প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
শ্বশুরের মূল বাড়িটিতে উঠোন বলতে এখন আর কিচ্ছু নেই। অথচ আমার শ্বশুরের বাবার বাবা এই বাড়ি করার আগে আগুন দিয়ে জঙ্গল সাফ করেছিলেন, বাঘ তাড়াতে। এখন এখানে জমি মাপামাপির ধার না ধেরে শরিকেরা পরিকল্পনাহীন ঘেঁষাঘেষি পাকা পাকা সব ভবন করে বাড়িটিতে আভিজাত্যের কোনো লক্ষণ রাখেনি। তার ওপর আবার পরস্পর একটুতেই গ্রাম্য খেয়োখেয়ি বাঁধিয়ে নেয়। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার চেয়ে যার যার ঘরখানাকে একেকখানা দালান করে জাতের পুরনো গৌরব আরো বাড়িয়ে নিতে তারা সব মারমুখী। আর সেই ধাঁধায় ধারে-কাছে একটু স্বচ্ছ বুদ্ধির যারা আছেন, তাদেরও সবাইকে নাকাল হতে হয়। তাই তাদের অর্থহীন কূটচাল থেকে রেহাই পেতে আমার মাথার ভেতর অন্য বুদ্ধি ঝিলিক খেলে।
গ্রাম আমাকে প্রচ- টানে। আমার স্বপ্নের বাড়িটি তা যে কোনো সবুজ গ্রামেই হতে পারে। তাতে দুইপাশে বারান্দার মাঝারি একখানা চৌচালা টিনের ঘরমাত্র। মাঝে মাঝে যার চালে বৃষ্টি পড়ে বুঁদ করে আনবে যত চৌকস মনুষ্যচেতনা।
সে ঘরের উঁচু বারান্দা ছুঁয়ে থাকবে কিছু মৃদুু ফোটা হরেকরকম ফুলের ঝাড়। আঙিনায় কিছু হাঁস-মুরগির বিচরণ, কার্নিসে কবুতরের বকমবকম বসবাস আর চারপাশের সীমানাজুড়ে মাথা তুলে থাকবে ছায়াদায়ী যত ফলদ গাছ-গাছালি। ঘর থেকে সীমানার মাঝামাঝি থাকবে সবজির তেজি ক্ষেত ও মজবুত মাচা। সামনেই থাকবে জলেভরা পুকুরে ভাসমান কচুরির শুভ্র পাপড়িতে নীল নীল ছোপের রাশি রাশি ফুল। আবার সে পুকুর থেকে মিটতে হবে পরিবারের মাছের প্রয়োজনও। পারাপারের জন্য নয়, শহর থেকে আসা ছেলেমেয়েদের শুধু হইচই করে জলে ভাসতে ঘাটে বাঁধা থাকবে একখানা মাঝারি নৌকা।
নতুন করে কাঠের ডুপ্লেক্স করে, বাড়ির মানুষগুলোর সাথে মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলাম। না পেরে, রেহাই পেতে, ভালো করে না বুঝে-শুনে, ছেলেমেয়ে কারো সাথে কোনো পরামর্শও না করে আবার দেড় কিলোমিটার দূরে শ^শুরের আরেকটি জায়গায় আরেকটি বাড়ির আয়োজন করে ফেলি। যদিও গ্রামে থাকার কোনো অবসর বা প্রয়োজন কোনোটাই আমার নেই। সংসারের প্রতিটি কাজে ছেলেমেয়েরা তখনো আমার ওপর নির্ভরশীল। এমনকি বাজার করা থেকে এককাপ চা বানাতেও তারা অপটু। তবু এই বাড়ি পেরিয়ে মসজিদের সামনে, বড় রাস্তার পাশে সেই মানুষটি সমাধিস্থ বলে মনে হয়, এ জায়গাটাই যেন শুধু আমার নয়, আমার ছেলেমেয়েরও জিরো পয়েন্ট।
বিয়ের পর আমার উদ্দেশ্যে বলা যার প্রথম কথা ছিলো, ‘আমার গায়ে একবিন্দু রক্ত থাকতে তোমার কোনো দাবিই অপূর্ণ থাকবে না।’ এই মানুষটিই আমার লেখকসত্তাকে আবিষ্কার করে তার মুখোমুখি পরিচয় করিয়ে দিয়েছে! ঢাকা শহরে আমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, তাকে যা করতে হয়েছে, মনে হলে আমি আজও ছটফট করি। দেরিতে বিয়ে করেছিলেন বলে, তার অবর্তমানে তার ছেলেমেয়েকে যেন কারো কাছে কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা না চাইতে হয়; সেজন্য তিনি জীবদ্দশায় সবসময় তৎপর থেকেছেন! আর সেই মানুষটিকে গ্রামের কোথাও মাটির নিচে পুঁতে রেখে আমি শহরে নির্ঝঞ্ঝাট ঘুরে বেড়াবো? আমি তা পারিনি। তাই যেন ওখানে গিয়ে কিছু সময় কাটানোর জন্য, যা অন্যদের দৃষ্টিতে অযথা কিছু টাকা খরচ করার নিমিত্ত ঠেকেছে! এমনকি তা আমার ছেলেমেয়ের কাছেও। কিন্তু কী এক অদৃশ্য সুতোর টান আমাকে ওখানে, ওই বাড়ি-ঘর ছুঁইয়ে জড়িয়ে রাখে!
সমাধির মানুষটি আমার বাবার সবচেয়ে ধীমান শিষ্য, যাকে বাবা শুধু ভালোবাসার টানে নয়, নিজের অবর্তমানে পরিবারের অনিশ্চয়তা ঠেকাতে বলেছিলেন, ‘আমার বড় মেয়েটিকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই!’ এককথায় এই শিষ্য, এ. কে. ফজলুর রহমান যার নাম- বাড়ির মানুষ অবশ্য তাকে বাচ্চু মিয়া বলে ডাকেন, তো সেই তিনি তার আধ্যাত্মিক পিতা, মানে আমার বাবার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু বাবার সে শিষ্য গত হয়েছেন আমার বাবারও বছর চারেক আগে।
পিতার এই শিষ্য ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্সসহ ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করেছিলেন। মাত্র ছয়মাস বয়সে মা’কে হারানো বাবার এই শিষ্য-মানুষটির মাতামহ মৌলবি আবুল বাসার ওসমান গণি ছিলেন, তার পিতামহ খোদাবক্সের আপন ভাই। মানে আমার শ্বশুর আর শাশুড়ি ছিলেন আপন চাচাতো ভাইবোন। তাই একবাড়ির ভেতরই আমি অনুভব করতে থাকি দুইরকম আত্মীয়তার রেশ। তারপর বাচ্চু মিয়ার মৃত্যুর পর দিনে দিনে বাড়িতে আমার যাতায়াত বেড়ে গেলে, আমি মানুষগুলোর কাছে হয়ে উঠি কাঁটাশাল। যার জের টানতে আমার নাভিশ্বাস ওঠে।
মৌলবি ওসমান গণির এই মাতৃহীন দৌহিত্রকে, একবাক্যে সবাই এইবাড়ির সেরা সন্তান হিসেবে গণ্য করেন, কিন্তু লাফাঙ্গা শব্দ থেকে কিছুটা মাত্রাও না কমিয়ে বউটিকে মনে করা হয় সেরা লাফানি। কারণ বউ ধীরে ধীরে ও-বাড়ির সবার ফস্কা গেরো খুলে আসল মূর্তির উন্মোচন ঘটিয়েছেন। অসার মানুষগুলোকে অযথা আর শ্রদ্ধা প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছেন।
পুরনো বাড়ির ভিটার ওপর বিশাল একখ- জমি পড়োজমি হিসেবে পড়ে আছে। যার মালিক আমার শাশুড়ির বাবা। আমার নানাশ্বশুরের মূল কোনো শাখা-প্রশাখার কেউ এ বাড়িতে কোনোদিন পা রাখেননি। সেই কবে আকালের সময় নানা শ্বশুর মাওলানা আবুল বাসার মোহাম্মদ ওসমান গণি নাকি কিছুদিনের জন্য তাঁর এই পিতৃপুরুষের বাড়িতে এসেছিলেন টানাপোড়েনের বেসামাল অবস্থা সামলে নিতে। কিন্তু বাড়ির মানুষেরা নাকি তাঁদের রান্নার সময় লাকড়ি লুকিয়ে রাখতেন। যাতে তারা দিশা হারিয়ে শহরেই ফিরে যায়। আর সত্যিই তাতে ওসমান গণি সাহেব অত্যন্ত মনোক্ষুণœ হলেন। কারণ, তিনি তার নিজের ভাই ও চাচাতো ভাইদের সব উঠতি বয়সী ছেলেগুলোকে ঢাকার বংশালে নিজের কাছে নিয়ে তুলেছিলেন, লেখাপড়া শিখিয়ে সবগুলোকে বিদ্বান বানাবেন বলে। যাদেরকে তুলে নিয়েছিলেন, তাদের সবাই প্রায় ফিরে এসেছিলেন অনেক মানুষের জন্য একত্রে রান্না করা পাতলা ডাল, আর মোটাচালের ভাত খেতে না পেরে! দু’একজন যারা টিকে ছিলেন, সেই দু’একজনের একজন আমার শ্বশুর। যিনি চাচার আশ্রয়ে থেকে এলএমএফ ডাক্তার হয়েছিলেন এবং পরে হয়েছিলেন চাচার জামাতাও।
১৯৪৩-৪৪-এর সেই আকালে ওসমান গণি বাড়িতে টিকতে না পেরে সেই যে ফিরে গেলেন, এরপর আর তিনি কেন, মাঝখানের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তাঁর জীবিত চার সন্তানের কেউ-ই আর এ বাড়িমুখো হননি। ধীরে ধীরে মৌলবিবাড়িটি, ডাক্তারবাড়ি নামেও পরিচিত হতে থাকে। অবশ্য এ ডাক্তার আমার শ্বশুর নন। আমার শ্বশুর ডাক্তার তফাজ্জল আহম্মদ বিভিন্ন শহরে চাকরি করেছেন। রিটায়ার করে বাড়িতে ফিরলে তিনিও ভাইদের রোষানলে পড়ে মুহ্যমান হয়েছেন। শহরে বাড়ি-গাড়ি করে থেকে না গিয়ে বাড়িতে ফিরে পৈত্রিক জায়গাজমিতে ভাগ বসানোটা তাঁর ভাইদের কাছে ক্ষমাহীন দোষের ছিলো।
ডাক্তারবাড়িতে আমার পদচারণা ঘন হতে থাকে এ বাড়ির সেই সেরা ছেলেটির মৃত্যুর পর। আগে তো কখনোসখনো এমনিই যেতাম, শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখতে। তাও মাঝে মাঝে। তবে বাচ্চু মিয়ার কোনো টান ওই বাড়ির প্রতি ছিলো বলে আমার মনে হয় না। টানটি তিনি ছিঁড়েই পিছুটানহীন হয়েছিলেন। আচমকা বাচ্চু মিয়া বিনা নোটিশে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেও, আমার পরিবারের তখন অর্থনৈতিক দিক থেকে দিশা হারানোর দশা নয়। চার ছেলেমেয়ে ফারহানা, ফারজানা, আরিফ তিনজনই কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত থাকলেও বড় ছেলে আশিক আমেরিকা থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে একটি নামকরা সফটওয়্যার ফার্মে জয়েন করেছে। অস্ট্রেলিয়ার একটি নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করা ইফা তার স্ত্রী। সেও আশিকের সাথে দেশে এসে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে টিচার হিসেবে ঢুকেছে। ও-বাড়ির মানুষ আমার কোনো বিত্ত-বৈভব, স্ট্যাটাস জানার ধার ধারে না। ওরা মনে করে ওদের গায়ে ও বুদ্ধিতে যে জোর আছে, ভুবনে ওটাই শেষকথা! তাই দিয়ে সবার সবকিছু অর্থহীন করে দেওয়া যায়। তার ওপর আমি অন্য জেলার মানুষ। তাও আবার গোপালগঞ্জের। এইসব বাজে খেয়োখেয়ির সুরাহা করতে বাচ্চু মিয়ার বৈমাত্রেয় ভাই দুটিও কখনো আমার পাশে গিয়ে দাঁড়াননি।
বড়ছেলে সামনে জায়গা পায়, সেটাও তাঁর হয়ে আমাকে দেওয়া হয়নি। অথচ তারা জানে না, যে আমি জানি, বাড়ির ওই জমিটুকু বাচ্চু মিয়ার নিজ মায়ের নামে। সে হিসেবে প্রায় সবটুকুই আমি পাই। তারা পায়, আমার শাশুড়ি মারা গেলে শ্বশুর মৃত স্ত্রীর যে চারআনা পান, বাচ্চু মিয়া সেখানেও একাংশ পান পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে।
বাচ্চু মিয়া মারা যাওয়ার পর যে কাঁচা আবেগ নিয়ে সবার বসবাসের জন্য ঢালাওভাবে কাজ শুরু করেছিলাম, বাড়িতে সবার মাথা গোঁজার মতো করে করতে, পরে তার থেকেও রহিত হয়ে শুধু নিজের জন্য একটুখানি ঘরের আয়োজন করতে হয়। মাঝে মাঝে গেলে যেন নিজের মতো থাকতে পারি, এই আশায়।
যে জমির প্রায় পুরোটাতে আমারই হক, তার শেষ কোনায় আমাকে ঘর করতে হলো। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া মিস্ত্রি নিয়ে কাজ করতাম। একটানা সে কাজের সময় সারাদিন ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘুরতে হতো আমাকে। শ্বশুরের আমলের পুরনো, বেড়া-চাল খসেপড়া, জীর্ণ ঘরে কোথাও টাকাসহ ব্যাগ রাখার জায়গা ছিলো না। কিন্তু সে ঘরে শ্বশুরের আমলের কাঠের একটি আলমারি ছিলো। বাচ্চু মিয়া তার মায়ের একটিই সন্তান। তার বৈমাত্রেয় ছোটভাইকে খবর পাঠিয়েছিলাম, কাছে একবাড়িতে রাখা চাবিটা নেবো বলে। কিন্তু বিকেল বেলায় আমার ছোট চাচাশ্বশুরের ছেলে ডাক্তার ইকরামুল হক আমাকে ডেকে বললো, ‘ভাবি, ওই আলমারিতে নাকি তাদের অনেক জরুরি জিনিসসহ জরুরি কাগজপত্র আছে, আপনাকে ওর চাবি দেওয়া যাবে না বলে ঢাকা থেকে বাচ্চু ভাইয়ের ছোটভাই জানিয়েছেন।’
বাচ্চু মিয়ার বউয়ের হাতে বাচ্চু মিয়ার বাবার আমলের ভাঙাঘরের আধখসা কাঠের আলমারির চাবি দেওয়া যাবে না, এই খবরটা চাউর হতেই আমার প্রতি ডাক্তারবাড়ির এতদিনের বিরোধী মানুষেরাও এবার বেশ থতমত খেলো। তারাই নিজেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, যে বাচ্চু মিয়া সময়মতো নিজে বিয়ে না করে তার পিতার দায়িত্ব পালন করেছে, তার সৎ ভাইদের মানুষ করার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে। বাচ্চু মিয়া চাকরিতে ঢোকার বারো বছর পর যদি এই বউয়ের বাপ সেধে তার এই মেয়েটিকে তার সাথে না বিয়ে দিতো, তাহলে তো তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হতো, সংসারী না হয়ে। তাই বাচ্চু মিয়ার সেই বউয়ের কাছে তালার চাবি দেওয়া যাবে না, না না, এইটা নিশ্চয় আল্লাহ সইবে না!
আমার মায়ের ছেলে ছিলো না বলে মাকে দেখেছি, তার শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ি এমনকি সমবয়সীদের মধ্যেও হীনম্মন্যতায় ভুগতে। সর্বগুণে গুণান্বিতা হয়েও আমার মা’র ভেতর একটি কাচুমাচু ভাব টের পেতাম। যা আমাকে অলঙ্ঘনীয় পীড়া দিতো। মায়ের সেই মনোপীড়াকে লাঘব করতেই আমাকে সবখানে জিতে আসতে হতো। এমনকি ছোটবেলায় অনেকের সাথে মাছ ধরতে গিয়ে, মাছ বেশি ধরতে না পারলে অন্যের পাতা চাঁই তুলে ঝেড়ে নিয়ে আসতাম।
দীর্ঘদিন ধরে আমার বিনয়টুকু যারা বুঝতে পারেনি, তাদের প্রতি আমার ভেতর তখন কী এক দম্ভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি দুইছেলের মা! আমার মেয়ে দুটিসহ তাদের চারজনের যোগ্যতাই এ বাড়ির সবাইকে ছাপিয়ে যায়! তাহলে? এই একই আলাপে সারাবাড়ি যখন সয়লাব, তখন আমি শাবল হাতে এগোতেই একজন কাঠমিস্ত্রি উদ্দেশ্য টের পেয়ে এগিয়ে এলো। শাবলের অরেক মাথা ধরে ফেলে বললো, ‘আন্নে হাইরতেন ন্য! আঁরে দ্যান…।’ শাবল থেকে মিস্ত্রির হাত টেনে খুলে, তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললাম, পারবো না মানে? তালা হলো ভদ্রতা রক্ষার একটি কবজমাত্র! তালা টাঙানো মানে, এখানে ঢোকা নিষেধ। এটা খোলা নিষেধ। কিন্তু তস্কর বা দুর্বিনীতের জন্য কোনো তালাই কোনো বড় বাধা নয়।
আমার এই বিদ্রোহকে আলমারির চাবি না দেওয়ার হোতাদের একেবারে মর্মমূলে পৌঁছে দিতে আমার ডুপ্লেক্স সে ঘরের কাজে লাগাতে কেটে ফেললাম, শ্বশুরের আমলের একটি গাছও। যা ঘরের সামনে ছিলো।
তারপর বাড়ির আধাখ্যাঁচড়া শরিকদের দমন করার উপায়টাও মাথায় উঁকি দিলো। নানাশ্বশুরের আমল থেকে তাঁর পড়ে থাকা জমিকে বলা হয়, ঢাকাইয়াগো সম্পত্তি। তাই বাড়ির মানুষ মনে করেছিলো, ওসমান গণির সম্পত্তির ওপর তো আমাদের থেকে বাচ্চু মিয়ারই বেশি অধিকার। তাই তার বংশধর এখানে এলে, ওই জমির প্রতি আমাদের অধিকার ক্ষুণœ হবে!
কিন্তু ওদের চোখ তো অতদূর দেখে না, যেখানে বাচ্চু মিয়া নিজেই ছিলেন, নির্লোভ পিছুটানহীন এক সন্ত-প্রকৃতির মানুষ। আর তার ছেলেমেয়ের দৃষ্টি যে আরো দূরে! অন্যের পড়ো সম্পত্তির দিকে ফিরে তাকাবার জাত তারা নয়!
তবু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, ফন্দিবাজরা লেগে থেকে কারো কারো ভিটেয় ঘুঘু চরায়। আমিও এইবাড়ির মানুষের কঠিন লোভের উপাত্ত, ওই ভিটেয় সেই ঢাকাইয়াদের এনে ওঠাবো। আমার ছোট মামিশাশুড়ি তার ভাগ্নে বাচ্চু মিয়ার আত্মীয়দের প্রতি টানা দূরত্ব ভেদ আমাকে যথেষ্ট ভালোই বাসতেন। আর তার কারণ ছিলো, আমার লেখালেখির অভ্যাসটুকু।
একদিন ছোট এই মামিকে গিয়ে বললাম, আপনার শ্বশুরবাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না?
কিছুদিন আগেমাত্র ছোট মামাশ্বশুর, আবু নসর হাবিবুর রহমান গত হয়েছেন। আমার কথা মামিশাশুড়ি, রওশন আরা বেগমের মনে ধরলো। তিনি বহু বিপত্তি ঠেলে একদিন নিজের বড়মেয়ে রুহী আর জামাই মন্টুকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
সারাবাড়ির মানুষ তাকে দেখে থতমত খেলো। তারা যে তাদের পাকা বাড়ির অনেকখানি করে ঢাকাইয়াদের পড়োজমিতে তুলে দিয়েছে, তাদের রাস্তাও আস্ত নেই। এখন ঢাকাইয়া কারো আগমন তাদের গলায় কৈ মাছের কাঁটার মতো ফুটছে! ওই গদগদ ভীড়ে তলিয়ে থেকে আমি শুধু দেখছি, এদের দশা কী হয়। আর ওরাও টের পেয়েছে, ভিটেয় এই ঘুঘু কে এনে তুলেছে!
এর ভেতর ছোটমামি আশ্চর্য চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘দীলতাজ, কী আশ্চর্য, একবারে গল্পের মতো ঘটনা। তুমি আমার ভাগ্নেবউ। অথচ তুমিই আমার বিয়ের বায়ান্ন বছর পর আমাকে আমার শ্বশুরবাড়ি দেখার সুযোগ করে দিলে। আমার কী যে ভালো লাগছে! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!’
বাড়ির নাম যখন আগের নামে পাকা পিলার তুলে পাকাপাকিভাবে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, তখন আমি মামির বড় সন্তান সাইফুর রহমান ওসমানী জিতুকে বললাম, মসজিদের পেছনের যে পাকা ঘাট, সেটা সংস্কার করে ঘাটটির নাম ‘রওশন আরা ঘাটলা’ রাখা হোক। জিতু আবেগতাড়িত হয়ে প্রস্তাবটি মাথায় রেখেছেন। গেট আর ঘাটলা দুটোই একসাথে করতে।
মামির প্রথম আসার সে যাত্রা তো আমি মামিদের সাথেই ঢাকায় ফিরে আসছিলাম। কিন্তু পরের যাত্রা থেকে টের পাই সেই আধখ্যাঁচড়া শরিকদের দৌরাত্ম্য। দৌরাত্ম্য বলতে তো শুধু ভাববাচ্যে বাজে ভাষায় বকাঝকা! আর তাদের আরেকজনের আফসোস, বাচ্চুর বউয়ের পলকা কাঠের দোতলা ঘরের জন্য রাস্তা থেকে এখন তার কার্নিশ দেখা যাবে না। যে জন্য দালানের চৌহদ্দি খালিবাড়ি পেয়ে অবৈধভাবে আমাদের জায়গায় ঠেলে তোলা। ভাসুরসম্পর্কীয় তিনি ভেবেছিলেন, কার্নিশে লাল রঙ টেনে পথচারীর সম্ভ্রমের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।
অদৃশ্য সুতোর টানে দুইতিন মাস পরপর পুরনো বাড়িতে যাই। কিন্তু মানুষগুলোর মুখ আর দেখতে না চেয়ে ধারে-কাছে সেই স্বপ্নের বাড়িটির জন্য আমার মনটা হা-পিত্যেস করতে থাকলো। তাতে কাছেই এক জায়গায় শ্বশুরের দেড় একর জমির দিকে নজর গেলো। তার প্রায় পুরোটাই সেধে উপকার করতে আসা কাছাকাছি বাড়ির একজনের দুরভিসন্ধির কবলে পড়ে, কেটে পুকুর নয়, যেন ব্রিটিশ আমলের খালে পরিণত করা হলো। কারণ মদদদাতাও মনে করেছিলো, এই মহিলা বাড়ি-গাড়ি আর রাজধানীর জৌলুস ফেলে কি আর গ্রামে থাকতে আসবেন! তারও ওপর ছেলেমেয়ে বড় দুটি থাকে বিদেশে। অতএব, অবশেষে এই পুকুরে আমিই মৎস্য চাষ করে সুখে খাবো!
তাই দপদপানো উৎসাহের সাথে ওরকম আরো দু’চারজনের আশকারা মেলানোর সেই খাল সাদৃশ্য পুকুরের পাড়ে ঘর যখন করবোই, রতন মিস্ত্রির কথাই মনে পড়লো। ঢাকার খিলগাঁওয়ে প্রথমজীবনে যখন বাড়ি করি, তখন প্রথমে বাউ-ারি ওয়াল করে নিতে অত টাকা আমাদের ছিলো না। তাই একদিকে দালান আর ফাঁকা তিনদিকে তিনকাঠা জায়গাজুড়ে চারখানা নামক বেড়ার ঘের দিয়েছিলাম। আর তাতেই পরিচয় হয়েছিলো রতন মিস্ত্রির সাথে। সেই থেকে যেখানে যত ঘর-বেড়ার কাজ রতন মিস্ত্রিই করে।
রতন মিস্ত্রি তেছরা চোখে তাকায়। ঠোঁটের হাসিটি দুষ্টু। দুপুরের পর থেকেই তার কাজের গতি শ্লথ হতে থাকে। যেন একদিনের কাজ দু’দিনে গড়িয়ে দেওয়া যায়। তবু সে চেনা-পরিচয়ের গ-িতে কাছাকাছি বলে পুরনো ক্ষোভ ভুলে বারবার তাকেই নতুন সব কাজে ডাকা হয়।
কিন্তু পুকুরপাড়ে যখন বাড়ি করতে রতন মিস্ত্রির কথা মনে পড়লো, মাঝখানে প্রায় একযুগ সময় পার হয়ে গেছে। এর ভেতর রতন মিস্ত্রির সাথে আর যোগাযোগ নেই। আমার ব্যক্তিগত সহকারী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে খবর পৌঁছানোর পর যখন রতন মিস্ত্রি দেখা করতে এলো, মুখে সমীহকাড়া চাপদাড়ি। পরনে পা পর্যন্ত সাদা পাঞ্জাবি। কপালে সেজদার সুরমা রঙের গাঢ় দাগ। সেই গুজে গুজে হাঁটুর ওপর পরা লুঙ্গি, খালি গা চোখে বদ-দৃষ্টির ঝিলিক রতনকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না!
তবে চোখের চামড়া কিছুটা ঝুলে পড়ায় দৃষ্টি সোজা হয়ে এলেও হাসিটি তেমনি রয়ে গেছে। বক্র অথবা তির্যক। গাল বেয়ে লাল কষ গড়ানোয় বোঝা যাচ্ছে, রতন কিছুক্ষণ পরপর বিড়ি খাওয়া ছেড়ে এখন পানে আসক্ত হয়েছে।
পুকুরবাড়িতে রতনের সহকারী হয়ে কাজ করবে আমাদের চেনাজানা আরেকজন। ছগির। সে আমার বাবার বাড়ির এলাকা গোপালগঞ্জের মানুষ। বর্তমানে ছগিরই ঢাকার বাসাতেও বড় ধরনের কাজকর্মের হোতা। কাজের লোকের দরকার পড়লে ডাকলেই আসে। সেসব কাজ একটানা হলে ড্রয়িংরুমে কাঁথা-কম্বল পেঁচিয়ে সে একটানা বাড়ির মানুষের মতো থেকে যায়।
ঢাকা থেকে তুমুল আয়োজনে ফেনী গিয়ে পুকুরপাড়ে ঘরের কাজ শুরু করি। তার আগে শ^শুরের মূল বাড়িতে পড়েথাকা শ^শুরের আমলের সেই জরাজীর্ণ ঘরখানা, যাতে হেলে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই বিদ্রোহের আলমারি। শেষে সেই ঘরও কোনো মালিক না পেয়ে, আমাকেই বললো, ‘আমাকে তোমার হেফাজতে নাও।’ তাকে সংরক্ষণ করতেই, জোড়াতালি দিয়ে আগে ওই পুকুরপাড়ে দাঁড় করাই। ছুঁতেই পটাপট খুলে যাওয়া প্রতিটি পার্ট আর একত্র করেও আলমারির আকার দেওয়া যায়নি। ঘুণ নয়, ঘরের ঝাঝরা টিন চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির পানি তার প্রতিটি রন্ধ্র খেয়ে, সব তেজ হরণ করে নিয়েছে।
খোলা জায়গায় ইট-কাঠ-টিন কিনে নতুন ঘর নির্মাণ করতে প্রতিদিন পুরনো বাড়ি থেকে সকাল হলে নতুন আমেজে নতুন বাড়িতে আসি। সন্ধ্যা হলে তরাসে চলেও যাই। আর চব্বিশঘণ্টা পুকুরপাড়ে থেকে যায়, ছগির আর রতন মিস্ত্রি। কারণ চারপাশে হইহইরইরই ডাকাত। গরিব প্রতিবেশীদের ইট-কাঠের প্রতি লোভে নিশপিশে বাড়ানো লম্বা হাতও পাহারায় রুখতে হয়। কঠিন ঘরঘোরের ভেতর দুরুদুরু ভয় নিয়েই কাজ আগাই। বয়স সত্তর পার হওয়া রতনের শক্তি দেখে আমি আর ছগির এবার আশ্চর্য হই। মিস্ত্রির এই তেজ আর নিষ্ঠা আগে কোথায় ছিলো! এবার কোনো ফাঁকির আলামত টের না পাওয়ায় আমি আর ছগির ফিসফিসিয়ে রতন মিস্ত্রির সুবুদ্ধির তারিফ করি সারাদিন।
কিন্তু একদিন ছগির বলে ভিন্নকথা। ‘অগ্রহায়ণের পনের তারিখের ভেতর রতন মিস্ত্রিকে যে করেই হোক, দেশে থাকতে হবে, তাই তাড়াতাড়ি কাজ সারা। কাজ শ্যাষ না অলি আপনি তো আবারা টাকা আটকাবেন!’
সারাদিন পুত্রের বয়সী ছগির রতন মিস্ত্রিকে ইয়ার-দোস্তের মতো ঠাট্টা-টিটকারি করে মাতিয়ে রাখে। তামাশায় রতন মিস্ত্রিও কম যায় না। এবার মিস্ত্রি সেই ভোরে আজান দেওয়ার পর উঠে নামাজ পড়ে, আর একদ-ও বসে না। কারণ হাঁস-মুরগির খামারসহ, কল্পনা থেকে নামিয়ে আনা রাজহাঁসের জন্যও দৃষ্টিনন্দন একখানা ঘরের স্বপ্ন জাঁকানো আছে চোখে। সব মিলিয়ে পুকুরবাড়ির কাজটি বেশ বড়।
রতন মিস্ত্রির মেয়ে নেই। তিনটিই ছেলে। তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। সেই বিয়েদারী তিন ছেলের কেউ নাকি বাড়ি আনাসহ ধানকাটার কাজটি ঠিকঠাক করতে পারবে না।
‘পারবো কোম্মেরতন, হ্যারা কি কোনোকালে দ্যাশে রইছে নাহি? হ¹লব্যালা মুই হ্যাগোরে তো ঢাহাই রাখছি! যেইব্যালা মুই এই ছৈয়লি কামও শিহি নাই, হেইব্যালা আকবর মুন্সীর ক্যালার পোজা টানতাম। ক্যা, আফনেরা দ্যাহেন নাই? একেক পোজা ক্যালা ম্যারাইদ্দার আঁটের কাছে খালের নৌকারতন আকবর মুন্সির বাড়িৎ লইয়া গ্যালে একটাহা হর্ইরা মোরে দেতে মুন্সি। দুই পোলায় যা লইতে, মুই লইতাম তারতনও বেশি…। হেইকামে পোষাইৎ পারি নাই বুইল্লাই তো ছৈয়লিকাম হিগলাম। মিস্ত্রিকাম তো হিগলাম হেদিনকো…।’
রতন মিস্ত্রির দাঁড়িকমাহীন জীবনকাহনের ভেতর অতীতের আরেকটি ঘটনা মনে ঝিলিক দিয়ে উঠলে বললাম, আচ্ছা রতন ভাই, তুমি যে আমার সাভারের বাড়িতে ঘর করার সময়, প্রায়-ই দিন সন্ধ্যা হলে বলতে, ‘আফনে গো সোনালি পল্লীর অফিসরুমে ম্যালা মশা! এইহানে ধারে-কাছে শালির বাড়ি আছে। রাইতে শালির বাড়ি থাকমু।’ তা তোমার সে শালির বয়স কত? এখন আছে কোথায়?
‘হ্যায় তহন সাভারে আফনেগোর বাড়ির কাছে এক কুডুমবাড়ি বেড়াইতে আইছেলে। কতেকদিন থাইক্কা আবার দ্যাশে চইল্লা গ্যাছেলে।’ বলে রতন মিস্ত্রি শালি প্রসঙ্গে ওখানেই থেমে যেতে চায়। কিন্তু আমার মনে পড়ে যায়, রতন প্রায়ই দিন বোতলে একলিটার করে দুধ নিয়ে যেতো, পরদিন ফিরে এসে বলতো, দুধটা জব্বর বালা! বিজাইন্না পিডা বানাইছেলে। বেমালা মজা অইছেলে!
পাশ থেকে পাশের বাড়ির এক মহিলা কেয়ারটেকার, মোমেনা, যার সাথে রতন মিস্ত্রির বেশ ভালোই খাতির জমে গেছিলো। দুজনেরই একই জেলা। ভোলা। তো তখন সেই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের খাতিরের মোমেনা টিপ্পনি কেটে বলেছিলো, আফা, বোজেন, দুদ অইলেগিয়া একসার। মানু অইবে কোমপোক্ষে হাতজন। তাইলে কত্তডি পিডার কাম! একসার দুদে তাও বোলে বেমালা মজা! আফা, আপনের মিস্ত্রি দেহেন গিয়া, শালির পীরিতে পড়ছে। আর দ্যাখছেননি, পেত্যেকদিন শালির গল্প হরতে এই বুইড়া বয়সেও কেমুন লাল অইয়া উঢে।
মোবাইল ফোন তখনো এতটা সুলভ হয়ে ওঠেনি। পাশের বাড়ির এক ছেলের নাম্বার দেওয়া আছে রতনের বউ এবং ছেলেদের কাছে। তারা সবাই ঢাকায় থাকে বলে জানি। তবে ফেনীর পুকুরবাড়ির পাশের বাড়ির বিশ একুশ বছরের এক ছেলে রুস্তম আলী মাঝে মাঝে দৌড়ে এসে রতনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘কাকা, আন্নের ফুন! আন্নের দ্যাশতুন কইচ্ছে। কইছি দুই মিনিট হর আবার কল দিতো!’
আরেকদিন এমনি ঘটনায় আমি গিয়ে সামনে পড়ায়, ফোন নিয়ে বাড়ি থেকে দূরে নেমে গিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললো মিস্ত্রি। মোবাইল ফোনে এতক্ষণ কথা? রতন ফিরে এলে বললাম, কী ব্যাপার রতন ভাই! এটা কি শালির ফোন ছিলো নাকি যে এত দূরে গিয়ে কথা বলতে হবে? বেলা বাজে ক’টা? তোমার কাজ আজ একটুও আগায় নাই। না, তোমার পুরনো অভ্যাস গেলো না ফাঁকি দেওয়ার! খালি লেবাসটাই যা পাল্টেছো!
রতন মিষ্টিমুখে সকালের রোদের মতো গলগল করে ওঠে, ‘মুই কতা কইতে ইট্টুহানি দূরে গেছি, তাই ওনার কাজ কুইম্মা গ্যাছে! আর মুই যে হেই ফজরের ওক্তো উইড্ডা ইদিক-উদিক গাড়ও ফিরাই না, হেইডা মোডেও চোউহে দ্যাহে না!’
আমি বলি, বউয়ের সাথে এই বয়সে এত দূরে যাওয়ার মতো কথা কারো থাকে না, রতন মিস্ত্রি!
আমার কথা শুনে ছগির বলে উঠলো, ‘ও আপা, ওই যে আপনি শালির কথা কন, সেই শালি এহন উনার ছোট বউ!’
আমি আশ্চর্য হলাম। বললাম, ‘এতদিন আমার চোখে ধুলো দিয়েছো রতন মিস্ত্রি?’
: ক্ক্যা, মুই দুলা দিমু ক্ক্যা?
: ওই যে এতদিন আমার কাছে যাকে শালি বলে চালিয়ে এসেছো, সে তোমার আরেকটা বউ? তোমার বড় বউ তোমার নামে মামলা করে নাই এই বিয়ের জন্য?
: হ্যায়ই তো মোরে এই নিকাহ্ হরাইছে। মুই কি হরতে চাইছিলামনি? এ্যাহ্, বিশটাহা স্যার চাউল খাওয়াইয়া বোলে আবারা দুইডা বিয়া হরে! ওরে মোর আল্লারে…।
: তুমি তো করলে?
: অইছে কি তয় হোনেন, মোর হউরে মোর হাওড়িরে তালাক দেলে, পরে য্যার লগে আবার নিক্যা বইছে, হেই গরে হেই হউরের আগের দুই পোলপান আছেলে। এক মাইয়া এক পোলা। তয় তাগো মায় আগেই মইরা গ্যাছেলে। মোর হাউরির সেই যে সতাই মাইয়া, হ্যায় ইট্টুহানিকালে বিয়া অইয়া, হ্যারও দুই পোলাপান অইতে না অইতে জামাই মরছে। আমার হাউরির হেই সোয়ামির মেলা সুম্পত্তি। আমার হাউরির এই হতাই মাইয়াও বেশ কত্তানি সুম্পত্তি পাইবে হ্যার বাপের। আমার হাউরির আবার হেই গরে কুনো পুলাপান অয় নাই। শ্যাষে মোর পোলাগো মা কইলে, মায় মইরা গেলে তো এই বাড়িৎ আমাগো আওন-যাওন, নেওন-থোওন সব বন্দ অইয়া যাইব্যয়ানে। ছালেহারে তয় তুমি নিকা করো! পোলারাও তাগো মায়েরে কইলে, আব্বারে কও, ছালেহা খালারে নিকা হরুক! নাইলে নানি মরলে আমরা কই বেড়াইত যামু!
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমার মুখে কথা সরে না। কণ্ঠের ভেজাভাব শুকিয়ে কাঠ! সেভাবেই বললাম, তোমার বউ তোমারে নিজে আরেকটা বিয়া করতে বললো? ছেলেরা বেড়াতে যাওয়ার জায়গা বানাতে তাদের বাপকে আরেকটা বিয়ে দিলো?
: হয়। বুইনে বুইনে কী মিল। আপনেরা চিন্তাও তো হরতে পারবেন ন। এই যে দ্যাশতন ছালেহা যহন ডাকা আইবে, কত্ত কিছু যে লইয়া আইবে! ভাতের চাউল, চিড়া, মুড়ি। গাছের লাউ, কুমড়া। আম-জাম, কাঁডল। কাঁডলের বীচি হুগাইয়া বালুর মইদ্দে কি যত্ন কইরা যে আনবো। ফল-ফলাদি…। মোরা কিছু কিইন্না খাই নাহি? এই যে ছালেহা আহে, মোর তো খোঁজই থাহে না। বুইনে বুইনে এক বিছানায় থাহে। কত কতা তাগো! তাগো নিজেগো কতা আর ফুরায় না!
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, তাহলে আসে কেন? খালি ওই বালুতে ভরে কাঁঠালের ওই শুকনো বীচিগুলোই দিতে আসে তোমার বড় বউকে?
পাকা গমের মতন রঙ, এখনো পেটানো শরীরের রতন মিস্ত্রির রাঙামুখে হাসিটি মুখের সমস্ত ভাঁজ নিয়েও ঈষৎ রোদের মতো একটু লজ্জাভাব ঝিলিক দিলো। মিস্ত্রি সে হাসি সমঝে গুটিয়ে নিলো। নামিয়ে নিলো ঘোলাটে চোখ দুটিও। কিছুক্ষণের জন্য তার করাত পোঁচে বিচলিত থাকে।
পনের অগ্রহায়ণে মিস্ত্রিকে তার গ্রামের বাড়িতে থাকতেই হবে। কিন্তু কাজ তো অনেক। সে কাজ অসমাপ্ত রেখে যে আমি তাকে যেতে দেবো না, তা সে জানে। তাই ইদানীং তার হাতুড়ির বাড়ি আমার কাছে একটু দায়সারা গোছের মনে হতে থাকে। যেন ভাবনা-চিন্তাহীন হাতুড়ির প্রতিটি বাড়ি। তাই যতটা কুলোয় তীক্ষè নজরদারিতে রাখি তাকে। এর ভেতর ছগির বলে উঠলো, ‘আপা, মিস্ত্রির ছোট বউ আজ আবার ফোন করছোলো। মিস্ত্রিরে কইছে, ইবার কানের সোনার জিনিস নিতি। আর মিস্ত্রি ওইযে ধান কাটতি দ্যাশে যাবে, সে ধান ওই শালিবউয়ের ক্ষ্যাতে।’
আমি বললাম, তাই নাকি রতন ভাই, তুমি সোনার জিনিস কিনবে ছোট বউয়ের জন্য? রতন মিস্ত্রি করাত না তুলেই একের পর এক সিলিংয়ের তক্তা সাইজ করতে করতে উত্তর দিলো, ‘হেইয়া অইবে না বাবি! সোনার জিনিস কেনতেয়ারুম না কারুর জন্যিই। বাজার-সদাই যদ্দূর লাগে, হেইয়া দিমু আর জমি-জিরাত কিনুম।’
: তোমার এই মিস্ত্রিগিরি করে, দুই পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে আবার জমিও কিনতে পারো?
: অ্যাহ, পারি না তে! এইকাম শ্যাষ অইলে আমনেই তো আমারে কত্তডি টাহা দেবেন, হেইডা ইসাব করছেন? আমার বাপে আমার লাইগ্যা কিচ্ছু রাইখ্যা যায় নাই! যা-ও ইট্টু আছেলে, মোর বড়বাই তা ফাঁহি দিয়া নিয়া নেছে।
ঘাড় না তুলেই শুধু চোখ ঘুরিয়ে, তাতেই দেড় একর জমির সীমানা বুঝিয়ে দিয়ে মিস্ত্রি বলতে লাগলো, আমি তো আপনে গো এই জমির মতো এৎখানি জমি এল্লাহ্ কিনছি। আমার গাছ-গাছালি আপনের গাছ-গাছালিরতন বড়। ঘর দিলাম একখান, য্যান তিন পোলা, হ্যারা যদ্দিন আলাদা ঘর হরতে না পারে, য্যান একলগে থাকতে পারে।
: তো, তোমার তিনছেলের জন্য বাড়ি করো, ছোট বউয়ের…।
: তার বাপের বাড়িরটুকে তার অইয়া যাইবে! হ্যারপর আগের সোয়ামিরও বালোই কৎখানি পাইছে।
: তোমার ছেলেমেয়ে হয়নি শালির পেটে?
: না! লাইগেশোন করাইন্না আছেলে। হ্যার আগের গরের পুলাপান দুইডা। হ্যারাও খালুরে ছাড়া কিচ্ছু বোজে না। কুনো কাম শুরু হরতে গ্যালেই পুলাপান দুইডায় তাগো মায়রে কইবে, খালু আহুক, খালুরে জিগাইয়া হ্যারপর করবা।
: তাহলে তো জীবনে তোমার অনেক সুখ!
: তা কইৎ পারেন! ইবার বাড়িৎ গিয়া বিদ্যুতের লাইগা চিষ্টা হরুম। আরোক বাড়িরতন লাইন আইন্না দুইডা বল জ¦ালাই, তাতেই তাই তাগো বাড়ির সব বিল আমার দেওন লাগে। অথচ তাগো বাড়ি ফিরিজও চলে। সারারাইত বাতি নিবায় না।
: স-ব মানুষের মনই তোমার মতন আলো-পিয়াসী, রতন মিস্ত্রি। পাশের বাড়ি আলো দেখলে নিজের বাড়ির যে কোনো মূল্যে আর আন্ধার সয় না।
: মোর লাই¹া না বাবি, মোর লাই¹া না! বালো গরেরতন মাইয়া আনতে গ্যালে, বাড়িতে বিদ্যুৎ আছেনি, হ্যাও তারা দ্যাহে। মাশাল্লা পুলাগো বিয়া করাইছি যে, কারুরতন কারু হউরের অবস্থা খারাপ না!
পড়ন্তবেলায় টুকটাক কাজ নিয়ে ছগির একটু দূরেই ছিলো। সে মিস্ত্রির কথাবার্তার শেষ পর্যায়ে এসে বললো, ‘এই যে রতন ভাই, তোমার শালিবউয়ের এত কিছু আছে কও, তবু তারে যহন বাজার কইরে দেও, তোমার ছাওয়ালরা আর তোমার আসল বউ হিংসা হরে না?’
: ক্ক্যা? হিংসা হরবে ক্ক্যা? মুই মরলে মোর পোলারা হ্যার সুম্পত্তি পাইবো না? ম্যালাখানি সুম্পত্তি পাইবে!
: তোমার দ্বিতীয় বউয়ের সুম্পত্তি তুমার ছাওয়ালরা কিবাবে পায়, আমারে বুজাও! ছগির বললো।
: ক্ক্যা, মুই হ্যার চাইরআনি সুম্পত্তি পামু না? মিস্ত্রি বললো।
: তুমি পাবা, ঠিকাছে। কিন্তু তোমার ছাওয়ালরা কিবাবে পায়?
: মুই যেডুক পামু, হেইডুক মোর পোলারা তো পাইবোই, বড়বউ, ছোডবউ মিইল্লা আবার দুইআনি পাইবো! আর আগে যে মরবো, হ্যায় আর পাইবো না। যে বাঁইচ্চা থাকপো, হ্যায় এল্লাহ্ই দুইআনি পাইবো!
: মানে, তোমার শালিবউ একলা বাইচে থাকলি, সে দুইআনা তুমার থেইকে, মানে তুমার পাওনা সম্পত্তিরতে কাইটে রাখতে পারবে, আর তোমার শালিবউয়ের মোট সম্পত্তিরতে তোমার পাওনা তোমার তিন ছাওয়াল নিয়া আসফে?
: হয়!
: আর এটুকির জন্যি তোমার ছাওয়ালরা তোমারে বিয়ে দেলো?
: হয়!
ছগির আর মিস্ত্রির এইসব কথার পর আমি আর কথা খুঁজে পাই না। ছগিরের দৃষ্টি আমার মুখে বিদ্ধ। যেন আচমকা দমকা বাতাসে মাটিতে পড়ে যাওয়া লতানো গাছের মতো তার উঠতি বয়সের বদ্ধমূল বিশ্বাস মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেছে। তাই আমি কী বলি, তা শোনার জন্য সে ব্যাকুল অপেক্ষা করে থাকে!
কিন্তু সে-বেলা আমারও কথা সরে না। পরদিন দিনের শুরুতে কাজ শুরু হতেই খেইহারা ছগির যেন খেই ফিরে পেয়ে আমাকে বলছে, আপা, ইবার বুজলেন, ক্যান রতন মিস্ত্রির ছাওয়ালরা কইছোলো তাগে মায়েরে, যে আব্বারে কও, খালারে নিকা করতে? বুজচ্ছেন আপা, কেন বুইনে বুইনে এত্ত মিল? আমি তো আপা সারারাইত গুমাতি পারি নাই এই পোলিটিকসির জট খুলতি খুলতি।
কিন্তু আমার কাছে রতন মিস্ত্রির বউ আর শালিবউ কোনো জট নয়, বরং তাদের ঘোরহীন জীবনযাপনের গ্লানিকর কটুস্বাদ চরমভাবে জারিত করতে থাকে। বারবার ঘর বানানোর নেশাটা আমার টুটে যেতে থাকে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে। সূক্ষ্ম কৌশলে, প্রণয়ের মাধুরী দিয়ে বোনা পুরুষ বাবুই পাখির বাসাটা উঁচু ডাল থেকে একবার খসে পড়ে গেলে তা যেমন তাদের দু’টি পাখির কাছেই শুধু অনর্থ-কুটোই, মানুষের সম্পর্কও তো তেমনি সৌন্দর্য হারালে তা কেবলই সারবত্তাহীন পাশাপাশি দিনযাপন।
ঢাকাতে চামেলীবাগে আমার ঠিক সামনের ফ্ল্যাটে নামকরা একটি কলেজের শিক্ষিকা থাকতেন। কলেজে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদানের আগে তার বিয়ে হয়। আমরা যখন পাশাপাশি থাকতাম তখন তার যে ছেলেটি বুয়েটের আর্কিটেকচারের ফাইনাল ইয়ারে, তার পাঁচ বছর বয়সে একদিন ভোরে শিক্ষিকা তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে কী দেখে সন্দেহ হয়েছিলো, তার স্বামী আর তার বেড়াতে আসা ছোটবোনের সাথে কিছু একটা ঘটিয়েছে। আর সেদিনই তিনি ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে ওই বাসায় আর ফেরেননি। ঢাকাতে বসবাস করা মা-বাবার কাছেও যাননি। তবু বিষয়টি নিয়ে তিনি তখনও পর্যন্ত নাকি কারো কাছে মুখ খোলেননি।
সবাই নাকি শুরুতে বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য দূরে থেকে কঠোর চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু শিক্ষিকার তোলা প্রাচীর ভেঙে কেউ কাছে ভিড়তে পারেননি। লেখালেখি করি জেনে দরজা খোলা পেলে নিজেই তিনি আমার একটার পর একটা বই চেয়ে নিয়ে যান। তবু আমার সাথে তার কোনো কথা হয় না। শুধু একবার মুখ ফসকে বলেছেন বলে মনে হলো, ‘আপনাকে নিয়ে, আপনার গল্পগুলো নিয়ে আমি কলিগদের সাথে আলোচনা করি!’
ছেলে সীমান্তকে তার বলা আছে, ‘বাবার কাছে যেতে চাইলে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আর আমার কাছে ফিরে আসতে পারবে না এবং আমার জন্য কোনও চিন্তাও করবে না। আমি ভালোই থাকবো।’ শিক্ষিকার স্বামী কি তার সেই ছোটবোনটিকেই বিয়ে করেছে? তাও তিনি জানেন কি জানেন না, তাও কেউ জানেন না।
আশপাশের মৃদু কানাঘুষা থেকে আমার প্রবল আগ্রহ ছিলো তার ব্যক্তিত্বের এই কাঠিন্যের প্রতি। পাহাড় ছেদন করে সুড়ঙ্গ তৈরির চেষ্টার মতো নতুন কিছু বিষয় পেলে, পড়ে ভালো লাগলে সেধে দিয়ে আসতাম। তিনিও তা পড়ে ফেরতও দিয়ে যেতেন। তবু সুরাইয়া জাহানের সাথে আমারও দূরত্ব ঘুচতো না! যেন প্রতিটি মানুষের কেউ তার প্রতিপক্ষ নয়। শুধু দূরের কেউ!
কাল থেকে সেই সুরাইয়া জাহানের সবকিছুর প্রতি দূরত্ব বজায় রাখার মতো, আমারও আপাতত বাড়িঘর, আর প্রতিটি সম্পর্কের সাথে ওইরকম ঘেরাটোপকেই মোক্ষধাম বলে মনে হতে থাকলো।
ছগিরকে বললাম, তোমাকে তৎপর হয়ে কাজটা বুঝে নিতে হবে। বাড়িঘর তো শুধু এক প্রজন্মের জন্য নয়। পনের অগ্রহায়ণের আগে মিস্ত্রি গেলে যাক। প্রয়োজনে আমরা আরো ক’দিন এখানে থেকে কাউকে জোগাড় করে বাকি কাজ সারবো।
আমার মরতে ইচ্ছে করে না কিন্তু কল্পিত কবরে একখানা এপিটাফের স্বপ্ন বিভোর হয়ে আছে। যাতে আমি অবচেতনে কিছু কথা লেখার জন্য একটানা বারবার অনেক কথা লিখি আর মুছি। লেখাটুকুতে থাকতে হবে, যে মানুষটি আমার লেখকসত্তাটিকে আবিষ্কার করে আবার তার সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলো এবং সাতাশ বছর মানুষটির সাথে সংসারযাপনের আরো অসংখ্য স্মৃতির মধুরেশ সম্বলিত সে অক্ষরগুলো যেন স্থির নাক্ষত্রিক দ্যুতির মতো সাধারণ পথযাত্রীরও অবচেতনে গভীর আলো ফেলে।
আর সে কথা লেখার জন্য পৃথিবীতে যেন কোনো কাগজ নেই। কোনো বৃক্ষের বাকল বা পত্রও যেন তা উৎকীর্ণ’র জন্য উপযুক্ত নয়! তবে সেই অনাগত এপিটাফ ধারণের জন্যই কি আমার এই পুকুর কেটে স্বপ্নের বাড়িটি গড়ে তোলা, পরবর্তী প্রজন্ম যার পাশে আসবে সেই মৃদু শিখার আলোর টানে!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..