শাহীদ লোটাস এর মুক্ত-গদ্য

শাহীদ লোটাস
মুক্তগদ্য
Bengali
শাহীদ লোটাস এর মুক্ত-গদ্য

১৮ মার্চ ২০১৯

 মধ্যরাত!

চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের সব টুকু শক্তি দিয়ে, আমাদের ঘরের দরজা জানালা খোলা, কিছুক্ষণ আগেই ঝড়ো-বাতাসের সঙ্গে একটু বৃষ্টি হয়েছে, এই বৃষ্টিতে মাটি ভিজেনি, এখন প্রকৃতি সব শান্ত, আশপাশের সব বাড়ির মানুষ গুলো ঘুমিয়ে আছে, শুধু আমাদের ঘরেই কোলাহল, আম্মা শান্ত হয়ে শোয়ে আছেন, যে কিনা ঘণ্টা খানিক আগেও অসুস্থতা কাতরাচ্ছিলেন সে এখন শান্ত নীরব, কোন রোগ নেই, নেই কোন যন্ত্রণা, আম্মার এই শান্ত দেহের চারপাশে কান্নাকাটি করছে আত্মীয়সকল, আমি বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝিতে বাস্তবতা নিয়ে আম্মার শিয়রের পাশে বসে আছি । মৃত্যু কতো সুন্দর! কতো আবেগ নিয়ে,  ভালোবাসা নিয়ে জীবনকে জয় করে, বিদায় জানায়, আম্মা যেন তারেই বর্ণনা করে গেছেন শেষ মুহূর্ত । কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই, অপ্রাপ্তির আক্ষেপ নেই, নেই কারো প্রতি কোন প্রত্যাশা, আম্মা নিজের আপন পৃথিবীতে চলে গেছেন সব মায়া ত্যাগ করে ।

একাকীত্ব কেমন ? শূন্যতা কতখানি নি:সঙ্গ করে ? পৃথিবীকে কখন সত্যি সত্যি মনে হয় এই আমার চির আবাস ভূমি নয় ? আগে কখনো বুঝতে পারিনি, এখন বুঝি, যখন আমার হাতে আমার বুকে মাথা রেখে আমার আম্মা চির বিদায় নিলেন । আমি কখনো ভাবতে পারিনি আমার চোখের সামনে প্রাণহীন আম্মাকে আমি দেখবো, শান্ত স্থির এক নীরব মানুষ, যার কাছে পৃথিবী পর, পৃথিবী তাকে চির বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতি করছে । কয়েক ঘণ্টা পরেই আম্মা চিরদিনের জন্য চলে যাবেন, আর কখনোই দেখা যাবে না আমার আম্মাকে, যে প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আমাকে দেখে যেতো, লেপ কাঁথা আমার চারি পাশে গুজে গুজে দিত, সে আর আসবে না । যে আম্মা ভালো কিছু পেলে রাঁধলে আমার জন্য যত্ন করে রেখে দিত, নিজে না খেয়ে আমাকে খাওয়াত, সে আর কখনই আমার জন্য কিছু রাখবে না ! সামান্য ঠাণ্ডার সময়েও আমার গোসল বেলায় যে প্রচণ্ড অসুস্থতা নিয়েও আমার জন্য গরম পানি করে আমাকে বাধ্য করতো গরম পানিতে গোসল করতে, তাকে আর কখনই দেখবো না । আম্মা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে, আমার জীবন থেকে সবার জীবন থেকে চির দিনের জন্য চলে যাবে ।

মধ্যরাতের এই বিয়োগব্যথার মাঝে দূরে থাকা আত্মীয় স্বজন খবর পেতে শুরু করেছে, কেউ কেউ আসতেও শুরু করেছে । আমাদের ঘরের কাছে এসেই উচ্চ স্বরে কাঁদতে শুরু করছে । আমি বসে আশি আম্মার পাশে ।

আমার খুব ইচ্ছে করছে, আবার চরপাড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই, আম্মাকে আমার কেবিনে শুয়ায়ে আবার চিকিৎসা করি, স্যালাইন চলবে, আমি রৌদ্র উত্তাপের দুপুরে ফার্মেসী দৌড়ে যাবো, আবার সার্জারি ওয়ার্ডে ডাক্তারদের কাছে ছুটাছুটি করবো, কর্তব্যরত ডাক্তার খুব অবহেলায় করবে আমাকে, আমার উপর বিরক্তও হবে, কিন্তু পাশে বসে থাকা এক শ্যামল বর্ণের ইন্টার্র্নি ডাক্তার আস্তে আস্তে আমার কাছে আসবে, কিছুই বলবে না সে, তারপর কর্মরত ডাক্তার বুঝে যাবে এই মেয়েকে বললেই আমার সঙ্গে আমার আম্মাকে দেখতে যাবে, এই শ্যামল বর্ণের ডাক্তার মেয়ে আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে হাটতে শুরু করবে ২ তলা সার্জারি ইউনিট থেকে  ৩ তলায়, কখনো কখনো ৪ তলার ক্যাবিনে আম্মাকে দেখবে, ক্যামুথেরাপির, স্যালাইন গুলো ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়ে আবার চলে যাবে তার কাজে, আমি কেবিনেই বসে রবো আম্মার পাশে, মেয়েটি একা একাই ফিরবে তার সার্জারি ইউনিটে । আমার খুব ইচ্ছে করছে আম্মা আবার পৃথিবীতে আসুক, আম্মা আমাকে যেভাবে আদর করত সেই ভাবে আমাকে আবার আদর করুক । তার আদরে আর বিরক্ত হবো না আমি, তার রেখে দেওয়া সব খাবারেই আমি খেয়ে নিব এখন । কখনই ঐ খাবার গুলো আর রেখে দেব না ফেলেও দেবো না । আমার খুব ইচ্ছে করছে আম্মার সঙ্গে গল্প করি, কথা বলি । আম্মা খুব কথা বলতো, কথা বলতে ভালো বাসতো, আত্মীয়দের সব খবরা খবর রাখতো সে, সেই খবর আমাকে বলতো, বলতে চাইতো কিন্তু আমি বেশী কথা পছন্দ করি না বলে কখনো কখনো আম্মা ভয়ে সেই সব আমাকে বলতে পারতো না । আমার খুব ইচ্ছে করছে আম্মা আবার পৃথিবীতে আসুক, মন খোলে আম্মা আমাকে তার মনের সব কথা বলক, যা সে বলতে চায়, আমি সব শুনবে ।

আমি আম্মার মৃত্যু দেহের পাশে বসে বসে আম্মার দিকে তাকি তাকিয়ে বলছি, ‘ আম্মা আপনি আবার আসুন, আবার আসুন এই পৃথিবীতে…!’

কিন্তু আম্মা নিরুত্তর শোয়ে আছে আমাকে পর করে । আজকের ভোরের আলো আম্মা আর দেখবে না, এই আলোতে চির দিনের জন্য আম্মা চলে যাবে এই পৃথিবী থেকে ।

 

ওয়ার্ডের প্রতি ভাবনা

 মনে করুন আপনি এখন আছেন কোন একটি জেলার প্রধান হসপিটালের কোন একটি ওয়ার্ডে । আশপাশের সব উপজেলা সহ পাশের জেলা সদরের রোগীদেরও এখানে পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য, এই কারণে সব সময় রোগী আর রোগীর সঙ্গে আসা লোকজনের চাপে এক ঘিঞ্জি-মারা পরিবেশ হয়ে থাকে হসপিটালের ভেতর বাহির । প্রতিটি ওয়ার্ডে রোগীর জন্য যত গুলো সিট বরাদ্দ থাকে তার থেকে অনেক অনেক বেশী রোগী শুয়ে থাকে প্রতিটি সিটের পাশে, ফ্লোরে আর বারান্দায় । আপনি এখন যে ওয়ার্ডে আছেন, সেখানে রোগী হয়ে শুয়ে আছে আপনার কোন আপন জন বা আত্মীয় । আপনি ভেতরে চারদিকে তাকালেন, দেখলেন ঘিঞ্জি-মারা ওয়ার্ডের সবটুকু জায়গা, রোগী আর রোগী, এই রোগীরা কতদিন যাবত গোসল করেনা তা আপনি অনুমান করতে পারলেন না, রোগীদের উপরে আছে ময়লা যুক্ত কাঁথা ময়লাযুক্ত চাদর, কারো কারো কাঁথা আর চাদরে বমি বা রক্তের দাগও লেগে আছে । আপনি দেখলেন ওয়ার্ডের ভেতরে এদিকে ওদিকে রোগীরা হাঁচির পর হাঁচি দিচ্ছে, কেউ কেউ বা কাশছে, রোগীদের হাঁচি আর কাশিতে তাদের মুখ আর নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে লালা থুথু । কোন কোন রুগীর অবস্থা এমন যে তারা বমির পর বমি করেই যাচ্ছে, ডিস বা বালতিতে রাখা হয়েছে তাদের সেই বমি,কোন কোন বালতিতে বমি গুলো থাকতে থাকতে তা জমাট বাদা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই । আপনি আরো দেখলেন বাথ রুম ওয়ার্ডের এক পাশে, কেউ বার্থ রুম করতে গিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরেই সে পায়খানা করে দিয়েছে, আবার সেই পায়খানা মুছার চেষ্টা করে তা লেপটে দিয়েছে ওয়ার্ডের ভেতরের অনেকটা জায়গা, সেই জায়গার উপর অনেকের হাটার কারণে মলটুকু পুরু ওয়ার্ডের ছড়িয়ে পরেছে মানুষের পায়ে পায়ে । সব মিলিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে কি এক অদ্ভুত দুর্গন্ধ বিরাজ করছে ।

এমতাবস্থায় এই ওয়ার্ডের ভেতরে আপনাকে যদি ভাত খেতে দেওয়া হয় আপনি কি করবেন ? যদিও ভাতের সঙ্গে আছে সুস্বাদু মুরগীর মাংস আর চিকন চালের ভাত, আর এই খাবার নিয়ে এসেছে আপনি দেখতে আসা রোগীর কোন আত্মীয় স্বজন, আপনি তখন কি করবেন ? আমি জানি আপনি এই অবস্থায় খেতে পারবেন না, সেই খাবার নিয়ে আসা আপনার আত্মীয় বা কাছের লোকসকল আপনাকে খাবারের জন্য যতই পিড়াপীড়ি করুক আপনি খাবেনেই না, নানান টালবাহানায় আপনি খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন । কিন্তু যদি আপনার নিকট আত্মীয় কেউ সেখানে রোগী হিসেবে শয্যা-শায়িত থেকে থাকে আর আপনার উপর পরে সেই রোগীকে দেখ ভালের দায়িত্বটুকু তখন আপনি আশপাশের কথা চিন্তা না করে ক্ষুধার তাড়নায় ভাত খাওয়া শুরু করে দিবেন ।

 

মেলামেশার প্রতি ভাবনা

আপনি খেয়াল করলেই দেখবেন যে, যে কোন সমাজে বসবাসরত মানুষেরা বিভিন্ন শ্রেণীতে সংঘবদ্ধ হয়ে চলাচল করে । সেই শ্রেণী গুলোর মধ্যে ফাজিলদের একটি শ্রেণী থাকে, বদমাইশদের একটা শ্রেণী থাকে, চোরদের একটা শ্রেণী থাকে, মদখোর , সুদখোর, ঘোষ-খুর, খাজা খোর, ভালোভাবে বললে যে যেই স্বভাব ও চরিত্রের হয় সে সেই রকম স্বভাব ও চরিত্রের লোকগুলোর সঙ্গে আপনা আপনি সংঘবদ্ধ হয়ে একটি শ্রেণী তৈরি করে, আর তারা সখ্যতা তৈরি করে মিলেমিশে থাকে আড্ডা দেয় । প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের দোষ নয়, কারণ একজন বদমাইশ একজন ভালোমানুষের সঙ্গে চলাফেরা করে আরাম পাবে না কখনই, একজন বদমাইশ সব সময় বদমাইশিই করতে চাইবে আর ভালোমানুষটি চাইবে সব সময় ভালো কাজে করতে, এতে তাদের দুজনের মাঝে কাজের বিরোধ হবে মতামতের পার্থক্য হবে, যা এক সময় তাদের এক সঙ্গে চলাচল ও কাজ কর্ম করাটা হয়ে যাবে খুব মুশকিল, যার কারণে তাদের হয়ে যাবে বিচ্ছেদ আর তারা হয়ে উঠবে একে অপরের শত্রু । একজন চোরের বেলাতেও এমনি কথা খাটে, কারণ একজন চোরের ধান্ধা থাকবে চুরি করা, যার কারণে যারা চুরি করাকে অপছন্দ করে তাদের সঙ্গে চলাফেরা করলে তারা তাদের চুরি করার ব্যাপারে সুবিধে পাবে না । ভালো মানুষটি তার চুরি করার পথে বাধা হয়ে যাবে, যার জন্য তার চুরি করাটা হয়ে যাবে মুশকিল  । এই কারণে একজন চোর অন্য কিছু চোরদের সঙ্গেই মেলামেশা করবে, আর তার চুরি করাটায় কি ভাবে আরও উন্নতি করা যায় ও সে কি ভাবে চুরি বিদ্যায় আরো পারদর্শী হতে পারে কার বাড়িতে চুরি করলে বেশী মাল পাওয়া যাবে এই ব্যাপার গুলো বিষয়ে মত বিনিময় করবে, শলাপরামর্শ পারবে সে অনন্যা চুরদের সঙ্গে মেলামেশা ও আড্ডা  মাধ্যমে । এই ভাবে বললে সকল মানুষের বেলাতেই বলা যায় একেই কথা । একজন ধার্মিক সব সময় সৃষ্টিকর্তার ভয়ে কাতর হয়ে ধর্মকর্ম পালন করবেন, আর অন্যান্য তার মত ধার্মিক মানুষদের সঙ্গে উঠবস ও বন্ধুত্ব করবেন ।  মানুষ যেই সমাজে তার নিজ স্বভাব চরিত্র আর সম মন-মানসিকতার মানুষ যদি না পায়  তার জন্য সেই সমাজে বসবাস করাটা হয়ে উঠে খুব কষ্টকর । আপনি আরও একটু গভীর ভাবে খেয়াল করে দেখবেন, মানুষ তার নিজ স্বভাব মতো মানুষ না পেলে আর তার নিজ চরিত্র ও স্বভাবে যায় না এমন মানুষদের সঙ্গে যদি তার চলতে হয়, বসবাস করতে হয়, এমন পরিস্থিতিতে পরলে, তখন তার জন্য বসবাস ও জীবন যাপনের ব্যাপারটা হয়ে উঠে ভয়াবহ অশান্তির কারণ ।

 

শিক্ষিতের প্রতি ভাবনা

শিক্ষা কি ?  শিক্ষিত কাকে বলে ? কে অশিক্ষিত ? কে অর্ধ-শিক্ষিত ? এই প্রশ্ন এবং উত্তর মাঝে মাঝে আমাকে হয়রান পেরেশান করে দেয় ।

ধরা যাক কোন এক ব্যক্তি নামীদামী কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার কমপ্লিট করে ভালো চাকরী করছেন, ভালো ভালো পোশাক পড়ছেন, সুন্দর তার সংসার, দুর থেকে বোঝা যায় তিনিই হলেন শিক্ষিত, তার পরিবারেই হলো শিক্ষিত পরিবার ।  কিন্তু যখন তার কাছে গিয়ে একটু আলাপ আলোচনা করা হয় তখনেই ধারনা পাল্টে যায়, বুঝতে পাই তার আচার ব্যাবহার অশালীন, শিষ্টাচার নেই তার মাঝে, মানুষকে মানুষেই ভাবেন না তিনি, তখন হোঁচট খেয়ে যাই আমি । এমনও হয় যে, টাকা পয়সা, শিক্ষা দীক্ষা সব দিকেই কোন একজন পারফেক্ট, কিন্তু তার নৈতিক দিক খুব ঝামেলার, তিনি সততাই বুঝেন না, ঘোষ সুদ বা অন্যায় ভাবে অর্থ উপার্জন তার নিত্য কর্ম, তখনেই প্রশ্ন জাগে, এই লোক পড়াশোনা করে কি শিখল ? এনাকেই কি শিক্ষিত বলে ?

যারা শিক্ষায় দীক্ষায় খুব স্বয়ং সম্পূর্ণ থাকার পরেও  পরিবার ও সমাজে বসবাস রত অন্যান্য মানুষজনের সঙ্গে কোন প্রকার সৌহৃদ্য পুণ্য আচরণেই করছেন না, তিনি তার অহমিকা স্বেচ্ছাচারিতায় সবাইকে অতিষ্ঠ করে তুলছেন, তখনো খুব ভাবনায় পড়ে যাই, মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করি, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য তাহলে কি ?

অনেকেই আছেন যারা  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব সনদ পত্র অর্জন করে, তার যোগ্যতায় তিনি প্রচুর অর্থও রোজগার করে ফেলেছেন, কিন্তু অশ্লীলতায় তিনি খুব পটু, প্রতিনিয়ত চলে তার ধর্ম বিরোধ কর্ম কাণ্ড, তখন সেই ব্যক্তিকে দেখেও মনে হয়, শিক্ষিত তাহলে কারা ?

 

কোন  কোন ক্ষেত্রে এর ভিন্নতাও লক্ষকরা যায়, দেখা যায় কোন এক ব্যক্তি আচার ব্যবহারে খুব সাবলীল, সবার কাছেই সে প্রশংসার পাত্র, তিনি সব দিক দিয়ে সমাজ পরিবার রাষ্ট্রের ভালো হয় এমন কথাই বলছেন,কাজও করছেন, তার দ্বারা কারো ক্ষতি হচ্ছে না, কোন না কোন ভাবে তার দ্বারাতে কেউ না কেউ উপকৃতই হচ্ছে, কিন্তু ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায়, এমন আদর্শ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিটির কোন প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্রই নেই । এমন ব্যক্তিকে দেখে তখন খুব ধাঁধাঁয় পরে যাই, এই ব্যক্তিকে কি বলবো ?

শিক্ষিত ? নাকি,  মূর্খ ?

 

বাস ভাড়ার প্রতি ভাবনা

আপনি আপনার যাত্রা পথে বা কোন বাস-স্ট্যান্ড এ চা খাওয়া বা আড্ডা দেওয়ার সময় দেখবেন যে, কিছু বাস আছে যেই বাসগুলোতে টিকেটের নিয়ম থাকলেও কেও টিকেট কেটে বাসে উঠছে না, আর এমন বাসে যখন যাত্রীরা কোথাও যাওয়ার জন্য উঠে তখন তাদের ভাড়া নিয়ে ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি হয় বাস কন্টাক্টের সঙ্গে হরহামেশাই । এই সব যাত্রীদের যদি আপনি ভালো ভাবে খেয়াল করেন তবে দেখতে পাবেন, কিছু যাত্রী আছে যারা বাসে উঠার আগেই সে তার ভাড়া কত তা বাস কন্টাক্টের সঙ্গে নির্ধারণ করে নেয়, যেন পরে কোন ঝামেলায় পরতে না হয় । আবার কিছু যাত্রী আছে যারা খুব অনুনয় বিনয় ও অসহায় সেজে ভাড়া কম দেওয়ার চেষ্টা করে । আবার কিছু কিছু যাত্রী আছে যারা এই দুইয়ের কোনটিই না করে বাসে উঠে পরে আর ভাড়া দেওয়ার সময় তুই বাস কনট্রাকটরকে তোয়াক্কারই করে চোখ রাঙ্গায় কোন কোন সময় মারপিটেও লিপ্ত হয়ে যায় ।

 

এই ব্যাপার গুলো আমাদের সামনে, আমাদের দৈনন্দিন চলার পথে হরহামেশাই দেখা যায় । আর এই ব্যাপার গুলো ঘটে যাত্রীদের বুদ্ধিমত্তা, নির্বুদ্ধিতা ও ভয়ের কারণে ।

 

বুঝতে পারলেন নাতো ? আপনাকে একটু বুঝিয়ে বলি ।

ধরুন কোন এক স্থান ধরা যেতে পারে সেই স্থানের  নাম, ‘ বিনোদবাড়ি ’ এই

বিনোদবাড়ি থেক ঢাকা যেতে বাস ভারা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, আর এই ১৫০ থেকে ২০০ টাকা হওয়ার কারণেই বাস কন্টাক্টর আর যাত্রীদের মাঝে ভাড়া নিয়ে কথা কাটা কাটি ও মারপিট হয় । বাস কন্টাক্টর নিতে চায় ২০০ টাকা আর যাত্রীরা দিতে চায় ১৫০ টাকা, মাঝের ৫০ টাকাই হলো ঝামেলা । এই ৫০ টাকাই বুদ্ধিমান, নির্বোধ, আত্ম-মর্যাদাহীন  ও ঝগড়াটে লোকের মুখোশ উন্মোচন করে দেয় ।

আপনাকে আরো খোলাসা করে বলি, ধরুন একজন যাত্রী সে

বিনোদবাড়ি থেকে ঢাকা যাবে, সে বাসে উঠার আগেই সে বাস কন্টাক্টর কে বললো ‘ আমি আপনাকে ১৫০ টাকা ভাড়া দেবো ’, আর বাস কন্টাক্টর ২০০ টাকার জন্য নানান অজুহাত ও যুক্তি দেখাল কিন্তু এই যাত্রী সোজা সাপটা বলে দিলো ‘যদি ১৫০ টাকা আপনার পোশে তাহলে আপনি আমাকে নিতে পারে বা আমি আপনার বাস দিয়ে যেতে পারি তা না হলে আমি আপনার বাসে যাবো না, অন্য বাস দিয়ে যাবো ’, এমতাবস্থায় বাস কন্টাক্টর উপায়কুল না পেয়ে এই যাত্রীকে ১৫০ টাকাই ঢাকা নিয়ে যাবে, আর তাকে একটি ভালো সিটেরও ব্যবস্থা করে দেবে, কারণ বাস কন্টাক্টর জানে এই যাত্রীকে সিট না দিলে যাত্রীটি ফট করে বাস থেকে নেমে যাবে আর অন্য বাসে উঠে পরবে ।

এবার ধরুন আরেকজন যাত্রী, সেও

বিনোদবাড়ি থেকে ঢাকা যাবে আর সে বাসের দরজার সামনে গিয়ে বাস কন্ডাক্টরকে বাবা ভাই ডাকতে ডাকতে বললো, আমার কাছে টাকা নাই, আমার কাছে ১৫০ টা টাকাই আছে, আমারে ঢাকা নিয়া যান’, এই যাত্রীর এমন কথা শোনে বাস কন্টাক্টর চোখমুখ কুচকিয়ে খুব বিরক্ত ভাব দেখাবে, তারপর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে এই যাত্রীটির দিকে তাকাবে, আর বলবে, বাস ভাড়া কম নাই কম  নাই, তখন যাত্রীটি আরো অনুনয় বিনয় কাকুতিমিনতি করে বাস কন্টাক্টর কে আরো তোষামোদ করবে, এক সময় বাস কন্টাক্টর দান সদকা দেওয়ার ভঙ্গিতে এই যাত্রীকে বলতে, পিছনে যাইয়া বইন, সামনের সিটে বইননা যে।

এবার ধরা যাক অন্য আরেকজন যাত্রীর কথা,  এই যাত্রী অনুনয় বিনয় কাকুতিমিনতি বা ভাড়া ফুরিয়েও বাসে উঠবে না, সে শরীর ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বাসে উঠে পরবে ধপাধপ, আর যেই সিট খালি আছে সেই সিটে বসে পড়বে, সিট খালি না থাকলে দাড়িয়েই যাবে, এমন যাত্রীর কাছে যখন বাস কন্টাক্টর ভাড়া নিতে আসবে তখন এই যাত্রী ১০০ টাকা দেবে আর তখন বাস কন্টাক্টর ২০০ টাকার জন্য তর্ক শুরু করে দিবে, এই তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে এই যাত্রী আর বাস কনট্রাকটরের মধ্যে মারামারি কিলাকিলি শুরু হয়ে যাবে ।

আবার আরেক শ্রেণী যাত্রী আছেন এরাও ভাড়া না মিটিয়ে বাসে ওঠে পারে । তারপর  বাস কনট্রাকটর যখন তাদের কাছে বাস-ভাড়া নিতে আসে তখন তারা সঠিক ভাড়াই দেয়, তারপরেও বাস কনট্রাকটরের সঙ্গে তাদের ঝগড়া শুরু হয়ে যায়, বাস কনট্রাকটর তাদের কাছে ২০০ টাকা নিতে চায়, আর এই শ্রেণীর যাত্রী কিলাকিলি বা তর্কবিতর্ক না করে সে আইনের কথা বলে, সঠিক যুক্তি দেখায়, আর অন্যায় ভাবে বেশী ভাড়া নেওয়ার কুফল সম্পর্কেও বলে, এতেও কাজ কাজ হয় না, বাস কনট্রাকটর তার কাছে থেকে ২০০ টাকাই আদায় করে ছাড়ে ।

 

আপনাকে আমি পূবেই বলেছি যাত্রীদের মাঝে, বুদ্ধিমান, নির্বোধ, আত্ম-মর্যাদাহীন ও ঝগড়াটে লোক কারা তা অনুমান করা যায়  তাদের ভাড়া বিষয়ক কাজকর্মের মাধ্যমে । আমার উল্লেখিত যাত্রীদের মধ্য থেকে যিনি বাসে উঠার আগেই ঝুট-ঝামেলায় না গিয়ে সঠিক ভাবে বাস কনট্রাকটর এর সঙ্গে ভাড়া নির্ধারণ করে নেন, তিনি চালাক বা বুদ্ধিমান । যিনি বাসে উঠার আগে অনুনয় বিনয় করে সাহায্য প্রার্থনার মতো ভাড়া নির্ধারণ করতে চান তিনি আত্ম-মর্যাদাহীন । আর যিনি অনুনয় বিনয় বা ভাড়া না মিটিয়ে বাসে উঠে মারামারি বা ঝগড়া করে সে ঝগড়াটে বা ঝুট ঝামেলার লোক । আর যিনি ভাড়া না মিটিয়ে বাসে উঠে পরে আর পরিশেষে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে দেন, তিনি বোকা । যাত্রীরা যে ভাবেই বাসে উঠুক না কেন, বাস কন্টাক্টর ১৫০ টাকাই কিন্তু ঢাকা যাত্রী নিবেই আর ১৫০ টাকায়

বিনোদবাড়ি থেকে যাত্রী নিলে বাস কন্টাক্টের-রো লস হবে না । আর বাসে করে যাত্রীরা ১৫০ টাকায় ঢাকায় অহরহ যাতায়াত করে আর বাস কনট্রাকটর নিয়েও থাকে । যাত্রীরা টাকা নেই বলে কাকুতিমিনতি করলেই ১৫০ টাকা, ঝগড়া করলেও ১৫০ টাকা, আর সম্মানের সাথে বাসে ভাড়া ফুরিয়ে উঠলেও এই ১৫০ টাকাই ভাড়া । শুধু মাত্র বুদ্ধি, নির্বুদ্ধিতা, ও আত্মমর্যাদার প্রার্থকের কারণেই বাস কন্টাক্টর ও যাত্রীদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ঘটে যা আমরা দেখতে পাই ।

 

প্রকৃত

 

প্রকৃত-১

 

মাঝে মাঝে শহর বড় অস্থির লাগে । দুর থেকে শহরকে যতোটা রঙ্গিন, যতটা হাসির, যতটা খেলার জগত মনে হয় সত্যি বলতে ততটুকু স্বচ্ছন্দতা থাকে না বিরাট শহরে । আমি এগিয়ে যাই, রিক্সা, বাস, মানুষের কোলাহল অলিগলি ঘেঁষে ঘেঁষে। আমাকে যেতেই হবে বা এগোতেই হবে এমন যেন জীবন চক্র আমার ।

কোন এক ভীতি যে ভীতি সব সময় ভয় দেখায় বা যার মাথায় সব সময় জিউয়ে রয় সে তো কখনই থামে না ।

প্রকৃত-২

সত্যি বলতে এক কঠিন বিষণ্ণতার মাঝে আছি আমি । আমার চারপাশের লোকগুলোকে বড় বিচলিত মনে হচ্ছে আজ, তাদের হাতের নখগুলো বড় বড়, অপরিচ্ছন্ন মুখ, তাদের মুখের দিকে তাকালেই চিন্তামগ্ন ক্লান্ত হয়ে জেগে থাকা ক্লান্ত এক জোড়া চোখ দেখা যায় । মায়েদের আচল ধরে বাচ্চা গুলো কাঁদছে খুব আহাজারির স্বরে, তাদের কান্না দেখে মনে হয় যেন তারা কোথাও যেতে চায় না এই শহর ছেড়ে । এই সব কান্না রত শিশুদের মায়েরা সেদিকে যতোটুকু-না মনোযোগ রেখেছে তার থেকে বেশি মনোযোগ রেখেছে আজ অন্য যে শহরে যেতে হবে সেই শহরের দিকে । ইতি মধ্যেই বেশ কিছু অপরিচিত মানুষের মুখ দেখা হয়ে-গেছে সবার, বহু পথ অতিক্রম করে যখন একটি বাস এসে দাঁড়ালো আমাদের মাঝে তখন আমরা সবাই নতুন ভাবে কর্ম উদ্দীপনায় আবার চঞ্চল হয়ে উঠলাম, কারণ আমাদেরও বহু পথ পারি দিয়ে যেতে হবে অন্য কোথাও । অথচ বাসে আর কাউকে নেবার মতো তিল পরিমাণ শূন্য জায়গাটুকু নেই ।

 

সত্য

সত্য-১

আমরা শিখতে শিখতে বড় হই, আমাদের  শিক্ষাগ্রহণ যখন পরিপক্বতা পায়, মৃত্যু ও অদৃশ্য সম্পর্কে খুব জটিল জটিল প্রশ্নের উত্তর জেনে যাই ঠিক তখনেই আমাদের মৃত্যু আসে, এই সব তথ্য কাউকে না জনিয়ে আমরা মৃত্যু বরন করি ।

সত্য-২

আমরা যাদেরকে নিয়ে ভাবি তাদের ৯৯% মানুষেই জানে না যে তাদেরকে নিয়ে আমরা ভাবছি । যেমন ধরা যাক, আমরা যাত্রী হয়ে কোথাও যাচ্ছি, তখন বাসে থাকা সহযাত্রীদের নিয়ে আমরা কতকিছুই না ভাবি, তারা কেউ বুঝতেই পারে না যে তাদের নিয়ে আমরা তাদের পাশের সিটে বসেই ভাবছি। আমরা যখন পথে বসে থাকি তখন সামনে দিয়ে চলাচল-রত মানুষজনদের নিয়েও আমরা অনেক কিছুই ভাবি । অচেনা অজানা অসংখ্য পথচারী আমাদের ভাবনায় এসে পড়ে। মূলত আমাদের চোখের সামনে আর আড়ালে থাকা অসংখ্য মানুষজনেই আমাদের ভাবনার খোরাক । কিন্তু তারা কখনই জানতেও পারেনা তাদের নিয়ে আমরা কখনো কোনদিন ভেবে ছিলাম ।

সত্য-৩

জীবন সহজ ভাবে নিলে জীবন খুবেই সহজ

আর জীবন কঠিন ভাবে নিলে জীবন খুব কঠিন ।

যারা দুঃখ কষ্ট অপ্রাপ্তি আর মৃত্যুকে উপভোগ করতে পারেন

তাদের কাছে জীবন আনন্দময় ।

 

শাহীদ লোটাস। বাংলা ভাষার লেখক, বাংলাদেশ-এর নেত্রকোনা জেলায় মোহনগঞ্জ থানায় ৩০ মে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে শাহীদ লোটাস-এর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহবোধ করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ