শিদেল চোর

অরবিন্দ ভট্টাচার্য
ছোটগল্প
Bengali
শিদেল চোর

আমি তখন খুব ছোট। এক দিন সকালে গোটা পাড়া জুড়ে হৈচৈ। লোকজন ছুটছে।  শুনলাম দিদির বন্ধু ধুন্দাদিদের বাড়িতে একটা চোর ধরা পড়েছে। ওদের বাড়ি ছিল একটা গলির ভেতরে। টিনের চাল, দরমার বেড়া, মাটির মেঝের দুটো ঘর। একটা থাকার,   অন্যটায় রান্না বান্না।   পূর্ব পাকিস্তান থেকে সদ্য উদ্বাস্তু হয়ে আসা দারিদ্র ক্লিষ্ট অজস্র পরিবারের একটি ছিল ধুন্দাদিদের পরিবার। বাড়িতে দুগ্ধ জাত দ্রব্য বানিয়ে ফেরি করে বেচে  দিন গুজরান হতো ওই ঘোষ পরিবারের। নিজের বাড়ি নয়, ওরা ভাড়া থাকতো অন্য আরো অনেক পরিবারের সাথে। উঠোনটা সবার।

চোর দেখতে ঠিক কেমন,  মানুষ, অসুর না  গল্পে পড়া দস্যুদের  মতো তা জানতে আমার তখন  কৌতূহল ছিল অদম্য। তাই পাড়ার অনেকের মতো  দিদির হাত ধরে ওদের বাড়ি পৌছে গেলাম সকাল সকাল। গোটা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। অনেক কষ্টে বাড়ির ভেতরে ঢুকে    দেখি,  সারা গায়ে মুখে চুন-কালি মাখা তৈলাক্ত কলেবর  হার জিরজিরে একটা মানুষকে বারান্দার বাঁশের সাথে পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে তুমুল ধোলাই চলছে। বুঝলাম,   ওটাই চোর। মারের চোটে মাথাটা নেতিয়ে পড়েছে,  রক্তাক্ত শরীরটা প্রায় অবশ।  পাড়ার বীর জওয়ান ছেলেরা চুলের মুটি ধরে পালা করে কিল চর লাথি ঘুষি মেরে চলেছে অবিরত। যে দেখতে আসছে সেই দু ঘা বসিয়ে দিচ্ছে। আর সঙ্গে চলছে অশ্লীল গালি গালাজ। পাড়ার সুপারি ছোটন, যে নিপুণ হাতে ট্রেনে পকেট কাটতো, ক্রিম বিস্কুটে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে যাত্রীদের খাইয়ে,  মাল হাপিস করে ধরা পড়ে সাত দিন আগে জেল থেকে খালাস পেয়েছে, সেও দেখলাম বীর বিক্রমে চোরটাকে পেটাচ্ছে আর বলছে,  “শালা চুরি করার যায়গা পাওনি নি!”    একজন মানুষকেও পেলাম  না  যে ওর প্রতি বিন্দুমাত্র সহনুভূতিশীল। ছেলে বুড়ো সবাই বলছে মার শালাকে,  আরো মার।  ওর  অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য! শুভ্র কেশ রমণী দাদু  রাগে গজ গজ করতে করতে বললেন, “হালার ব্যাডা কি করসে জানস,  রাইতের বেলা  একডা লোহার খন্তা দিয়া শিদ   কাইট্টা ধুন্দাগো ঘরে ঢুইক্কা   হাড়িত রাখা পান্তা  ভাত  সাবাড় কইরা  দিছে”।

হেরপর একটা বস্তায় কইরা পিতল আর ভরনের   থাল বাসন, একটা হেরিকেন একটা পিতলের কুপী  লইয়া  চম্পট দিতে গিয়া ধুন্দার মায়ের চিত্কারে  পাড়ার পোলাগো হাতে ধরা পইড়া গ্যাসে। হালারে ছারস না, আরো মার”। শীতের সকালে খদ্দরের আলোয়ান জড়ানো রমণী দাদু হলুদ   রুমালে নস্যির নাক মুছতে মুছতে বিদায় নিলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, “পুলিশে দিয়া লাভ নাই, হালারা টাকা খাইয়া  ছাইড়া দিবো”। মানুষ কতটা নির্মম হতে পারে সেটা ওই বয়েসেই আমি পরখ করেছিলাম।  যাইহোক তৈলাক্ত কলেবর ভিনদেশী নাম গোত্রহিন  ওই বেচারা চোর প্রথমে নাকি পাড়ার ছেলেদের হাত পিছলে প্রায় পালিয়েই গিয়েছিল।

কিন্তু পাড়ার কানুদা ওকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে জাপ্টে ধরেছে। ঢোলা পাজামা আর নীল ফুলসার্ট পড়া  লিকলিকে চেহারার  কানুদার ওজন বড়জোর  আটচল্লিশ কিলো হবে!  সেই  কানুদাকেও দেখলাম হিরোর মতো ভিড়ের মাঝখানে বসে পড়শীদের  বাহবা কুড়াচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন কানুর মতো ছেলে আমাদের পাড়ার গর্ব। কানুদা বলছেন, “কাকা আরো একটা ছিল ধরতে পারলাম না। এটাকে ঠিক করে সাইজ করলেই অন্যটার নাম জানা যাবে। মৃতপ্রায় মানুষটিকে ঠিক কি করে সাইজ করা হবে সেটা আমার বোধগম্য হয় নি।  যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ভবঘুরে বনমালী কাকুকে ছুটে এসে বলতে শুনলাম,  “আর মারিসনা তোরা,  ও যে  মরে যাবে তখন  তোরা উল্টো কেসে পরবি বলে দিলাম”।   সকাল গড়িয়ে  দুপুর হলো। কে বা কারা পুলিশে খবর দিয়ে দিল।  পুলিশ এসে ধুন্দাদির বাবা সুনীল গোয়ালাকে  এজাহার লিখতে বললেন। কাচুমাচু করে উনি বললেন, “স্যার আমি তো লেখা পড়া জানি না”।

শেষ পর্যন্ত পাড়ার সুরেশ মহুরীকে ডেকে আনা হলো। তিনিই লিখে দিলেন এজাহার। সুনীল গোয়ালা তাতে টিপ সই দিলেন। ভিড় একটু একটু করে হালকা হয়ে গেল। যে যার মত সবাই নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়লেন। সাক্ষীর জন্য  ডাকাডাকি  করে একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না,  এমন কি কানুদাকেও না। এবার ঘটনার বিবরণ শুনতে ধুন্দাদির মায়ের ডাক পড়লো। তিনি ঘোমটায় মুখ ঢেকে দরজার ভেতর থেকে বেমালুম   বলে দিলেন, “আমি  তহন ঘুমায়াছিলাম, আমি কাউরে দেহি নাই”। অগত্যা  পুলিশ   সেই মৃতপ্রায় হতভাগ্য মানুষটিকে  গাড়ি করে থানায় নিয়ে গেল। ও বেঁচে  থাকলো না মরে গেল ওই বয়েসে  সে খবর আমার আর জানা সম্ভব হয় নি।

অরবিন্দ ভট্টাচার্য। লেখক। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কোচবিহার।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ