শিশুদের রুপকথার বই পড়তে দিন

আর্শিনা ফেরদৌস
প্রবন্ধ
Bengali
শিশুদের রুপকথার বই পড়তে দিন
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে  এখন  শুরু  হয়,
 দৈত্য-দানো, পরী কিংবা সিন্ডারেলার জুতা হারিয়ে যাওয়ার গল্প কিংবা ব্যাঙকে চুমু দিয়ে রাজপুত্র বানিয়ে ফেলার গল্প তো পড়েছেন নিশ্চয়ই। আপনার মা বা দাদী হয়তো আপনাকে গল্প পড়ে পড়ে শোনাতেন আর আপনি হারিয়ে যেতেন কল্পনার রাজ্যে। বড় হওয়ার পরেও রূপকথার গল্প পড়ে আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন হয়তো কেউ কেউ। রূপকথার গল্প শুধুই নিছক বিনোদনের মাধ্যম নয়। রুপকথা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। গল্পের ছলে জীবনের নানান সমস্যা ও আনন্দের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় রূপকথায়। জীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরী ছোট্ট বেলার সেই রূপকথার গল্প গুলো। জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাত, সমস্যা, সুখ, দুঃখ, ভালো-খারাপের পার্থক্য শেখায় রূপকথা। ফলে ছোট বেলায় যখন বুদ্ধির বিকাশ হয় তখন জীবন সম্পর্কে নানান রকম শিক্ষার হাতেখড়ি হয় রূপকথার মাধ্যমেই। তাহলে এবার জেনে নেয়া যাক জীবনের জন্য কেন রূপকথা প্রয়োজন।
ঠাকুরমারঝুলি কেন সফল রুপকথার বই
রূপকথার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই । এটাই রূপকথার প্রধান বৈশিষ্ট্য । এই বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি করে আমরা ঠাকুরমার ঝুলিকে সার্থক রূপকথামূলক গল্প বলতে পারি । ঠাকুরমার ঝুলিতে আমরা দেখে/পড়ে আসছি যে তাল গাছের পেত্নী , আমবাগানের ডাইনি অথবা শ্মশানের ব্রহ্মদৈত্য ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এইধরণের গল্পে আমরা দেখি/পড়ি অমুক রাজ্যের রাজকুমারীকে কোন এক বিকটদর্শনা পেত্নী অপহরণ করে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে কোন গুহায় অথবা পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে রেখে আসে । সেখানে কোনো একটি টিয়া পাখির মধ্যে সেই পেত্নীর জীবন লুকিয়ে আছে । এখন তমুক রাজ্যের রাজকুমার সেই টিয়া পাখিটিকে হত্যা করে রাজকুমারীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং তার সাথে রাজকুমারীর বিয়ে হয় । এইধরণের গল্প‌ই সাধারণত আমরা ঠাকুরমার ঝুলিতে দেখে এসেছি ।
এই গল্পগুলোর সাথে বাস্তবের দূর দূর পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু তবুও আমরা এগুলো পড়ি বা দেখি । গল্পগুলোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই চরম অবাস্তব এটা জানার পরেও আমরা এগুলো বিশুদ্ধ বিনোদনের জন্য পড়ি অথবা দেখি । আর এখানেই ঠাকুরমার ঝুলির সার্থকতা ।
মূলত কিশোর পাঠক-পাঠিকাদের অবসর বিনোদনের জন্যই দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ঠাকুরমার ঝুলি নামক গল্পগ্রন্থ লিখেছেন । আর কিশোরপাঠ্য হবার পরেও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরাও ঠাকুরমার ঝুলি তে বুঁদ হয়ে থাকে । তাই রূপকথা মূলক গল্প হিসেবে ঠাকুরমার ঝুলি চরম সার্থক ।
সমস্যা সমাধান করতে শেখায়
আমরা প্রতিনিয়ত কত সমস্যায় জর্জরিত হই। আজ এই সমস্যা তো কাল ঐ সমস্যা। ছোট বেলায় আমরা যখন রূপকথার গল্প পড়তাম কত ডাইনী বুড়ি, দৈত্য-দানোর আক্রমন ও কুট-চালে থেকে রাজকুমারী-রাজকুমারদেরকে নিজের বুদ্ধি বলে উদ্ধার পেতে দেখতাম। আর সেখান থেকেই কিভাবে বিপদ এড়াতে হয়, কিভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয় সেসবের প্রথম শিক্ষা পেয়ে যেতাম আমরা। এই প্রাথমিক শিক্ষাই সারাজীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করে আমাদেরকে।
ভালো মন্দের তফাৎ শেখায়
১.ভালো মন্দের তফাৎ শেখায়
কে ভালো, কে খারাপ কিংবা কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এটার পার্থক্য শেখায় রূপকথা। কিভাবে ডাইনি বুড়ি ছল চাতুরী করে বিপদে ফেলে, কিভাবে দৈত্য আক্রমন করে এগুলো ধীরে ধীরে বাচ্চাদের মস্তিষ্কে ঢুকে যায় এবং যে ভালো চাইছে কে খারাপ চাইছে এই বোধ তৈরী হয় তাদের মধ্যে।
২.প্রানীদেরকে ভালোবাসতে শেখায়
রূপকথার গল্পে ইদুর, পাখি, খরগোশ ও আরো অনেক প্রানীকেই বন্ধু ভাবতে শেখানো হয়। গল্পের রাজকুমারীকে তাঁরা নানান ভাবে সাহায্য করে, রাজকুমারীর সাথে গল্প করে, রাজকুমারীর কোলে- কাঁধে বসে থাকে এসব প্রাণী। আবার যেসব প্রাণী ক্ষতিকর সেগুলোকে খারাপ হিসেবেই দেখানো হয়। তাদেরকে দেখানো হয় শত্রুর সহচর হিসেবে। তাই ছোটবেলাতেই শিশুরা শিখে ফেলে কোন প্রাণীটি বন্ধু আর কোন প্রানীটি ক্ষতিকর। যেসব প্রাণী ক্ষতিকর না সেগুলোকে বন্ধু ভেবে ভালোবাসতেও শেখায় রূপকথা।
৩.গল্প তৈরি শেখায়
গল্প বানাতে শেখার প্রথম হাতেখড়ি হলো রূপকথা। মূলত রূপকথার গল্প পড়ার মাধ্যমেই কিভাবে গল্পের প্রেক্ষাপট তৈরী করতে হয়, মূল চরিত্রগুলোকে কিভাবে সাজাতে হয়, কাহিনী এগিয়ে নিয়ে একসময় গুছিয়ে শেষ করতে হয় ইত্যাদি শেখা যায়। এমন কি কোন গল্পটি ভালো কোনটি খারাপ এটা তুলনা করার ক্ষমতাও জন্মায়।
৪.কল্পনা শক্তি বাড়ায়
যখন কোনো রূপকথার গল্প শুনতেন তখন নিশ্চয়ই কল্পনায় সেই দৃশ্যগুলো ভেসে উঠতো। রূপকথার গল্পের চরিত্রেগুলোর কথা বললেই এখন আপনার মনে যেই গোলাপী জামা পরা রাজকন্যা, সবুজ শিং ওয়ালা দৈত্য কিংবা কালো পোশাক পরা ডাইনি বুড়ির ছবি ভেসে উঠে তা আপনার ছোটবেলারই কল্পনা। রূপকথার গল্পের বইয়ের রঙিন ছবিগুলোরও কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে মনের উপরে। শোনা গল্প এবং বইয়ের রঙিন ছবি দুটি মিলিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায় শিশুরা। ফলে কল্পনা করার ক্ষমতা বাড়ে যা পরবর্তি জীবনে নানান ধরণের সৃষ্টিশীল কল্পনা করতে সহায়তা করে।
আমরা অনেকে  শৈশবে রুপকথা ছাড়া কিছু ভাবতেই পারতাম না।অন্য বইও পড়া হত রুপকথা উপকথা আগে থাকত।
কিছু ক্ষতিকর তেমন নেই আপাতত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে কিছু কাল্পনিক চরিত্র  কোমলমতি শিশুদের।
রূপকথাগুলিতে প্রায়শই এমন থিম থাকে যা অবাস্তব এবং লিঙ্গ স্টিরিওটাইপগুলিকে স্থায়ী করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একমত যে শিশুদের উপর তাদের সামগ্রিক প্রভাব ইতিবাচক , তাদের সৃজনশীলতাকে শক্তিশালী করা থেকে শুরু করে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের সাহায্য করা
বড়বেলায় ও  কেউ কেউ ছোটদের বই পড়ি লেখার চেষ্টা তো আছেই। ছোটরা প্রযুক্তির থাবায় একেবারে হারিয়ে যাবার আগে ওদের হাতে রুপকথা উপকথা তুলে দিন। অন্য বইগুলোর প্রতিও আগ্রহ গড়ে তুলতে হবে। অক্ষর বাক্য    ইত্যাদি খাতা কলম পেন্সিল দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করুন। ল্যপটপ বা মোবাইলের ব্যবহার শেখার আগে কাগজ পেনসিলে লিখতে শিখুক। বইপড়া এভাবেই শুরু হবে।আইন স্টাইনের কথা মেনে চলি
“শিশুদের বুদ্ধিমান করে গড়তে হলে রুপকথার বই পড়তে দিন  “- আলবার্ট আইনস্টাইন

আর্শিনা ফেরদৌস। কবি। জন্ম বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলা শহরে। বর্তমান নিবাস ঢাকা। প্রকাশিত বই: 'কাঠগোলাপের গাছে মেঘ নেমেছিলো' (২০২০)

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..

কবি চন্ডীদাস ও চন্ডীভিটে

কবি চন্ডীদাস ও চন্ডীভিটে

  কেতুগ্রামে যেখানে চন্ডীদাস বাস করতেন সেইস্থানটি চন্ডীভিটে নামে লোকমুখে প্রচারিত। চোদ্দপুরুষের ভিটে বাঙালির মনে…..