শামুকের পাঠ, লেখা দানবের

সমীরণ ঘোষ
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
শামুকের পাঠ, লেখা দানবের

গণগনে আঁচের ভেতর দুটো হাত চেপে ধরে যদি স্বীকারোক্তি চান উত্তর একই কবিতা কী, আমি জানি না। মা-কসম। জানি না। শুধু অপসৃয়মান গোধুলিপ্রাচীন এক দ্যুতি, পাঁশুটে বর্ণালী জ্বেলে ফুরোতে চাইছে। আর অনুসরণরত এক অবোধ অদৃষ্টপূর্ব অতলে হাজির। যেখানে প্রহরে প্রহরে দিনরাতের আঁখমিচৌলি। স্থানকাল পরম্পরা পিরহান বদলে বদলে ঢুকে পড়ছে একে অন্যের সুড়ঙ্গে। ফলশ্রুতি মহাসময়। যার অন্তরিক্ষে লাট খাচ্ছে এই অধমের চারহাজার বছরের বেঁচে থাকার পাপ। এই সমাপ্তিশূন্য আবর্তনই কী কবিতা! জানি না। সংজ্ঞার ডোরাকাটা সম্মোহনের বাইরে ধুলোর পোশাকে ছিলাম বলেই না কুহকিনী তার কাঁটাঝোপের নিচে জোনাকিজ্বলা রান্নাঘরে ডেকে নিল। খেলার কপাট খুলে দেখাল গুহ্য কোটর। স্তন্যে আদরে শুন্যে লুফে আচমকাই চূড়ান্ত আছাড়। এবং পুনরায় বনের আয়ুর্বেদে ধুইয়ে মুছিয়ে হাড়ের পালঙ্কে। নিশ্চেষ্ট পড়ে থাকলাম কালের চাদরে। ব্যোমে। উড়ানখাটোলায়। মা- কসম কবিতা জানি না।

তাহলে লিখি কেন? সেটাও সর্বৈব এক মিথ্যের ঘানি। ভুরভুরে তরলে রটানো এক পরিণাম। লিখব না বলেই তো কলমভাঙাপণে সপাট তক্তপোষে। বালিশের পাশে ইতস্তত শলাকাবেঁধা বই। কাঁটা তুলে পড়ি। আবার বিঁধিয়ে। নয়তো দেয়াল ছাদ নিমেষে গায়েব করে আকাশপাতাল কোঁদা। তুলতুলে জেলিমাছ। ভবসমুদ্র থেকে শুন্যের সাঁতারে। নিথর ভূমণ্ডলে কণার আবেগে জুড়ে যাওয়ার নির্লিপ্তি। এমন নির্ভার জাদুকল্প ছেড়ে কে চাই কোনও কেজোকঠিন কলমকালির জীবনে হত্যে দিতে। আমার লেখা বলে যা কিছু পরিচিত, লিপিপদবাচ্য, তা আমারই অভ্যন্তররূপী দানবের অসমীচীন কারবার। আমারই অস্তিত্বের ছদ্মমুকুটে বসে মূলত আমার বিরুদ্ধেই চরম অন্তর্ঘাত। তার কামক্রোধ রক্ত হাড় প্রেম বাহ্যি নখ ও নিশ্চেতনা একান্তই তার। যা কিছু প্রাপ্তি সম্মান অবজ্ঞা অনাদর শাস্তি একান্তই সেই অন্তরালবাসী ষড়যন্ত্রীর। তাকেও প্ররোচিত করেছি, কেন লিখবে? কাটাপাঞ্জা টেবিলে রেখে বেরিয়ে পড়। স্বপ্নে জুড়ে নাও তোমার বাহন। রিলের পর রিল জটে ভরে যাক ভাবনাতরঙ্গ। যার সম্পাদনাও হয়ে উঠুক অসম্ভব। আমি ব্যর্থ। শুধু তার অন্তর্বর্তী ক্রিয়ার সাথে আমার নামটা বিশ্রিরকম জুড়ে গেল।

তো প্রশ্ন হল পড়ি কেন? স্বাভাবিক। কেতাবের কথা যখন আগেই এসে গেল। সেই মাথার পাশে। কাঁটা পোঁতা। কিন্তু রগড় হচ্ছে, না পড়েও তো বেশ যেত দিব্য মাছ ধরে। জঙ্গলের শিকার। হোগলবাড়ি। নীল টোকা মাথার কৃষি। দুলে দুলে বিড়ি বাঁধা। লোহা পেটানো। গুহার তপস্বীপনা। তুরপুন চালিয়ে তুলে আনা কাঠের সরগম। নতুবা অনর্গল পরিব্রাজকতায় দেশদুনিয়া এক লাটাই এ গুটিয়ে ভ্রামণিকের গুজরান। তো এই অর্জনের কোনও একটিও আমার সাধ্যের বহুযোজন দূরের বসত। আমার নেতানো মণ্ডপ্রায় শামুকবৃত্তীয় লালাপথে তাদের কোনও কুটো অব্দি জলচলহীন প্রবাস। অচিন পৃথিবী অচিন ভৌগলিকতা বলতে যৎসামান্য পারানির কড়ি আমার নিজস্ব জনপদের বাইরে কিছু গ্রাম। তারই চলমানতার ছড়ানো আয়নায় আমার যেটুকু প্রক্ষালন। তো, এত সামান্য পুঁজিতে কী একজন স্বপ্নাবিষ্টের চলে! আমাদের আত্মকূপে অভিশাপের আদলে ভেসে পুরু পিপাসা-সর। যে হাঁ করে ভুবন দেখার আকুতিতে ফেটে পড়েছে। সেই মত্ত তৃষ্ণাই আমাকে পালঙ্গে শুইয়ে ক্যালাইডোস্কোপে দেখাতে থাকে বিরামহীন জগৎ। বাকিটুকু এ গ্রন্থ থেকে সে-গ্রন্থে ডুবে ভেসে পিছলে এবং নাকানিচোবানিসহ ঢুঁ। স্প্রিঙের জিভে ভোজ্যের গলধঃকরণ। আসলে বইগুলোই এক একেকটা উপকূল। অববাহিকার হাওয়া। রূঢ় শুষ্ক নিঃসীম মরুতা আমাকে লেজে বেঁধে ঘষটে নিয়ে যায় ততদূর, যতক্ষণ না মাংস সরে হাড়ের দেয়াল দেখা যায়। তাছাড়াও আমার ল্যাজেগোবরে স্বেচ্ছাপঙ্গুত্ব আমাকে শুনিয়ে গেছে এই মফস্বলের দুপুরজোড়া কাঠ কাটার ধ্বনি। তার বিষণ্ণতা। তার নিভৃতি। তার আরাম। তার আড়ালউজাড় মগ্ন সুদূর। সেই ধ্বনির ক্রমমন্থর অনুষঙ্গে আমার জগৎভ্রমণ। কোন টিকিট নেই। রেলবিমান নেই। মাঝিমাল্লা নেই। আর এক বিশালবিপুল করোগেট টিনের ফোঁকরে চোখ রেখে বসে থাকা। তাঁবুর দেশ। এক বয়স্ক জোকার এক তরুণীর চুলে শতাব্দীর পর শতাব্দী চিরুনি চালাচ্ছে। সেই চুলের প্রাচীন থেকে উঠে আসা যুদ্ধ রক্ত প্রেম সোহাগ ধ্বংসের কণার আকাশ। নীচে মুর্শিদ আর তার একতারা- প্রসূত সুদূর আলপথ। সুভানআল্লা!

সমীরণ ঘোষ। লেখক, কবি ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৫৫, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করেছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। প্রকাশিত বই: 'কবিতাসংগ্রহ' (কবিতাগ্রন্থ), 'চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান' (কবিতাগ্রন্থ), 'অন্তর্বর্তীরেখা' (কবিতাগ্রন্থ), 'কালো পাথরের হারমোনিয়াম' (কবিতাগ্রন্থ), 'মরচে গোধূলির পাঠ' (কবিতাগ্রন্থ), 'প্রিয় পঞ্চবিংশতি' (কবিতাগ্রন্থ), 'সান্ধ্য...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..