শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহরঃ রিভা ডেল গার্দা

রিম সাবরিনা জাহান সরকার
ভ্রমণ
Bengali
শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহরঃ রিভা ডেল গার্দা

জার্মানির সব শহরেই ছোট বড় রেল স্টেশন ছাড়াও একটা করে কমলাপুর থাকে। সেগুলোকে বলে হপ্ট-বান-হফ। কেন্দ্রীয়-রেল-স্টেশন। আজকে ট্রেন ধরেছি মিউনিখের কমলাপুর থেকে। গন্তব্য, ইটালির ট্রেন্টো অঞ্চলের রিভা ডেল গার্দা। আল্পাইন পাহাড়ঘেরা গার্দা হ্রদের পাড়ের এক শান্ত শহর এই রিভা। ইটালি পৌঁছে রোভেরেতো নামের এক জায়গায় ট্রেন থামলে সেখান থেকে গাড়ি এসে আমাদের রিভা শহরে নিয়ে যাবে। হোটেল বুকিংয়ের সময় গাড়ির ব্যবস্থা করে যাত্রাপথের হাঙ্গামা কমিয়ে ফেলা হয়েছে।

ট্রেনে ছয় আসনের একটা কামরা ভাড়া নিয়েছি। এক দিকে বসেছে মৌরী আপু আর হাদী ভাই। আরেক দিকে আমরা রুমি আর রিম। মাঝখানে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে দুই অনু পরিবারের দুইজন পারমানবিক সদস্য। তারা যে যার মত গলা সপ্তমে চড়িয়ে চ্যাঁচাচ্ছে। চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে বড়দের ব্যাগ থেকে কলা, রুটি আর কেক উঁকি দেয়া শুরু করেছে। রুটি চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে হালের মুরাদ টাকলীয় বাংলিশের একনিষ্ঠ ভক্ত হাদী ভাই আনন্দে আত্মহারা ভঙ্গিতে বলছেন, ‘মগা হাবা, মগা হাবা’ (moga haba)। মজা তো হবেই। একঘেয়ে ঘানিটানা প্রবাসজীবনের গোয়াল ফাঁকি দিয়ে দড়ি ছেড়া গরুর পাল আজকে বাছুর সমেত পালিয়েছি যে! সামনের কয়েকটা দিন ছাড়া গরুর মতই মাঠ ঘাট দাপিয়ে বেড়াবো। এই না হলে জীবন। মনে মনে আমিও বললাম, ‘জয় বাবা, মগা হাবা!‘

গার্দা লেকের সন্ধ্যা

জানালার বাইরে দৃশ্যপট একের পর এক বদলে যাচ্ছে। কখনো শহরতলী, কখনো ছবির মত সাজানো গ্রাম, কখনো বা তুষারে ঢাকা মাঠের পর মাঠ। সবার ভারী জ্যাকেটগুলো ট্রেনের কামরার হুকের সাথে লটপটিয়ে ঝুলছে। কিন্তু আমি বেচারা জ্যাকেট তো খুলিই নি, বরং চেইনটা গলা পর্যন্ত তুলে, ঢাকা কলেজের উল্টো থেকে কেনা নকল কাশ্মীরি শালটা নিশ্ছিদ্রভাবে পেঁচিয়ে জাঁকিয়ে বসেছি। নিজেকে তিব্বতদেশীয় কল্পিত প্রানী ইয়েতি মনে হচ্ছে। আসল কাহিনী হল, ঠান্ডা লেগে চাট্টিবাট্টি গোল অবস্থা। ঘাড় নাড়াতে পারছি না। পেরিফেরাল ভিউ বলে কিছু নেই আর। যেদিকে তাকাতে চাই, ঘাড়-ধড় এক সাথে ঘুড়িয়ে দাঁড়াতে হয়। সামান্য কাশিটা বেড়ে এমন যক্ষা মার্কা চেহারা নিবে, ভুলেও ভাবি নি। মনীষীরা বোধহয় এমন পরিস্থিতির কথা ভেবেই এর নাম দিয়েছেন, ‘মাইনকা চিপা’।

সেদিন ডাক্তারের চেম্বার থেকে প্যাঁচ মেরে বলা হয়েছে, ঠান্ডাটা কোন ভাইরাল সংক্রমন হতে পারে আবার ব্যাকটেরিয়াজনিতও হতে পারে। সাত দিনে সারতে পারে, আবার এক সপ্তাহও লাগতে পারে। অধৈর্য আমি মুখ ফসকে জানতে চাইলাম, ‘এত যে কাশছি, হুপিং কফ হয়ে গেল না তো আবার?’ চোরের উপর বাটপারির মত ডাক্তারের উপরও খোদকারি করতে নেই। ডাক্তারের হাসিমুখ দপ্ করে নিভে গেল, ‘হুপিং কফ আবার কি?’ তাড়াহুড়া করে বললাম, ‘কেন, ওই যে বললে, পারটুসিস হবার ভয় আছে?’ ডাক্তার চোখে মুখে চরম অবিশ্বাস নিয়ে অন্তর্জালে হামলে পড়ে গোকুল (পড়ুন গুগল) দৈত্যের প্রদীপে ঘষা মেরে বসল। এদিকে আমি স্বেচ্ছায় ভুলভাল বকছি, ‘হুপিং কফ তো মনে হয়ে ধনুষ্টংকার। বিড়ালে কামড়ে যা হয়, তাই না?‘ আমার আমতা কথা উপেক্ষা করে উজ্জ্বল মুখ তুলে ডাক্তার বলল, ‘আরে না, তুমিই ঠিক। যাহাই পারটুসিস, তাহাই হুপিং কফ!‘

তো চিরকালের ল্যাটিন নাম চেনা জার্মান ডাক্তার আমার সম্ভাব্য হুপিং কফের কোন রকম নিদান ছাড়াই বিগলিত হাসিতে বিদায় দিল সেদিন। তার ভরসায় না থেকে আমি দেশে আমার ডাক্তার ভাইকে ফোন লাগিয়ে রোগ লক্ষন জানিয়ে আলমারির দেরাজে খুঁজে পেতে তিন বড়ির একটা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শুরু করে দিলাম। আজকে তার প্রথম দিন। তবে অতি স্বাস্থ্যকর ইতালীয় রিভা শহরে গিয়ে একবার পড়লে বায়ু পরিবর্তনের জোরে কাশির গলায় ফাঁসি পড়বেই। আর আমিও সুস্থ হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবো। সেই আশাতেই ডিসেম্বরের এক বিষন্ন ম্যাটম্যাটে শীতের সকাল পেছনে ফেলে টিকেট মিলিয়ে বগি খুঁজে ইটালির ট্রেনে চেপে বসা।

 দুই.

হোটেলে পৌঁছালাম যখন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। হোটেল বলা হয়তো ভুল হবে। ভ্যাকেশন অ্যাাপার্টমেন্ট বা ভ্রমন নিবাস বললে বোধহয় বেশি মানানসই হয়। তিনতলা বাড়ির অনেকগুলি ফ্ল্যাটের একটা। হোটেলের তুলনায় সস্তা। কিন্তু রুম সার্ভিস নেই, চাদর-তোয়ালেও নিত্য নিত্য নিজ থেকে পাল্টে যাবে না। আর ঘরের ধুলা-ময়লা ভ্যাক্যুম চেপে নিজেদেরই সাফসুতরো করতে হবে। এ যেন পুরোপুরি বিটিভি’র ‘এসো নিজে করি’ অনুষ্ঠান। তবে নিজেদের মত করে এলোমেলো থাকার আর রান্নাঘরে যথেচ্ছা রেঁধে বেড়ে খাওয়ার স্বাধীনতা আছে। সেটাও বা কম কিসের?

কিন্তু ঘরে তো ঢুকতে পারছি না। বাড়ির মালিককে ফোন লাগানো হয়েছে। ভদ্রমহিলার আসার নাম নেই। বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তাও মিনিট বিশেক হয়ে গেছে। অবশ্য আমাদের সঙ্গ দেবার জন্যে ঘাড়ের ওপর থেকে উঁকি দিচ্ছে আল্পসের সুউচ্চ প্রাচীর। জায়গাটার তিন দিক পর্বত প্রাচীরে ঘেরা আর আরেক দিক জুড়ে গার্দা হ্রদের তীর। যেন কোন যুদ্ধবাজ রাজা সুরক্ষিত এক দূর্গ বানিয়ে শেষে সবচেয়ে জরুরী অভেদ্য ফটকটা লাগাতেই ভুলে গেছেন। ফটকবিহীন দূর্গটায় হু হু করে মাতাল হাওয়া ঢুকে চারপাশে পড়ে থাকা জলপাই গাছের পাতাগুলোকে মর্মর সুরে নাচিয়ে বিচিত্র এক অভ্যর্থনা জানিয়ে গেল অপেক্ষায় থাকা ক্লান্ত আমাদের দলটাকে।

জিঙ্গেল বেলের সুরে ডাইনীর দল

আধা ঘন্টা পর কাঙ্খিত গৃহপ্রবেশ ঘটল। কিন্তু কোথায় সবাই হাত-মুখ ধুয়ে তাজা হবার চেষ্টা করব, তা না করে হাতের ফোন উঁচিয়ে ঘরের কোনাকানচি, চিপা-চুপা সব পরখ করে বেড়ানো শুরু করলাম। উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ওয়াই-ফাই সংকেত পাকড়াও করা। বাড়িওয়ালী চলে গেছে, কিন্তু তাকে আবার ফোন লাগিয়ে পাসওয়ার্ড যাচাই করা হল। অক্সিজেন না হলেও চলতে পারে আমাদের, কিন্তু অন্তর্জাল নামের অদৃশ্য মাকড়সার আঠালো জালে নিজেরদের স্বেচ্ছায় বন্দী করে না ফেলা পর্যন্ত কেমন অসহ্য রকমের মুক্ত মুক্ত লাগতে থাকে। অবশেষে সদর দরজার সামনের বড় আয়নাটার কাছে মিলল বহু কামনার মোক্ষ। সদলবলে গর্জে উঠলাম, ‘হুররে…!’। এই আধুনিক মোক্ষের সন্ধানে অশ্বথ গাছের ছায়ায় গৌতম বুদ্ধের মত অনন্ত কাল বসে থাকতে হয় না। পাসওয়ার্ড টিপ দিলেই সিসিম দুয়ার খুলে যায়। পর্যাপ্ত পরিমান চেক ইন আর স্ট্যাটাসের বন্যা বইয়ে দিতে কেউ নীল-সাদা জগতটা হারালাম। কেউ বা দেশে ফোন লাগিয়ে ‘আম্মা, আমি পৌঁছায় গেসি’ জাতীয় আশ্বস্তবানী শুনিয়ে বাঙ্গালী মায়ের মাঝ তিরিশের চিরশিশু সাজলাম। আর সত্যিকারে শিশুগুলো তখন পর্দার কোনা ধরে ঝুলছে কিংবা সোফার হাতল কামড়ে লালা দিয়ে ভিজিয়ে ফেলতে ব্যস্ত। মোক্ষ তো আসলে এরাই লাভ করে বসে আছে।

শেষ বিকালের রোদটা আমাদের ছেলেমানুষি আর সইতে না পেরে বারান্দায় হানা দিয়ে একেবারে ঘাড় ধরে ঘরের বাইরে ডেকে নিল। বেরিয়ে এসে দেখি পাহাড় মুচকি হাসছে, ‘এতক্ষনে সময় হল বুঝি?’। আকাশের পড়ন্ত সূর্যঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, আসলেই তো, বেলা যে পড়ে গেল। পাহাড়ের বিশালতার কাছে লজ্জা পেয়ে পা বাড়ালাম মধ্যযুগে গড়ে ওঠা এই শহরটা ঘুরে দেখবো বলে। পথের বাঁ পাশে গার্দা হ্রদও আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে বয়ে চলল। আল্পসের গ্লেসিয়াস থেকে সর্বশেষ বরফযুগের একেবারে শেষ প্রহরে এই হ্রদের সৃষ্টি। এর অববাহিকায় রিভা ছাড়াও গড়ে উঠেছিল আরো কতগুলো শহর। সব তো দেখা সম্ভব না। একটাই না হয় প্রান ভরে দেখি এই দু’টো দিন।

এককালের সাদামাটা রিভা এখন পুরো মাত্রায় খাঁটি পর্যটন শহর। শহরে এখানে ওখানের প্রাচীন দালানকোঠায় ভেনিশিয়ান স্থাপত্যের ছাপ আছে পড়েছি। স্থাপত্যের এই ধারার জন্ম সেই চৌদ্দশ শতকের প্রাচীন ভেনিসে। এতে মিশেছে তৎকালীন কন্সট্যান্টিনোপলের বাইজেন্টাইন নকশার কিছু মিছু আর সে যুগের আন্দালুসিয়ার মুরিশ স্থাপত্যের প্রভাব। সাথে ইটালির নিজস্ব গথিক ধারার অনেকটা অংশ তো আছেই। কিন্তু আমরা যে পথে হাঁটছি, সেখানে তেমন কোন বাহারি দালানগুলো চোখে পড়ছে না তো। ঐ তো সব একালের চারকোনা বাক্সগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো জানালাটা ভারিক্কী কিংবা ফটকটা রাশভারী। বড়জোর আয়েশি ঝুল বারান্দা। ব্যস, এই তো। কিংবা কে জানে হয়তো একটা শিল্পীমনের অভাবে সূক্ষ্ণ সৌন্দর্য আমি দেখতে পাই না। বাহারের চাইতে বরং একেকটা বাড়িঘরের একেক রঙ বেশি চোখে লাগল। বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা-এ যেন রংধনুর শহর! কটকটে লাগছে না মোটেই, বরং একটা মোমরঙ্গা স্নিগ্ধতা আছে। হঠাৎ মাঝে চোখের পড়ল বেমানান এক ধূসর মিনার। মধ্যযুগে গড়ে ওঠা সান মার্কো নামের এই মিনারটা ভেনিশীয় যুগে এসে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। তারপর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এটুকুতে এসে ঠেকেছে। তবু সেটুকু নিয়েই সে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাল্লাবিহীন বিশাল দরজা এখনও তার অতীত দর্প জানিয়ে যায় যে, এককালে সে ছিল শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার।

ভারোনের ঝরনা

আমাদের দলটা এগিয়ে চলছে। বাতাসে ক্যারামেলে ভাজা অ্যালমন্ড বাদামের মিষ্টি ঘ্রান। বড়দিন ঘনিয়ে আসছে। ঈশান কোন থেকে বেহালার সুরে ভেসে আসছে, ‘জিঙ্গেল বেল, জিঙ্গেল বেল…’। ঘের দেয়া জমকালো পোশাকে ডাইনী বুড়ি সেজেছে জনাকয়েক তরুনী। পোশাকের সর্বাঙ্গে জড়ানো ছোট ছোট রঙ্গীন বাতি। সাঁঝের জোনাকির মত সেগুলো জ্বলছে আর নিভছে। সাথের ষোল-সতেরো বছরের সুশ্রী চেহারার দুই কিশোর ড্রাম পেটাচ্ছে তালে তালে। তাদের ছোট দলটা মূর্ছনার রেশ তুলে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা হয়ে শহরের অলি গলি ধরে হাঁটতে থাকলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধ ইঁদুরের দলের মত তাদের পিছু নিলাম। ডাইনী্রা আবার আমাদের গার্দা হ্রদের পাড়ে না নিয়ে গেলে হয়। অল্প সাঁতার জানা আমাদের সলীল সমাধি তখন আর ঠেকানো যাবে না।

একটু এগোতেই আরেক বাজনার দল পাওয়া গেল। বয়সে এরা প্রবীণ। কিন্তু তারুন্য যে সাদা চুল আর চামড়ার ভাঁজেও অনায়েসে থাকতে পারে, সেটা বোঝা গেল যখন দলটা তাদের অদ্ভূত চেহারার কিম্ভূত একেকটা বাদ্যযন্ত্র বেদমভাবে বাজানো শুরু করলো। একেবারে সুরের তুমুল কালবৈশাখী বয়ে গেল। আবার বাজনার মাঝপথে থেমে তারা হঠাৎ হঠাৎ হুংকার ছাড়ছে, ‘গাবালু হেহ্ হেহ, গাবালু হোহ্ হোহ…’। গাবালু যে কি বস্তু, ক্যোঁৎ করে গিলে খায়, নাকি চপচপে করে তেলের মত মাথায় দেয়, কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু অভিভূতের মত দেখছি এই বুড়ো যুবকদের তেলেসমাতি কান্ড। বাচ্চারাও সুযোগ পেয়ে তালে তাল মিলিয়ে ক্ষ্যাপা নাচ জুড়ে দিয়েছে।

এদিকে বাচ্চাদের বাবারা কফি আর স্ন্যাক্সের খোঁজে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে সে অনেকক্ষন হল। মৌরী আপু আর আমি আর না পেরে কুটিল রমনীর মত লাপাত্তা বাবাদের নামে একে অন্যের কাছে নালিশ করছি। হাদী ভাই নাকি মৌরী আপুর সোনার জীবন তামা তামা করে দিয়েছে। শুনে প্রবল আবেগে আমিও যোগ করলাম, ছেলের বাবাও কিভাবে আমার কচি পাতার মত সবুজ কলিজাটা একদম তেজপাতা করে ছেড়েছে। এরা সব দুষ্ট লোক। বলতে না বলতেই দুষ্ট লোকেরা কফি আর স্যান্ডউইচ হাতে উদয় হল। আর আমরা দুই ঘষেটি বেগম, আমাদের তামা জীবন আর তেজপাতা কলিজার দুঃখ ভুলে ছোঁ মেরে খাবারগুলো বাগিয়ে নিলাম। হাত বাড়িয়ে ছানাগুলোকেও ডেকে নিলাম। এখন আর লোকগুলোকে অতটা দুষ্ট লাগছে না।

সন্ধ্যাটা বাদুড়ডানায় ভর করে কখন যে নিশব্দে নেমে এসেছে, খেয়ালই করি নি। গার্দার নিস্তরঙ্গ জলে পাহাড়ি বাতাসের তোড়ে মৃদুমন্দ কৃত্রিম ঢেউ খেলছে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই বুঝি বা ঢেউ মাথায় রহস্যময় কোনো জলদানব ভেসে উঠবে। কিন্তু না, উপকথার কোনো লকনেস দানবের দেখা মিলল না। অগত্যা পা বাড়ালাম ভালো কোন রেস্তোরার খোঁজে। ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর কফি-স্যান্ডউইচ নিমেষে হজম করে নিয়ে বুভুক্ষের মত আরো চাইছে।

জেন গার্ডেন

তিন.

সারাটা রাত খকর খকর কেশে মহল্লার সব ইটালিয়ান চোরদের ভাত মেরে ভোরের দিকে চোখ বুজে আসল। কিন্তু সে সুখ বেশিক্ষন সইলো না। বাকিরা উঠে পড়েছে। আমি একা মটকা মেরে অলস পড়ে থাকলে কেমন দেখায়। অগত্যা অনিচ্ছার আড়মোড়া ভাঙতে হল। মৌরী আপুও সকালের প্রথম চায়ের জোগাড়ে ব্যস্ত। স্বাস্থ্যসচেতন হাদী ভাই ছয়টায় বেড়িয়ে গেছেন দৌড়াতে। ঘরের ভেতরটা সোনারঙ্গা রোদে সয়লাব। ঘুম ঘুম রেশটা কেটে গেল। রোদের এমনই ক্ষমতা। আজকের বেড়ানো ঝরনাকেন্দ্রিক। খুব চমৎকার একটা ঝরনা আছে কাছেপিঠে, সেখানে যাওয়া হবে খানিকবাদে। মনটা চনমনিয়ে উঠল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরোবার জন্যে তর সইছে না।

একে একে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। ঘাপলাটা বাঁধিয়ে দিল দলের সবচেয়ে ধবধবে সদস্য রুমি। সে মিনিট চল্লিশেক লাগিয়ে গোসল করছে তো করছেই। ইশ্রাফিলের শিঙ্গা ফোঁকার আগ পর্যন্ত মনে হয় চলবে এই প্রাতঃস্নানের ঘটা। মৌরী আপু তো আর না পেরে দরজায় দড়াম দড়াম কিল মেরে আসলো। অভিযোগের সুরে জানালাম, এই গোসলের নাম বিউটি গোসল। হাদী ভাই যেমন স্বাস্থ্যসচেতন তার ছোট ভাই তেমন রূপসচেতন। ঘরে তো প্রতিদিন এই অত্যাচার চলে। এখানে এসেও সে ধারাবাহিকতার হের ফের হয় নি। শুনে আপু কি বলল ঠিক বোঝা গেল না। শুধু দাঁত কিড়মিড়টা স্পষ্ট শোনা গেল। যাহোক, সবার চুলে পাক ধরে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে বিস্ময়কর বিউটি গোসলের জনক শ্রীযুক্ত জনাব রুমি তার গোলাপি কানের লতি নিয়ে লাজুক হাসি হেসে বেরিয়ে এল। গোলাপি লতি আমাদের মুগ্ধ করতে পারলো না। তাকে আমরা প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

মন্টে বাল্ডো’র চূড়ায়

রিভা শহর থেকে বাসে করে মিনিট বিশেকের পথ। গন্তব্যের পুরো নাম পার্কো গ্রোত্তা কাস্কাটা ভারোনে। বলতে গিয়ে জিভ পেঁচিয়ে আসছে। তার চেয়ে ব্যবচ্ছেদ করে বলি। জায়গাটা আকর্ষন দুইটা। এক, কাস্কাটা ডেল ভারোনে। মানে কাস্কাটার ঝরনাধারা। আরেকটা হল পার্কো গ্রোত্তা বা গুহা বাগান। বাগান অবশ্যই গুহার ভেতরে নয়। বরং গুহার আশপাশ দিয়ে উঠে-নেমে গিয়েছে নাকি। খুব সহজ বাসযাত্রা আমরা কৃতিত্বের সাথে গুবলেট করে ফেললাম। ভুল বাসে চড়ার মাশুল হিসেবে এক স্টেশনে বসে ঠিক বাসের জন্যে অপেক্ষায় কেটে গেল ঘন্টাখানেক। ভোগান্তি পর্ব দুই পর্যন্ত গড়াতো যদি না হাদী ভাই তার স্বল্প ইটালিয় বিদ্যার জোরে আধবোজা চোখে ঝিমোতে থাকা বাস চালকদের মারফত বাসের নাম্বারটা জেনে না আস তো। অল্প বিদ্যা এখানে ভয়ংকর হয় নি। বরং তাক লেগে গেল এটা দেখে যে, একটা ভাষার শুধু সংখ্যা জ্ঞান থাকলেই ছোটখাট বিপদ-আপদ এড়ানো যায় কত সহজেই।

অবশেষে পৌঁছালাম। টিকেটের সাথে সাথে স্যুভিনির শপ-কাম-ক্যাফে থেকে দুপুরের খাবার  হিসেবে কয়েক টুকরা পিজা কিনে নিলাম। সুকান্তের কাছে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় লাগলেও আমাদের কাছে খালি পেটে কাস্কাটা ডেল ভারোনের অনিন্দ্যসুন্দর ঝরনাধারা  আবার ফুটো হয়ে যাওয়া ওয়াসার পাইপের পানির তোড়ের মত লাগতে পারে। তাই পেটপূজার এই আগাম ব্যবস্থা। পা বাড়িয়েছি আর চোখে পড়ল, দোকানের সামনে বর্ষাতি সাজিয়ে রাখা। ঝরনার কাছে গেলে পানির ঝাপটায় ভেজার হাত থেকে বাঁচার জন্যে। এই জিনিস পাই পাই গুনে পয়সা খরচ করা জার্মানরা কেউ কিনবে না। জার্মান মুলুকে থেকে আর তাদের স্বভাবের বাতাস গায়ে লেগে হাতখরুচে বাঙ্গাল আমরাও কিপ্টে হয়ে গেছি। তাই বর্ষাতিগুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সামনে এগোতে বাঁধলো না।

ঝরনার পথটা বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। বোটানিকাল গার্ডেন একটা। সব গাছের নাম-ধাম, গোত্র-বংশ গাছের গায়ে সাঁটা রয়েছে। বাগানটা একই সাথে একটা zen gaden ও বটে। জেন গার্ডেন আসলে প্রকৃতির আদল ধরতে চেয়ে বাগান করার একটা জাপানি বুদ্ধি বলা যেতে পারে। zen বা জেন কথাটা নাকি চাইনিজ শব্দ থেকে এসেছে। আর সেই চাইনিজ শব্দ আবার এসেছে সংস্কৃত ‘ধ্যান’ থেকে। খেয়াল করে দেখলাম কথা সত্য। কেমন শান্তি শান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে চারিপাশটায়। দুই পাশে সুশৃংখলভাবে সাজিয়ে রাখা পাথরগুলো পাহাড়-পর্বতের প্রতীক। মাঝের নুড়ি পাথরের পথটুকু যেন বয়ে চলা খরস্রোতা নদী। আর সারি সারি গাছগাছালি যেন প্রকৃতির রক্ষাকবচ হয়ে অতন্দ্রপ্রহরীর মত সটান দাঁড়ানো জওয়ানের দল। জেন বাগানের এই প্রতীকী রহস্যের কথা আমার নিরেট মাথায় খেলার কথার না। তথ্যগুলো পথ চলতে চলতে মারাত্মক বই পড়ুয়া হাদী ভাই পেশাদার ট্যুরিস্ট গাইডের মত করে বলছিলেন দেখে জানলাম। নইলে আলাদা করে এর সৌন্দর্য সাদা চোখে ধরা পড়ত না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না। বাগানের ধ্যানমগ্ন আবেশ ভেঙ্গে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্পিকার থেকে এলভিস প্রিসলির গান ভেসে আসছে। এমন গুরুগম্ভীর পরিবেশে টুংটাং পুংপাং জেন সংগীত মানে ধ্যান সংগীত আশা করছিলাম। তবে, এলভিসের হার্টব্রেক হোটেল লাগছে মন্দ না। পুংপাংয়ের চেয়ে উত্তম।

প্রচন্ড ঝমঝম ঝংকারে বুঝলাম ঝরনার কাছে চলে এসেছি। এই ঝরনা এসেছে গার্দা হ্রদ থেকে নয়, বরং আরেকটা হ্রদ, নাম যার, লাগো ডি টেনো বা Lake of Tenno-সেখান থেকে। পানির ঝাপটা উপেক্ষা করে সবাই যতদূর কাছে যাওয়া যায় গেল। শুধু আমি দূর থেকে ঝরনা দেখলাম। সৌন্দর্য কাছ থেকে দেখার চেয়ে সামান্য তফাতে থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেই ভাল লাগে কারো কারো। খুব কায়দা করে নিচ থেকে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। উজ্জ্বল নীল আলোয় নেমে আসা ঝরনাটাকে বুনো ময়ূরের ময়ূরকন্ঠী নীল পেখম বলে ভুল হচ্ছে। তার চেয়েও চমৎকার লাগলো, শত বর্ষের অবিরাম ধারা কিভাবে পাষানের নিশ্ছিদ্র হৃদয় গলে আপন সুরঙ্গ খুড়ে বয়ে গেছে। সাধনা থাকলে অসাধ্যও মুঠোয় এসে ধরা দেয় একদিন। রবার্ট ব্রুসের মাকড়শার কথা মনে পড়ে গেল। সাত বারের বার সে বেচারা কার্নিশের এক ঝুল থেকে আরেক ঝুলে যেতে পেরেছিল। ঠিক করলাম, ভারোনের এই ঝরনা কিংবা ব্রুস সাহেবের মাকড়শা-জীবনে এ দু’টোর একটা হতে হবে। হতাশাগুলো এক ফুঁ দিয়ে না পারি, সাত ফুঁয়ে ধূলোর মত উড়িয়ে দিতে হবে। তাতেও কাজ না হলে আজীবন হতাশার গায়ে শকুনে ঠোকর মেরে যাব। টেনো লেকের ঝরনার মতন।

পায়ে পায়ে ফিরে আসলাম ফিরতি পথে। বাসে ওঠার আগে ঢুকে পড়লাম ছিমছাম একটা ক্যাফেতে। ভেতরটা তত ছিমছাম লাগলো না। দরজায় প্রমান সাইজ মদের পিপে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। দেয়ালের ঢাল-তলোয়ার তাদের শান শওকতের ঝিলিকে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এই জলদস্যুর জাহাজের খোলের ভেতর কফি খাব কি করে ভাবছি। হাতের কব্জিতে  ভয়ংকর উল্কি আঁকা অথচ ভীষন বিনয়ী সুদর্শন ওয়েটার জানতে চাইলো কি খাব। ইতস্তত করে কেউ হট চকলেট, কেউ কেক-কফির জন্যে বলে এসে বসেছি ফায়ারপ্লেসের আড়াআড়ি রাখা মখমলের গদি আটা পুরু সোফাটায়। অভিজাত ইটালিয়ান বিলাস আর কাকে বলে। এমন মজার জায়গা পেয়ে সাথের শিশুরা মেঝেতে গড়াগড়ি শুরু করেছে। গড়াগড়ির চোটে কাঠের তকতকে মেঝে আরো আয়নার মত মসৃন হয়ে উঠছে। তাদের বাধা না দিয়ে প্রায় গলে পড়া চকলেট কেকের টুকরোয় লোলুপ চামচ বসালাম।

স্কালিজার দূর্গ

চার.

আজকে যাব মালচাসিনে। শুনেছি গার্দা হ্রদের পুব পাড়ের মালচাসিনে এক কালে ছিল ঘটনাবিহীন ঘুম ঘুম নিরুপদ্রব জেলেপল্লী। কালের পরিক্রমায় সাধারন জেলে পাড়া থেকে তার প্রমোশন হয়েছে। কারন আর কিছুই না-পর্যটন। গার্দা হ্রদের সবচেয়ে উঁচু চূড়া মন্টে বাল্ডোর রাজত্ব সেখানে। মন্টে বাল্ডো মানে দাঁড়ায় টেকো পর্বত। চূড়ার মাথায় নাকি মুকুট হয়ে বসে আছে প্রাচীন এক দূর্গ। তো, এই টেকো রাজার মুকুট দর্শন আজকের দিনের প্রধান আকর্ষন।

বাসের জন্যে সবাই অপেক্ষায় আছি। বাসের দেখা নেই। ব্রিটিশ এক বুড়ো-বুড়ি অনেক্ষন প্রতীক্ষায় থেকে রনে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে গেল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও আমরা হাল ছাড়লাম না। বরং স্কটিশ সেনাপতি রবার্ট ব্রুসের মাকড়শা হয়ে স্টপেজের পাশের পাঁচিলের ধারে ঝিমোতে থাকলাম। এই বাসটা এলো না তো কি হয়েছে? পরেরটা নিশ্চয়ই আসবে। সময় কাটানোর জন্যে হাদী ভাই নানান ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। আমাদেরকে জনে জনে জিজ্ঞেস করছেন, ’বড় হয়ে কি হতে চাই?’ দলের দুই শিশু সদস্য বাদে বাকিরা যে সব বড় হতে হতে প্রায় বুড়ো হবার পথে, তাদেরকেই কিনা এই প্রশ্ন! তবে যেমন প্রশ্ন, তেমনই উত্তর। দারুন সুরেলা কন্ঠের মৌরী আপু বলল, সে গায়িকা হতে চায়। হতে চাওয়ার আবার কি আছে আমরা ঠিক বুঝলাম না। কারন, এত চমৎকার নজরুলগীতি গাইতে পারা লোক তো ইতোমধ্যেই গায়িকা হয়ে বসে আছেন। ওনার বলা উচিত,’নায়িকা হতে চাই। বাংলা সিনেমার চাকভুম চাকভুম নায়িকা।‘ আর এদিকে আমি উদাস ভঙ্গিতে বললাম, ‘তিন বাচ্চার মা হতে চাই’। একটা তো আছেই। আরো গোটা দুই থাকলে জমতো বেশ। মায়ের আরেক কাঠি সরেস দুই ফুটি ছেলে পাশ থেকে যোগ করে বসল, সে ভাইয়া হতে চায়। তার মুখে দুষ্টু হাসি। আমাদের এহেন বে-আক্কেল চাওয়া-পাওয়ার বহর দেখে ছেলের বাপের আক্কেলগুড়ুম। আরো কতগুলি নতুন লোকের স্থান সংকুলানের জন্যে উচ্চ ভাড়ার একটা ভাল বাসার দুশ্চিন্তায় স্ত্রী-পুত্রের প্রতি ভালবাসা উবে গিয়ে শরৎচন্দ্রের স্কেপিস্ট নায়কদের মত ‘তাহার মুখ দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়াই যেন নিমেষে ছাই হইয়া নিভিয়া গেল।‘ রুমির আমচু চেহারা দেখে আমরা হেসে লুটিয়ে পড়লাম।

সান্তা বারবারা চ্যাপেল থেকে রিভা শহর

বাস আসছে না। চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু তার থেকেও চিন্তার বিষয়, খিদে পাওয়া শুরু হয়েছে। তার প্রমান-বড় হয়ে কি হতে চাই থেকে প্রসঙ্গ পাল্টে আলোচনাটা খাদ্য বিষয়ক হয়ে গেছে এক ফাঁকে। খাদ্যের নাম ডিমের বিরিয়ানি। এক ডজন সেদ্ধ ডিম, এক কেজি চাল, গোটা দুই নধর আলু, গরম মশলা আর আধা লিটার দুধ হলেই হবে। সাথে প্রচুর বেরেশতা করা পেয়াজ। হাত নেড়ে, মাথা দুলিয়ে এমনভাবে রেসিপি বলছি যেন এখনই জলপাই গাছের পাতা কুড়িয়ে পথের ধারে লাকড়ির চুলা পেতে ডিমের বিরিয়ানি রাঁধতে বসে যাব। সবাই যখন কাল্পনিক ডিমের বিরিয়ানির অস্তিত্ব মেনে নিয়ে তার মৌ মৌ ঘ্রানের হ্যালুসিনেশনে ভাসছি, ঠিক তখনই আমাদের ভেতর বাস্তববাদী একজনের মাথায় দারুন বুদ্ধি খেলে গেল। বাসের অপেক্ষায় আর হাঁ করে না থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেই না কেন। ঘুরতে এসে এত হ্যাঁপা সয় না। কল্পনার বুদবুদ সূঁচের খোঁচায় নাই করে দিয়ে সবাই তাতে সায় দিলাম।

ট্যাক্সি মিলল। পাহাড়ি উঁচু নিচু ঢালু পথে দুর্ধর্ষ ইটালিয়ান চালক তার পংক্ষীরাজটা ফর্মূলা ওয়ানের মাইকেল শ্যুমাখারের মত উড়িয়ে দশ মিনিটের মাথায় আমাদের মন্টে বাল্ডোতে নিয়ে এল। মাথার ওপর মাঝ দুপুরের অবারিত আকাশ। তাতে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ নিরুদ্দেশের ভেলা ভাসিয়েছে। নীল আকাশের নিচে আমরাও বেরিয়েছি আজকে নিরুদ্দেশ হব বলে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে অনেকখানি উঠলে পরে পাহাড় চূড়ায় দেখা মিলবে স্কালিজার দূর্গের। ইটালিয়ান উচ্চারনে কাস্তেলো স্কালিজিরো (Castello Scaligero)। দূর্গের ভেতরে আছে গার্দা লেকের ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরটা। দেখার খুব শখ। অনেক পুরানো জিনিসের বিশাল সংগ্রহ। এক ঢিলে দুই পাখি হয়ে যাবে।

সিড়ি কাটা পাথুরে পথ। বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে ডিঙ্গোচ্ছে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি কাশি বিরতি নিয়ে খাবি খেতে খেতে আধ মাতালের মত টালমাটাল গতিতে দলটার পিছু পিছু চলছি। দুই পাশে নাম না জানা বুনো ফল থোক বেঁধে ঝুলছে। রঙ্গীন ফলের হাতছানিতে নিষিদ্ধ মাদকতা।

অবশেষে পায়ে হাঁটার ক্লান্তি ভুলিয়ে পাহাড় চূড়ায় শ্বেত পাথরে গড়া মধ্যযুগীয় স্কালিজার দূর্গ উঁকি দিল। তেরশ শতকের গড়িমা তার ম্লান তো হয়ই নি, বরং প্রাচীন আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে সূর্যের প্রখর আলোয়। তের আর চৌদ্দ শতকে ডেল্লা স্কালা পরিবার শাসন করেছে ভারোনে অঞ্চলটা। তাদেরই নামে নাম এই স্কালিজার দূর্গ প্রাসাদের। আস্তে আস্তে এগোলাম প্রবেশদ্বার বরাবর। টিকেট কাটতে হবে। দূর্গের একটা একত্রিশ মিটার উঁচু মিনার আছে। সেখান থেকে নিচে তাকালে কি যে অসাধারন লাগবে, ভাবতেই শিহরন জাগছে।

কিন্তু কপালের নাম গোপাল প্রমান করে দিয়ে টিকেট বাক্সের লোক জানালো আজকে  চব্বিশে ডিসেম্বর বেলা দুইটার পর থেকে দূর্গের ঝাঁপি বন্ধ দর্শনার্থীদের জন্যে। হাতঘড়িতে বাজে এখন দুপুর দেড়টা। ভেতরে আর ঢোকা যাবে না এত দেরিতে। কিন্তু যদি চাই, এই আধা ঘন্টায় দূর্গের সামনের উঠোনে ঘুরে আসতে পারি। কি আর করা! অগত্যা নাই মামার বদলে কানা মামাকেই মামা ডাকলাম। উঠানের মাঠে গিয়ে দেখি, এই বা কম কোথায়। এই চূড়া থেকে পুরো মালচাসিনে দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট বাড়িঘর পাহাড়ের পায়ের কাছে মাদুর বিছিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠিক যেন ছিড়ে যাওয়া পুঁতির মালার মতন। স্কালিজারের ভেতরটা ঘুরে দেখতে না পাবার আফসোস কমে এল। প্রকৃতির অপরূপ দম্ভের কাছে মানুষের জোড়া দেয়া পাথুরে স্তম্ভের আস্ফালন চিরকালই তুচ্ছ ঠেকে।

ফিরতি পথে টিকেটের লোকটা জানতে চাইল, আমরা একা একা অচেনা পথে নামতে পারবো তো? আগের পথে গেলে গাড়ি মিলবে না, তাই। চাইলে সে আমাদের সাথে যেতে পারে। তারও গন্তব্য একই দিকে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ছানাপোনা হাতে ঝুলিয়ে চললাম জাতে আলজেরিয়ান লোকটার দেখানো পথ ধরে। কত সহজেই না অন্ধ বিশ্বাসে ভিনদেশের অচেনা লোকের পিছু নিলাম। পৃথিবীর পথে একবার বেরিয়ে পড়লে বোধহয় মানুষের ওপর বিশ্বাস জন্মানোটা খুব সহজাত একটা ব্যাপারে দাঁড়ায়। ফুলেল বুনো পথ মাড়িয়ে নিরুদ্দেশ থেকে উদ্দেশের হদিসে চলতে লাগলাম নিশ্চিন্তে।

পাঁচ.

স্কালিজার প্রাসাদ যেমন দেখা হল না, তেমনি অদেখা রয়ে গেল ডি আনুজ্জিও’র জাদুঘর ভিত্তোরিয়ালে। ইটালির ইতিহাসের বিচিত্র চরিত্র গ্যাব্রিয়েল ডি আনুজ্জিও। বিখ্যাত এই কবি একসময়ে ঋনের ভারে ফ্রান্সে পাড়ি দেয়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে বটে। কিন্তু এসেই কবিতার খাতা হেলায় ফেলে বিমান উড়িয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে। মাত্র তিনশ যোদ্ধা নিয়ে ফিউমে অঞ্চল (বর্তমানের ক্রোয়েশিয়ায় পড়েছে) এক বছর অবরোধ করে রীতিমত স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে বসে আনুজ্জিও। সেখানেও ক্ষ্যাপামির পরিচয় মেলে। সৈনিক কবির একনায়ক রাষ্ট্রে সংবিধানের মূল নীতি ছিল সংগীত! কিন্তু দখল নেয়ার এই মানসিকতা দেখে ফ্যাসিজমের বীজ ঢুকে যায় মুসোলিনি আর হিটলারের মাথায়। তারপর দুনিয়াজুড়ে শুরু হয় ফ্যাসিবাদের ফ্যাসাদ। যাহোক, যুদ্ধে এক চোখ খুইয়ে ফিরে এসে জীবনের শেষ সতেরো বছর গার্দা লেকের পাড়েই কেটেছে আনুজ্জিওর। আলোয়-কালোয় মেশানো খামখেয়ালী লোকটার বিচিত্র সংগ্রহে ঠাসা বাড়িটাই এখন জাদুঘর। আবার সুযোগ হলে যাওয়াটা অবশ্যকর্তব্যের ভেতর পড়ে।

সোনালি সকালে গার্দা হ্রদ

সব শুরুরই শেষ থাকে। সেই নিয়ম মেনে আজকে বাড়ি ফিরে যাব। দুপুরের ট্রেনে চেপে। কিন্তু সকালটাকেই বা বিকিয়ে দেই কি বলে? তাই গুটি গুটি পায়ে সবাই এসে দাঁড়িয়েছি গার্দার তীরে। সোনারঙ্গা রোদের ঝিলিকে খোলামকুচির মত পড়ে থাকা নুড়িপাথরগুলো মনি মুক্তা বলে বিভ্রম হয়। আর কূল ভাসানো গহীন নীল জল দেখে মন ভাবতে চায় এ যেন সাগর পাড়। কিন্তু ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ার তাড়া নেই। অলস রাজহাঁস জলকেলির খুনসুটিতে ব্যস্ত। দূরে পটে আঁকা ছবির মত একটা দুটো নৌকার আনাগোনা। জলে ভাসা এক নন্দনকানন। কে বলবে আমরা সমুদ্রের পিঠ থেকে পঁয়ষট্টি মিটার উঁচুতে বসে আছি?

বড় বড় পাথুরে চাঁইয়ে বসে ভাবছি, আরে আমরা নিজেরাই তো একেকজন হ্রদের মতন। কোথাকার বঙ্গোপসাগরের জল গড়িয়ে গড়িয়ে ভাগ্যের খুঁড়ে দেয়া পথ বেয়ে ভিনদেশের বদ্ধ জলাশয়ে আটকে গেছি। সাগরের মত মহাসাগরের সাথে আর যোগ নেই। তাই জোয়ার ভাটায় বয়ে চলার স্বাধীনতাও নেই।

গাঢ় ভাবনাটাকে জোর করে সরিয়ে দিলাম। তিন দিকে পাহাড়ের প্রহরী সবুজের হাতছানিতে ডাকছে। পাহাড়ের গায়ে সান্তা বারবারা নামের ছোট একটা চ্যাপেল আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে গড়া। জলবিদ্যুতের স্থাপনা বানাতে গিয়ে ধর্ম ভীরু খনি শ্রমিকরা নিজেরাই হাত লাগিয়ে চ্যাপেলটা বানিয়েছিল। সেটা দেখার আর সময় হল না এবার। তাকে এমনি এমনি দেখা যায় না। জয় করে দেখতে হয়। হেঁটে কি দৌড়ে পেশীতে টান ধরিয়ে তবেই তাকে জয় করা যায়। অসাধারন হাইকিং ট্রেইল আছে ওপরে ওঠার। হাদী ভাই এক দৌড়ে দেখে এসেছিল। আমি সে চেষ্টা করতে গেলে দেখা যেত ফুসফুসটা পাজর ফুঁড়ে বেরিয়ে চার হাতে পায়ে দুড়দাড় করে পালাচ্ছে। অগত্যা নিচ থেকে সান্তা বারবারাকে শ্বেতপায়রার মত চুপ করে আল্পসের কোলে আদুরে ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে দুধের সাধ ঘোলে মিটাতে হল।

মোটের ওপর এই ভ্রমনে আমরা ছেলে বুড়ো বারো আনার ওপরে ষোল আনা খুশি। আনা-আধুলির কথা বলতে গিয়ে আরেক আনার কথা মনে পড়ছে। জার্মান বান্ধবী আনা। সে প্রায়ই খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করে, ‘শনি-রবি কি করলে?’ কি করে বলি যে চাক্ চাক্ করে আলু কেটে চাইনিজ দোকানের কই মাছ ঝোল করে রেঁধেছি কিংবা তুর্কি দোকানের হালাল মুরগি টমেটো দিয়ে ভুনা করেছি? যেখানে আনার সপ্তাহান্ত কাটে অস্ট্রিয়ার বরফে স্কি করে কিংবা আল্পসের কোথাও হাইকিংয়ে, সেখানে ছুটির দিনগুলোতে আমি মাছ-মুরগির সাথে ধস্তাধস্তি করে কাটিয়ে দেই। দুর্দশা দেখে ছুরির নিচে আলু-টমেটোরাও মুখ টিপে হাসে। কি বিচিত্র জটিল বাঙালি জীবন! তবে এই ক’টা দিনের ঘুরে বেড়ানো সেই দুঃখ খানিকটা ভুলিয়ে দিয়েছে। যাক, এবার ফিরে গিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন গপ্পো করবো যে জার্মান বান্ধবীর চোখ ট্যাঁ হয়ে যাবে।

ঘড়ির কাটা বেরসিকের মত সময়ের চাবুক মারলো পিঠে। ফিরে যেতে হবে ফেলে আসা কুয়াশায় ঢাকা শীতের শহরে। আমাদের ইবনে বতুতাগিরির এখানেই সমাপ্তি। তবে আনন্দের রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন। দিন শেষে স্মৃতিটুকুই অমূল্য। আর বাকি সব জাগতিক বস্তুর মামুলি হিসেব কষা দর আছে। তাই শেষবারের মত শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহরের স্মৃতি যতটুকু পারি হাতের আজলায় তুলে নিলাম। যাযাবর মনের মুকুরে যোগ হল আরেকটা পোস্টকার্ড।

 

আলোকচিত্র: হাদী।

রিম সাবরিনা জাহান সরকার, পি,এইচডি। জীববিজ্ঞানী ও রম্যলেখক। বর্তমানে জার্মানির মিউনিখে বায়োটেক কোম্পানিতে মানোন্নয়ন ও ডাটা ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..