শিখণ্ডী পুরাণ

মঈনুল হাসান
গল্প
Bengali
শিখণ্ডী পুরাণ

সময়টা পাঁচ বছরেরও কিছু কাল পরে। বিন্দুগঞ্জের ফেরিঘাটের কাছে আষাঢ়ের এক মধ্য দুপুরে হঠাৎ তার সাথে দেখা। দেখা মানে সম্মুখ সাক্ষাৎ নয়, শুধুই দূর থেকে বিস্ময়ভরে দেখা। আর দেখামাত্রই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে হাফিজ। কে জানত, সময়ের পরিক্রমা এত নিষ্ঠুর, এমন দুর্বহ হবে?

মুখের আদল অবিকল সেই রকমই আছে। তবে কিছু রুক্ষতা এসে ভিড় করায় আশ্চর্য এক বৈপরীত্যের ছায়া স্পষ্ট হয়েছে তার চেহারায়। সময়ের জের ধরে পরনের বেশভূষাও আগের চেয়ে পাল্টে গেছে অনেক। রঙমাখা ঠোঁট-গাল কিংবা উৎকট প্রসাধনমাখা মুখের চাকচিক্য দেখে হোঁচট খেতে হয়। গলার স্বর অস্বাভাবিক রকমের ভারী ও কর্কশ শোনা যায় দূর থেকে। দেখে-শুনে চেনার জো না থাকলেও হাফিজের হোঁচট খাওয়া দৃষ্টি বার বার সেদিকেই চেয়ে থাকে।

বাসের জানালা থেকে মুখ বের করে বকের মতো গলা উঁচিয়ে একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকে হাফিজ। বাইরের জটলার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে এক মনে, খুব নিবিষ্ট হয়ে। ঠিক সামনের বাসের যাত্রীদের সাথে ওই অচেনা আগন্তুক দলটির কী নিয়ে যেন গোলমাল চলছে ভীষণ। সেই নিয়ে সৃষ্ট তুমুল শোরগোল ঘাটজুড়ে অপ্রয়োজনীয় একটা জটলার সৃষ্টি করেছে।

আকাশের মেজাজ তেমন ভালো নয়। অকারণে তার মুখ কালো থমথমে হয়ে আছে সকাল থেকে। তার চেয়েও বেশি ভার হয়ে আছে হাফিজের মুখ। কারণ, ইতোমধ্যে তার অস্থির মন-মস্তিষ্ক অনেক পুরানো কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে। ঘাটের হৈ-হট্টগোল ও তীব্র জনজটের মধ্যে একঘেঁয়ে বসে থেকে তার উৎসুক মন বার বার ডুব দিচ্ছে পাঁচ বছর আগের সেই দিনগুলোর দিকে। অনেক জটিল হিসাবের উত্তর মেলানোর জন্য তার মন উদ্বেলিত হয়ে উঠছে বার বার।

আকাশ গুড়গুড় করে বৃষ্টি নামার পাঁয়তারা চলছে বাইরে। গরম ভাপ ওঠা একটা বাতাসের দমক বাসের ভেতর উঁকি দিয়ে যায় মুহূর্তে। ভেতরের গুমোট গরমে কেমন হাঁস-ফাঁস লাগে হাফিজের। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানালার কাঁচের গায়ে বৃষ্টির ছাঁট লেগে বাইরের পৃথিবীর মধ্যে হালকা পর্দা টেনে দেয়। আর তখনই আরও উসখুস করে ওঠে হাফিজের মন। ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাসের সিট থেকে উঠে নিচে নেমে পড়ে সে। গুটি গুটি পায়ে সলজ্জ সংকোচে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় জটলাটির দিকে।

এলোমেলো বৃষ্টি বা বাতাসের তোড় কোনো কিছুতেই মনোযোগ নেই ঘাটের লোকজনের। উৎসুক জনতা, বাসযাত্রীসহ পথচলতি সকল উটকো মানুষের যাবতীয় মনোযোগ পাঁচজনের আগন্তুক দলটিকে ঘিরে। অকস্মাৎ এ হৈ চৈ এর মূল কারণ, তৃতীয় সত্তার অন্তরাল নিয়ে বেঁচে থাকা হিজড়া নামের এ মানুষগুলো নাকি জোরপূর্বক যাত্রীদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে টাকা দাবী করছে। ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তেজিত কোনো এক বাস যাত্রীর সাথে এ নিয়ে সামান্য হাতাহাতিও হয়েছে। এ নিয়েই চলছে উচ্চৈঃস্বরে বাকবিতণ্ডা।

হাফিজের মন অন্য কোনোখানে নয়; তার দৃষ্টি ঠায় নিবদ্ধ হয়ে থাকে শুধু একজনের দিকে। যেন কতদিনের পরিচিত মুখ। হাফিজ ভালো করে লক্ষ্য করে, বাইরের পৃথিবী এখন তার কাছে মুখ্য নয়; তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়সহ সমগ্রকিছুই হারিয়ে গেছে ছোট্ট একটা ঘটনার দিকে। ভিড়ের আওয়াজ তার কানে আসছে না মোটেই। সে শুধু অপলক চেয়ে থাকে নীল পোশাক পরিহিত ঢ্যাঙা লম্বা ফর্সামতো মানুষটির দিকে।

ভিন্ন সত্তার কারোর মাঝেও যে এমন মায়াকাড়া মুখের আদল লুকিয়ে থাকতে পারে, এ কথা ভেবে শিহরিত হয় হাফিজ। আর হবেই তো, মুখটা যে খুব অপরিচিত কারো নয়। কিন্তু, বাস থেকে নেমেও ভিড়ের চাপে বেশি দূর এগোতে পারে না সে। আবার ভিড় থেকেও কেউ লক্ষ্য করে না তাকে। আর কেনইবা লক্ষ্য করবে? তাদের কারো তো হাফিজকে চেনার কথা নয়!

এক সময় ভিড় স্তিমিত হয়ে আসলে সেই পাঁচজনের দলটি হাফিজের চোখের সামনে দিয়ে দ্রুত বেগে হেঁটে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। হারিয়ে যায় একেবারে তার দৃষ্টিসীমানার অগোচরে।

এক বেদনাহত মানুষের আর্তি নিয়ে হাফিজের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। অপ্রাপ্তির এক শূন্যতা আপাদমস্তক তাকে বিবশ করে রাখে। অদ্ভুত এক অস্থিরতা ধারণ করে রাজধানীর পথে অগ্রসর হয়ে যায় তার বাসটা। তবে তার দ্বিধান্বিত মন ফিরে ফিরে যেতে চায় বিন্দুগঞ্জের ঘাটের কাছে। কী যেন ফেলে এল সে! একটা রক্তের পরম্পরা, অদৃশ্য মায়ার টান নাকি অন্য কোনো কিছু?

হাফিজের অশান্ত মনে যে ঝড়ের তাণ্ডব সৃষ্টি হয় তাই যেন তুমুলভাবে আছড়ে পড়তে থাকে বাইরের প্রকৃতিতে। দমকা বাতাসে মুহুর্মুহু কেঁপে কেঁপে ওঠে চারদিকটা। নোনা অশ্রুবিন্দুর প্লাবন তার চোখদুটো ঝাপসা করে দেয়। তার বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বেদনার নীল রঙ মনের অলিগলি উপচে ছাপিয়ে যায় বাস্তবের বাহ্য জগতে। আত্মগ্লানিমাখা এক অপরিসীম বিষাদ নিরুপায় হয়ে বিচরণ করতে থাকে হাফিজের আকাশ পাতাল জুড়ে।

ছুটন্ত বাসটা অনেকদূর চলে এলে কী যেন মনে মনে ভাবে হাফিজ। বৃষ্টির মধ্যেও জানালা খুলে পেছন ফিরে একবার চায় সেদিকে। কই না তো! কেউ নেই পেছনে। কাউকে দেখা যায় না। এক সময় দৃষ্টির সীমানা বিন্দুতে পরিণত হলে বৃষ্টির ছাঁটের সাথে সংশয়মাখা অশ্রুকণাকে মিলিয়ে দিয়ে কিছুটা হালকা করে নিতে চায় নিজেকে। বাসটা ততক্ষণে উল্কা গতিতে আরও এগিয়ে যায় তার নিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।

২.

ব্যস্ততার মধ্যে ডুবে থেকেও বাড়ি ফেরার প্রচণ্ড প্রচ্ছন্ন তাগিদ অনুভব করে হাফিজ। মনের অস্থিরতার সাথে কাজের একটা স্পষ্ট সংঘাত ক্রমশ বেড়েই চলছিল তার। এভাবে কাজে মন দেয়া মোটেই সম্ভব নয় জেনে সে যেন আরও অস্থির হয়ে ওঠে। তাই প্রয়োজনের চাইতে এক মুহূর্তও বেশি সময় নষ্ট করতে সে রাজী নয়।

বাড়ি ফেরার পথে বিন্দুগঞ্জের ঘাটের কাছে এসে আগের মতো তার চোখগুলো খুঁজে বেড়ায় সেই চেনা আগন্তুককে। হাঁ, চেনা তো বটেইÑ যাকে সে খুঁজে বেড়িয়েছে তন্ন তন্ন করে; পথ-ঘাট-মাঠে, ময়দান প্রান্তরে। কোনো খোঁজ মেলেনি তার। অথচ, কী আশ্চর্য! কতগুলো দিনের দূরত্বে কত অচেনা অন্যরকম হয়ে গেছে শৈশবের মানুষটি।

মাত্র তিনটি মানুষের মধ্যে হঠাৎ একজনের অনিবার্য অনুপস্থিতিতে নির্বাক নূরজাহান বেগম শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর। কিন্তু, সেই শোক-বিহ্বল সময়কে অতিক্রম করার শক্তি কি হাফিজদের সত্যিই আছে? সমাজের ধারণ করা নিরর্থক কিছু কৌতূহলকে আশকারা দিয়েই তো তারা এতদিন বেঁচে ছিল। সামাজিক বিধি নিষেধের অন্তরালে ভীষণ নোংরা গলি-ঘুপচির অন্ধকারে তালুবন্দি হয়েই তো যাপন করে নিচ্ছিল তাদের নৈমিত্তিক দিনগুলো। কিন্তু, আর নয়।

বাড়ি ফিরে তাই সোজা মা নূরজাহানের শোবার ঘরে প্রবেশ করে হাফিজ। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ যেন অপেক্ষায় ছিল এমন একটি মুহূর্তের।

জেগে আছ মা? আমার কথা কি শুনতে পাও তুমি?

হাফিজ নিশ্চিত জানে, কোনো উত্তর পাবে না ওপাশ থেকে। কাত হয়ে শোয়া নূরজাহান বেগমকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জেগে তোলে সে। হাফিজের মস্তিষ্কের অস্থিরতা ত্বরিত খেলে যায় দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। অনেকটা জোর করেই হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয় নূরজাহান বেগমকে।

দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনে নিঃসাড় নূরজাহান বেগমের শরীর-মন। বয়সের চেয়েও শারীরিক নানান অসুখে বিপর্যস্ত তিনি আজ। তীব্র মানসিক যন্ত্রণার ধকলে তার প্রতিবর্তী ক্রিয়া ধীর। কিন্তু, কিছু একটা শোনার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চোখ দু’টো খুলে তাকিয়ে থাকে হাফিজের মুখের দিকে। নিরুত্তর চোখের তারায় কিছু শোনা বা জানার তিরতির কাঁপুনি।

শোনো না মা, কী হইছে। সলিমরে কাল দেখলাম মনে হয় বিন্দুগঞ্জের ঘাটের কাছে। আমি নিশ্চিত ওইটাই সলিম। আমারে যদিও দেখে নাই সে।

নামটা উচ্চারিত হবার সাথে সাথে নূরজাহান বেগমের চোখের তারা আরও চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিছু যেন বলতে চায়। হাফিজ তারপর সবিস্তারে জানায় পূর্ব দিনের ঘাটের ঘটনাটা।

নূরজাহান বেগমের মুখ থেকে কোনো কথা আসে না। শুধু চোখের কোণ হতে দর দর করে বেয়ে নামে নোনা উষ্ণ জল। জমে থাকা বিষাদের উষ্ণ প্রস্রবণ।

নূরজাহান বেগমের বুকের চাপা কষ্টটা সেদিন হালকা হয়েছিল কিনা কে জানেÑ তবে হাফিজের মনে হয়েছিল সেই রাতে একটা গভীর ঘুম হয়েছিল তার। পরদিন সকাল থেকে দীর্ঘদিনের জমে থাকা অপরাধবোধ একটু একটু করে হালকা হতে শুরু করেছিল তাদের।

নূরজাহান বেগমের হঠাৎ এ বোধোদয় কিংবা চিন্তার পুনরুজ্জীবন আঁকড়ে ধরা সমাজ বা সমাজের চর্চিত সংস্কারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে একটা প্রত্যাখ্যান মাত্র। তাই তার মাতৃহৃদয় নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া পুত্রের জন্য পুনরায় ব্যাকুল হয় অকাতরে। শঙ্কাগ্রস্ত সকল ভাবনাকে নিরঙ্কুশ পেছনে ঠেলে। আর যাই হোক, সন্তান তো।

৩.

অনেকদিন পর নূরজাহান বেগম তার স্যাঁতসেঁতে ঘরের ছোট্ট গণ্ডি থেকে বের হয়ে অপ্রশস্ত বারান্দায় এসে বসে। বৃষ্টিভেজা দিনের শরীর হালকা রোদের গায়ে পিঠ পেতে অলস শুয়ে রয়েছে সেই সকাল থেকে। উচ্ছল সে রোদের খেলা, রোদ-ছায়ার অবিরাম লুকোচুরি গোপন হানা দিয়ে যাচ্ছে তার মনের ভেতরেও। আর যাই হোক, তার ছেলেটা বেঁচে আছে। এটা জানতে পেরেই অপরাধের এক বিশাল পাথরখণ্ড বুক থেকে নেমে গেছে। নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও বিরাট এ পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে ঠিক বেঁচে আছে সলিমÑ জানতে পেরেই সে মহাখুশি। নূরজাহান বেগমের মুখমণ্ডলে খেলা করে আলো-হাওয়ার প্রতিচ্ছবি। ঝিরঝিরে হাওয়ার সাথে নরম রোদের সন্ধি তার বুকেও এনে দিয়েছে গভীর অনাবিল প্রশান্তি।

মা হিসেবে সলিমের কষ্টটা গভীর উপলব্ধি করার চেষ্টা করে নূরজাহান বেগম। সলিম ও হাফিজের মধ্যে সলিমই বড় ছিল। পিঠাপিঠি দুজনের মধ্যে সলিম ছিল কিছুটা লাজুক, অন্তর্মুখী স্বভাবের। ধীরে ধীরে সে লক্ষ্য করে সলিমের মাঝে পরিবর্তনের চিহ্ন, এক ভিন্ন সত্তার আগমন। তার চলাফেরা, ভাবভঙ্গি, বেশভূষা সব কিছুই কেমন পাল্টে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। সলিম একদিন নিজে থেকেই এসে বলে,

মা, সবাই জানি আমার দিকে কেমন করে তাকায়?

কেমন করি বাবা?

আমারে দেখলে বিদ্রুপ করে। ভেংচি কেটে খ্যাপায়। বলে হাফ লেডিস। হাফ লেডিস কী মা? আমার এসব শুনতে ভালো লাগে না মা।

ওইসবে কান দিস না সলিম।

কিন্তু, আমিও যে কিছু বলতে চাই মা।

তোর কষ্ট আমি বুঝিরে বাবা। চারদিকে মানুষও নানা কথা কয়। আমি নিজেও বুঝি না কী করব? ঘরের বাইরে একদম পা দিস না সলিম। যা কিছু লাগে হাফিজরে বলবি, সেই করে দিবে।

সলিমের আর কিছু বলা হয় না, জানাও হয় না তার অব্যক্ত অনুভূতি। নূরজাহান বেগমও জানে, তার কথায় সলিম আশ্বস্ত হবে না মোটে।

সলিম একদিন আবিষ্কার করে, মা নূরজাহান বেগম ও একমাত্র ছোট ভাইয়ের সাথে একটা মানসিক দূরত্ব বেড়ে গেছে তার। সবার মাঝে থেকেও সলিমের কোথাও থাকা হয় না। নিঃসঙ্গতার ঘুণপোকা ডানা মেলে অপরিচিত এক খোলস তৈরি করেছে তার চারপাশে। ঘরের মধ্যেও তৈরি হয়ে যায় নির্বাসিত ছোট্ট আরেকটি ঘর। সুখ থাকার চাইতেও দু’দণ্ড স্বস্তি খুঁজে বেড়াতে চায় সকলে। আস্তে আস্তে সলিম বুঝে যায়, তার বেড়ে ওঠার এ কঠিনতম সময়ে মা কিংবা ভাইয়ের অনুপস্থিতি চরমভাবে দৃশ্যমান। তার শারীরিক প্রতিবন্ধিতার চেয়েও প্রতিবন্ধী সমাজের খোলস ও অসহায়ত্ব প্রকট হয়ে ওঠে।

গভীর এক যন্ত্রণাবোধ পেছন থেকে খামচে ধরে সলিমকে তখন। অক্টোপাসের মতো ঘিরে আসা অন্ধকার তাকে আঁকড়ে ধরে। খামচে ধরে পিঠের উপর নখের আঁচড় বসিয়ে দেয়। সলিম দিব্যদৃষ্টি দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়, দগদগে লাল সে ক্ষতের চিহ্ন। সে চিহ্ন তার নিজ পরিবারের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার, খোজা এক সমাজের দৈনন্দিন স্বার্থপরতা বা বিপন্নতার। হয়তো তার চেয়েও বড় কোনো প্রতিকূল অবস্থাকে সম্মুখে মোকাবেলা করার চেয়ে তা থেকে পালিয়ে বেঁচে যাওয়ার এক অবিরাম প্রচেষ্টার দাগ।

মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ব্যাকরণ বা সূত্র সলিমের অজানা। সমাজকে বোঝানোর চাবিকাঠি তার হাতে নেই। তার জগত যে সম্পূর্ণ আলাদা। নিজের একান্ত আপনজনের মধ্যেই অসহায়, বিপন্ন বোধ করে সে। একটা সকরুণ নৈঃশব্দ্য, একাকীত্বের উন্মাদনা টানটান বুক পেতে থাকে তার অস্তিত্বের মাঝে। তীব্র এক কষ্ট, যাতনাবোধ তাকে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ। অথচ, কৈশোর পেরোনো তরুণ সলিমের দেহ ও মনে যে ভাঙাগড়ার খেলা চলছে তার দায় তার নয়। তার এ যৌন প্রতিবন্ধিতা তার অর্জিত নয়, শুধুই প্রকৃতি হতে আরোপিত তার সত্তায় ।

সলিম ততদিনে স্পষ্ট বুঝে গেছে, সে সমাজের অন্যদের চেয়ে ভীষণ আলাদা অন্যরকম এক সত্তা। নারী নয়, পুরুষও নয়; কোনো অস্পৃশ্য এক মানব কাঠামো। আচ্ছা, তার আত্মাটা কি পুরুষের নাকি এক কোমল নারীর? সেখানেও কি কোনো ভিন্নতা আছে? তার আত্মাটা কি অসম্পূর্ণ না পরিপূর্ণ; সেটা কি তার শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে? তার আত্মাটাও কি তৃতীয় কোনো মানুষের? নানান জটিল রহস্যের গোলক-ধাঁধায় আগাগোড়া আচ্ছন্ন থাকে সে।

সলিমের মনের ভেতর নানান কথার তোলপাড়ের মাঝেই তার শরীরের ভেতর অন্য এক শরীর বাসা বাঁধতে শুরু করে দেয়। এ অমোঘ পরিণতির কথা ভেবে ভেবে কাউকে কিছু না বলে এক সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। সৃষ্টিকর্তার কাছে তার খুব জানতে বা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে তার অপরাধটা কী? সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষে পরিণত হয়ে সলিমের বেঁচে থাকার এক নিত্য যুদ্ধ শুরু হয় সেদিন থেকেই।

৪.

নূরজাহান বেগমের পীড়াপীড়িতে সলিমের খোঁজে বের হতে হয় হাফিজকে। ততদিনে হাফিজও তার হারিয়ে যাওয়া ভাই সলিমকে ফিরে পেতে উন্মুখ হয়ে ওঠে। মা নূরজাহান বেগমের বিগত বছরগুলোর বেদনার ভারকে কিছুটা লাঘব করে দিতে চায় সে। জমে থাকা যন্ত্রণার ক্ষতের উপর উপশমের উপযুক্ত প্রলেপ লাগাতে ব্যস্ত মরিয়া সে।

বিন্দুগঞ্জের ঘাটের কাছে এসে একদিন খুঁজতে থাকে সলিমকে। কিন্তু, তার কাছে তো কোনো ঠিকানা নেই। কী করে তাকে খুঁজে পাবে সে? সেদিন তো শুধু মুখটা দেখেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। কিন্তু, কথা বলার কোনো সুযোগ হয়নি।

মেঘহীন আকাশে ঝকঝকে রোদের ছড়াছড়ি। রোদের আঁচে মনটা প্রফুল্ল হয়ে থাকে। একটা পান-বিড়ির দোকানদারকে কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করে হাফিজ; আচ্ছা, এই ঘাটে হিজড়াদের একটা দল আছে না? কোথায় থাকে বলতে পারেন?

হাফিজের এ জিজ্ঞাসায় চোখ দু’টো সরু করে উল্টা তাকেই সে প্রশ্ন করে, ক্যান, কী দরকার?

উত্তর দেয়ার সে ভঙ্গিমার সাথে তাচ্ছিল্য এমন ভাবে মিশে থাকে যেন মাটি ফুঁড়ে এক দুর্বিনীত দৈত্যের উদয় হয়েছে হঠাৎ। তাকে তখনই থামানো দরকার। আদিম কোনো হিংস্র প্রাণির খোঁজে বেরিয়ে পড়া হাফিজের এ ঘোরতর অন্যায়। যারা এ পৃথিবীর কেউ নয়, তাদেরকে কখনও খোঁজ করতে নেই।

আপনার জানা থাকলে আমাকে বলতে পারেন, একটু দরকার আছে। লোকটির চেহারায় ঘৃণা লেপটে থাকে, চোখে ফুটে ওঠে প্রশ্নাতীত এক সন্দেহ। চোখের চাহনিতে মিশে থাকে অবহেলা, অবজ্ঞার এক সকরুণ নির্লিপ্ততা। নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়ে আগের চেয়েও বেশি শ্লেষ মিশিয়ে বলে,

দক্ষিণ পাড়ের ওই বেড়ার টঙের দিকে কেউ যায় না। ওইদিকে খোঁজ নিয়া আসতে পারেন, এই কথা বলে সে তার কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ঘাটের কাছে মানুষের তৈরি বাস্তব এক চিড়িয়াখানার খাঁচার চার দেয়ালের মাঝে বন্দি রয়েছে প্রাণিগুলো। সমাজ বাস্তবতার সবচেয়ে সকরুণ উদাহরণ তারা। তাদের অবয়ব আলাদা, দৈনিক আচার ভিন্ন, মনস্তত্ত্ব ভীষণ রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ। সমাজে থেকেও সমাজের বাইরের কেউ তারা। তাদের অন্তরালের জীবন সমাজেরই কিছু দুর্বোধ্য, অগম্য, দুর্ভেদ্য লৌকিক আচারের বিধি-নিষেধে সামগ্রিক বন্দি ও বিস্তৃত।

হাফিজের মনোজগতে ভীষণ ধাক্কা দেয় কথাগুলো। বাতাসে আলোড়ন তোলে নিমেষে। ঠিক না বুঝলেও যেন জোর করেই বুঝে নেয় হাফিজ, অথবা বুঝে নিতে হয় তাকে। ভয়ানক এক আত্মগ্লানিতে নিজেকে গুটিয়ে রাখা হাফিজ নিজেও এ অপরাধবোধ হতে পরিত্রাণ পেতে চায়।

নদীর তীর ধরে সেই টঙ লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে থাকে হাফিজ। বাড়ি থেকে বের হবার সময় কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে মা অনেক খাবার দিয়ে দিয়েছিল তাকে। সলিমকে সামনে বসিয়ে যেন সব খাইয়ে আসে সে, এমনটাই মায়ের আবদার। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তার এখানে আসা মনে হয় সফল হয়েছে।

বেড়ার টঙের সামনে কাঠের পাটাতনের একটা টানা ঝুলবারান্দা নদীর দিকে মুখ করে বসানো। সেদিনের সেই পাঁচজনের একজনকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। খুব ইতস্তত করে একটু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, সলিম থাকে এইখানে? চাপা অস্বস্তির কারণে কথাগুলো কেমন ভেঙে ভেঙে যায়।

কে সলিম? পাটাতনে দাঁড়ানো মানুষটার গলায় সপ্রতিভ উচ্চকিত হাসি। সেও মনে হয় বুঝতে পারে সব। সে ফেটে পড়ে আরও উচ্চ হাসিতে।

সালমা, সালমা, দেখ তো; কে জানি মনে হয় খোঁজ করছে তোকে। একবার আয় এদিকে।

ভেতর থেকে গোলাপি সালোয়ার কামিজ পরিহিত উৎকট সাজে বের হয়ে আসে সালমা। পাউডার মাখানো মুখটা সেদিনের চাইতেও অস্বাভাবিক সাদা হয়ে আছে। হাফিজের মনে হয়, যাত্রাদলের নটীর সাজে কোনো পুরুষের এ যেন ক্ষণিকের রূপসজ্জা, অভিনয়ের প্রস্তুতি মাত্র। তার শুধুই মনে হতে থাকে, এ কেবল অভিনয়; বাস্তব জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো দৃশ্য নয়। এ কি সলিম, না সালমা, নাকি দুজনের কেউই নয়।

নতুন কিম্ভূতকিমাকার সজ্জায় সলিমের এ দেহ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোশ পরিহিত অসহায় ব্যথাতুর সমাজের প্রতিচ্ছবি যেন। এ ইতিবৃত্ত একা সলিমের নয়, বরং খণ্ডিত খোজা সমাজের পুরো অংশের।

হাফিজের মুখে কোনো কথা সরে না। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে একটা নিরাপদ দূরত্ব রেখে সযত্নে পাটাতনের দিকে ঠেলে দেয়। ঠিক যেমন কোনো জন্তুর খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষরূপী মানুষগুলো আহার দিয়ে শান্ত করা বা আয়ত্তে নেয়ার চেষ্টা করে তেমনিভাবে। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে হাফিজ।

ভাই, তুই কেমন আছিস? কতদিন তোরে খুঁজেছি। তোর জন্য দুশ্চিন্তায় আর কষ্টে মা বিছনায় পড়ে আছে সেইদিন থেকে। ক্যান তুই কাউরে না বলে এই ভাবে অভিমান করে চলে আসলি?

সলিম বা সালমা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। শান্ত, নিরুত্তর কিংবা অভিমানী, তবে নতজানু নয়। একটা চাপা জেদ চোয়াল শক্ত হওয়া রুক্ষ মুখমণ্ডলের আবরণ ভেদ করে ভেসে ভেসে উঠছিল, চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল সমাজের প্রতি তীব্র ক্রোধের আগুন। প্রতিদিনের প্রতিবন্ধকতা ঠেলে ভাষা হারিয়ে ফেললেও বেঁচে থাকার সংগ্রাম বুঝে গেছে আজ।

সেদিন বৃষ্টি ছিল না বিন্দুগঞ্জের ঘাটে। আকাশটাও ছিল ঝকঝকে পরিস্কার। রোদের আলো ও উদ্দাম হাওয়ার মাখামাখি নদীতীর ঘেঁষে। তারপরেও ছোট্ট একখণ্ড মেঘ কোত্থেকে তাড়িয়ে এসে অঝোরে বৃষ্টি ঝরায় সলিমের আকাশে।

কে আমার ভাই, কে আমার মা? কোথায়ই বা আমার ঘর? আমাদের কেউ থাকতে নাই।

তুই বাড়ি যাবি না ভাই?

বিপুলা পৃথিবীর উদার আকাশের নিচে অচেনা এক আগন্তুক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে উত্তরহীন, অবিচল।

মঈনুল হাসান। কথাসাহিত্যিক ও ছড়াকার। ১৯৭৮ সালের ৪ আগস্ট (বাংলা ২০ শ্রাবণ, ১৩৮৪ বঙ্গাব্দ), ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার তেজগাঁওয়ে শৈশব কাটলেও পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলায়। বাবা মরহুম মোঃ আব্দুল আউয়াল এবং মা বেগম শামসুন নাহার। বটমলী হোম বালিকা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..