দেখামাত্র এদের চিনতে পারে না ইউসুফ, খানিকটা ঘনিষ্ঠ হতে হয়। চোখজোড়ায় এদের নিশ্চিত পরিচিত লেখা থাকে। সমানে গিয়ে দাঁড়ালে পয়সা বা বিনোদন কিছু অন্তত মেলে। কখনো দুটোই। ইউসুফের কাছে তাই এই উন্মাদগুলো লোক হিসেবে ভালো। একজনকে দেখে সন্দেহ হওয়ার পর সামনে না দাঁড়িয়ে পারেনি। বসতে বলার পর আর দ্বিধা করল না। পাতার গাঁটটা মাটিতে রেখে তার পাশে সাধুর মতো আসন পাতল।

‘নাম কি?’

‘ইসুব।’

‘অর্থ জানিস? এ নামের মানে কি জানিস?’

মাথা নাড়ল ইউসুফ। জানে না।

‘এর অর্থ হলো, যে বড় হবে। কী বুঝলি। কিছুই বুঝলি না। যে বড় হবে মানে আবার কী।’

ইউসুফ আবার হাসল। এই হাসিটা মন্দ না। নাহারের ইচ্ছে হলো ছেলেটিকে আরো কিছু বলে। না বুঝলেও সই। অনেক মানুষ এর আগে তাকে বলেছিল যে সে যা যা বলেছে সব তারা বুঝতে পেরেছে। কই, কাজের সময় কেউ একটা কিছু প্রমাণ করে দেখাতে পারল না তো। নাহার কম বার প্রতারিত হয়নি। এতোবার হয়েছে যে তার সমাজবন্ধুদের সে আর বিশ্বাস করে না। অবিশ্বাসীকেই বেশি নিরীক্ষাধর্মী হতে দেখা যায় এবং নাহারও কেন বা তার ব্যতিক্রম হবে। নিরীক্ষা করতে দোষ কী। সব ফলই শেষমেশ বিরাট এক নাশপাতি।

‘হুম। তোর হাসির অর্থ আমি বুঝতে পেরেছি। বুঝেছিস মানকচু। কিন্তু ওই মানকচুর খনিজ লোহা দিয়েই অস্ত্র বানাবো। দেখতে চাস, তুই দেখতে চাস?’

ইউসুফ এবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। এই দেখে হাসি পেল নাহারেরও। সেও খুব করে হাসতে থাকল কিন্তু হঠাত থেমে গেল আবার। যেন কোনো অন্যায় করে এইমাত্র তার মনে পড়ে গেছে। বলল, ‘হাঁই! যেখানে, অন্যায়ে ঘোরাচ্ছে ছড়ি সেখানে সে হাত তোকে মুচড়ে ভেঙে দিতে হবে। ওই ভেঙে দেওয়ার মতো অতটা বড় তোকে হতেই হবে। কী বুঝলি? থাক, বলতে হবে না। আমি খুব জানি। যা বোঝার আমিই বুঝব। বোঝার বোঝা আমি একাই টানতে পারি। আজ থেকে তোকে একটা নতুন নাম দিলাম। ইউসুফ নামে অন্যেরা ডাকুক। আমি তোকে কী নামে ডাকব জানিস? আমি তোকে ডাকব- অভূতপূর্ব। অভূতপূর্ব। কী, পছন্দ হয়েছে?’

‘হ।’

‘বাহ, এই তো চাই। এখন তুই  অর্ধনগ্ন অশিক্ষিত, নোংরা হলদেটে দাঁতাল, পিঠে শুকনো পাতার ঝোলাসহ এক অনুকরণ প্রিয় শিশু। কিন্তু একইসাথে, তুই একটা অস্তিত্ব। খনির গহীনে পোরা আকরিক হীরের মতো। তুই একটা সুপ্ত বুদ্ধিমত্তা। আমি বিজ্ঞান শেখাবো তোকে। সাথে চিত্রকলা, সংগীত। নাম শুনেছিস এসবের শেখানো কাকে বলে তা জানিস? জানিস না। তুই যে জানিস না এখানেই আমার শক্তি, তা জানিস?’

নাহার হাসতে থাকে। সেই হাসি ইউসুফেও সংক্রমিত হয়। হঠাত আঙুল তুলে নাহার আবার বলতে থাকে, ‘তবে সবার আগে, সবার আগে খুউব যতনে শেখাব তোকে দর্শন। দর্শন হলো দাঁত। দাঁত না থাকলে সামনের সব খাবারই বৃথা। আমি এ যাবত যতগুলোকে পেয়েছি, কোনোটারই দাঁত ছিল না। ওরা সবাই বিরাট সব গিলবাজ, মানে শুধু গেলে। শুধু গিলে ফেলে- কোঁত! কী বুঝলি। হ, কম হাস, বেশি হাসলে মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। বেশি কাঁদলে মাথা ভার হয়ে যায়। দুটোই শত্রু। তো ওই গিলবাজরা কোঁত করে গেলে। ফলে যা হয়, একেকজনকে দেখায় খুব মোটাসোটা। কিন্তু গা ভর্তি কেবল রোগশোক। একটাকেও পেলাম না। তাই বোধয় প্রকৃতি এবার তোকে পাঠাল। তাও বা কে জানে, বাজিয়ে দেখি। তোকে আমি বিদ্যা দেবো, সেই বিদ্যা তোকে পুষ্টি দেবে। সেই পৃষ্টিতে ‍তুই হৃষ্টপুষ্ট হবি আরো। এখন তোর এই কালো শরীরটা হৃষ্টপুষ্ট, তখন তো এই বুকের ভেতরটা তোর পুষ্ট হবে। ফুলে উঠবে মগজের বাইসেপস ট্রাইসেপস। তুই তখন বাগান বানাবি, নালা কাটবি, জল ঢালবি, ফুল ফোটাবি। তার কিছু নিয়ে অর্ঘ্য দিবি মানুষকে। আর কিছুকে ফল হতে দিবি। আর সেই ফল পাকলে টুকে নিয়ে ভরবি ঝোলায়। পুষ্ট অংশটা খেয়ে বাঁচবি। এরপর বীজ ছড়িয়ে দিবি নতুন বীজতলায়। ওখানে নতুন বাগান করবি। যাহোক, ওসব অনেক পরের কথা। সব শিখিয়ে দেবো সব! তোকে সবাই তখন একশ মাইল দূর থেকে দেখতে পাবে তুই হবি এতো বড়! তোকে সবাই পাঁচশ মাইল দূর থেকে দেখতে পাবে তোর শরীরে তখন এতো আলো। তুই একহাতে আস্ত একটা একটা হাতি ওঠাতে নামাতে পারবি, তোর গায়ে তখন এতো শক্তি। হাতির ওপর কে থাকে জানিস তো! রাজা! আর মানুষের রাজা যারা হয়, তারা ভুলে যায় যে আমরা সবাই রাজা। তুই সেটা মনে করিয়ে দিবি। যদি পারিস তো অভূতপূর্ব থেকে নামটা বদলে তোকে ডাকব ‘অপূর্ব’। আর যদি না পারিস তো ডাকব ‘ভূত’। কী বুঝলি?’

ইউসুফ, নাহারের কথা গুলো শুনে হাসতে হাসতে পাতার গাঁটের ওপর হেলে পড়ল। এরপর দুটোই গড়াতে থাকল মাটিতে। নাহার তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চলি রে! চিনেছি তোকে আমি টিকটিক ঠিকঠিক!’

সকালে ঘর ছেড়েছিল, এখন দুপুর হয়ে গেছে। আকাশে কিংবা গাছে কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠল কাছে। বসন্তবিলাসী প্রেয়সীপিয়াসী সেই ডাক। নাহারের খুব ক্লান্তি বোধ হল। পৃথিবীটা বিভূতিভূষণের উপন্যাস হলে সে ঘুমিয়ে পড়ত ঘাসের ওপর। পৃথিবীটা হয়েছে যুদ্ধবাজ ধূর্ত সন্তানহন্তারক ট্যান্টেলাসের বুকের ছাতি তার ওপর ঘুমোবার মতো রুচি তার নেই। পেছনে ধুনো পথের ধুলো উড়িয়ে সে বাড়ির পথ ধরল। নিরুপায় শেষ আশ্রয়। যেতে যেতে পথেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো।

একি। এদিক সেদিক এধার ওধার এপার ওপার কোথাও সে তার বাড়ি খুঁজে পেল না!

যেখানে ছিল তার বাড়িটা সেখানে মস্ত এক প্রমোদোদ্যান। যে উদ্যান থেকে সে এসেছে তার সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। তার ওই উদ্যানে দারিদ্রের সঙ্গে একটা হার্দিকতা ছিল। কিন্তু এখানে সব কেমন যেন বড় বেশি এলিট! চারপাশে ঘনায়মান সন্ধ্যা রেখে দিয়ে ওই উদ্যানের ভেতর ঠিক যেন প্রাকৃতিক সকাল! কী ব্যাপার! সূর্য তো সবার জন্যেই ডোবে। তাহলে এখানে হচ্ছেটা কী!

নাহার খানিকটা এগিয়ে গেল। সারি সারি বাহারি গাছ ফুল ফল, পাখির ডাক আর ঝর্ণার নীরপতনের নিরবচ্ছিন্ন শব্দ। মানুষের মগজের ভেতর গাঁট হয়ে বসে থাকা স্বর্গের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভেতরে তরুণ তরুণীরা হাত ধরে হাঁটছে। প্রেমিক, প্রেয়সীর কানের ফাঁকে গুঁজে দিচ্ছে বড় বড় নীল অপরাজিতা- অবিশ্বাস্য দৃশ্য। নাহারের ঘরের বারান্দায় অনেক ঝোপালো হয়ে ওঠা একটা অপরাজিতা ছিল। নেই অপরাজিতা, যে পর পর নারী আর পুরুষবোধক। শুরুতে সে অপরাজিতা, ফুল শুকোলে সে অপরাজিত। এই অপরাজিতা তার লতা বাড়িয়ে ছড়িয়ে কি মহালতা মহাজটা হয়ে উঠেছে! নয়ত এতো এতো উদ্যানচারীর হাতে হাতে সে কী করে ফুল ছড়িয়ে দিলো। এরপর ফুল ঠেলে তার বীজাধার কী করে বেরোবে, যদি ফুলটাই হারাল? তবে কি সে আর বংশধর চাইছে না? সে চাইছে না, নাকি প্রকৃতির কিছু ওলট পালট ঘটেছে। কিন্তু সে ব্যাপারে ভাবার অবকাশ কোথায়, নাহারের বাড়িই তো নেই! কোথায় গেল বাড়ি?

নাহার গম্ভীরমুখো উদ্যানরক্ষীর কাছে গিয়ে বলল, ‘এখানে আমার বাড়ি ছিল। কোথায় আমার বাড়ি! আমার স্পষ্ট মনে আছে এখানে আমার বাড়ি ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না!’

প্রহরীর মুখটা দেখার মতো। চিবুক চোখ আর গোঁফের এই গাম্ভীর্য তার চেনা। যারা খুব চোখ আর ভারি দাঁতের অধিকারী, যাদের দশনের নিচে গ্রানাইটের শীলা মুড়মুড়িয়ে ভেঙে যায়, তারাই এমন দর্শণধারী।

উদ্যানরক্ষী তুন্দ্রাকণ্ঠে উচ্চারণ করল, ‘চিরকালই প্রমোদোদ্যান ছিল এখানে।’

নাহার বলল, ‘এ হতেই পারে না!’

‘তাই হয়েছে।’

লোকটার কথায় ভীষণ জোর। এতো নিশ্চিত করে বলছে যে নাহারও বিভ্রান্ত হয়ে গেল। সে ভাবনার খানিকটা অবকাশ চায়।

‘এমন সকাল কেন এখানে?’ নাহারের কণ্ঠে ক্লান্তির সঙ্গে কৌতূহল।

প্রহরী বলল, ‘এখানে সময় তার সীমারেখা অতিক্রম করছে।’

‘সকাল কী করে সীমারেখা হলো?’

‘সকাল একদাসূচনারেখা। তাই সকালই অন্তিম রেখাতুল্য। সূচনা আর অন্ত চক্রবদ্ধ।’

নাহার একটা কিছু বলবে বলে মুখ খুলেছিল। ঠিক তখন প্রহরী একটা হাত তুল থামিয়ে দিলো তাকে। মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে যেন খুব মেপে মেপে শব্দ দুটো উচ্চারণ করল।

‘বিদায় হও।’

এই তো সহজ সমাধান! এই এক কথা থেকেই কেমন দিব্বি কাজসূত্র বেরিয়ে গেল। একটা ঘরের চেয়েও তো এমন স্বর্গপ্রবেশের চিন্তাই বরং লোভনীয় নাহারের পক্ষে। হতে পারে তার ঘরটাও এখন এই স্বর্গীয় উদ্যানে খুঁজলে পাওয়া যাবে। হয়ত ওটাও একটা আরামদায়ক ঠাণ্ডা স্বর্গ হয়ে উঠেছে। তবে কি শেষমেশ স্বর্গ মানুষের মগজ থেকে কানের ছিদ্র গলে পৃথিবীতে চলে এলো? এও কি সম্ভব? মানুষের কী এতো সৌভাগ্য হয়েছে! যাহোক, অতো ভাবনায় কাজ নেই। অপরাজিতার মহালতা, মহাজটাটিকেও দেখতে হবে। কল্পনায় তখন হাওয়ায় হাওয়ায়  কালচে খয়েরি স্ফীত ডাল দোলাচ্ছে মহাঅপরাজিতা।

‘আমি ভেতরে ঢুকতে চাই!’ ব্যাগ্র কণ্ঠে বলল নাহার। ‘আমি এসেছি আমার বাড়ি খুঁজে পেতে। তোমার তো আমাকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়ারই কথা। কিন্তু আমি তা শুনব কেন?’

প্রহরী বলল, ‘মেয়ে। আমি ছড়ির জোরে তোমাকে দূরে সরে যেতে বলছি না। বলছি অন্য কারণে। এই  উদ্যানে বিচরণরত প্রজাতি কিছুক্ষণের মাঝে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর, আর চাইলেও তুমি ওখানে ঢুকতে পারবে না। ঠিক যেমন, চাইলেও ওরা ওখান থেকে কখনো বেরোতে পারবে না।’

‘কেন? কেন? আমার দুটো কেন। ওরা তো দিব্বি আমিই, মানে আমারই তো জাত। তাহলে আমাকেই বা বাইরে রাখা কেন!’

প্রহরী তার হাতের সূঁচাল বল্লম মাটিতে নামিয়ে রাখল। এরপর নাহারের দিকে এগিয়ে এসে দূরে কোথাও হাত তুলে বলল, ‘চলো। দূরে গিয়ে বলছি।’

লোকটা হাঁটতে শুরু করতেই নাহারও তার পেছন পথ ধরল। একবার শুধু পেছনে তাকিয়ে দেখল। ওই মানুষ মানুষীদের ছোট একটা দল জলে নেমেছে। না, তারা জলকেলি করছে না। জলকেলির মতো মন তাদের নেই। কী এক গাঢ় বিপন্নতা তাদের চোখে, যেন আসন্ন বিপর্যয় ওরা টের পেয়েছে। পাওয়ারই কথা। প্রেমিক মন বিপর্যয় টের পাওয়ার সবচেয়ে সংবেদনশীল লতাশীর্ষ। ওদের ওভাবে রেখে এগোতে নাহারের খুব খারাপ লাগল। একবার ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে ওদের বলে দেয়, চিতকার করে ওদের সতর্ক করে দেয়, এই দেয়াল দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু ডাকটা ওদের কানব্দি পৌঁছুবে তো? চেষ্টা করতে দোষ কি। সামনের বুড়ো লোকটা তখনো খানিকটা এগিয়ে গেছে। এই লোকটার কথা কেন তাকে বারবার শুনতে হবে? কে সে? এরচেয়ে বরং ছুটে ওই দরজার কাছে চলে যাওয়া যাক।

এমন সময় সামনের বৃদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘নতুন প্রজাতি আসবে। তাদের আসতেই হবে। আসবে নব্য আচরণবিধি। নবতর আবেগ। নরনারীর এই যে প্রেম তুমি দেখতে পারছ, তা বিলুপ্ত হবে। প্রকৃতি প্রজন্মান্তরে প্রমাদ শুধরে নেয়। ওদের ধ্বংসের পর ওই শোধন প্রক্রিয়া চলবে কিছুকাল। এরপর আবার নতুন সদস্যেরা এসে প্রকৃতি সরব করে তুলবে। কিন্তু প্রকৃতি কয়েকজনকে রেখে দেয় ওই পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে, এটা তার ঐতিহ্য। এর আগে যতগুলো পরিবর্তন এসেছে, প্রত্যেকটা পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে কিছু অপরিবর্তিত জীবের দল রেখে দেওয়া হয়েছে। তোমার বেঁচে যাওয়ার কারণ আশা করি বুঝতে পেরেছ। কিন্তু এই বেঁচে থাকার চেয়ে অনেকের জন্যে আবার মরে যাওয়াটাই ভালো হতো। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। আলাদা কারণ, তুমি এক শক্ত উদাহরণ। তুমি এক লাবণ্যময় উদাহরণ। তোমার মতো উদাহরণীয় ললিতকুসুম আর নেই। তুমি একাই এক জাদুঘর। তাই তোমাকে বাইরে রেখেই সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।’

‘দাঁড়াও দাঁড়াও!’ নাহার যেন ঠিক সামলে উঠতে পারে না। বলে, ‘তোমার একটা কথাও আমি নিচ্ছি না। কারণ বলছ প্রেম প্রমাদ। প্রেম প্রমাদ? প্রেম তো বরং অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে আমি দেখতে পাই!’

বৃদ্ধ বলে, ‘না। অস্তিত্ব বলতে যা বোঝাচ্ছ, তা রক্ষা করে চলেছে কাম। কামই বংশধর আনে। কে এলো তা তার কাছে মূখ্য নয়, এলো কিনা তাই মূখ্য। প্রেম তার ভেতর মাথা গলিয়ে অকারণ ‘কে এলো’র চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়। প্রেম দুর্ঘটনাকেও নকশায়িত করতে চায়। প্রেম অকারণ পক্ষপাত জাগায়। এই পক্ষপাত জাগায় অন্ধত্ব। অন্ধত্বের শূলদণ্ডে প্রেম রত্নখচিত অলঙ্করণ।’

‘তুমি বুঝি তাই ভাবছ? তুমি কি সুস্থ আছো?’

‘আমি তা ভাবছি না বরং প্রকৃতি তাই দেখছে। আমি তা বুঝে চলেছি এর বেশি কিছু নয়। আমি প্রহরী আমি নিয়ম। প্রকৃতি আমার ভেতর দিয়ে ব্যক্তিরূপে প্রকাশিত।’

নাহার চুপ করে থাকে। লোকটা আদিম শাস্ত্রীয় ভাষায় আরো কত কী যে বলে যায়, তার সবটা নাহার বুঝতে পারে না। কিন্তু আত্মাটুকু ধরতে পারে। লোকটা প্রেমকে ধীরে ধীরে বিভেদ নিরসন নয় বরং বিভেদের কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করে। এভাবে কেউ ভাবতে পারে, না দেখলে নাহার বিশ্বাস করত না কখনো। সে আরো একবার পেছনে তাকায়। বোধয় তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর একটা কথাও না বাড়িয়ে তার ওখানে যাওয়া উচিত। তার জাতির সামনে আজ মহত বিপদ এসে উপস্থিত। আর এটুকু ঝুঁকি সে নেবে না?

নাহার হঠাত ঘুরে দাঁড়াল। দৌড়ুতে শুরু করার পূর্বমুহূর্তে তার কানে এলো লোকটা শেষ কথা ক’টা। লোকটার শীতল কণ্ঠ কী দৃঢ়তায় উচ্চারণ করে চলেছে, ‘সুতরাং প্রেম অস্তিত্বপরিপন্থী প্রমাদ বৈ তো নয়। নতুন প্রজন্মের ভোর হবে তাই প্রেমশূন্য, কামপূর্ণ।’

নাহার বাতাস কেটে দৌড়ুল। কানের পর্দায় তার শব্দ তাকে ক্রমশ উসকে দিতে থাকল। আজীবন পরাজিত হতে থাকা নাহার হঠাত সেদিন কী করে বিজয়ী হয়ে উঠবে? ফটকের কাছাকাছি যেতে না যেতেই সে চিতকার করবে ব’লে কণ্ঠে সমস্ত শক্তি এক করার পর টের পেল, একটা বর্ণ উচ্চারণের ক্ষমতাও তার নেই। কেউ কি তাকে জাদু করেছে? ওই বৃদ্ধ কি সত্যিই নিয়ম? প্রকৃতি যেখানে নিয়ত প্রাকৃত যৌবনা, সেখানে ওই বৃদ্ধ কী করে নিয়মের প্রতিনিধি হয়? হতেও পারে। নিয়ম ভাঙে যৌবন, এটা সত্য। আর নিয়মের কথা নিয়ত মনে করিয়ে দেয় ওই বার্ধক্যই তো। একদিন তারও যৌবন ছিল, এটা তো আর ভোলা যায় না! আদতে এই সমস্তের গাণিতিক ফল শূন্য। তাই বুঝি শূন্যের ধারণা এসেছে সংখ্যারও সবার পরে! একটা শূন্য হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নাহার ওই দরজার কাছে চলে যেতে চায়। যায়ও। দরজার গরাদ ধরে সে গলার রগ ফুলিয়ে বলে উঠতে চায়, ‘পালাও তোমরা পালাও! ওই জলের নিচে গিয়ে লুকোও! পারো তো এই দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসো! তোমরা প্রেমকে বাঁচাও! তোমাদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে!’

মনের গতি আলোরও বড়। মনের কথাও তাই সহস্রমুখী। কিন্তু বাইরে সুযোগ, যোগ, পথ, উপায় যে বড় কম! নাহারের মন ভেঙে যায়। ভেজা চোখে দেখতে পায়, প্রমোদোদ্যানে শীতল আগুন জ্বলে উঠল। তরুণতরুণীরা পায়ে চলা থামিয়ে অবাক তাকিয়ে থাকল। প্রেমিকের মুগ্ধতা রূপ নিল ভ্রূকুটিতে। পাখিগুলো উড়তে গিয়ে হঠাত অচঞ্চল হল। খরতাপে উবে গেল জল। দেখা গেল, একটি দম্পতি সত্যিই জলের তলে লুকিয়েছিল! এরপর স্বর্গদাহের শ্রীহীন কটকট কটকট চলতেই থাকল একটানা। আগুনের তরঙ্গিত জিভ তখন চতুর্মুখী।

আরো অনেকটা সময় পর, সব কিছু পুড়ে গিয়ে, থাকল শুধু ছাই। কোথাও কোনো সপ্রেম জীবের কোনো অস্তিত্ব আর নাই।

নাহার, একজন পরাজিত পারিজাত মানুষের মতন, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল উদ্যানফটকে। নিজের প্রজাতিটি চোখের সামনে বিলুপ্ত হল, কেউ বাঁচাতে এলো না। প্রকৃতি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রকৃতি সাক্ষী বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রকৃতি কি সাক্ষী বাঁচিয়ে রেখেছে? নাকি প্রকৃতি সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রেখেছে!

নিশ্চয়ই! শেষেরও সীমাবদ্ধতা আছে। ইউসুফ যেন প্রেমহীনতায় জন্ম নেওয়া এক শিশু হয় হে মহানিয়ম! তাহলে তাকে নিশ্চয়ই প্রকৃতির চরেরা বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রকৃতি যদি সম্ভাবনাই রাখে তো ওই তাকেই এ মুহূর্তে চাই। তার পিঠে ছিল জ্বালানি। এই তো সূত্র মিলেছে! আর তাকে কি নাহার জয় করেছিল খানিকটা হলেও? তার মনে কি নাহার একটুখানিও স্থান পেয়েছিল ওই খেয়ালাহিত অভূতপূর্বতায়? একটা সেতু কি তবে গড়া গিয়ছিল? সদ্যনেভা মোমবাতির ধোঁয়ার কাছে, জ্বলন্ত কাঠি রাখলে তা ফের জ্বলে ওঠে। নাহার! তোমার অন্তর্গত আগুন এ দগ্ধ সমাধির, এ বিষসর্পিল ধুম্রকুণ্ডলীর কাছে মেলে ধর!

নাহার চোখ বন্ধ করে মনে মনে ডাকতে থাকল অবিরত, ‘অভূতপূর্ব, অভূতপূর্ব, অভূতপূর্ব, অভূতপূর্ব, অভূতপর্ব!’

ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে উঠেছে তাঁর কপালে। তার মনের ডাক যেন বিকীর্ণ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক আয়নায় প্রতিফলিত হবে বলে ছড়িয়ে পড়ল। তার চিবুকে, বন্ধ চোখের পাতায় একটা সবল বিশ্বাস, একটা কাতর অনুনয়।

হঠাত, যেন বহুকাল আগের এক প্রহরের মতো, চারদিকে খানিকটা পায়চারি করে তার সামনে একজোড়া পদশব্দ থেকে গেল।

‘অভূতপূর্ব! আমার অক্ষয়বাণাধার। অক্ষয় তুণির আমার। এসেছিস তুই?’

‘হ।’

‘আয়। ঐ দেখ। নব্য প্রজাতির কিম্ভুত শরীর। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে কেমন মুচড়ে পাকিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। প্রেমকে প্রমাদ ধরে নিয়ে প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে এদের। কি ভয়াবহ প্রেমহীন কামুক, তাদের অঙ্গভঙ্গি! তাদের চিন্তায় চেতনায় প্রেমের কোনো স্থান নেই। শুধুই কাম, শুধুই ক্লেদ, কেবলই ধারায় ধারার জল মেশানোর তাগাদা, আর কিচ্ছু নেই। এলো কিনা তাই মূখ্য, কে এলো তা গৌণ ওদের কাছে। অভূতপূর্ব, ধোঁয়া জমাট বাঁধার আগেই তুই তোর ক্ষমতা দেখা। তুই তো খুব হাসতে পারতিস অভূতপূর্ব! তোর মনে আছে তো কখন তোকে অপূর্ব বলে ডাকব আমি! তোর মনে আছে তো রে আমার প্রিয় ভূত টা! এদের তুই করুণা কর! করুণা কর অভূতপূর্ব! করুণা কর, অপূর্ব!

অপূর্ব ওদের দিকে আঙুল তুলে দুলে দুলে হাসতে শুরু করল। ধোঁয়া তখনও জটিয়ে ওঠেনি। তাই তার হাসির একেক ঢেউয়ে আচমকা নব্য প্রজাতিটির সদ্যগ্রন্থিত অস্থি চর্ম হাড় অগ্রন্থিত হয়ে পড়তে থাকল। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পরমুহূর্তে বিশ্লিষ্ট হয়ে পড়ল। ছোট ছোট কোনো প্রাণ তখনই মিশে গেল। বড় আর জটিল প্রাণগুলোর কোনোটা রাগত হয়ে ফিরে তাকাতে থাকল তার দিকে। কেউ জিঘাংসার চরিতার্থতায় ছুটে আসতে শুরু করা মাত্র হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। কোনো কোনোটা ফটকে সম্পন্না তরুণীকে দেখামাত্র খলখলিয়ে তেতে উঠে তেড়ে আসতে চাইল। কিন্তু তাদের বিপরীতে বড় নিষ্ঠুর অপূর্ব। নিরেট কামের বিপরীতে নধর প্রেম যতটা নিষ্ঠুর হতে পারে।

মানব মানবীর দগ্ধ লাশ আর নির্বাচিত কামুকদের গলিত শবদেহের নিচে, কিছু হলদে পাখি, কিছু সারস, কিছু কোকিল, কিছু ঘুঘু, একটা পেঁচা পড়ে ছিল অবিকৃত।

নাহার বলল, ‘এদের জাগাতে হবে। এখানে এই মৃত দেহগুলোর কাছে, আমাদের জ্যান্ত সময় বন্দী হয়ে আছে। তোর সেই বলিনিমিত্তএকদাহরিতশল্ক কোথায় রে? আছে তো?’

‘হ।’

‘এদের ওপর ছড়িয়ে দে। তারপর যতটা হাসি ছড়িয়েছিস, ততটা কান্না এবার ঢাল। ওই শুকনো পাতাকে গাঁজিয়ে তোল, পারবি না? কোথায় পেয়েছিলাম তোকে আমি, ভূত কোথাকার!’

ইউসুফকে শুন্যে ছুড়ে লুফে নিল উল্লসিত নাহার।

হামিম কামাল। লেখক। জন্ম- ১৯৮৭ সালের ৯ অগাস্ট, ঢাকায়। আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক। প্রকাশিত গ্রন্থ- 'জঠর' (২০১৬), 'কারখানার বাঁশি' (২০১৮)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..