শিবব্রত মণ্ডলের কবিতা

শিবব্রত মণ্ডল
কবিতা
শিবব্রত মণ্ডলের কবিতা

এক মৃতের জৈবনিক সংলাপ

আজ ভোরের দিকেই কিম্বা ধরুণ খুব সকালে আমি মরেছি
কয়েকটা কাক নাকি আমার সব পরিজনদের মাথায় একপ্রকার ছোঁ মেরে সে খবর পৌঁছে দিয়েছে, কত জনের কত রকম দায়িত্ব!
আমার পা যম-পুকুরে, মাথার কাছে দাউ-দাউ জ্বলন্ত মশাল
চারপাশে বীভৎস কান্নার রোল- বলহরি হরিবোল বলহরি হরিবোল।
এইভাবে মরে নাকি একদিনে কেউ! আগে আমি মরিনি কখনো!
আমার প্রতিশ্রুত বিবেক, আমার হৃদয়, আগে মরেনি কোনদিন!
বলা কিম্বা চলায়, নিত্য যাপনে- নিতি নিতি মৃত্যু আমাদের
অচেনা অজানা শত শত লাশ; কত বিশ্বাস, কাঙ্খিত অবকাশ
আর চোরা ইচ্ছেরা পুরাতন মৃত তারাদের মত আমারই ভেতরে
ম’রে পড়ে আছে, আজ থেকে নয়- পূর্ব পূর্ব পুরুষের পথ ধরে।
হ্যাঁ, আমি মরেছি, আজ-ই ভোরে কিম্বা ধরুণ খুব সকালের দিকে
এক ভোরে নয়, শত ভোর, সহস্র মুহুর্ত অথবা তারও ঢের বেশি,
আমার বে-হিসাবি সে মরা আমি আটকাতে পারিনি কখনো।
আমি-সে-তারা, ঐ কুঁড়ে ঘরের চালার নীচে যারা শুয়ে আছে
কল্পিত বিশ্রামে, সবাই মরেছে জানি কতবার নিজেরই ভেতর।
কতবার? যতবার মরে মরে মৃত্যু জুড়ে বেঁচে ওঠা যায়
হয়ত বাঁচার জন্যই কোষের মত বারে বারে এই মরে যাওয়া,
অগণন মৃত্যুর আশ্চর্য গ্রন্থনে নির্মিত আমাদের জীবন।
অচেনা সহস্র মুহুর্ত জুড়ে জুড়ে যেমন গড়ে ওঠে আয়ু
তেমনি মরেছি আমি; আমার পা যম-পুকুরে ,মাথার কাছে
দাউ-দাউ জ্বলন্ত মশাল, চার পাশে বীভৎস কান্নার রোল….
এ কোন মরণ নাকি! জীবন-পথে একটা মরণে কী থাকে আর!
শত সহস্র মরণের তান জুড়ে আজীবন গেয়ে চলি জীবনের ভৈরবী।

 

একটি কথা বলা আয়না ও নির্বাক আমি

আমার শোবার ঘরে খাটের উল্টো দিকে এক মস্ত আয়না ছিল
রোজ রাতে শোবার আগে ওর দিকে তাকিয়ে এটা ওটা বলতাম
নানা অঙ্গভঙ্গি, হাসি বা কান্না যেদিন যেমন যায়।
বেটা নির্দয়, শুধুই নকল প্রিয়, বন্ধু হওয়ার নিতান্ত অযোগ্য,
সেবার কি যেন এক যথেষ্ট কারণে ভারী ফুলদানি ছুঁড়ে
ওর সারা গা দিলাম ফাটিয়ে আচ্ছা করে,বোঝ আমার জ্বালা,
আমার ভেতরে এমন কত ফাটা, অসহ্য দগদগে ক্ষত।
পরদিন ওর মুখ না দেখে সোজা বিছানায়, দশ বছরে প্রথমবার।
ঘোর অন্ধকার, আধো ঘুমে চোখ সবে বুজেছি তখন
মাথার কাছেই কে যেন কচকচ-ফিসফিস, লাফিয়ে উঠে বসি।
হালকা আলো, সুইচে হাত,মাথা ঝিমঝিম, হাত-পা কাঁপে
তীব্র বেগে, তবু সাহস নিয়ে দুচোখ রাখি ভাঙা আয়নায়-
আরো কিছু কাচ, টুকরো ফলার মত ভেঙে ভেঙে পড়ছে মেঝেতে,
তার কয়েকটা এগিয়ে আসছে আমার পায়ের দিকে –
ধারালো, তীক্ষ্ণ; আমাকে মারবে বলে যেন বদ্ধ পরিকর।
তার পর ভুল ভাঙল আমার, কোন হিংস্রতা নেই ওর বিক্ষত মুখে,
স্পষ্ট মনে আছে, তীব্র কাতরানি- ও কাঁদছে- আ………আ………
ওর প্রতিটি ঝরা টুকরোয় রক্তের ছাপ, সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত কোন প্রশ্ন নেই আজ, নেই অঙ্গ ভঙ্গি, ওর কাতর নড়াচড়া, ব্যথা
আমার ভিতর আজ প্রথম বিঁধছে, এবার কথা বলল ও –
পৃথিবীর প্রথম ভাষা পাওয়া শিশুটির মতো- বলল, স্পষ্ট শুনলাম,
ভাঙা ভাঙা গলায় বলল-‘আমায় দেখো’, আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম-
আমি কাঁদলাম, খুব কাঁদলাম, তবে ওর থেকে বেশি নয় বোধহয়।
‘কী দেখলে’? আমি ভাষা হারালাম, ও পেলো প্রথম গোপন মুখরতা
কী করে বলি! ওর রক্তাক্ত শরীর জুড়ে অনেক গুলো আমি দেখলাম!
কোনটাতে আমার হাসি কোনটাতে কান্না, আর যে অংশগুলো
ভেঙে গড়িয়ে এসেছে মেঝেতে- ওগুলোতে আমার গোপন নিষ্ঠুরতা
অবিশ্বাস, পুরানো প্রতারণা, আরও যত লুকানো অপরাধ।
ও আবার কথা বলল- ‘দেখাও তোমার সমগ্র অন্দর’।
আমার ভয় ভাঙতে থাকল , ওর সামনে মেঝেতে বসে পড়লাম
আমার মুখে তবু আজ কোন কথা নেই বলার মত
আজ ও একাই বলছে, এবার নরম গলায়- ‘আমায় ভালোবাসো……’
আর আমি তখন মেঝেতে ছড়ানো ভাঙা টুকরো গুলো দুহাতে কুড়াচ্ছি
কোনো ভাবে জুড়ে দিয়ে ওকে আবার বাঁচাব ব’লে,
ঠিক তখনি কানে এলো, এখনো ভুলিনি আমি ওর শেষ কথা-
‘ওই তো নিজেকে ভালোবাসতে শিখছো’।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..

ফ্রেম

ফ্রেম

দেবী না পরিণীতা রাতটা একা থাকে এবং নিঃসঙ্গ অন্ধকার মানে রাত; তাহলে অন্ধকার নিজেও একা…..