প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
হামি ওকে কহেছিনু গে নানি, শুনেই না হারামির ব্যাটা…
কী কহেছিলে রে ভাইজান? শুনা হামাকেউ!
কহিব ফের কী, কহনু যে, হাঁরে বুড়বক মারানি, তোদের পোন্দে গু না আটকালে নানির কথা মনে পড়েনাখো, না?
তো কী কহিলে উ?
রা কাঢ়ে নাখো গে, মিছামিছি খালি মাথা হিলাছে…
উ শালা হারামখোরের জন্মা আছে, বুঝলি রে ভাইজান, দোযখে যাবে হারামির বেটা!
না তো ফের কী গে নানি, একশোবার যাবে জাহান্নামে। দোযখেই যাবে উ!
গতবারের বন্যায় রাস্তার হাল খাস্তা; হিড়িং বিড়িং করে চলে সাইফুদ্দিনের টোটো গাড়ি। তাও আজকাল টোটো হওয়ায় জানে একটু আরাম পেয়েছে গুলশন বেওয়া। তা নইলে তিন চার মাইল পথ পায়ে হেঁটেই পটলডাঙার হাটে যেতে হতো। বলে, হাঁরে বাপ সাইফুদ্দি, দেইখে চালা বাপ, হামার মাজায় যে বড্ডা দরদ রে ভাই হামার।
সাইফুদ্দিন সে কথায় কান দেয় না। মেজাজে টোটো চালায়। সাধের টোটো গাড়ির ব্যাটারির সাথে তার জুড়ে মাথার উপর সাউন্ড সিস্টেম লাগিয়েছে। তাতে চলিয়েছে কোনও এক মৌলানার তকরীর। ফাঁকা রাস্তার দুই দিকে ষর্ষে ক্ষেত, গমগম করে মৌলানার ভাষণ বাজিয়ে সাইফুদ্দিনের টোটো চলেছে। তাই গুলশন বেওয়ার সাথে তার কথপোকথন হয় উচ্চগ্রামে। একটা ছোট গর্তে পেছনের চাকা গোঁত্তা খেলে গুলশন বলেন, হ্যাঁরে বহিরা মারানি! শুনতে পেছিস না? হামি তোর নানি নাকি আলুর বস্তা রে? ভালো কইরা চালা না রে, মাজা যে ভেইংগ্যা যেবে রে!
তখনও সাইফুদ্দিন সে কথায় আমল না দিয়ে খানিক চিৎকার করে বলে, নানি হে, কত কইরা কহেছিনু নানি, আলিমার বিহা হামার সাথে দে গে নানি, শুনিস নিখো!
কী? ফের ওই কথা? জানিস নাখো, কত্তাবার কহিব রে ছোঁড়া আলিমা কহেছিল খালাতো ভাই কে বিহা করব না! হামি তো দিতেই চেহেছিনু, মা মরা ছুঁড়িটা তোদের ঘরে গেলে হামার দিলেই বাতাস বহিত!
বুঝো নানি এখন, মেয়াটা রোজ রেতের বেলা হারামিটার লাথ খেছে গে!
হালিম তোরই তো দোস্ত রে সাইফুদ্দি, তুই তো লিয়ে এসেছিলি ওদেরকে!
দোস্ত না ল্যাউড়া! মোন হছে কি শালার ব্যাটাকে কেইট্যা কুত্তাকে খিলিয়ে দি!
সাচা কথা কহিব রে বাবু? গুলশন বেওয়া গলায় নিখাদ আদর মিশিয়ে বলেন, তোকে বিহা না করে ছুঁড়িটা বহুত বড়া ভুল কর্যাছে রে…
সাইফুদ্দিন পেছন ফিরে তার নানিকে এক ঝলক দেখে নেয়। কিছু বলে না। কয়েক মিনিট দুজনই বাক্যহীন। অনেক ভেবে নিয়ে সাইফুদ্দিন এক সময় বলে, নানি গে, সব ভুলেরই সুধার আছে গে। ভেইব্যা দেখ। সুধার কইর্যা লিলে ভুল ফের ঠিক হয়্যা যায়।
সে তো বুঝলুক রে বেটা, কিন্তুক আর কি সেটা হবে রে…
ভেইব্যা দেখ। ভাব। কথা কহ্ না গে নানি আলিমার সাথে…
রাস্তার গর্তে টোটো গাড়ির ঝাঁকুনি সামলাতে সামলাতে গুলশন নিজের মনে উপরবালাকে স্মরণ করেন, আল্লা হে!
খাস শর্তনামা
দুলহা দুলহান উভয় পক্ষের খাস শর্ত এই যে আমরা শরিয়াত মোতাবেক একে অপরের হক আদায় করিয়া চলিতে বাধ্য থাকিব প্রকাশ থাকে যে বিবি মাজকুমার প্রতি কোন অত্যাচার করিলে কিংবা কোথাও চলিয়া গিয়া কোনো প্রকার খোঁজ খবর না করিলে, খোর পোষ যোগাইতে অসমর্থ হইলে ইচ্ছা করিলে বিবি মজকুমা শরিয়াত মোতাবেক নিজের হক দেন মোহর খোর পোষ এবং যাহা কিছু প্রদান করা হইল, তাহা আইনত নিজ স্বামীর নিকট হইতে আদায় করিয়া লইতে পারিবে এবং নিজে নিজের প্রতি খোলা লইতে পারিবে।
ইহা প্রকাশ থাকে যে বিবি মজকুমার পিতা নিজ জামাইকে ১ টি পালসার মোটর সাইকেল সোনার গহনা ২।৫ ভরি এবং পাত্র পক্ষ হইতে বউমা কে সোনার গহনা ২ ভরি দেওয়া হইল। যে স্থানে বিবাহ হইল তাহার পূর্ণ ঠিকানা – পাত্রীর বাবার নিজ বাড়ি।
তালাক দিবার ক্ষমতা স্বামী স্ত্রীকে দিচ্ছেন কি? (হ্যাঁ)।
বিবাহ সংক্রান্ত সাক্ষীদিগের দস্তখৎ দুলহার দস্তখৎ
১) দুলহানের দস্তখৎ
২) কাজীর দস্তখৎ
৩)
উকিলের দস্তখৎ
দুলহার সাক্ষীর দস্তখৎ
দুলহানের সাক্ষীর দস্তখৎ
আলিমা টিনের তোরঙ্গ থেকে তাদের শাদিনামার ফটো কপি বের করেছে। হালিম গেছে মালদা টাউন, কোন এক পেশেন্টকে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে। কখন ফিরবে জানা নেই আলিমার। মালদা, আর মুর্শিদাবাদের নার্সিং হোম গুলোতে এলাকার পেশেন্ট নিয়ে গিয়ে কমিশন পায় হালিম। বিশেষ করে অপারেশনের কেস। গল ব্লাডার, অ্যাপেন্ডিক্স, সিজারিয়ান বেবি, হার্নিয়া, অর্শ ইত্যাদি। সবচেয়ে সস্তা নাকি লালবাগের নার্সিং হোম গুলো। পাঁচ হাজার থেকে বারো হাজারের মধ্যে এসব কেসে রফা হয়।
কালিয়াচক দুই নম্বর ব্লকের মোথাবাড়ি হাই স্কুলে এগারো ক্লাস অব্দি পড়েছে হালিমা। কম-বেশি ইংরাজিও পড়তে পারে। স্মার্ট ফোনে নেট সার্ফ করতে পারে। …শাদিনামা বারবার খুঁটিয়ে পড়ে আর কী কী যেন গুগলে সার্চ করে। ‘তালাক দিবার ক্ষমতা স্বামী স্ত্রীকে দিচ্ছেন কি?’ শাদিনামার এই অংশে দুটি বিকল্প আছে, হ্যাঁ আর না। এখানে, আলিমা দেখছে, ‘না’ শব্দটা পেন দিয়ে কেটে দেওয়া। তার মানে ‘হ্যাঁ’। এই কন্ট্রাক্টে এবিষয়ে তাকে অধিকার দেওয়া হয়েছে। আশ্চর্য, খুঁটিয়ে না পড়লে সে তো জানতই না একথা! কাগজে লেখা অধিকার থেকে চোখ তুলে আলিমা জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাদ্র মাসের মেঘ জমছে, জোর পানি নামতে পারে। …
তাদের কেসরপুর গাঁয়ে বর্ষাকাল ছিল মায়াময়, স্বপ্নের মতো। আল্লার সমস্ত বরকত ছিল সেই গ্রামে, সেখানের মানুষ মিষ্টি কথা বলে আর ভালো চোখে তাকায় অপরের দিকে। বৃষ্টির পানি জমিতে পড়লে আসমানি সুবাসে সারা গাঁ ঢেকে যায়। সেখানে গাছে গাছে ফুল ফল আর পাখি। নিজের গাঁয়ের কথা মনে পড়লে দু-চোখ পানিতে ভরে যায়।
হঠাৎ পেছন থেকে চুলের মুঠি ধরে কেউ হেঁচকা টান মারে, কোন ভাতারের কথা ভাবছিস রে হারামজাদি? বাপ-চুদানি! আধা ঘন্টা লইলো ঘরে এনু, এখ্নো ভাত খুইল্যা দিলি না রে শালি! মিছাই কি লাথ খেছিস তু?
***
বাইশ গাঁয়ের মোড়ল ডেকে ‘বাইসি’ সভা ডাকার ফিকির সাইফুদ্দিনের মাথায় ঘোরাফেরা করে। বাইসির মোড়লরাও নাকি ঘুষ খায়, শুনেছে। তেমন হলে হালিম কায়দা করে নিবে সহজেই। শালা নার্সিং হোমে অনাপ-সনাপ রুগি সাপ্লাই দিয়ে ভালই কামাচ্ছে আজকাল। আল্লা হারামিকে কঠিন শাস্তি দিবে, নিজে চোখে দেখেছে সাইফুদ্দিন, বন্ধুত্বের চক্ষু-লজ্জায় কাউকে জানাতে পারেনি; নিজে চোখে দেখেছে রোজার দিনে হালিম মানিক সাহার দোকানের ভিতরে লুকেয়ে চা খাচ্ছে! তেমন বুঝলে মৌলবি সাহেবকে বলেই দিবে এবার। কিন্তু তাতে কি আর আলিমার দুঃখ ঘুচবে। পারে যদি কিছু করতে তবে ‘বাইসি’ই পারবে।
কিন্তু ‘বাইসি’ সভার কাছে ঠিক কী চায় সাইফুদ্দিন! এই ভাবনা তেকে অন্যমনস্ক করে রাখে। মোড়লরা যদি হালিম আর আলিমার বিবাহিত জীবন সুখী করার নানান উপায় বাৎলে দেয়? আর তারপর সমাজের ভয়ে হালিম এমন কোনও অত্যাচার করা বন্ধ করে দেয়, যা আলিমা প্রকাশ করার ভাষা জানেনা। বা, সেইসমস্ত দুঃখের কাহিনি ‘প্রমাণ’ হিসেবে কেউ মানতে না চায়? কী হবে তখন! মুখ বুজে সারাজীবন হালিমেরই কাছে পড়ে থাকবে মেয়েটা? এই কি চায় সাইফুদ্দিন!
না। আজগবি শেখের দোকানে বসে নিবিষ্ট মনে চা খেতে খেতে বুঝতে পারে, সে মোটেও এরকম সুরাহা চায়না। নিজের উপর কেমন যেন রাগ জমে ওঠে সাইফুদ্দিনের। শালা, কেন বারবার, সারা দিনরাত তার মাথায় ঘুরে ফিরে আসে আলিমার করুণ মুখখানা। মিষ্টি, উজ্জ্বল, অথচ খুব দূরের কোনও তারা যেন; তার বুকের শূন্য আকাশে জেগে থাকে আর পুড়িয়ে মারে প্রতিটা মুহূর্ত! হালিমের ঘরে চলে যাবার পর আরও যেন তীব্র হয়ে উঠেছে ভালোবাসার টান।
অথচ সে তো তাকে ভালোবাসে না! নাকি ভালোবাসে, শুধু খালাতো ভাই বলে বিয়ে করতে বাধা ছিল মনে? …বেশি পড়া লেখা শিখলে এমনই বোকা-বোকা হয়ে যায় মেয়ে মানুষের মন, বুঝতে পারে সাইফুদ্দিন। কোরান-হাদিস-শরিয়ত সব তুচ্ছ করতে শেখে! যা মর গা, লাথ খেয়ে মর ভাতারের!
কী রে বাপ, আজ কি শুধু চা খাবি বসে বসে, গাড়ি চালাবি না?
সাইফুদ্দিন মুখ তুলে দেখে, বিডিও অফিসের ক্যাশিয়ার বাবু। প্রায়ই তার টুকটুকে যাওয়া আসা করেন। – না স্যার, যাব না ক্যানে, বইসে থাকলে কি প্যাট চলে স্যার!
বুঝলেন স্যার, টোটো রিক্সার গতি সামান্য কমিয়ে এক ঝলক পেছন তাকিয়ে ক্যাশিয়ার বাবুকে দেখে নিয়ে শুরু করে সাইফুদ্দিন, ফের বোম্বাই চলে যাব স্যার! মন শালা এখানে বসেনাখো, বুঝলেন…
বিডিও অফিসের মাঝ-বয়সি ক্যাশিয়ার সনাতন রায় অফিসের নানা প্যাঁচ মাথায় নিয়ে থাকেন সারাক্ষণ, তবু সাইফুদ্দিনের কথার জবাবে আন্তরিকতা মিশিয়ে জানতে চান, কেন রে বাপ, বেশ তো আছিস। বোম্বে-দিল্লি-হিল্লি গিয়ে খাওয়া থাকা পরা বাবদ কি খরচ নাই? রোগ-ব্যামো নাই? বাড়িতে থেকে এই যা আট-দশ হাজার হচ্ছে তাকি খারাপ নাকি?
না স্যার, কী আর বলব স্যার… হামার মা শয়তান আছে, বুঝলেন… হামাকে বাঁচতে দিবেনাখো… মায়ের সাথে রহিলে হামার বিহা হবে না স্যার…
আহ্! কী বলিস রে পাগলা!
না স্যার,হামার মা, বুঝলেন, ভিন্ন মরদের সাথে সুতছে।
এই কথার আকস্মিকতায় সনাতন রায় হতভম্ব। এমন একটা কথা যে সাইফুদ্দিন তাকে বলবে, বিশ্বাসই করা যায় না। খুব মায়া হয় ছেলেটার জন্য। নিশ্চয় খুব যন্ত্রণায় আছে, নইলে নিজের মায়ের নামে এমন কথা বেরোবে কেন মুখ দিয়ে।
আর তোমার আব্বা? তিনি কোথায়? কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জানতে চান সনাতন রায়।
ইন্তেকাল হয়েছে, বুঝলেন স্যার, হামি তখন মেলাই ছোট্ট আছিলাম। তাও বাপের চেহারাটা খানিক মনে আছে…
ও…। আচ্ছা, ভিন্ন মরদ বলতে? আবার বিয়ে করেছেন তোমার মা?
সাইফুদ্দিন কঠিনভাবে বলে, না।
নিকা করতে পারে তো। তুমি চাও না? যে, ধর্মের রাস্তায় তোমার মা আর সেই লোকটা নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা করুক?
টোটোর এক্সেলেটর আচমকা কমিয়ে দিয়ে প্রায় গর্জে ওঠে সাইফুদ্দিন, কেইট্যা গাঙের পানিতে ভাসিয়ে দিব স্যার! দুটোকেই!
একী বলছ বাপ! ছি! নিজের মা না তোমার?
মা? আরে হামার মা ভিন্ মরদের সাথে সুতছে বলেই তো আলিমা হামার সাথে শাদি করতে চাহেনি স্যার। হামি কি বুঝি না, কেনে আলিমা হামাদের ঘরে এইলো না!
টোটো থেকে নেমে ভাড়া দিতে দিতে রায় বাবু জানতে চান, আলিমাটা আবার কে?
আরেক দিন কহিব স্যার। আপনার কাছে কিছু যুক্তিও লিব। আজ থাক-
সাইফুদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে সনাতন রায় বলেন, আচ্ছা। সাবধানে থাকিস। মাথা গরম করিস না বাপ।
***
বর্ষার পানি মাঠে-ঘাটে জমা হয়, ব্যাঙ সাপ ঝিঁঝিঁপোকা আর কত কীটপতঙ্গ বেরিয়ে আসে আসরে। আলিমার শ্বশুর বাড়ির গ্রামে যখন সন্ধ্যা নামলে এইসব জীবের ডাক আর আনাগোনায় চরাচর ভরে যায়, খুব গভীর কোথাও সেই চলাচল টের পায় আলিমা। স্কুলের দিনগুলো মাঠ-ঘাট রাস্তা বাগান মেঘ পাখি আরও কত কী নিয়ে উথাল পাথাল হয় তার গুমরে থাকা মনের ভেতর।
নানী বলত পড়া-লিখা শিখছিস রে বহিন, তোর বিহা দিব বিডিওর সাথে লয় ডাক্তারের সাথে লয় হেড মাস্টারের সাথে! দেখিস গে বহিন, খুব বাবু মানুষের সাথে ঘর করবি তুই। কিন্তু করল কী, না এই ডাক্তারের দালালটাকে জুটিয়ে দিল তার কপালে। কি কাম করে হালিম সেটা বড় কথা নয়, জানে আলিমা; কিন্তু মনটা যে বড্ড হারামি লোকটার। আর সেই মনের মধ্যে সারাক্ষণ একটা শয়তান বাসা বেঁধে থাকে। কত কুটিল-জটিল কথা কয়ে কয়ে কাঁদায় শুধু। আর মারে। শরীরের যাতনা তবু বরদাস্ত করা যায়, মনে হুল বিঁধালে যে খুব জ্বালা করে, সেই জ্বালা কোরান মজীদের কোনও আয়াতই ঠিক করতে পারে না। বাপ-মা থাকলে কি আর এমন হতো তার। চোখের পানি সামলায় আর ঘরের কাজ করে সে। আবার কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। আল্লা কি এতই দয়াহীন, নেক পাক ইনসানের দুঃখ দেখতে পায় না? কিসের ইন্তেহান নেয় আল্লাপাক! …শয়তানিটা করেছে সাইফুদ্দিনই। বেশ বুঝতে পারে আলিমা। আর তার নানীই বা কেমন। সাইফুদ্দিনের কথার ফাঁদে ভুলে হালিম কে বেহেস্তের ফরিস্তা ভেবে বসল।
***
শেষে সত্যিই একদিন ‘বাইসি’ সভা বসে। সভায় হালিমের অত্যাচার প্রতিপন্ন হয় আলিমার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে। সভায় হালিম জানায় ও নানাভাবে প্রমাণ দিতে চায় যে সাইফুদ্দিন, তার বন্ধু, আসলে আলিমাকে তার ঘাড়ে ‘গছিয়ে’ দিয়েছে এই আশায় যে তাহলে সে তলে তলে প্রেম করতে পারবে তার খালাতো বোনের সাথে। তা নইলে কথা নাই বার্তা নাই, নাই কোনও পরব, হঠাৎ সেবার একটা শাড়ি কিনে আলিমাকে দিতে গেছিল কেন সাইফুদ্দিন!
বাইসি সভার প্রধান জামালুদ্দিন মণ্ডল বলেন, কই রে বাপ সাইফুদ্দিন! এই অভিযোগের জবাব দে!
সাইফুদ্দিনের মাথায় তখন অসীম আকাশ বাতাস আর জীবসকলের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র এই আজব কায়নাত তোলপাড় হয়। বেহেস্ত আর দোজখের সমস্ত হেদায়ত মিলে-মিশে একাকার। সে সাভার মাঝে উঠে দাঁড়ায়। খুব স্বাভাবিক গলায় বলে, হাঁ, হামি আলিমাকে চাই। ভালোবাসি হামি উয়াকে।
‘বাইসি’ আলিমার মতামত জানতে চায় না।
‘সভা’ হালিমকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ফাইন করে আর বিবিকে বিধিবদ্ধ ভাবে তালাক দিতে বলে। তার দেনমোহর ফিরিয়ে দিতে বলে। আলিমাকে নানি গুলশন বেওয়ার বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেয়। সভা এও বলে যে, এক মাস পর, অর্থাৎ রোজার পরই আবার ‘বাইসি’ বসবে আর তখন আলিমা আর সাইফুদ্দিন সহ তাদের পরিবারের বক্তব্য শুনে ওই দুজনের নিকার ফয়সালা নেওয়া হবে। আলিমার প্রয়োজনীয় জামাকাপড় ইত্যাদি যেন আজই নানির বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
বাইসি সভা শেষ হলে সাইফুদ্দিন দেখে নানির সাথে আলিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে তাদের কাছে গিয়ে নানিকে বলে, চল গে নানি হামার টোটো গাড়িতে। তোদেরকে ঘরে দিয়ে আসি। গুলশন বেওয়া আলিমার মুখের দিয়ে তাকায়। আলিমা মুখ ফিরিয়ে নেয়। বলে, না। হামরা ওর গাড়িতে যাব না। ওকে যেতে কহো নানি। আরো কহ যে, হামার এখনও তালাক হয় নাই। ও যেন দূরে থাকে। কহো, আল্লা যে বিচার করবে তাই হবে। ইনসান ইনসানের বিচার করার কে!
সাইফুদ্দিন নিঃশব্দে আলিমার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। এই কথাগুলো আলিমা কাকে বললো, কেন বললো জানার প্রয়োজন নেই তার। তার পক্ষে বললো না বিপক্ষে তাও জানতে চায় না সে। এমন কি ভালো বাসে কিনা আলিমা, একটুও, এক রত্তিও টান আছে কিনা সে কথাও বুঝতে চায় না সাইফুদ্দিন। শুধু অবাক বিস্ময় আর অদ্ভুত মোহে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। শুধু আলিমার কথা ভেবে ভেবে কাঁদতে চায় একা একা। একা একা বসে থাকতে চায় এই মুখ মনে করে সারাটা দুপুর, সমস্ত রাত। কী হবে আলিমার মনে যদি তার প্রতি ভালোবাসা না থাকে? না থাক! সে কি হালিম কে ভালোবেসে তবে বিয়ে করেছিল? তবে? না বাসুক ভালো তাকে আলিমা, তবু তো তার ঘর করতে পারে সে। আর যাই হোক আলিমাকে কোনও দিন দুঃখ তো দেবে না সে। কাঁদাবে না তো। তবে?
***
সামনেই বকরিদ। কুরবানির খাসি জবাই এর জন্য পটলডাঙার হাট থেকে ধার দিয়ে আনা চাকুখানা বের করে টোটো গাড়িতে রাখে সাইফুদ্দিন। সেই দৃশ্য দেখে হায় হায় করে ছুটে আসে তার মা। -কুন্ঠে যাস রে বাপ হামার, হাঁ রে বাপ!
এই দুনিয়ার হাওয়া-পানিতে ওই শালার আর হক নাই গে মা! আজ শালাকে খতম করে দিবে হামি, ওই কুত্তার বেটা এই দুনিয়াটাকে ভারি বানিয়ে রেখেছে, বুঝলি? হাল্কা করে দিব আজ হামি!
কার কথা কহিছিস রে বাপ? কী কহিছিস এইসব রে, হাঁ?
সাইফুদ্দিন চিবিয়ে, ধীরে ধীরে বলে, তুই সবই জানিস, নাটক চোদাসনাখো মা! দূরে থাক তুই কহে দিলাম!
বাপ রে হামার, হাঁ রে বাপ, এত গুস্সা করিস নারে বাপ! কিছু এটা-সেটা হয়ে গেলে জেহেল হবে রে তোর, কেস-মুকদ্দমা হবে, ফাঁসি হবে রে !
ফাঁসি? আলিমার কি গুণে ফাঁসি হল গে তেবে? কী করেছিল উ?
হাঁরে বেটা অই ছুঁড়ি তো লিজেই ফাঁসি লাগিয়ে ঝুইলেছে বাবলা গাছের ডালে রে বাপ!
ওই শালা বুরমারানির বেটা হালিমের লেগে মরেছে গে আলিমা…
চুপ রে বাপ চুপ। আয় ঘরে ঢুকে বস। পানি খা রে বেটা, মাথা গরম করিস না।
যা কহিলাম যা ! ভালো চাহিস তো হটে যা…
বাপ, বেটা হামার
যাবি না?
তুই চাকুখানা আগে রাখ, ঘরে চল…
সাইফুদ্দিন অনেকক্ষণ মায়ের চোখর দিকে চেয়ে থেকে ধীর পায়ে টোটোর দিকে যায়। সেখানে রাখা চকচকে চাকুখানা প্রশ্নাতীত নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় হাতে তুলে নেয়। তার পর আরও শান্ত ভাবে এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরে বলে, চল, ঘরে চল।
হঠাৎ এক ঝটকায় সাইফুদ্দিনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার মা বীভৎস চিৎকার করে প্রাণপণ ছুটে পালায়।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..