প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
শঙ্কর তাদের বসার মোড়াগুলি সরু গলি রাস্তার ভেতর উবু হয়ে বসে ঠিক করে দিতে থাকে। এর জন্য মেয়েরা কিছু কিছু পয়সা তাকে দেয়। কিছু মেয়ে গলির ধারে বসে লাল টুলে। সে সব প্লাসটিকের। সারানোর প্রশ্ন নেই।
তবে ওতে বসলে একজন বেশ্যাকে ঠিক বেশ্যার মত লাগে না। মনে হয় যেন উচু জায়গায় বসে থাকা কোন একজন নারী। যে বেশ্যা পাড়ার নিচু টালির চালের ঘর ছাড়িয়ে ওদিকের আকাশটা দেখছে। যে আকাশ দিয়ে একজন মাছরাঙা উড়ে যায়।
মাসি বলে, হ্যাঁরে, সোনালি কি এখনও পুকুর পাড়ে বসে আছে নাকি? তোর কাজ হয়ে থাকলে তুই যা। ওকে ডেকে ঘরে তোল। নইলে মেয়েটি বোধহয় আজ কোন খদ্দেরই পাবে না। ঘরভাড়া দেবে কি করে?
এই যাই।
বলেও শঙ্কর নীরবে কাজ করে যেতে থাকে। মেয়েরা গলির ভেতর দাঁড়িয়ে গা টেপাটিপি করে, হাসে; চোখে চোখে কথা কয়। একজন বলে, হ্যাঁরে শঙ্কর, এখানে তোর শিউলিই কেবল সুন্দরী, আর আমরা নই? আমরা কী তবে বানের জলে ভেসে এসেছি?
শঙ্কর কোন উত্তর করে না। সে উঠে পড়ে। অনেকক্ষণ উবু হয়ে বসে থেকে হাঁটু ধরে গেছে তার। ফলত সোজা হতে সময় লাগে তার। তাদেরই একজন মুখ বেঁকিয়ে বলে, তোর মাছরাঙা উড়ছে এখন, শঙ্কর?
অমনি চাপা হাসির শব্দ সোনা যায়।
শংকর তাকায়।
আর তোর মাছরাঙা?
ওটা এমনি মাছরাঙা নয়, ও হল একটি পুং মাছরাঙা।
আবার হাসির হল্লা। গায়ে গায়ে ঢলে পড়া। একজন বলে, ওই হল! মাছরাঙা হল মাছরাঙাই, তার আবার পুং কীসের? তুই কি পুং? তুই হলি ফুং।
কোমরে হাত রেখে শঙ্কর বড় করে শ্বাস নেয় আর বলে, যাই।
অমনি মেয়েরা খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, তুই আবার যাবি কই? আর একজন বলে, শিউলি গুছাইএর ভেতর গিয়েও যদি তুই ঠিকঠাক সেঁধোতে পারতিস, বুঝতুম কাজের কাজ কল্লি একটা। এখন যা, সে খদ্দের পেল কিনা, দেখ গে।
লং বারমুডা ও লাল গোলগলা গেঞ্জি পরিহিত শঙ্কর সামনের টালির চালের কাঠামো ধরে নিজেকে সিধে করে। একজন মেয়ে বলে, অই, ওটি কার ঘর জানিস? ফতিমার। তোর এমনি তাগড়াই চেহেরার ভারে যদি চাল খুলে আসে, চারগুন দাম নেবে সে—জানিস তো?
শঙ্কর এবারও কিছু বলে না। একবার পলক ফেলে মেয়েদের দিকে। শাড়ি, চুরিদার ও ছোট জামা পড়ে মেয়েরা চড়া লাল লিপস্টিক মেখে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এই পাঁচজনই দাঁড়ায়। শংকরের সঙ্গে কথা বলছে তাদের মধ্যে দুইজন। এরা হল মিনু আর রুপালি। বাকি মেয়েরা মুচকি মুচকি হাসছে।
গলির ওদিক থেকে একটা সাইকেল আসছে। ওদিকটাতেই গঙ্গা বয়ে চলেছে কুলকুল করে। ক্রিং ক্রিং…। ইচ্ছে করেই বেল বাজাচ্ছে মাঝবয়েসী সিরিঙ্গে চেহেরার লোকটা। তার মাথার সামনে টাক। ভাঙাচোরা এক পুরাতন সাইকেলের উপর সে একটু ঝুঁকে পড়ে বসে সাইকেলটা ঢিমে চালাচ্ছে, আর সাইকেল তার হয়ে বলছে, ক্রিং ক্রিং…
একটি মেয়ে বলল, এসো না…
না, না।
লোকটা একগাল হেসে বাধ্য ছেলের মত দু’দিকে ঘাড় নাড়ে।
একজন বলে, তোমার তো রোজই না।
মেয়েরা আবার নিজেদের মধ্যে গল্পে মত্ত হয়।
লোকটাকে চেনে শঙ্কর। দিনের এইসময় মাঝে মাঝে আসে সে। কোথা থেকে আসে কোথায় যায়; প্রতিবার নদীর দিকে থেকেই বা তার উদয় ঘটে কেন—এসব নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করে না। বেশ্যাপাড়ায় কেউ কাউকেই কোন প্রশ্ন করে না, করতে নেই। সে আসে আর বেশ্যাপাড়ার মধ্যে সাইকেল বাজিয়ে ঘোরে, ক্রিং… ক্রিং।
ক্রিং এর শব্দে উড়ে যায় পাখি।
শঙ্করের মনে হয়, লোকটি আসলে কে? কী চাই তার? কোন মেয়ের ঘোরে ঢোকে না কেন?
মেয়েরা তাকে নিয়ে আর কোন কৌতুহল দেখায় না। অন্যরাও আর কিছু বলেও না। তবুও লোকটা কয়েকবার পাক দেয় বেশ্যাপাড়াটা।
নীরবে হাঁটতে থাকে শঙ্কর। এবার সে যাবে শিউলি গুছাইয়ের কাছে। আহা, বড় মন খারাপ করে বসে থাকে সেই মেয়ে। তাকে দেখে লাইনের মেয়ে বলবেই না কেউ!
আহা, শিউলি গুছাই! তুমি আর এসো না এ পাড়ায়। থাক, থাক, নিজের ঘরেই থাক।
শিউলি গুছাইকে দেখে শঙ্করের মনে পড়ে গেছিল তাদের উঠোনে কচকচ শব্দ তুলে ঘুরে ফেরা সেইসব সাদা হাঁসেদের কথা যাদের গায়ের রঙ শিউলি গুছাইএর মত। হ্যাঁ, সেই থেকেই শিউলিকে সে একগুচ্ছ হাঁস ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। হাঁসেদের চলা আছে, তাদের পথ আছে; আদের আকাশ বাতাস নদী ও পুকুর আছে।
শিউলি ত অমনই। তারও একটি পুকুর আছে। বেশ্যাপাড়ার পুকুর। তাতে কিছু পানা আছে; পানাপাড়ে আমড়া গাছ আছে, তাতে একটি পুং মাছরাঙা এসে বসে। শিউলি গুছাই বলে, এর ভেতর যদি কিছু জ্যান্ত পুঁটি এনে ছেড়ে দেওয়া যায় তবে কেমন হয়?
বেশ হয়। সে নিজেকে প্রশ্ন করে আর নিজেই তার উত্তর করে। এমনি হলে পুঁটির বংশবিস্তার হয় আর পুং মাছরাঙা তার খাদ্য পায়। এত মাছ এত মাছ…যে তাকে আর খাদ্যের জন্য এইপুকুর সেই পুকুর করতে হয় না। সে ছানাপোনা নিয়ে এই পাড়ের গায়েই মাটি খুঁড়ে ঘরবাড়ি গড়ে তুলতে পারে। কি, পারে না?
শঙ্কর এবার বলে, নিশ্চয় পারে।
কিন্তু শিউলি পুকুরপাড়ে নেই। তবে সে গেল কই?
টলটলে জলের একটা পুকুর। পাড়ের গাছ তাতে ছায়া ফেলে। সেখানে আছে ঘাট। বেশ্যারা সেখানে আছড়ে কাপড় কাচে। অনেকে পুকুরে ডুব গেলে সাঁতার কাটে।
খানিক আগেই শিউলি এখানে ছিল। তার সঙ্গেই নানা কথা বলছিল সে। কখন সরব কখনও নীরবে কথা বলে তারা। শিউলি জল দেখে আর শঙ্কর খুঁজে চলে একটি পুং মাছরাঙা।
তারপর মেয়েদের কাছ থেকে ডাক এল। শঙ্কর তাদের কিছু কাজ করে দেয়, কিছু পয়সা পায়। তাই সে মোড়া সারাতে এল আর ফিরে এসে দেখে, জল আছে ছায়া আছে। শিউলি নেই। আর নেই পুং মাছরাঙা।
ওরা তবে গেল কোথায়?
পুকুর ছেড়ে শঙ্কর বাইরে এল। আলপথ । এখানে কোন কুটির নেই। আছে তফাতে। এখানের মেয়েরা তার সঙ্গে তেমন রগড় করে না। এখানে একটা আমগাছ আছে। তাতে কাক ও শালিক বসে।
তফাতে এককামরা ইটের ঘর সেখানে একটি মেয়ে থাকে। প্লাস্টারহীন দেওয়াল। নীল রঙ। মাসিক ভাড়ায় এখানেই থাকে সে। তার ঘরের দরজা বন্ধ।
পাশের ঘরের দুয়ারে বসেছিল নলিনী বেশরা। হাঁটু বুকের কাছে জড়ো করা। থুতনিতে মুখ। তার ছোটখাট চেহেরা। মুখখানা ভারি মিষ্টি। তার পাশের ঘর শিউলির। সেখানে তালা। সে বললে, শিউলিকে খুঁজছ? সে গেল ওই গলি দিয়ে, বেরিয়ে গেছে বাইরে।
শঙ্কর চুপ করে রইল।
নলিনী মুখ তুলে বলল, সঙ্গে কেউ ছিল না।
মাছরাঙাটা?
সে তার লম্বা চুল হাত দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, দেখিনি।
এতবড় মাছরাঙাটা তবে কি হাওয়া হয়ে গেল?
এটা শুনে মেয়েটি বড় বড় চোখ করে তাকাল তার দিকে।
কিছু বলে গেছে?
না। নলিনী দু’দিকে মাথা নাড়ে। মুখ তেমনই করে নামিয়ে নেয়। বাতাস বয়। শঙ্কর অমনি মুখ উঁচু করে আমড়া গাছের ডালে তাকায়। গাছের পাতা ঝরছে। সেখানে কিছু ফল এখনও রয়ে গেছে, থোলা হয়ে দুলছে নিজে নিজেই। বড় পাতারা জলে-বাতাসে ভাসছে নৌকার মতন।
মাছরাঙাটা ফেরেনি। সে কি তবে শিউলি গুছাইয়ের সঙ্গে সঙ্গেই গেল?
পাখিটা খুব জ্বালায় তাকে। আর শিউলি গুছাই খুব ভদ্র বেশ্যা বলে মাছরাঙার এইসব উৎপাত মেনে নেয়। আরও একদিন ব্যর্থ হয়ে শঙ্কর ঘর থেকে বেরিয়েই পাখিটিকে তার নাকের ডগায় উড়তে দেখে। যেন টাকে ভেঙাচ্ছে। যে আধলা ইঁটটা মাটি থেকে কুড়িয়ে ছুঁড়েছিল। পাখি তা পাশ কাটিয়ে যায়। সেই থেকে তার উপর শঙ্করের বিষম রাগ।
এই বেশ্যাপাড়াতে শঙ্কর কি আজ আসছে? তা নয়। কতদিন হয়ে গেল, সে কথা আজ আর তার মনে নেই। প্রথম যেদিন এসেছিল, এমনিই এসেছিল। আস্তে আস্তে এই পাড়া তার ভাল লেগে গেল। সে এখানেই থেকে যেতে লাগল। মেয়েদের ও বাবুদের ফাইফরমাশ খাটা তার জীবিকা হয়ে দাঁড়াল। একবার এক খদ্দের তাকে অনেকগুলি টাকা দিয়ে বলেছিল, গঙ্গা থেকে একটা পদ্ম তুলে আনতে।
এই বেশ্যাপাড়াও আজ তার কাছে অর্থহীন। সত্যি শুধু শিউলি গুছাই ও একটি পুং মাছরাঙা। শিউলি গুছাইয়ের কাছে সে নতজানু হয়ে রয়। এই বেশ্যাপাড়া, আকাশ বাতাস সব যেন মগ্ন তার রূপের কাছে। সে দেখেছে, শিউলি হল এক আশ্চর্য নারী। তার সঙ্গে যৌন ক্রিয়া করতে চায় এক পুং মাছরাঙা। আর সে যতবার যায় ততবার ব্যর্থ হয়। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বাইরে এসে শিউলি গুছাই দেখে পুকুরের জল এবং তার প্রবাহ। টাকে না ছোঁইয়ার দূরত্বে বসে থাকে শঙ্কর। শিউলি গুছাইএর এইভাবে তাকানো ও মগ্নতা দেখে শংকরের মনে হয়, সে তখন ভাবিত থাকে ঈশ্বরের প্রতি। তখন তার গা থেকে চন্দনের গন্ধ উঠে আসে।
তার ইনকাম হাতছাড়া হয়ে যায়। তার খদ্দের অপেক্ষা করে করে ফিরে যায়। এমনিতে একটু ভেতর দিকে তার এই দৈনিক ভাড়ার ঘর। খদ্দেরপাতি এদিকে কমই আসে। মাসি বলে, ওলো, যৌবনকে এমনি করে পায়ে ঠেলতে নেই। মেয়েদের রূপ-যৌবন হল লক্ষ্মী। ভগবানের কৃপায় এখন কামাবি না তো কবে কামাবি। তুই একটু ছলাকলা শিখলেই মাসে তিরিশ হাজার ইনকাম তোর কাছে কোন ব্যাপার হল? কামানোর জন্যই ত এখানে আসিস নাকি পুকুরপারে ওই ধ্বজুকেষ্টকে নিয়ে বসে থাকার জন্য আসিস?
আমার আর একটা বাচ্চার শখ মাসি, তুমি জান।
ঘরে একটাকে রেখে আসিস তো?
হ্যাঁ। ছেলে।
কত বয়স হল?
সাত।
আবার কেন?
শখ যে!
বুঝেছি। বাচ্চাটা তোর স্বামীর তো?
শিউলি গুছাই ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁ।
এবার তবে কি শঙ্করের বাচ্চা নিতে চাস?
শিউলি গুছাই লজ্জা পায়। বলে, না। তা কেন?
তবে যে বাচ্চা বাচ্চা করে হেদিয়ে মরছিস? একটাতে হচ্ছে না?
শিউলি গুছাই চুপ করে থাকে। মাসি বলে, অনেকেরই এমনি হয়। একটাই ফল থাকে। এরপর যতই চেষ্টা কর, আর আসে না। এখন ওসব না ভেবে মন দিয়ে কাজ কর। তোর ছেলেটার একটা ফিউচার আছে তো নাকি?
কোন কথা বলে না শিউলি গুছাই।
কেন শিউলি গুছাইএর পিছনে সব সময় চক্কর কাটে এক পুং মাছরাঙা? কেন সে ওড়ে তার মাথার উপরের আকাশে? কী উদ্দেশ্য তার? সে কী সত্যিই তবে মাছরাঙার বীর্য গর্ভে ধারণ করতে চায়? একদিন শঙ্করের এই প্রশ্নের উত্তরে হেসে ওঠে শিউলি গুছাই। তারপর শুরু করে গল্প।
আমার স্বামীর নাম রতন গুছাই। সে কাঠের কাজ করে। একবার এক নদীর ধার থেকে একটা গাছ কেটে এনেছিল। সেখানেই বিশ্রাম নিত এক পুং মাছরাঙা। জলে মাছ ভেসে উঠলে সেই গাছের ডাল থেকেই ছোঁ মেরে মাছ তুলে ফেরত আসত সেই গাছেই। গাছে বসে তার মাছ খাওয়া ও ঝিমানোর পালা চলত। রতন গুছাই সেই গাছকে কেটে ফেলে। ক্রদ্ধ পাখি রতনের পিছু নেয়, তার মাথায় ঠোক্কর মারে। রতন মাথা বাঁচাতে চলে আসে বাড়ি। সেখানে পুং মাছরাঙা শিউলি গুছাইকে দেখে ও শান্ত হয়।
এ-গলি সে-গলি পেরিয়ে শঙ্কর রাস্তায় এসে পড়ে। ভাঙাচোরা পাকা রাস্তা। এটাই গলি, এটাও পাড়া। এটা সোজা চলেও গেছে গঙ্গার দিকে। বেশ্যাপাড়াকে ছুঁয়ে গঙ্গা চলে গেছে সোজা উত্তরে। এখানে তার ছোট্ট বাঁক আছে। সেই বাঁকের উপর বটগাছ ও একটি দুটি বাড়ি, দিশি মদের দোকান। সেসব কাটিয়ে গঙ্গা। অনেকটা চড়া পড়ে আছে। সেখানে দুটি বাচ্চা একটা আধখাওয়া আধ ভাঙা মূর্তি নামিয়ে রেখেছে। আর তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে কে?
শিউলি গুছাই!
এটা কি ব্যাপার হল? এই তো খানিক আগে শিউলি গুছাই ঘাটের ধারে বসেছিল। তার পাশে শঙ্কর। গালে হাত রেখে জলের দিকে তাকিয়ে সে স্থির চোখে বসে আছে; আহা তার পটলচেরা চোখ।যেন সে এখানেও এক গ্রাম্য বধূ, এই শহরের বেশ্যালয়ে সে বেমানান। কিন্তু সে কি অরবে, তার যে সংসার চলে না। সেই যে একটি পুং মাছরাঙা বে-ঘর হল, সেই থেকে তার স্বামী গাছ কাটা ছেড়ে দেয়, কাঠ চেরাই থেকে বিরত থাকে। আর সে চাষের কাজও জানে না। কিন্তু সংসার সে কথা শুনবে কেন? তাই দিন প্রতি চুক্তিতে শিউলি গুছাইকে ঘর ভাড়া নিতে হয়। বেশ্যাপাড়ায় ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করতে হয়।
প্রথম আলাপের অনেক পর শিউলি গুছাই তার আসল নাম বলে শঙ্করকে। শঙ্কর শুনে অবাক হয়ে যায়। বলে, গুছাই? সেটা আবার কী জিনিস?
কি জিনিস হতে যাবে কেন? আমি হলুম শিউলি গুছাই, গুছাই আমার পদবি।
গুছাই না গুছাইত? শিউলি গুছাইত।
নানা, পদবি নিয়ে অমনি বললে চলবে না। শিউলি গুছাই বলে ডাকবে আমায়। তবে তুমি কিন্তু পুরকাইত। শঙ্কর পুরকাইত।
তুমি পুরকাইত হতে চাও না?
শিউলি গুছাই তার দিকে আহত চোখে তাকায়।
চোখ নামিয়ে নেয় শঙ্কর। আহা, শিউলি গুছাইএর কি দোষ? সে তো কিছুই পারে না! কেবল হাঁটকায়।
তবে কী সে শিউলি গুছাইএর জন্য কিছুই করতে পারে না?
এক্ষণে, সে শিউলি গুছাইএর জন্য কী করতে পারে?
পারে সে অনেক কিছুই; কিন্তু তার মুখপানে চেয়ে চেয়ে তার এমনি সময় কেটে যায় যে, মাছরাঙাটাকে ডেকে ডেকে সতর্ক করে না দিলে তার নড়ে না। পাখিটাকে মোটেই বিশ্বাস করে না সে। ওকে না তাড়িয়ে শঙ্কর সেখান থেকে নড়তে পারে না। সে তখন পুকুরপারের ধুলোমাটি জামাকাপড় থেকে ঝেড়ে বলে, এবার তবে যাই শিউলি গুছাই?
শিউলি গুছাই বলে, যাবে? যাও তবে। আসবে ত আবার?
আসব।
দেরি কোর না। আজ ছেলেটার জ্বর; তাড়াতাড়িই ফিরব। ভাবছি তিনটের ট্রেন ধরব।
কাল আসবে?
বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে শিউলি গুছাই বলে, জানি না। ছেলেটার ভাল থাকা না থাকার উপর নির্ভর করছে।
শঙ্করের কাজ এই। শিউলির জন্য খদ্দের ধরে আনা সে বাজার থেকে হোক বা রাস্তা থেকে। অনেক সময় গঙ্গায় নৌকা ভেসে আসে, তাতে খদ্দের থাকে। চারপাঁচজন ইয়ার একজোট হয়ে এল মাঝিরটা ফ্রি। সেই টাকা পায় শঙ্কর।
শিউলি গুছাইএর জোড় হাত, চোখ বন্ধ। আহা, কী অপূর্ব তার মুখখানি। বাতাসে তার ঝুলপি কাঁপে, চোখের পাতা কাঁপে। মাথার চুল ওড়ে অল্পঅল্প। শঙ্করের মনে হয়, মনের গভীরে সে মন্ত্রোচারণ করছে। আর তাই, আকাশের ওদিকে চাঁদের উদয়।
সে ডাকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। তখন কানের ওপাশে শব্দ ওঠে ক্রিং…ক্রিং…। ঘুরে তাকিয়ে দেখে, সেই লোকটা। তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশারায় শঙ্করকে ডাকে। পায়ে পায়ে যায় শঙ্কর। নিচু গলায় বলে, কী?
ওকে ডেক না।
কারণ?
দেখছ না, ও স্তব করছে।
হুম! কার স্তব?
একটি পুং মাছরাঙার।
সে খবর তুমি পেলে কোথা?
রাখতে হয়। ওর নাম কি?
শিউলি গুছাই।
আহা, ভারি চমৎকার নাম।
হুম!
ও কোথা থেকে আসে? ওর বাড়ি কোথা?
তাতে তোমার কি?
ওকে আমি ট্রেন থেকে নামতে দেখি প্রায়। এই বেশ্যা পারাতে ঢুকতে দেখি। কিন্তু তারপর ওকে আর দেখি না।
ওর কীসের অভাব?
সেটা জেনে তুমি কী করবে?
লোকটা শঙ্করের কথাটাকে পাত্তা না দিয়ে বলে, এমনি সুন্দরী বেশ্যা সচরাচর দেখা যায় না। ফর্সা, দেখতে ভাল বেশ্যা অনেক আছে। কিন্তু এমন নিঁখুত রূপবতী খুব কম দেখা যায়। ও যার পুজো এই কাদামাটিতে বসে করছে, সে হল একটা কার্তিক ঠাকুরের ফেলে দেওয়া মূর্তি। ওর মাথার উপর মাছরাঙা ওড়ে। কি করে হয়? ওর কি ভাল কোন বাবু নেই? আমি ওর বাবু হতে চাই। ওর লগেই বেশ্যাপাড়াতে সাইকেল চালাই, কিন্তু ওকে প্রায় দেখিই না। কপাল ভাল থাকলে চোখে পড়ে। ওর কোন বাবু নেই। তাই এই অসময়ে ভাঙা কার্তিকের পুজো সারে বাচ্চাদের নিয়ে। আমাকে ওর বাবু করে দিতে পার? অনেক টাকা দেব তোমায়।
শঙ্কর ঘুঁষি মারলে সাইকেল সহ লোকটি পড়ে যায় ও যাচ্ছেতাই রকমের গালমন্দ করতে শুরু করে। সে ফিরে আসে শিউলি গুছাইএর কাছে। শিউলি গুছাই ততক্ষণে চোখ খুলেছে। বললে, কীহল?
কিছু নয়। পুজো হল?
হল। তবে এই রকম একটা মূর্তি আমার চাই। এনে দেবে?
এ আবার এমন কি? বলে শঙ্কর ভাবতে থাকে কোথায় সে পেতে পারে এমনি মূর্তি। পটুয়াপাড়াতে পাবার কথা নয়। এখন কার্তিক পুজোর সিজিন নয়। উপায়?
সেটাও বাতলে দেয় শিউলি গুছাই। বলে, তুমি চলে যাও এই পাখির পিছুপিছু। ও তোমাকে পথ বলে দেবে।
দারুণ অবাক হয়ে শঙ্কর পুং মাছরাঙাকে দেখে। সে শিউলি গুছাইএর মাথার উপর অতি আনন্দের সঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে। মোটা গলায় কি যে বিচ্ছিরি রকমের ডাকছে!
শঙ্কর বলে, মানে?
ও সে পথ চেনে। সেখানে আছে হোগলার বন, অনেক অনেক আকাশ আর জলাভূমি। সেখানে হায়েনা ও শিয়ালের দল একত্রে থাকে। সেই ফাঁকা ধু ধু শূন্যতার ভেতর একটা ভাঙা মন্দির আছে। সেখানে অনেক কার্ত্তিক ঠাকুর রাখা থাকে। যে লোকটা নানা জায়গা থেকে এসব কুড়িয়ে এনে রাখে, তার নাম শ্রীযুত মাধব ঘোষ। তার একচোখ সাদা পাথরের। একগাল খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। সামনের দুইখান দাঁত উঁচু। সে দাঁতের রঙ হলুদ। মন্দিরের পেছনে আছে একটি করমচার গাছ। মাছরাঙাটা সেখানে থাকে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যে নালা বয়ে গেছে, সেখানে মাছ শিকার করে সে খায়। সেখানে যেতে আসতে তিনদিন লেগে যাবে তোমার। সে যা দাম বলবে তাই তোমাকে দিতে হবে; কারণ দরদাম করলে কোন ফল মেলে না।
শঙ্কর চুপ করে শোনে। নদী দিয়ে জল বয়ে যায়। স্রোত টেনে আনে মাঝির নৌকা।
শিউলি গুছাই বলে, এছাড়া সেই মূর্তি আনার নিয়ম আছে।
কীরকম?
ঠাকুরের মুখ উল্টা করে আনবে না। তুমি সে পথে হাঁটবে, সেদিকেই থাকবে ঠাকুরের মুখ। মনে থাকবে?
হুম! থাকবে।
নাও শঙ্কর, যাত্রা শুরু কর। এই পাখি, যাঃ—!
শঙ্কর মাছরাঙাকে দেখল। মহানন্দে সেটা ডানা ঝাপটে শিউলি গুছাইকে ঘিরে পাক দিচ্ছে। আপাতত এই পুং মাছরাঙাকে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার।
শঙ্কর এই প্রথম নতজানু হয় শিউলি গুছাইএর কাছে। বলে, তুমি যা বললে। আমি তা করব শিউলি গুছাই। কিন্তু এতদিন তোমার কাছে আমি কিছুই চাইনি শিউলি গুছাই। আজ জানতে চাই, আমি কি পাব?
উদাস শিউলি গুছাই বলে, কী চাও তুমি?
তুমি আমায় শঙ্কর পুরকাই বলে ডেক।
শিউলি গুছাই গঙ্গা নদীর জোয়ারের মতন হাহা করে হাসে।
কতদিন পর যে তাকে এইভাবে হাসতে দেখছে শঙ্কর পুরকাই!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..