প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
দিদি ভাত দিবি?
সতরো বছরের লম্বা ঝাঁকড়াচুলো নাতির দিকে তাকিয়ে শিবি সাড়া দেয় না। পিঁড়িটা পাতাই ছিল। উপুড় করে রাখা থালাটা তুলে সোজা করে ভাত বেড়ে দেয়। একটা ছোট আলুভাতের তাল তুলে দেয় নাতির পাতে। তেল ছিল না ঘরে তাই শুধু নুন দিয়েই মাখা। গপাগপ করে খেতে থাকে তরুনটি। শিবি একদৃষ্টে দেখতে থাকে নাতির খাওয়া। ঐটুকু আলুভাতে দিয়ে ভাত খেতে দিতে বুকের ভেতরটায় কষ্ট পাক খেয়ে ওঠে। কিন্তু ঘরে আর কিছু ছিল না। ছেলেটার অবশ্য জ্বালাও কিছু নেই। এক চুড়ো ভাত দিলে নুন দিয়েও কতদিন খেয়ে উঠে গেছে। আজও আপন মনে খেয়ে
উঠে যায় সে। একবারও জানতে চায় না দিদি তুই খাবি না? হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। বাউন্ডুলে হয়ে গেছে ছেলেটা। খাবার সময় আর ছাড়া ঘরে দেখা পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে মেশিনের কাজ কিছু করে দুটো পয়সা ঘরে আনে‚ তখন একটু পেটভরা ভালোমন্দ খাবার
জোটে। তারপর যে কে সেই।
একটা সময় শিবির বয়স ছিল‚ গতর ছিলো খেটে সংসারে দুবেলা খোরাক জুটিয়েছে‚ কিন্তু এখন আর পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবি আঁচলের খোঁটে বেঁধে রাখা একটা গড়া পান খুলে মুখে দেয়। ইদানীং তার পানের নেশাটা খুব বেড়েছে। আর খাওয়ার পরিমান কমেছে। কিছুতো বাঁচে সংসারে। এঁটো থালাটা নামিয়ে রাখে দরজার পাশে। সরিয়ে রাখে ভাতের হাঁড়ি জল ঢেলে।
হাঁড়িতে চাট্টি ভাত আছে। ঐ ভাতকটাই সম্বল। রাতে যে কিছু রাঁধবে এমন পয়সা হাতে নেই। মাস শেষ হতে চলল। ভাতকটা খেয়ে নিলে রাতে নাতির পাতে কি দেবে। এঁটো জাবগাটা ন্যাতা দিয়ে মুছে ন্যাতাটা রেখে দরজা টেনে বেরিয়ে যায় সে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। বাসন
মাজতে হবে বোস গিন্নীর বাড়িতে। সব কাজ গিয়ে তো এই একটা কাজই টিকে আছে।
রাস্তা চলতে চলতে ভাবে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে এলো সে। বয়সও তো কম হল না। খাটতে খাটতে শরীর তো সেই কবেই গেছে। তবু বোসেদের বাড়ি তাকে রেখেছে তাই রক্ষে না হলে মাসের বাকি পনেরোটা দিন উপোস করেই কাতট। পদা আর কত দেবে। নিজের মনেই হাসে শিবি। কপাল করে তার দিদি এই সতীপোটাকে পেয়েছিল। একমাত্র এই মামাকেই খুব ডরায় নাতিটা। মামার ভয়েই কিনা কে জানে এই কদিন আগেই শিবি যখন অসুস্থ হয়েছিল আবার‚ নাতি বলেছিল দিদি তুই কাজটা ছেড়ে দে‚ আমি তো করছি‚ চলে যাবে আমার আর তোর। মোটে একটা বাড়ির কাজ‚ না হয় সংসারে নাই লাগল‚ কিন্তু জমলে তো কাজেই দেবে ভেবে আর কাজটা ছাড়তে রাজী হয়নি। আজ ভাবে ভাগ্যিস ছাড়েনি।
পথ বেশি না তবু একটু হাঁটলেই আজকাল শ্বাস ফুলে যায়। একটু দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে নেয় সে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কুড়িয়ে নেয় এর-ওর বাড়ির গাছ থেকে ঝড়ে পড়া পাকা সুপুরি। কে জানে এত সুপরি খাওয়ার জন্যই ভাতের ক্ষিধেটা মরে যাচ্ছে কিনা!
কোঁচরে বেঁধে নেয় সুপরিগুলো। মনে পড়ে সেই ছোটোবেলার কথ। এরম কোঁচরে করে কত কাঁচাআম-কুল-কাঁচা পেয়ারা নিয়ে গ্রামের আলপথ বেয়ে ছুট ছুট আর ছুট। মা-বাবার অনেকগুলি সন্তানের মধ্যে শিবি ছিল খুব খাটিয়ে। সেই কোন ছোটোবেলা থেকেই ঝাঁটা বেঁধে-বিড়ির পাতা বেঁধে বাবা-মার সংসারে সাহায্য করে এসেছে শিবি। দড়ির মত পাকানো দেহে কবে যে যৌবন এসে কড়া নাড়ল টের পাওয়ার আগেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিল।
অভাবের সংসারে একটা পাত কমলেও তো অনেক। অব্শ্য খারাপ বিয়ে হয়নি তার। স্বামী একটু বয়সী ছিল বটে‚ কিন্তু মানুষটা ছিল বড় ভাল। তার জীবনের সুখের দুটো বছর। মাত্র দুটি বছর স্বামীর ঘর করেছিল। মানুষটা যখন চলে গেল। মেয়েটা তখন পেটে। তারপর শুধুই ভেসে বেড়ানো। স্বামীর শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে শ্বশুরভিটেটেই পড়ে থাকতে চেয়েছিল সে। কিন্তু শ্বশুড়বাড়ি রাখল না তাকে। আবার ফিরে যাওয়া বাপের ঘরে। মেয়েটা সেখানেই জন্মালো।
বোসেদের বাড়ির লোকগুল বেশ ভালো। কতবার নাতিকে কত কাজ দেখে দিয়েছে কিন্তু না সে কোন কাজই করবে না। আজকাল বড় মুখ হয়েছে নাতিটার। অথচ ঐ তো একটিমাত্র বন্ধন। না হলে নিজের জন্য কে ভাবে। একটা পেট ঠিক চলে যেত। এইতো গতবছর বৃন্দাবনে গিয়ে আর ফিরতে ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কই থেকে তো যেতে পারলো না সে। সেই এত্তোটুকু বয়সে ছেলেকে বিইয়ে যে মেয়েটা চোখ বুঁজলো। বাপেও নিলে না ছেলেটাকে। মেয়ের শোকে শিবির বুক ফেটে যাচ্ছিলো তাও সে নাতিকে ফেলে দিতে পারেনি। তখন বয়স ছিল। গতরে খেটে মানুষ করতে
চেয়েছিল নাতিকে। সে আশাও তো পুরণ হল না। পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিল নাতি লেখাপড়া। খুব আশা ছিল‚ নিজের তো অক্ষরপরিচয় হয়নি। মেয়েটাকেও স্কুলে পড়াতে পারেনি‚ কিন্তু নাতিটা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয় যেন।
আচমকা কাশিটা আবার শুরু হতেই শিবি একটা বাড়ির রকে বসল। এই এক রোগ তার শরীরের সব শক্তি শেষ করে দিল। একটা ফুসফুস তো কবেই বাদ গেছে। আর একটা ফুসফুসের অবস্থাও ভালো না। মাঝে মাঝেই মুখে দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত ওঠে। দুদিন শুয়ে- বসে থাকলে আবার শরীর ঠিকঠাক। আবার সে কাজে বের হয়। । না হলে যে মুসকো নাতিটা খেতে পাবে না।
লেখাপড়া যখন করল না‚ শিবি তখন এক ওকে ধরে পরে নাতিটকে মেশিনের কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। মেশিনে সেলাই করে বেশ ভালো রোজগার করছিলো নাতিটা। সুখের মুখে দেখেছিল শিবি। রেলপাড়ের বস্তির ঘরটা ভালো টিন দিয়ে ছাইলো। কারেন্ট ও নিয়েছিল। পদার সাদা-
কালো পুরোনো টিভিটা কিনে নিয়েছিল।
নাহ মাথাটা কেমন টাল খাচ্ছে। আজ আর কাজে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। আজ সকালে সেই ওদের বাড়িতে এক গেলাস চা আর দুটো বিস্কুত খেয়েছিল। তার পর থেকে আর পেটে কিছু পরেনি গোটা দুয়েক সুপারি আর নয়নের মার দেওয়া পানটা ছাড়া। অন্যদিন পদার বাড়ি গেলে
পদার বউ ভাত বেড়ে দেয়। আজ কেন জানি যেতে ইচ্ছে করেনি। ফিরে চলে শিবি বাড়ির দিকে।
ঘরের আগলটা খুলে শুয়ে পড়ে মেঝেয় পাতা বিছনাটায়। গলগল করে উঠে আসে কাঁচা রক্ত। চোখ অন্ধকার।
আজ এক সপ্তাহের ওপর শিবি হাসপাতালে ভর্তি। সবসময় একটা আচ্ছন্নভাব। বিড়বিড় করে কি যেন মাঝে মাঝে বকে চলেছে সে। আবার মাঝে মাঝে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলে নাতিটাকে বার কয়েক খুঁজেছে। সময় হয়ে আসছে‚ তাই বুঝি শেষবারের মত একবার দেখে নিতে চায় নাতিটাকে।
ডাক্তার কোন আশা দেয়ানি। তবে একটা অপারেশনের কথা বলেছিল‚ কিন্তু শিবির যা শরীরের অবস্থা অপারেশনের ধকল নিতে পারবে কিনা সন্দেহ। তার ওপর আছে অপারেশনের খরচ।
সরকারী হাসপাতাল হলেও কিছু তো খরচ আছেই। বাড়ির লোকের ওপর দায়িত্ব দিয়েছে চিন্তাভাবনা করার। বাড়ির লোক বলতে একমাত্র পদা। নাতিটা তো কেঁদেই চলেছে। ছেলেমানুষ ছেলে‚ কি বা করবে। পদারও করার কিছুই নেই। না আছে অর্থের জোর না আছে বুকে বল। এই
একটা মানুষকে সারাজীবন ধরে নীরবে ভালোবেসে গেছে সে। নিজের ক্ষমতায় যা ছিল যা আছে সব দিতে পারত এই মানুষটাকে। কিন্তু কিছুই দেওয়া হল না‚ সমাজ আর সংসারের নিয়মের আগল ভেঙ্গে। তার পরিপুর্ণ হৃদয়ের ভালোবাসা অজানাই থেকে গেল শিবির কাছে।
এগিয়ে যায় শিবির বিছানার দিকে। একটিবার সে বলতে চায় শিবিকে তার মনের কথা। আলতো করে মাথায় হাত দিতেই গা শিরশিরিয়ে ওঠে। বরফশীতল শরীর থেকে প্রাণটা কখন যেন বেড়িয়ে গেছে। পদা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..