শিকার

মঈনুল হাসান
গল্প
Bengali
শিকার

অঘ্রাণ শেষে পৌষের কুয়াশার ভোর। বিলের শান্ত গভীর জলের উপর অলস অজগরের মতো জমাট কুয়াশার চাদরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে এক টুকরা রোদের আশায়। ওদিকে পুবের কোণে কপট কুয়াশার আবরণ ভেঙে সূর্য উঁকি দিতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকী। সেই অপেক্ষায় পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘোট পাকানো কুয়াশাটা হালকা হচ্ছে ধীরে ধীরে। যেন কোনোই তাড়া নেই। সারা রাত আলসেমিতে ডুবে থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতেই এখন যত গড়িমসি তার।

সোনা ঝরা নরম রোদ ও পলাতক ছায়ার এক বিরামহীন কারচুপি বিলের চারপাশ ঘিরে। বড় বড় গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে কনক আলোর ইশারা আসা যাওয়া করছে বিলের বুক ছুঁয়ে। কিছুক্ষণ পরই সরল হয়ে নামবে জলের বুকে। যেন অজস্র সোনালি রঙের তীরের ফলা শান্ত সকালের সফেদ এই কুয়াশার চাদরকে ফানা ফানা করে দিতে একযোগে ছড়িয়ে গিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে। সেই অপেক্ষায় চারপাশে বিরাজ করছে এক অপার স্থিতি, সুনসান এক সৌম্য নীরবতা।

বিলের নাম পদ্মাকর। নামটা যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি এর বিশালতা। এর ঈষাণ কোণের পাড়টা আধ ফালি চাঁদের মতো দেখায় বলে লোকমুখে আজ চাঁদবিল নাম হয়েছে তার। শীতে আশপাশের অন্য বিলগুলোতে পানি শুকিয়ে গেলেও এই বিলটি তার চেয়ে আলাদা। চাঁদবিলের উত্তর-পশ্চিমের ঢালু উঁচু পাড়ের পেছনে বিশাল বুনো বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে চাঁদবিল গ্রাম। জনবসতি ঐ গ্রামটি ঘিরেই। গল্পের প্রধান চরিত্র আজাদ মাস্টার ও তার একমাত্র ছেলে টুকু এ গ্রামেরই সন্তান। গল্পের আবর্তন ও আদ্যোপান্ত এদের নিয়েই।

কান টুপিতে আগাগোড়া মাথা ঢেকে সারা গায়ে চাদর আর গলাবন্ধ পেঁচিয়ে জবুথবু বেশে খুব সকালে বেরিয়ে পড়ে আজাদ মাস্টার। শীতটা বোধ হয় জেঁকেই বসবে এবার। কেবল পৌষের শুরু। গেল বর্ষায় বৃষ্টি হয়নি তেমন। গুরুজনেরা বলতেন, ঊন বর্ষায় দুনো শীত। সেটাই মনে হয় অক্ষরে অক্ষরে ফলতে চলেছে এবার। ফজরের আজানের পর নামাজ সেরে ঘর থেকে বের হন তিনি। ভোরের আলো ঠিকমতো ফুটে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গাঁয়ের এ মাথা ও মাথা অনেকক্ষণ হেঁটে হাঁপ ধরে গেছে তার। চারদিক ফর্সা হয়ে আসলে বিলের ধারে প্রকা- জাম গাছটার নিচে এসে দুই দ- জিরিয়ে নেয় আজাদ মাস্টার।

বিলের শান্ত জলে দৃষ্টি প্রসারিত হলে দেখতে পায়, সকালের কুয়াশায় জলকেলিতে মগ্ন কয়েকটা বুনো পাতিহাঁস। জোর করে ঠাহর করলে ছোট সরালি আর মদনটাকের আবছা ছায়া দেখা যাবে হয়তো। উৎকর্ণ হয়ে তাদের তীক্ষè তবে চাপা আওয়াজ শোনার চেষ্টা করে সে। অনেকদিন পর এক জোড়া রাঙামুড়ি হাঁসের ইতস্তত অনবদ্য বিচরণ তাকে প্রচ-ভাবে মুগ্ধ করে দেয়। বিলের ধারের জংলা ঢোলকলমির ডালগুলোতে কালো ছায়ামূর্তির মতো অন্ধকার করে বসে আছে বিশাল বিশাল পানকৌড়িগুলো। মোহাবিষ্ট হয়ে সেইদিকে চেয়ে থাকে সে।

আনমনে ওদিকে দেখতে দেখতেই ডান চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে আজাদ মাস্টারের। হঠাৎ টনটন করে উঠে জল গড়াতে থাকে ডান চোখ থেকে। ঝাপসা চোখে চেয়ে থাকে নিথর জলের দিকে আর মনের গোপন অন্দরে শিকারের নেশাটাও জানান দিতে থাকে একটু একটু।

সৌখিন পাখি শিকারী সে। পরিবারের একটা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যও আছে পাখি শিকারের। কিন্তু, ছেলে টুকু পছন্দ করে না বলে তার প্রিয় দোনলা বন্দুকটার গায়ে ধূলির আবরণ জমেছে। বেশ অবহেলা ও অযতেœ দেয়ালের গায়ে ঝুলে থাকলেও শোভা বর্ধনের পাশাপাশি পরিবারের গৌরব বৃদ্ধি করছে অসংকোচে। আসলে রেওয়াজ বা ঐতিহ্য ক্ষয়িষ্ণু হলেও ইচ্ছাটার এতটুকু ক্ষয় হয়নি তার। তাই, মাঝে মাঝে টুকু বাড়ি না থাকলে কাঁধে বন্দুক চাপিয়ে আশপাশের হাওড়-বাওড়-বিলে হানা দিয়ে বিলাসী নেশাটা দমনের চেষ্টা করে শুধু।

টুকুর বাবা আজাদ তরফদার পেশায় একজন স্কুল মাস্টার। ভুবনডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিনি। পেশাগত কারণে পাঁচ গাঁয়ে তার যথেষ্ট সুনাম ও সম্মান রয়েছে। তবে সৌখিন শিকারী আর পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া পুরাতন প্রতাপের কারণে পরিচিতি ও নামডাকটা আরেকটু বেশি।

টুকু যখন অনেক ছোট আজাদ মাস্টার তাকে সাইকেলে নিয়ে এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন। আর শোনাতেন তার ছেলেবেলার গল্প। শিকারের রোমাঞ্চকর সব গল্প। তবে তাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য ছিল শিকারী পরিবার হিসাবে। টুকুর দাদারও ছিল নাকি নানান ধরনের বন্দুক। টুকু জানে, বাবার সখ ও নেশাটা উত্তরাধিকারসূত্রেই প্রাপ্ত। তার বাবার শিকার করার যে পুরাতন দোনলা বন্দুকটা ছিল সেটা সে তাদের বসার ঘরের দেয়ালে টাঙানো দেখেছিল অনেকদিন পর্যন্ত। একদিন দেয়াল থেকে বন্দুকটা নামিয়ে হাতে নিয়ে যখন কৌতূহলভরে সে দেখছিল বাবা তাকে বলেছিলেন,

কীরে, শিকারে যাবি?

আমার ভয় করে বাবা।

ভয় কীসের রে? আমি আছি না! যা, একদিন তোরে নিয়ে যাব। আমিও তো অনেকদিন যাই না।

টুকুর ভয় মেশানো সে উত্তরে আজাদ মাস্টার ছেলেকে আশ্বস্ত করতে চায়। অভয় দিয়ে শিকারের অদম্য ইচ্ছা জাগানোর চেষ্টা করে মনে। অন্যদিকে বাবার কথায় টুকুর মনে বিন্দু বিন্দু ইচ্ছাও জাগে। ইচ্ছার সে বিন্দুগুলো ক্রমাগত কৌতূহলের রঙিন বুদ্বুুদ সৃষ্টি করে আবার কল্পনার ফানুস হয়েই হারিয়ে যায়। কারণ, বাবার জগত আর টুকুর জগত ভিন্ন। তার মন থেকে উদ্দাম তাড়না আসে না। শুধু বাবা কীভাবে পাখি শিকার করে এটা দেখতে আগ্রহ হয় তার।

টুকুর কিশোর মনে নানা প্রশ্ন আঁকিবুঁকি কাটে, অনেক কৌতূহল উঁকি দিয়ে ঝুপ করে ডুব দেয় আবার। তার সত্যি ভালো লাগে না বাবা কেন পাখি শিকার করে? তারপরও শিকারী বাবাকে দেখার খানিকটা ইচ্ছা জাগে তার। আসলে পাখি শিকারের চাইতেও খোলা আকাশে পাখির অবারিত ছোটাছুটি তাকে ভীষণভাবে টানে। তালুবন্দী শৈশবে এটাই ছিল টুকুর চাওয়া। তাই বাবার কাছে সে বায়না ধরে যেন তাকে দূরের কোনো বিলে পাখি দেখাতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়েই তারা পাখির দুরন্তপনা দেখবে, সাথে হয়তো পূরণ হবে বাবার পাখি শিকারের লুকিয়ে থাকা সখ।

২.

আজাদ মাস্টারের হাতের নিশানা ভালো। এক টিপেই সে কাবু করতে পারে উড়ন্ত পাখিকেও। আগে মাঝে মাঝে যখন ঝোঁক উঠত বাড়ির পেছনের তাল গাছের বাবুই পাখির বাসার দিকে নিশানা তাক করে চাঁদমারি বানিয়ে অকারণ গুলি ছুঁড়ত। হঠাৎ গুলির শব্দে হলদে বাবুই পাখিগুলো ভয় পেয়ে এদিক ওদিক ডিগবাজি খেয়ে আকাশে উড়ে যেত। ফিরে আসত অনেক পরে, হয়তো দুরু দুরু বুক নিয়ে। টুকু দূর থেকেই তাদের নরম বুকের ধুকপুকানির আওয়াজ শুনতে পেত। এক গভীর মায়া নিয়ে সে শুধুই ভাবত, বাবা খেয়ালের বশে কেন এসব করে? কত কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছিল সে। বাবা কোনো নিষেধ বারণ শুনেনি।

বাবা যখন স্কুলে বা কাজে বেরিয়ে পড়তেন টুকু ভোঁ দৌড় দিয়ে চলে যেত বাড়ির পেছনে। হয়রান হয়ে গাছতলায় খুঁজে বেড়াত পাখির ঝরা পালক আর পরম মমতায় ও যতেœ সেগুলো আগলে রাখতো নিজের কাছে। তার একান্ত নিজস্ব জগতে। শৈশবে তার গোপন গ-ীর অনুষঙ্গ ছিল সেই কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদগুলো।

টুকুদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে সেই পলাশডাঙ্গার কাছে একটা বড় বিল রয়েছে। নীল ঝিনুকের বিল। একবার শুনেছে সেখানে পাখি পড়েছে অনেক। কত দেশ থেকে আসা শীতের সব পরিযায়ী পাখি। হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে অতিথির মতো তারা এসেছে সেখানে। নানান রঙের পাখি দেখবে বলে টুকুর সারারাত একদম ঘুম হয় না। একটা চাপা উত্তেজনা আর অস্থিরতা বোধ করে সে। পাশাপাশি বাবার পাখি শিকারের কথা মনে করে কৌতূহলটাও বেড়ে ওঠে তুঙ্গে। তবে তার ছোট্ট মনের গোপন গহ্বরে বিষাদের এক টুকরা কালো মেঘও সাথে সাথে জমতে শুরু করে।

একদিন ভোরের আগে কিছুটা অন্ধকার থাকতেই টুকু আর আজাদ মাস্টার দোনলা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মোটর সাইকেলে শব্দ তুলে কয়েক মাইল পথ পেরিয়ে গ্রামের আঁকাবাঁকা ইটের রাস্তা ফেলে তারা পৌঁছে যায় বিশাল এক বিলের সামনে। এটাই নীল ঝিনুকের বিল। দিঘে আর প্রস্থে একেবারে বিশাল একটা বিল। শীতকালেও বিলের বুকে টলমল করছে কালচে নীল রঙের পানি। ভোর হতে এখনও অনেক বাকী। বিলের দৈর্ঘ্যরে উত্তর প্রান্তে একটা ইট সুড়কির স্থাপনা।

ওটা কী বাবা?

মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। টুকুর জিজ্ঞাসায় আজাদ মাস্টারের প্রত্যুত্তর আসে। যেসব জেলেরা এই বিলে মাছ শিকার করে মাছ ধরার পর তারা এখানে সব জড়ো করে। তারপর এখান থেকে ওজন করে সকালের হাটে হাটে মাছ চলে যায়।

বাবা, এখানে কারা থাকে?

এখানে মাছ ধরার লোকজন থাকে টুকু। হালকা বিরক্তি নিয়ে আজাদ মাস্টার ছেলেকে চুপ করতে বলে নিজেও চুপ করে যায়।

টুকু আর কিছু বলে না। শুধু বাবাকে অনুসরণ করে। বারো বছরের শান্ত ছেলে টুকু। প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে অপেক্ষা করছে নতুন বছরে নতুন শ্রেণিতে ভর্তির জন্য। তাই তো এখন তার হাতে অনেক সময়। খেলাধুলা আর বই পড়ে কাটিয়ে নিচ্ছে ছুটির এ সময়টা। আর ফাঁক পেলেই বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে। ছুটির এ অবসরের মাঝে তার অনুসন্ধিৎসু মনে তাই জড়ো হয় হাজারো প্রশ্ন, চোখভরা অসীম কৌতূহলে জানতে চায় চারদিকের সবকিছু।

প্রসারিত বিশাল ডানায় কী একটা পাখি যেন ঝুপ করে ছুঁয়ে গেল শান্ত জলের বুক। অন্ধকারে ঠিক অনুমান করা যায় না। ধলাবুকের ডাহুক নাকি? নাকি কোনো সরালি, না কোনো কালো রঙের পানকৌড়ি। শীতের এইসব জলচর পাখির নাম শুনেছে টুকু। আরও আছে মদনটাক, গগনবেড়, শামুকখোল। একটা পাখি টুকু বেশ ভালো করেই চিনে। তা হলো সাদা বক। সে অবশ্য জানে না বাবা আজ কী পাখি শিকার করবে?

অবতরণ কেন্দ্রের পাকা সিঁড়িতে টুকুকে বসিয়ে রেখে আজাদ মাস্টার উধাও হয়ে যায়। কয়েক দণ্ড ঠায় বসে থেকে টুকুর কেমন যেন আলসেমি লাগে। তাই সে আপন মনে ছড়া কেটে যায়।

কাদা মেখে সাদা বক, এক পায়ে দাঁড়িয়ে,

জলপিপি দল ছুটে কোথা গেছে হারিয়ে?

চখাচখি, পানকৌড় ডুবজলে নাবছে,

ধলাবুক ডাহুকটা তাই দেখে ভাবছে।

বুড়ো ছাতিমের ফুলের উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধে আরও অস্থির হয়ে যায় সে। এদিকে সিঁড়ির উপরের ঘর থেকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বের হয় ওসমান। সে এই কেন্দ্রের পাহারাদার। ভোরবেলায় কথার আওয়াজ শুনে বিরক্তি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে।

এত সকালে এইখানে কী কর তোমরা? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে সে।

পাখি দেখতে আসছি আমরা। পাল্টা উত্তর টুকুর।

খবরদার মাছে হাত দিবা না।

আমরা মাছ ধরি না; পাখি শিকার করি।

সরকার জানতে পারলে তোমাদের জেলে নিব।

সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দিয়ে ওসমান আবার ঘরের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়। শিকার করাটা অন্যায়, ছোট্ট মাথায় এই কথাটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে সে। টুকু এরপর একা একা বসে থাকে অনেকক্ষণ।

নীল ঝিনুকের বিলটা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। কুয়াশার ফাঁকে আবছা যতটুকু দেখা যায় তাতে মনে হয় সামনে রাস্তার অংশ বাদ দিলে বিলের বাকী তিন পাশেই মসুর কলাইয়ের ক্ষেত। মাটি ফুঁড়ে পেঁয়াজের কালি উঠেছে ঠিক দক্ষিণ পাশের ক্ষেতেই। টুকু চুপচাপ শান্ত বিলের দিকে চেয়ে থাকে আর বাবার জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করে।

পুব আকাশে অরুণ আলোর হালকা আভা ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে মাছের ঘাই দেখা যায় ঘাটের আশে পাশে জলের অগভীর বুকে। এতে হালকা একটা ঘূর্ণি তৈরি হয়ে আবার তা মিশে যাচ্ছে জলের বুকেই। জলের উপর জলের নকশার আঁকিবুঁকি। এই শীতেও বিলে থৈ থৈ করছে জল। সেই অতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কতখানি জল আছে তা পরিমাপ করার চেষ্টা করে টুকু। কিন্তু, চেষ্টা শুধু চেষ্টাই থেকে যায়। তার ঠিক সামনে বিলের অপর প্রান্তে কয়েকটা বাঁশঝাড়। অনেকক্ষণ পর সে খেয়াল করে সেখানে অনেক সাদা সাদা বক। আর কালো পানকৌড়ির বসত। সে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে সেদিকে।

হঠাৎ বন্দুকের গুলির আওয়াজ ভোরের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙে দেয়। টুকু কিছুটা ভয় পেয়ে জল ছুঁয়ে থাকা সিঁড়ি বেয়ে ত্রস্ত পায়ে উপরে উঠে আসে। তারপর বাবাকে দেখতে পেয়ে একেবারে বড় ছাতিম গাছটার তলায় এসে দাঁড়ায়। দূর থেকেই দেখা যায় আজাদ মাস্টারের মুখে প্রসন্ন হাসি। টুকুর কাছাকাছি আসতেই সকল উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে উচ্চকিত কথার আওয়াজে।

বুঝেছিস টুকু, একেবারে চোখ নিশানা করে গুলিটা মেরেছি। চল, পাড় দিয়ে হেঁটে বিলের ও প্রান্তে যাই। মনে হয় বড় কোনো পাখি হবে।

বাবা হাত দিয়ে ইশারা করে বিলের অন্য পাড়ে যেতে বললে টুকুও আস্তে আস্তে বাবার অনুগামী হয়। আসলে টুকুকে একা বসিয়ে রেখে আজাদ মাস্টার এতক্ষণ ধ্যানী বকের মতো বিলে আশ্রয় নেয়া একটা বড় পাখিকে লক্ষ্য বানায় শিকারের। ওটাকে টার্গেট করেই এতক্ষণ পর তার সফলতা এসেছে। আগুনে বাজ যেমন ছোঁ মেরে মাছ ধরে উঠে যায় অনন্ত আকাশে বাবাও ঠিক তেমনি করে পাখিটাকে শিকার করে নিল চোখের পলকে। কী অব্যর্থ নিশানা। অথচ পাখিটা নয়, আজ সত্যিকার চাঁদমারি হয়ে টুকুই ছটফট করছে শুধু। গুলিটা তার বুকেই বিদীর্ণ হলো এইমাত্র যেন। বিলের ঐ পাড়ে গিয়ে টুকু দেখল যে পাখিটা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে ডানা ঝাপটে মরছে। বাবার প্রতি অভিমানে চোখে জল আসে। কিছুটা রাগ আর ক্ষোভও হয় তার। কিন্তু, আজাদ মাস্টারের উচ্ছ্বাসে জোয়ার বয়ে যায়।

আরে, এ তো শামুকখোল। কী বিশাল, দেখেছিস টুকু।

টুকু কোনো কথা বলে না। এক দৃষ্টে পাখিটার ছটফটানি দেখতে থাকে। আর থির দৃষ্টিতে বাবাকে দেখে নেয় সাবধানে। হঠাৎ করে কেমন যেন অশ্রদ্ধা উঠে আসে বাবার প্রতি।

চল, সকাল হয়ে আসছে। আজ বাড়ি ফিরে যাই। অন্যদিন আসা যাবে।

টুকুর প্রচ- মন খারাপ হয়। তাই আর কিছু না বলে বাবাকে অনুসরণ করে চলে আসে বিলের সামনের ইট বিছানো রাস্তায়। বড় একটা থলেতে পাখিটা ঢুকিয়ে নিয়ে মোটর সাইকেলে বাবার পেছনে বসে বাড়ির পথ ধরে টুকু। কিছুক্ষণের জন্য ল-ভ- হয়ে যাওয়া বিলের শঙ্কিত বসতিটার উপর তার একখ- মায়া পড়ে থাকে অজান্তে। যা তার মনেও প্রচ- দাগ কাটে সকলের অগোচরে। নিষ্পাপ বিহঙ্গের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা অবচেতনে প্রচ্ছন্ন একটা ঘৃণারও জন্ম দেয় টুকুর ছোট্ট মনে।

৩.

চাঁদবিল গ্রামেই শৈশব কাটে টুকুর। গ্রামের মায়া ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার পাঠ শেষ করলেও তেমন কোনো চাকুরী যোগাতে পারেনি। ছোটখাট ঠিকাদারি করে সে। হয়তো একদিন তার কাজের জমজমাট পসার হবে। বড় বড় কাজের ঠিকাদারি পাবে সে। এই তো গত বছর বাবার স্কুলের একতলা ভবন নির্মাণের বড় কাজটা পেয়েছিল সে। সদরের বড় খামারের অর্ধ কোটি টাকার কাজটা বাগানোর জন্য বড় বড় নেতার কাছে ধর্ণা দিচ্ছে এখন।

আজাদ মাস্টার অবসরে গিয়েছেন সদ্য। অখ- তার অবসর। শিকারের সেই পুরানো নেশাটা মনের ভেতর ছোঁক ছোঁক করে এখন আরও জেঁকে বসেছে তার উপর। তবে টুকুর জন্য সাহস হয় না। মাঝখানে এতগুলো বছর কেটে গেল অথচ টুকুকে তিনি আর কোনোদিন সঙ্গী করেনি শিকারের। টুকুও নিজে থেকে কোনোদিন যেতে চায়নি। তবে একদিন বাবা টুকুর কাছে আবদার করেছিল নতুন একটা পাখি শিকারের দোনলা বন্দুক এনে দিতে। পুরানোটা এখন আর তেমন কাজ করে না। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরে এসে সেও আর ভাবেনি শৈশবের সেই দেয়ালে ঝুলানো বন্দুকটাকে নিয়ে। আগে মাঝে মাঝে যেটাকে তার শত্রু মনে হতো। কিন্তু, মুখ ফুটে কখনও বাবাকে তা বলতে পারেনি।

মা মাঝে মাঝে বলতেন; খবরদার এই বন্দুক ধরবি না। এটা তোর বাবার অনেক সখের জিনিস। মায়ের সেই অনুশাসনে হালকা সোহাগ মাখানো বারণ ছিল হয়তো। তবে টুকুর মন থেকেই ধরতে ইচ্ছা হয়নি কখনও। মায়ের শাসন মাখা সেই নিষেধের মধ্যেও মাঝে মাঝে এই বন্দুকটাকে চাঁদবিলের গভীর জলে ফেলে দিতে ইচ্ছা হতো তার। শৈশবের প্রথম শিকারের স্মৃতি তার মনে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল এতকাল পরেও তা একটা কালো রেখার মতো আঁচড় কেটে রেখেছে।

শিকারের নেশা কোনোকালে টুকুর তেমন ছিল না। তারপরও পাশের গ্রামের স্কুল সহপাঠী আনিসের জোরাজুরিতে তার সাথে একবার গিয়েছিল অনেক দূরের একটা গ্রামে। কিন্তু, তা ছিল শুধু নতুন পাখি দেখা ও চেনার দুর্নিবার আগ্রহ ও রোমাঞ্চে। সেখানে গিয়ে সে তার বন্ধু আনিসকে কোনোভাবেই পাখি শিকার করতে দেয়নি। সারারাত ধরে তারা একটা গাঙের কাছে বাঁশের পাটাতনে বসে আড্ডা দিয়েছিল আর বুকভরে নিয়েছিল ফুরফুরে বাতাসের দম। চাঁদের নরম আলোয় অপাপবিদ্ধ মন নিয়ে বিলের বুকে দেখেছিল জলপাখিদের অবাধ বিচরণ। সেদিন চাপা একটা আত্মগ্লানি খামচে ধরেছিল তাকে। তার কালো ছায়া ক্লান্ত ও কাবু করে তুলেছিল অকারণে।

সেদিন ভোর হবার আগেই বাড়ি ফেরার জন্য অদ্ভুত তাড়া শুরু করেছিল টুকু। বাধ্য হয়েই শিকারের ইচ্ছা ত্যাগ করে বন্ধুর সাথে সওয়ার হয় আনিস। নিভৃত গাঙের বুকে সারি সারি বকের ধ্যানমগ্নতা টুকুকে আত্মনিবিষ্ট হতে শিখিয়েছিল সেদিন। তার মধ্যে নিবিড় জীবনবোধ ও অপার সহিষ্ণুতা এনে দিয়েছিল জীবন যাপনের পরবর্তী দিনগুলোতে।

আজাদ মাস্টারের দীর্ঘদিনের সখ ছিল একটা নতুন বন্দুকের। বাবার সখ মিটানোর জন্য তাই টুকু একদিন একটা দোনলা বন্দুক কিনে আনে। অনেক ঘোরাঘুরি করে লাইসেন্সও করিয়ে নেয়। নতুন বন্দুক হাতে পাওয়ার পর আজাদ মাস্টারের চোখে সীমাহীন খুশির ঝলকানি খেলে যায়। ঠিক এমন খুশি অনেক আগে সে একবার দেখেছিল পলাশডাঙ্গার সেই নীল ঝিনুকের বিলের ধারে। যেদিন বাবা একটা শামুকখোলের চোখ বিদ্ধ করেছিল অব্যর্থ নিশানার শিকারী গুলিতে। স্মৃতি হাতড়ে টুকু তা খুঁজে বের করে। বাবার চোখে চোখ রেখে অনুনয় করে তাকে।

বাবা, একটা শর্ত আছে তোমার জন্য।

কীসের শর্ত আবার?

এটা শুধু তোমার সখের জন্য এনে দিলাম। কিন্তু, তুমি এটা দিয়ে আর শিকারে যেতে পারবে না।

ঠিক আছে। তুই যেহেতু বলছিস, তোর কথাই সই। আমি আর কোনোদিন কখনও শিকারে যাব না। নে, যত্ন করে রেখে দে ট্রাংকের ভেতর। বাবার আশ্বস্ত জবাবে শান্ত হয় টুকু।

আজাদ মাস্টার বুঝতে পারে সেই দিনের কথা টুকু আজও ভুলতে পারেনি। কারণ, টুকুর এই সিকি শতাব্দীর জীবনে সে প্রায়ই বাবাকে শৈশবের সেই স্মৃতির কথা জিজ্ঞেস করে আত্মগ্লানিতে আচ্ছন্ন করে দিত। টুকু ভাবে, বাবা কেন তার মতো করে ভাবতে পারে না। একটা জীবন কেড়ে নিয়ে কী এমন আনন্দ পায় বাবা! এটা কি শুধু তার পারিবারিক পুরাতন ঐতিহ্য রক্ষা করে জাহির করবার একটা প্রচেষ্টা? নাকি অন্যকিছু, যা টুকু জানে না।

অনেক রাত পর্যন্ত বাবা আর ছেলে জেগে থাকে সেদিন। বাবার কাছ থেকে ছেলেবেলার অনেক গল্প শুনে টুকু। নতুন বন্দুক হাতে পেয়ে বাবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠা মুখ দেখে টুকুর কেমন জানি অচেনা অন্যরকম লাগে তাকে। পুরানো সেই নেশা তাকে আবার পেয়ে বসেছে এটা সে সহজেই বুঝতে পারে। তাই দীর্ঘদিন পর টুকুর তন্দ্রাহীন বাস্তবতায় পুরানো স্মৃতিগুলো আবার ফিরে আসে।

রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় টুকুর। জানালা দিয়ে এক টুকরো জোছনা ঢুকেছে তার চৌকির উপর। সাদা চাদরের উপর চাঁদি আলোর এক চোখ ধাঁধানো আবহ তৈরি হয়েছে। জানালার গরাদের শিকগুলো বিছানার উপর অপরূপ এক জাল বিছিয়েছে। বাইরে শীত রাতের হালকা হাওয়া বইছে।

ধবল জোছনায় জানালার পাশে সে হঠাৎ দেখে যেন সেই পাখিটাকে। শরীরের রোম খাড়া হয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠা-া হিমশীতল অনুভূতি গড়িয়ে যায়। চমকিত হয়ে ভাবে, এ কী করে সম্ভব? এ কি আসলে সত্যি?

শৈশবের যে দুঃসহ স্মৃতিকে সে মন থেকে একেবারে মুছে দিতে চেয়েছিল ছায়ামূর্তির মতো হঠাৎ তার আগমনে শঙ্কিত হয় টুকু। বেশ ক’দিন ধরেই ঘুমের ঘোরে পাখিটাকে দেখছে সে। লম্বা ঠোঁটে কী যেন বলতে চাইছে তাকে। কথাগুলো অস্ফুট, অর্ধস্ফুট। এটা কি চোখের ধাঁধা, নাকি কোনো মায়াবী ইন্দ্রজাল তা টুকু জানে না। এটা কি তার অন্তরের কোনো গোপন কুঠুুরিতে বাস করছে এখনও; সেটাও সে জানে না।

আধো ঘুম আধো তন্দ্রা এবং কিছুটা অস্থিরতা নিয়েই বিছানা ছাড়ে টুকু। তার মনে পড়ে শিকারের সেই দিনটির কথা। আজ এক যুগ পেরিয়েও কেন সেই স্মৃতি বিস্মরণ হলো না তার? ভাবনার এই জটিল জাল বিছিয়ে রেখে সে ঘরের চার দেয়ালের গ-ীর মধ্যে ঘুরপাক খায়। বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে দেখে বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো পুরাতন বন্দুকটা সেখানে আর নেই। যেটাকে আশৈশব তার শত্রু মনে হতো। মাঝে মাঝে বাবার সাথে দূরত্বের একটা প্রচ্ছন্ন দেয়াল মনে হতো এটাকে। বুকের ভেতরটায় ধক করে ওঠে তার।

ফজরের আজানের কিছু আগে টুকু নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে দেখে বাবা সত্যিই তার ঘরে নেই। টুকু জানে, শীত-বর্ষায় শিকার করা বাবার পুরানো একটা সখ ও নেশা। গেল দুই শীতে খুব একটা জুত করতে পারেনি সে। তাই শিকারের লোভে মধ্য পউষের এই কুয়াশামাখা সকালে নিশ্চয় বেরিয়ে পড়েছে চাঁদবিলের ধারে। রক্তে মিশে থাকা সেই নেশা নিশ্চয় তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আবার। তাই পুরানো বন্দুকটা নিয়েই হয়তো বেরিয়ে পড়েছে আবার শিকারে। খুব বীতশ্রদ্ধ হয় সে। মনের ভেতরে একটা খচখচানি নিয়ে খুব ভোরবেলাতেই কাজে বেরিয়ে পড়ে সে।

৪.

কুয়াশার ভোরে হাঁটতে হাঁটতে টুকুর মনে পড়ে যায় ছোট বেলার দিনগুলোর কথা। পদ্মাকর বিলের বুকে বরষার আগে আগে প্রচুর খয়েরী নীল শালুক ফুটত। ভাসমান পাতার ফাঁকে জলপিপিদের লম্বা ঠ্যাঙে নাচতে দেখা যেত। জলপাখিরা মেতে উঠত গানে। কুয়াশার এই ভোরে সেই কথা মনে করে আনমনেই টুকু বলে ওঠে,

বাড়ির পাশে শালুক ঝিল

শালুক ফোটে খয়েরী নীল

শৈশবের কথা মনের ভেতর উঁকি দিলে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায় টুকু। মনের অলিগলিতে হামাগুড়ি দিতে থাকে কল্পনার সেই শামুকখোল পাখিটা। তখন ছায়াছবির মতো সেসব স্মৃতি মনে পড়ে যায় তার। টুকুর নিত্যদিনের কাজের মাঝে শামুকখোলটা দিন দিন দৃশ্যমান হয়ে কথা বলে যাচ্ছে। প্রতিদিন দেখা দিয়ে তার সাথে আচরণ করছে একেবারে ছায়াসঙ্গীর মতো।

কী যেন মনে করে আবার বাড়ি ফিরে আসে টুকু। বাবাকে সখ করে কিনে দেয়া দোনলা বন্দুকটা স্টিলের ট্রাংকের ভেতর থেকে বের করে নেয়। সাবধানে গুলি ভরে নিয়ে কিছু একটা মনস্থির করে ঘর থেকে বের হয় সে। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের তাড়না অনুভব করে শিহরিত হয়। টুকু আজ শিকার করবে মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা সেই শামুকখোলটাকে। যে কারণে অকারণে বেলা অবেলায় তাকে উপদ্রব করে যাচ্ছে। উদভ্রান্ত করে চলেছে, বিদ্রুপ করে চলেছে কিংবা ক্ষত বিক্ষত করে চলেছে অনবরত।

ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে চাঁদবিলের উঁচু পাড়টায় এসে বসে সে। বুনো ঝোপঝাড় আর গাছের ফাঁকে বুড়ো জাম গাছটা রয়েছে এখনও। চাঁদবিলের যে প্রান্তে চাঁদবিল গ্রামটা তার প্রায় তিন দিকেই বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর মুগ মসুরের চৈতালি। কী মুগ্ধ করা এই প্রকৃতি, এই সকালের ¯িœগ্ধতা। কিন্তু, শান্ত সকালের সৌম্য প্রকৃতি কিছুতেই তার অস্থির মনকে অবদমন করতে পারে না।

চারদিকে কুয়াশার চাদর। তার মধ্যেই কাঁধে নতুন বন্দুকটা নিয়ে শিকারের মিথ্যা নেশায় বের হয় টুকু। কুয়াশায় এপার থেকে ওপারে কিছুই দেখা যায় না। কু-লী পাকিয়ে পাকিয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছে অলস কুয়াশাটা। ভোর হয়নি এখনও। তবে হালকা হালকা আলো ফুটছে চারপাশে।

টুকু সোজা গিয়ে বুড়ো জামগাছটার নিচে বসে। ভোরের কিছু পাখি ডাকতে থাকে দিন শুরুর জানান দিয়ে। সে ভাবে কোথায় গেল শামুকখোলটা? কাল রাতেও তো সে দেখেছিল তাকে। সেটা কি সত্যিই বাস্তব ছিল? না পুরোটাই তার অলীক কল্পনা। চারপাশে চোখ মেলে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে টুকু। দৃষ্টি আরও প্রসারিত হলে কুয়াশার বুক চিরে দেখা দেয় সেই পাখিটা। শিকারের উদগ্র বাসনা হয় তার। কাঁধে তুলে নেয় দোনলা বন্দুকটা।

বিলের উঁচু পাড়ের প্রকা- জাম গাছের বিস্তীর্ণ বাহু থেকে বের হয়ে একেবারে নিথর জলের কাছে নেমে আসে সে। দৃষ্টি খুঁজে বেড়ায় তন্দ্রাহীন আর স্বপ্নের ধাঁধার মাঝে আসা পূর্ব রাতের সেই ছায়া আগন্তুককে। শরীরী ছায়ার মতো যে অনুসরণ করে চলেছিল তাকে এতদিন। টুকু এদিক ওদিক তাকিয়ে ঠিক দেখতে পায় পাখিটাকে। আর তখুনি নিশানা তাক করে গুলি ছোঁড়ে। হঠাৎ গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয় চারপাশ।

চারপাশের বুনো পাটির ঝাড় আর বড় বড় যজ্ঞডুমুরের গাছগুলো হতে শীতের পরিযায়ী পাখিগুলো আঁতকে উঠে অস্থির কলরব জুড়ে দেয়। কালো পানকৌড়িগুলো উড়ে যায় এলোমেলো। কয়েকটা ডানা মেলে আকাশে। কোনোটা আবার নতুন ভোরের অপেক্ষা করে শান্ত হয়ে যায় শেষে।

কুয়াশার আস্তরণ হালকা হয়ে আসলে চকিতে তার ঘোর কেটে যায়। বিলের অপর প্রান্তের ঘাটের কাছের মাটির রাস্তায় আবছামতো অচেতন কাউকে পড়ে থাকতে দেখে। বোধ ফিরে আসার আগেই হাঁটুজল উপেক্ষা করে এঁদো কাদার মধ্যেই রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যেতে চায়। হতবল হয়ে ছুটে যেতে চায় সেখানে।

বন্দুকটা ফেলে কাদাজলে একেবারে মাখামাখি হয়ে টুকু দৌড়ে এগিয়ে যায়। চাঁদবিলের ঘাটের একেবারে ও প্রান্তে। ঘাটের কাছে যাওয়ার আগেই টক্কর খেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। এ সে কী করেছে? এ ভুলের মাশুল কী? ঘাটের দিকে মাথা দিয়ে পানিতে অর্ধেকটা শরীর ডুবে আছে তার বাবা আজাদ মাস্টারের। আর অন্য পাশে পড়ে রয়েছে তার দীর্ঘদিনের সাথী সেই পুরানো বন্দুকটা। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে টুকু হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিথর শরীরটার কাছে।

সংজ্ঞাহীন আজাদ মাস্টারের ডান চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে অবিরত। রক্তের সেই ধারা শান্ত জলের বুকে মিশে ভোরের আকাশকেও রাঙিয়ে দেয়। সেখানে বসেই টুকুর বুকে অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে। গুলিটা যেন লেগেছে তারই বুকে। আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে থাকে সে। আকাশ কাঁপিয়ে অঝোরে কাঁদতে ইচ্ছা হয় তার। তার বুকের গভীর কষ্টটা মোচড় দিয়ে দিয়ে গলা পর্যন্ত উঠে আসে।

শান্ত বিলের ধারে চারপাশের নিস্তব্ধতার মাঝে সে তার বুকের ধুকপুকানি শুনতে পায় স্পষ্ট। এক পর্যায়ে তার বুকের ধুকপুকানির আওয়াজ আরও বেড়ে যায়। সেই আওয়াজের মধ্যে উদভ্রান্ত বেদনাহত টুকু গত রাতের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করে। যেখানে ঘুমের মধ্যে শামুকখোল পাখিটা তাকে কী যেন বলতে চেয়েছিল ফিসফিস করে।

মঈনুল হাসান। কথাসাহিত্যিক ও ছড়াকার। ১৯৭৮ সালের ৪ আগস্ট (বাংলা ২০ শ্রাবণ, ১৩৮৪ বঙ্গাব্দ), ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার তেজগাঁওয়ে শৈশব কাটলেও পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলায়। বাবা মরহুম মোঃ আব্দুল আউয়াল এবং মা বেগম শামসুন নাহার। বটমলী হোম বালিকা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..