শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠনে সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ

এইচ বি রিতা
প্রবন্ধ
Bengali
শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠনে সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ

ইউরোপিয় ইতিহাসকে তিনটি বৃহৎ যুগে বিভক্ত করা হয়। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। যদিও ঐতিহাসিকরা পোস্টমেডিয়াভেল অর্থাৎ ইউরোপিয় ইতিহাসের মধ্যযুগের পরের সময়কাল ১৫০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আধুনিক যুগের শুরু হয়েছে বলে মনে করে থাকেন, তবে সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাস ও অনন্য বিষয়ের প্রেক্ষিতে অনেকের মতে ১৮৭০-১৯১০সময়কালকে আধুনিক যুগের সূচনা হিসেবে ধরা হয় যা বর্তমান পর্যন্ত চলমান। অর্থাৎ, আধুনিক শব্দটিতে ‌অতীত এবং বর্তমানের একটি সীমারেখা স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। যাতে ইতিহাস ও সময়কাল উভয়ই সম্পৃক্ত। ইউরোপের পুঁজিবাদী সমাজের উত্থানের সাথে সাথেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্র গৌরব নিয়ে আধুনিক যুগের সূত্রপাত।

সাহিত্যের মডার্নিজম বা আধুনিকতাবাদের উৎস হিসাবে ১৮৮০ এর দশকের শেষের দিকটাকে ধরা হলেও সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন চার্লস্ ডারউইন, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্ক্স এবংবিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, লেখক, চিন্তাবিদ এবং শিল্পীরা পূর্ব-ধারণাযুক্ত নিয়মগুলোকে দূরে সরিয়ে নিজেদের বাস্তবতা  বিবেচনায় একটি নতুন উপায় তৈরি করার  প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই আন্দোলনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার  প্রতিক্রিয়া হিসাবে নতুন শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠনে নগরের দ্রুত বিকাশ উল্লেখযোগ্য।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং আর্নেস্ট ম্যাকের মতো চিন্তাবিদগণ আধুনিকতাবাদী আন্দোলনকে প্রথম দিকে খুব প্রভাবিত করেছিলেন।উভয়ই মানুষের নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে বাইরের বিশ্বকে দেখার নিজস্ব বিষয়গত অভিজ্ঞতা, চালচলন, চিন্তা-চেতনা ও আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বিদ্রূপ, ব্যঙ্গ, চেতনাপ্রবাহ, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-একাকীত্ব বিভিন্ন যুক্তির ব্যবহারে তুলনা করা ছিল আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের একটি কৌশল। একসময় এটি শুধু ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাতে নিবদ্ধ ছিল।

আধুনিকতাবাদ সাহিত্য আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের পরীক্ষানিরীক্ষামূলক সাহিত্যে একটি আন্দোলন, সাহিত্যকেএকই ধরনের দার্শনিক, সাময়িক বা নান্দনিক বৈশিষ্ট্যগুলির বিভাগে বিভক্ত করার একটি উপায়। এটি কবিতা, গদ্য কথাসাহিত্য এবং নাটক সবদিকেই স্পর্শ করে। আধুনিকতাবাদী লেখকরা কল্পনাপ্রসূত সাহিত্যিক রূপ এবং মত প্রকাশের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে প্রতিটি ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। সাহিত্য আন্দোলন সাহিত্য কর্মের তুলনা এবং আলোচনার জন্য ভাষা সরবরাহ করে।

আধুনিকতাবাদ বিষয়গত এবং  শৈলীগত, দুইভাবে কাজ করে। বিষয়গত ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদ মানব সভ্যতার সৃষ্টিশীলতায় অঙ্গীকারবদ্ধ এবং শৈলীগত ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদ মনো-সমাজের দূরত্ব দূর করতে চায়।

আধুনিকতাবাদ একটি বৃহত্তর আন্দোলন। যার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ  সাহিত্য ও শৈল্পিক আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ইমাজিজম, এবং সিম্বলিজম, ফিউচারিজম, কিউবিজম, সুরিয়ালিজম, ডাডা এবং এক্সপ্রেসিওনিজম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের মধ্যে তিনটি ভিন্ন সাহিত্য আন্দোলন হল, ইমাজিজম (কল্পনাবাদ), সুরিয়ালিজম (পরাবাস্তববাদ), এবং এক্সপ্রেসিয়োনিজম।

ইমাজিজম (কল্পনাবাদ):

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অ্যাংলো-আমেরিকান কবিতায় ইমাজিজম ছিল এমন একটি আন্দোলন যা চিত্রাঙ্কিত এবং স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ ভাষার পক্ষে ছিল। প্রি-রাফায়েলাইটের পর থেকে এটি ইংরেজি কবিতায় সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কাব্যিক রীতি হিসাবে ইমাজিজম ২০শতকের গোড়ার দিকে আধুনিকতাবাদের সূচনা করে এবং ইংরেজি ভাষায় এটি প্রথম সংগঠিত আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হয়। এজরা পাউন্ডকে আধুনিকতাবাদী যুগের অন্যতম সেরা কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয়, চিত্রশিল্পী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তাঁর। তাঁর কাজগুলোর স্পষ্টতা, নির্ভুলতা এবং প্রাণবন্ত স্পষ্ট চিত্রগুলির  জন্যই তিনি পরিচিত।

প্রি-রাফায়েলাইট যা আগে প্রি-রাফেলাইট  ব্রাদারহুড হিসেবে পরিচিত ছিল, একটি ইংরেজি চিত্রশিল্পী, কবি এবং শিল্প সমালোচকদের  দল, যা ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম হলম্যান হান্ট, ফ্রেডেরিক জর্জ স্টিফেনস, থোমাস উলনার, জন এভারেট মিল্লাইস, দ্যান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসেটি, উইলিয়াম মাইকেল রোসেটি, জেমস কলিনসন দ্বারা সাত সদস্যের ‘ব্রাদারহুড’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যারা সাত সদস্যের ‘ব্রাদারহুড’ গঠন করেছিলেন, তারা ন্যাজারিন  আন্দোলনেরও অংশ ছিল।

টমাস আর্নেস্ট হাল্মে ছিলেন একজন  ইংরেজ সমালোচক এবং কবি, যিনি শিল্প, সাহিত্য এবং রাজনীতি সম্পর্কিত লিখাগুলোর মাধ্যমে আধুনিকতাবাদের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি ছিলেন নান্দনিক দার্শনিক এবং ‘ইমাজিজম এর জনক’।

তাঁর একটি কবিতা জনপ্রিয় কবিতা ‘Autumn!’

A touch of cold in the autumn night
I walked abroad,
And saw the ruddy moon lean over a hedge
Like a red-faced farmer.
I did not stop to speak, but nodded;
And round about were the wistful stars
With white faces like town children.

শরতের রাতে শীতের স্পর্শে
আমি বিদেশে হেঁটেছি,
এবং অসভ্য চাঁদকে একটি বেড়ার উপরে ঝুঁকে পড়তে দেখেছি;
লালমুখি কৃষকের মতো।
আমি কথা বলা বন্ধ করিনি, তবে মাথা নীচু করেছিলাম
এবং দেখেছি, চারপাশে ছিল শহুরে বাচ্চাদের মত
সাদা মুখের বিস্ময়কর তারা। (অনুবাদ)

কবিতাটির ভাবার্থে দেখা যায়, শরৎকালের শীতের ছোঁয়া পড়ার পরও  কবি বাইরে গিয়ে হেঁটে বিদেশের পথে যাত্রা করছিলেন। একটি অসভ্য চাঁদ তখন বেড়ার ওপর  ঝুলছিল যা লাল মুখের কৃষকের মত দেখাচ্ছিল। তিনি সেখানে থেমে থাকেননি। তিনি লালমুখের কৃষকের মতো বেড়াটির ওপরে ঝুলে থাকা অসভ্য চাঁদকে দেখতে মাথাটি ঝুঁকিয়েছিলেন এবং দেখেছিলেন, নক্ষত্রগুলি সাদা-মুখের শহুরে শিশুদের মতো জ্বলজ্বল করছিল।

এখানে কয়েকটি লাইনের মোড়কে কবি কল্পনার সাহায্যে শরৎকালের শীতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে দীর্ঘপথ তিনি হাঁটছেন, লাল মুখের কৃষক অর্থাৎ পরিশ্রান্ত নিম্নবিত্ত কেউ, বেড়ার ওপর চাঁদ ঝুলে থাকা অর্থাৎ দুর্লভ কিছু পাওয়ার আশা, এবং সাদা নক্ষত্রগুলি সাদা শহুরে বাচ্চাদের মতো ঝলমল করছে অর্থাৎ, আশার প্রদীপ  তখনো  জ্বলছে… ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ইঙ্গিত করেছেন।

মুষ্টিমেয় শব্দের সাথে তিনি কবিতাটির মূল ধারণাগুলিকে কল্পনার সাথে এঁকেছেন এবং কবিতার কাঠামোর মধ্যে অন্তর্নিহিত কাব্যিক চিন্তাকে ঘনীভূত করেছেন। অসভ্য চাঁদ, কুঁচকে থাকা তারা, লাল মুখের কৃষক, শীতের স্পর্শ, শরৎ-এর রাত ইত্যাদি কবিতাটিকে সৌন্দর্য, গভীরতা এবং অর্থ যুক্ত করে।

এক্সপ্রেসিওনিজম (অভিব্যক্তিবাদ):

এক্সপ্রেসিওনিজম একটি আধুনিকতাবাদী আন্দোলন, শুরুতে কবিতা ও চিত্রকলায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের সাথেমানবতার ক্রমবর্ধমান বিভেদপূর্ণ সম্পর্ক এবং সত্যতা ও আধ্যাত্মিকতার হারানো অনুভূতির সাথে এক বিস্তৃত উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জার্মানি জুড়ে বিভিন্ন শহরে একসাথে এক্সপ্রেসিওনিজম উত্থিত হয়েছিল। এটি উনিশ শতকের শেষের প্রাকৃতিকতা এবং ইমপ্রেশিওনিজমের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন। এর বৈশিষ্ট্য হল বিশ্বকে কেবল একটি বিষয়গত দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা এবং আবেগ দ্বারা এর ধারণাগুলি উৎসাহিত করা।

ইমপ্রেশনিজম এবং একাডেমিক শিল্পের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া হিসাবে এক্সপ্রেশনিজমকে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে প্রতীকবাদী স্রোত দ্বারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। ভিনসেন্ট ভ্যান গো, এডওয়ার্ড মাঞ্চ এবং জেমস এর বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগ ও আকুলতা  প্রকাশের জন্য রূপের বিকৃতি এবং  দৃঢ়বর্ণের স্থাপনাকে উৎসাহিত করে এক্সপ্রেশনবাদীদের কাছে  বিশেষভাবে  প্রভাবশালী  প্রমাণ করেছিলেন।

ইংরেজি ভাষার আধুনিকতাবাদী কবিতায় কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব এবং বিংশশতাব্দীর অন্যতম প্রধানকবি হিসেবে বিবেচিত টমাস স্টার্নস এলিয়ট ওএম ছিলেন একজন কবি, প্রাবন্ধিক, প্রকাশক, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক এবং সম্পাদক। টি,এস এলিয়টের কবিতার দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত কোয়াট্রাইনের কবিতাগুলির মধ্যে একটি অন্যতম জনপ্রিয় এক্সপ্রেসিওনিজম কবিতা হল, ‘Whispers of Immortality(1920)!’

একজন  নাট্যকার জন ওয়েবস্টার, তার জীবন ও মৃত্যুর কথা কীভাবে চিন্তা করছিলেন, সে বক্তব্য দিয়ে কবিতাটি শুরু করেন এলিয়েট। পাশাপাশি জন ডন-এর মতো অন্যান্য লেখকদের জীবনের মৃত্যুর সত্যতাও তিনি তুলে ধরেন। তাঁরা জ্ঞান ব্যবহারে গভীরভাবে তদন্ত করে নিজের হাড়ের মধ্যে মৃত্যুর উপস্থিতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবিতার মোট ৮টি স্তবকের প্রথম স্তবকটি তুলে ধরছি।

Webster was much possessed by death
And saw the skull beneath the skin;
And breastless creatures under ground
Leaned backward with a lipless grin.

ওয়েবস্টার অনেকটা মৃত্যুর কবলে ছিল
এবং সে ত্বকের নীচে খুলি দেখেছে;
এবং মাটির নিচে স্তনহীন প্রাণী
লিপলেস হাসি দিয়ে পিছনে ঝুঁকছিল। (অনুবাদ)

কবিতার প্রথম স্তবকে কবি জন ওয়েবস্টার এর বিশ্বাস এবং কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেছেন। জন ওয়েবস্টার আজ নাট্যকার ও ‘ডাচেস অফ মালফি’র লেখক হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত। তিনি শেক্সপিয়ারের সমসাময়িক ছিলেন এবং এলিয়টের খুব পরিচিত, কাছের একজন। কবি এখানে প্রথম লাইনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যে ওয়েবস্টার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং সে সময়তার তার চিন্তাভাবনাগুলি গ্রাস করেছিল। মৃত্যুর সময় ওয়েবস্টার পুরোবিশ্ব এবং ‘ত্বকের নীচে খুলি’ বলতে পৃথিবীর সজ্জিত মুখোশগুলিকে দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবি এখানে ওয়েবস্টারের চিন্তাভাবনাকে বর্ণনা করার জন্য আরেকটি রূপক ব্যবহার করেছেন। তিনি অদ্ভুত এবং ‘স্তন্যহীন প্রাণীদের’কে ‘মাটির নীচে’ দেখতে পেলেন। এই প্রাণিদের কবি হৃদয়হীন বা মানুষের মানবিক উদ্দেশ্য ছাড়াই বুঝিয়েছেন। এটি একটি গথিকচিত্র বলা যায় যেখানে একটি প্রাণীর চিত্র দ্বারা আরো গভীরভাবে প্রকৃতপক্ষে একটি উন্মুক্ত মানুষকে বুঝানো হয়েছে যিনি ‘ঠোটহীন হাসিতে’ ঝুঁকে পড়ছেন।

কবিতার দ্বিতীয়ার্ধে জীবনের সাথে যৌনতার পরিচয় দেখানো হয়। কবিতায় একটি চরিত্র গ্রিশকিন, যিনি জীবন এবং আবেগের প্রতিনিধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। তিনি একজন যৌনব্যক্তি এবং তার স্তনে পৌঁছানোর পরই অন্যরা তার শীতল হাড়ে শেষপর্যন্ত মৃত্যুর সন্ধান পাবেন। মৃত্যুর উপস্থিতির অধ্যয়ন কীভাবে সমস্তকিছু গ্রাস করবে, সেই বর্ণনা দিয়ে লেখক কবিতাটি শেষ করেন।

সুরিয়্যালিজম (পরবাস্তববাদ):

সুরিয়্যালিজম বিকশিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ডাডাবাদী কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে। ১৯২০ এর দশকে ফ্রান্সের একটি দর্শনপ্রক্রিয়া থেকে সুরিয়্যালিজম বা পরাবাস্তববাদের বিকাশ ঘটে। সুররিয়ালিস্টদের চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতনা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও শৈল্পিক সৃজনশীলতায় বিকাশ ঘটাতে অচেতন মনের গভীরে যাওয়ার চেষ্টায় অস্তিত্ববাদ আন্দোলনে বিশৃঙ্খলা তৈরি করাই সুরিয়্যালিজমের কাজ।

এটি এমন এক বাস্তবতা যার সাথে মূলত ব্যবহারিক সত্যজাত বাস্তবতার কোন মিল থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। প্রচলিত সামাজিক নিয়ম-নীতি, শৈল্পিক সম্মেলন, বস্তুনির্ভর যুক্তির শৃঙ্খল, এসব ভেঙে ফেলে সুরিয়্যালিজম  গুরুত্ব দেয় জীবনের বিস্ময়কর কল্পনার ওপর যা মানুষের স্বপ্নে লুকিয়ে থাকে। সুরিয়্যালিজম অবচেতন মনে বিশৃঙ্খলায়, অস্বাভাবিকতায়, ভয়ে, অযুক্তিতে, অনিয়ম-কুসংস্কারজ্ঞানে, গতানুগতিক সকল নিয়ম-কানুন, সংস্কার, নৈতিক ও নান্দনিক আইন-কানুনকে অস্বীকার করে।

সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদকে ডাডাবাদের সার্থক ও সফল উত্তরসূরী ধরা হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপিয় একটি শিল্প আন্দোলন ও শিল্পতত্ত্ব হল ডাডাবাদ। পূর্ব  ইউরোপ রুমানিয়ায় ডাডাবাদী চিন্তাধারা সূত্রপাত হয়েছিল। রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই ডাডাবাদী কবিতা ও গদ্যের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। অতিরিক্ত যৌক্তিক চিন্তা ও বুর্জোয়ামূল্যবোধ মানবসভ্যতার অমঙ্গল করে; কাজেই যৌক্তিকতা বিরোধী ও শিল্পবিরোধী অবস্থান নেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে-এই বিশ্বাসই ডাডাবাদী চিন্তাচেতনা।

সুররিয়ালিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি কবি গিয়োম অ্যাপোলিনিয়ার। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পল ডিরমি’র কাছে লেখা এক পত্রে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তাই গিয়োম অ্যাপোলিনিয়ারকে সুরিয়্যালিজম ধারার আদি পুরুষ ধরা হয়।১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর সুররিয়ালিজমের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। দুই সপ্তাহ পর ১৫ অক্টোবর দ্বিতীয় ইশতেহারটি এবং ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইশতেহারটি প্রকাশ করেন আন্দ্রে ব্রেতোঁ। এরপর দু’জনেই দু’টি দলে সুরিয়্যালিস্টশিল্পীর নেতৃত্ব দেন। ডাডাইজম আন্দোলনের সদস্য ছিলেন দু’জনেই।

যদিও ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সুরিয়্যালিজম আন্দোলন থেমে যায়, কিন্তু সাহিত্যচর্চায় সুরিয়্যালিজম এখনো বেশলক্ষণীয়। আন্ড্রে ব্রেটনের তাঁর ‘ফ্রিডম ফর লাভ’ কবিতায়  লিখেছেন,

My wife with the hair of a wood fire
With the thoughts of heat lightning
With the waist of an hourglass
With the waist of an otter in the teeth of a tiger
My wife with the lips of a cockade and of a bunch of stars of the last magnitude
With the teeth of tracks of white mice on the white earth
With the tongue of rubbed amber and glass
My wife with the tongue of a stabbed host.

আমার স্ত্রী কাঠের আগুনের চুল নিয়ে
তাপ বিদ্যুৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে।
একটি ঘণ্টাঘড়ি কোমর সঙ্গে বেঁধে
বাঘের দাঁতের মত একটি কোমর নিয়ে
আমার স্ত্রী পুরস্কৃত করে ঠোঁট এবং একগুচ্ছ তারার মেলায় শেষমেষ;
দাঁতের ট্রাকে সাদা পৃথিবীর সাদা ইঁদুর নিয়ে
রাবার এবং কাচের জিভ দিয়ে
ছুরিকাঘাতকারীর জিহ্বায় থাকে আমার স্ত্রী (অনুবাদ)।

এটি আন্ড্রে ব্রেটনের লেখা সুরিয়্যালিজমের অন্যতম সেরা একটি উদাহরণ। কবিতার লাইলগুলোতে তিনি তার স্ত্রীকে একটি কাঠের আগুনের চুল, তাপ বিদ্যুতের চিন্তা-ভাবনা, কোমড়ে  ঘণ্টাঘড়ি, কোমড়ে একটি ক্ষুদ্র বাঘের দাঁত, রাবার-কাঁচের ছুরিকাঘাতকারীর জিহ্বায় স্ত্রীকে বসিয়েছেন। এখানের ব্যবহৃত শব্দগুলোর সাথে বাস্তবতার চিত্রগুলি অযৌক্তিকতা। কোন মিলনেই। কবির মন এবং তার জীবন-যাপনের একটি বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি প্রদর্শন করার জন্য এগুলি কেবল অযৌক্তিকভাবে একত্রিত করা হয়েছে।

‘দ্যা ফিলোসোফার ল্যাম্প’ সুরিয়্যালিস্ট রেনে ম্যাগরিটের জনপ্রিয় চিত্রগুলির মধ্যে একটি যা তাঁর জ্ঞানের এবং নিজের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দার্শনিক চিন্তাধারার এক জনপ্রিয় চিত্রকর্ম। মোমবাতির কুণ্ডলী বলতে চিত্রশিল্পী এখনে তাঁর জ্ঞানকে-বুঝিয়েছেন, এবং  নাক ও মাথা দ্বারা নিজেই ধূমপান করছেন বলে বুঝিয়েছেন। ১৯৯২ সালে এলান হলস্ এর প্রথম এলবামপ্রিপেড্রিম এক কভার হিসাবে ‘দ্যা ফিলোসোফার’স ল্যাম্প’ ব্যবহার করেছিলেন। এটি একটি কৌতূহলপূর্ণ স্ব-প্রতিকৃতি যাতে ম্যাগ্রাইটের নাকটি একটি হাতির কাণ্ডের মতো ছড়িয়ে আছে এবং যে পাইপটি  দিয়ে ধূমপান করছেন সেখানে তাঁর নাক-পাইপটিতে নেমে গেছে। এটি দ্বারা তিনি নিজের নেশার গভীরতা বুঝিয়েছেন। তিনি এখানে একদিকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন যা তাঁর করুণ দুঃখ ও দুর্বলতাকে বুঝায়। একটি কৃমির মত মোমবাতি আমরা দেখতে পাই তার সামনের টেবিলে দুর্বল হয়ে জ্বলছে।

বাংলা কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা করতে করতে গেলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিকল্প আর কিছুই নেই। মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে আঠারো শতকে বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার ছোঁয়া। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো তিনি পরিবর্তন টেনে সাহিত্যকে আরো সাবলীল, বাস্তবিক, প্রাণবন্ত করেছেন।

আধুনিকতাবাদ বলতে আমরা যদি সাম্প্রতিক শৈল্পিক সাহিত্য চর্চা, মনোভার, চিন্তা-চেতনাকে বুঝে থাকি, তবে প্রশ্ন আসে, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁদের সময়কালে কি অনাধুনিক ছিলেন? না। যে কোন শিল্পকর্ম, চিত্রকর্ম বা কবিতা সমসাময়িককালের ক্ষেত্রে আধুনিক। তবে সর্বকালেই নয়। তিরিশের দশকের অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আজো আধুনিক কবিদের সাহিত্যে ভাব বিবর্তন, ভাষা নির্মাণ ও নতুন চিত্রকল্প সৃষ্টিতে নান্দনিকতার গহীন সৌন্দর্যে পৌঁছাতে আলোক দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমেই আমরা পাই শিল্পরীতির ঋদ্ধি।

বলা হয়ে থাকে ফরাসী বিখ্যাত কবি শার্ল বোদলেয়ার প্রভাব ফেলেছিলেন জীবনান্দের  কবিতায়। বোদলেয়ারের কাব্যে শূন্যতাআর মানসিক ক্লান্তির ক্ষয় চিত্রটি জীবনানন্দের বহু স্তরের নারী চেতনায় উপস্থাপন করেছেন। তবে পাশ্চাত্যের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হলেও জীবনানন্দ তাঁর বাংলার মাটি, পাখি, ফুল, নারীকে প্রাধান্য দিয়েছেন নিজ কবিতায়। জীবনের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করা কবি জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির রূপ-রসের মধ্যে শান্তি খুঁজেছেন।

মৃত্যুর পরে ট্রাংক ঘেঁটে উদ্ধার করা জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি ১৯৩৪ সালের দিকে লেখা ‘ত্রস্ত নীলিমা’ পাণ্ডুলিপিটির পরিবর্তিত নাম হিসাবে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। রূপসী বাংলা’য় দেখা যায় কবি কীভাবে প্রকৃতির রূপে আশ্রিত হয়ে জীবন ও জগতকে অনুসন্ধান করার তীব্র প্রয়াস চালিয়েছিলেন। কবির ব্যক্তি জীবনের লড়াই অনেকটাই আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্য চেতনা ও কলমে।

তবে একটা সময় বস্তুজগতের নিত্য লড়াই ও আঘাতে জর্জরিত হয়ে সত্যের সন্ধানে চৈতন্য মগ্ন কবি জীবনানন্দ পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করেন, যেখানে কবি তাঁর ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় রোদে খুঁজেছেন “কমলা রঙ’, ধূসর পাণ্ডুলিপি দেখেছেন ‘হরিণ ও সিংহের ছালে।‘  কবির পরাস্তববাদের শক্তিশালী একটি কবিতা হল ‘হাওয়ার রাত।’ এখানে কবি বলেন,

‘সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে; মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মত।’  কবি আরও বলেন,

জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!

কবি এখানে চারহাজার বছর আগের প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মহিলা শাসক রানী সেমিরাস বা সাম্মু-রামত’কে টেনে এনেছেন, যার শক্তিশালী অশূরীয় সাম্রাজ্য শাসন এবং রূপ রোমান যুগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত লেখক এবং চিত্রশিল্পীদেরকে ভাবনায় ফেলেছিল।

সমকালীন নগর সভ্যতার নাগরিক জীবনের বিমূর্ত চেতনায় জাগ্রত কবি শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় প্রেম টেনেছেন নতুন আঙ্গিকে। তাঁর ‘কোন এক পরিচিতাকে’ কবিতায় লিখেছেন,

জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া।

কবি এখানে অযৌক্তিক রুপকের ব্যবহারে প্রেমিকার চোখে ‘জারুলের বন’ দেখেছেন যা বাস্তবে সম্ভব নয়।

সাহিত্য আধুনিকতায় বিষয়বস্তু ছিল আধুনিকতাবাদ, চিরাচরিত লেখার চর্চা, শিল্পবাদ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া, যা আধুনিকতাবাদী লেখকদের রচনায় বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুতে লক্ষণীয়।

আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা অসংখ্য তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবি-লেখকদের দেখা পাই যাদের অনেক কবিতায় পরাবাস্তবতার গন্ধ পাওয়া যায়। আধুনিক কবিতার গতিশীলতায় পরাবাস্তব সময় উপযোগী।

 

সম্পাদনা: জোবায়েন সন্ধি

এইচ বি রিতা। কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। জন্ম বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। বর্তমান নিবাস কুইন্স, নিউইয়র্ক। তিনি নিউইয়র্ক সিটি পাবলিক স্কুল শিক্ষকতায় জড়িত রয়েছেন দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে। পাশাপাশি কাজ করছেন দৈনিক প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা ভার্সনে। এছাড়াও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..