শীলা আখ্যান

রাবেয়া রাহীম
গল্প
Bengali
শীলা আখ্যান

তাহের সাহেব গভীর মনযোগ দিয়ে শীলার কোমরের দিকে চেয়ে আছেন। তার মোটা দুই ভুরুর মাঝখানে চিকন ভাঁজ । সিগারেটে পোড়া পুরু ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে কামতৃষ্ণা। তিনি জীভ দিয়ে চেটে শুষ্ক ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করেন।

দুই মাস আগে শীলা যখন জয়েন করেছিল তখন তাঁর কোমর বেশ ছিপছিপেই ছিলো। কামিজের নীচে সরু কোমরের ছন্দ তুলে সে যখন তার রুম থেকে বের হয়ে যেতো নিজের চেয়ারে বসে পিছন থেকে শীলার কোমরের ঢেউ তোলা দুলুনী তিনি কামাতুর দৃষ্টি দিয়ে উপভোগ করতেন।

তিনি বেশ কয়েকবার আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন যে তার সাথে তিনি অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে চান কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারনে মেয়েটি তাকে এড়িয়ে চলছে।

তবে কোমরে মেদ জমলেও লাবন্য যেন চুইয়ে পরছে মেয়েটির শরীর বেয়ে।

তাহের সাহেবের লোভাতুর চকচকে দৃষ্টি শীলার শরীরজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। তিনি অশ্লীল আত্মতৃপ্ত লাভ করেন।

ছিপছিপে গড়নের আটাশ বছর বয়সী শীলা তাহের সাহেবের নতুন অফিস এডমিনিস্ট্রেশন অফিসার।

তাহের সাহেব কিছুটা বিব্রত হন এই ভেবে যে, শীলা তার বেতনভুক্ত কর্মচারী তথাপি এই মেয়েটি যতক্ষণ তার আশে পাশে থাকে তার পুরোটা মনোযোগ শীলার প্রতিই থাকে। অবশ্য ৫২ বছরের পুরনো এই শরীর – মনে শীলা তাঁর প্রথম আসক্তি নয়।

শীলার আগে ওই পোস্টে ছিলো দীপা। দীপার কথা মনে পড়ে যাওয়াতে তিনি কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠেন। অপূর্ব দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারিনী ছিলো দীপা। তুলনামুলক দীপার সাথে টেক্কা দিতে হলে শীলাকে আরো অনেক পরিবর্তন আনতে হবে তাঁর জীবন যাত্রায়।

ভরাট শরীরে আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত দীপা অফিসের কাজের পাশাপাশি তাহের সাহেবের সব রকম সুবিধা অসুবিধার দিকে ছিল খুব যত্নশীল। যদিও সে আজ তাহের সাহেবের নাগালের বাইরে। কিন্তু নিশুতি রাতে দীপার চমৎকার ঢেউ জাগানো পেলব শরীর তাহের সাহেবকে জাগিয়ে রাখে ।

উচ্চাভিলাষী দীপার জীবনের গল্পে জায়গা করে নিতে তাহের সাহেবেকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। প্রায় দুই বছর দীপা নামক নয়া অখ্যানের সমস্ত পংতি তাঁকে নেশায় বুঁদ করে রেখেছিল । এতে অবশ্য দীপাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দুই বছরেই সে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট–গাড়ীর মালিক হয়েছিল ।

একদিন দীপা স্ত্রীর মর্যাদা চেয়ে বসে। দুই কন্যা সন্তানের জনক তাহের সাহেবের এমন আবদার বরাবরই অপছন্দ। তাছাড়া ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে তাঁর স্ত্রীও অফিসের শেয়ারের অংশিদার।

রাতে তিনি যখন সুন্দরী স্ত্রী রানুর পাশে শুয়ে দীপার আব্দারের কথা ভেবে অনমনা হঠাৎ রানুর একটা হাত তাহের সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। অল্প ভারী নিঃশ্বাস ফেলে রানু ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে, “সকালে অফিস আছে, ঘুমাও।”

স্ত্রীর কথায় তাহের সাহেবের ভাবনার মোড় ঘুরে যায়। রানু তার দুই সন্তানের মা। রানু থাকতে তার আরেকটা বউয়ের তো প্রয়োজন নেই। যদিও রানুর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে।

কিন্তু… রানু… হ্যাঁ, একটা সমস্যা তো আছেই। রানু আর আগের মত নেই।

‘রানু আগের মত নেই’ এই বাক্য থেকে অন্ধকার ঘরে আবারও দীপার মুখ ভেসে উঠে। তবে কি তিনি দীপা স্যাটারিয়াসিসে আক্রান্ত ? তিনি শংকিত বোধ করেন।

দীপাকে ভূলে যাওয়ার জন্য তিনি নিজে সিভি বাছাই করে দীপার চেয়ে সুন্দরী যোগ্যতা সম্পন্ন শীলা কে নিয়োগ দিয়েছেন।

তাহের সাহেবের খুব ইচ্ছে করে রোজই এই পোস্টে নতুন কাউকে বসান। কিন্তু তার কাছে মেয়ে জাতি বিরাট একটা প্রশ্নবোধক। এরা শুরুতেই নিজেকে প্রকাশ করতে চায় না। তবে যখন নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করে, তখন না মানে জগত, না মানে আইন, না মানে জোয়ার।

অফিসের সব রকম কাজে শীলা যথেষ্ট পারদর্শী হলেও কি এক অজানা কারনে তার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে সে। তাহের সাহেব হিসেব মেলানোর চেষ্টা করেন। তবে মেয়েটি খুব আন্তরিক।

গাজিপুরে তিনি দুই বিঘা জমি কিনেছেন একটি মোটেল বানিয়ে ভাড়া দিবেন বলে। আজকে তিনি ইচ্ছে করেই শীলাকে তার সাথে গাজীপুর নিয়ে এসেছেন ।

কন্সট্রাকশনের কাজ দেখার বাহানায় শীলাকে যদি কিছুটা কাছে পাওয়া যায় সেটাই আসল উদ্দেশ্য। তার উত্তরা অফিস থেকে গাজীপুর যেতে সময় খুব কম লাগে। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম পার হয়ে প্রায় দুই ঘন্টা। গাড়ীতে ওই সময়ে ড্রাইভারের সামনে তিনি শীলার সাথে খুব ফরমাল কথাই বলেছেন।

শহরের কোলাহল মুক্ত চারিদিকে বাউন্ডারি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা জায়গাটি খুব মনোরম। এই জমিটি কেনার পর তাহের সাহেব শাল ও মেহগনি গাছের চারা লাগিয়েছিলেন সীমানা প্রাচির ধরে। গাছগুলো কয়েক বছরে বড় হয়েছে অনেকটা। প্রতিটি গাছে পাতার সমাহারে এই জায়গাটির পরিবেশ খুব মায়াবী ।

মোটেলের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে। পাশে কিছুটা জায়গা জুড়ে কর্মচারীদের থাকার জন্য অস্থায়ী টিনশেড একটি ঘর।

তাহের সাহেব আর শীলা যখন এখানে এসে পৌঁছান তখন প্রায় দুপুর। অবশ্য শীলা আগের দিন কেয়ারটেকার কে বলে রেখেছিল দুপুরের খাবারের কথা। তাজা সব্জী , টাটকা মাছ এসব কিছুই তাহের সাহেবের পছন্দ ।

তাহের সাহেব গাড়ি থেকে মোটেলের কাজের অগ্রগতি দেখে সন্তুষ্ট চিত্তে শীলার দিকে চেয়ে বলেন ” দুপুরের খাবারের কি আয়োজন ?”

“স্যার, আমি গতকাল কেয়ারটেকারকে বলে রেখেছিলাম আপনার পছন্দের খাবারের কথা। নিশ্চয় সে সবই রান্না করিয়ে রাখবে তারপরেও আমি একবার দেখে আসি” —

এই বলে শীলা গাড়ী থেকে নেমে অস্থায়ী টিনশেড ঘরটির দিকে এগিয়ে যায়।

তাহের সাহেব আবারও বিরক্ত বোধ করেন শীলার উপর। তিনি ঠিক ধরতে পারেন না এই মেয়েটি কেন তার আশে পাশে বেশীক্ষণ থাকতে পছন্দ করেনা। তবে কি তিনি বুড়িয়ে গেছেন! ৫২ বছর বয়সেও তিনি যথেষ্ট পেটানো শরীরের অধিকারী। বাইশ বছরের তার জমজ কন্যা আছে তাকে দেখলে কেউ বুঝতে পারেনা। বয়সের তুলনায় অনেক বেশী তারুন্য ধরে রেখেছেন। তাঁর মোটা মোটা জোরা ভ্রু আবার কুঁচকে যায়।

তাহের সাহেব পকেট থেকে লাইটার হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলেন । সিগারেটের প্যাকেট খুলতে ইচ্ছে করছেনা। দূর থেকে শীলার খিলখিল হাসি দেখে মেজাজ বিগড়ে গেছে তার। কার সাথে এত হাসাহাসি তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। শীলা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার মত খোলা জায়গাতে। যার সাথে কথা বলছে সে ঘরের ভেতর। তিনি হাত ইশারায় ইদ্রিস আলীকে ডাকলেন। ইদ্রিস আলী এই জায়গার কেয়ারটেকার। আজ সকাল থেকেই তাঁর ছোটাছুটি বেড়ে গেছে বড় সাহেব ঢাকা থেকে আসবে বলে। আশেপাশের খোলা জায়গায় হাল্কা ঠান্ডায় শীতের আমেজ এনে দেয়। কিন্তু বড় সাহেবের ইশারায় তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠে । সে ত্রস্ত পায়ে ছুটে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে বলল ” জী স্যার”

তাহের সাহেব শীতল গলায় জানতে চাইলেন —

” ঘরের ভেতর কে”?

ইদ্রিস আলীর ত্বরিত উত্তর — ” ইঞ্জিনিয়ার শামস স্যার, আপনি আজ আসবেন তাই তিনিও এসেছেন কাজের তদারকি দেখতে”

তিনি হাত ইশারায় ইদ্রিস আলীকে চলে যেতে বললেন।

দূর থেকে তাঁদের হাসি দেখে তাহের সাহেবের বেশ রাগ লাগছে। মোটেলের কাজ শেষ হলেই তিনি শামস ছেলেটিকে বরখাস্ত করবেন এই কঠিন প্রতিজ্ঞায় তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।

দুপুরের খাবার পর্যন্ত তাহের সাহেবের মেজাজ যথেষ্ট পরিমাণ খারাপ থাকে। দুপুরের খাবারের সময় শীলা তাকে নিজ হাতে বেড়ে খাইয়েছে। তিনি এই সময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন মেয়েটি খুব মায়াবতী। তার অশান্ত মেজাজ এ কারনে এখন কিছুটা শান্ত । ফরসা সুডৌল কবজির উপর কালো বেল্টের গোল ডায়ালের ঘড়ি পরা হাতে শিলা পানির গ্লাস তার দিকে এগিয়ে দেয়। তিনি আবারও শিলার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছেন।

খাবার শেষ করে ইঞ্জিনিয়ার শামস চলে যেতেই তাহের সাহেব সিগারেটে আগুন ধরিয়ে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,

‘শীলা , তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে’।

শীলা ততক্ষণে শামস এর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে গেছে । কিছুটা দূর থেকে সে তাহের সাহেবের দিকে পেছন ফিরে তাকিয়েই বললো, ‘জ্বি, বলুন স্যার’।

দুই.

তাহের সাহেবের ডান হাত প্যান্টের পকেটে মুঠি করে রাখা। বাম হাতে সিগারেট ধরে আছেন। দৃঢ় সংকল্পে তার চোয়াল কিছুটা শক্ত । কোন সিদ্ধান্তে যাওয়ার পূর্বে এটা তাঁর স্বভাবগত অভ্যাস। তিনি আজ শীলার কাছে ফাইনাল কিছু জানতে চাইবেন। এতোটা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার মানুষ তিনি নন । বিশেষ করে তার পোষা কর্মচারি থেকে। পেছন ফিরে তাকানোর সময় শীলার চোখে তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল তিনি টের পেয়েছেন।

শামস গাড়ীর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। শামসের গাড়ীটি গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। এখন এই পুরো বাংলোতে তিনি ব্যতিত শীলা আর ইদ্রিস আলী। যদিও ইদ্রিস আলীর কাছে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। তিনি সিগারেট ধরা হাতে ইশারায় শীলাকে তার কাছে আসার জন্য ডাকলেন।

নভেম্বর মাসে দিনের আলো খুব তাড়াতাড়ি কমতে থাকে। কাছেই মাইকে মাগরিবের আজান ভেসে এলো। পাখিদের ঘরে ফেরার কোলাহল বাড়তে থাকে। পাখিদের কোলাহল নির্জনতা বাড়িয়ে দিয়ে আলো-আধারিতে ঢেকে যেতে থাকে চারিদিক।

তাহের সাহেবের শীতল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে শীলা আরও বেশী নির্জনতা অনুভব করলো যেন! অজানা আতংকে তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে ঊঠে। হূৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতন ঘাবড়ে যায় সে । শুকনা গলায় ঢোক গিলে বলে “ জী স্যার আসছি” ।

চাকরি তে জয়েন করার কয়েকদিন পর থেকেই সে লক্ষ্য করছে তাহের সাহেবের গা ঘেঁষা স্বভাব। স্ত্রী আর দুটি মেয়ে নিয়ে তার একটি পরিবার আছে। বাইরে থেকে তাদের ভীষণ সুখি পরিবার বলে মনে হয় । স্ত্রী সন্তানদের অজান্তে লোকটার কি অচেনা মুখ! পাকা অভিনেতা একজন !

ইন্টারভিউয়ের দিন তাহের সাহেবের আন্তরিকতা দেখে তাঁর নিজের মৃত বাবার মুখটিই মনে এসেছিলো শীলার কাছে। যদিও সে খুব ভালো করেই জানে “বাবার মতন” বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। কিছু সুযোগসন্ধানী পুরুষ সুযোগ পেলেই নখ দাঁত বসিয়ে দিতে দ্বিধা করেনা। অফিসে নিয়মিত হওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই বুঝতে পারছে তাহের সাহেবের আন্তরিকতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি লোভাতুর কামুক মুখ।

এখানে আসার আগে অফিস ম্যানেজার টিপু সুলতান তাকে সাবধান করে দিয়েছিলো। সব রকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই সে এসেছে । তাকে এখানে আসতে হয়েছে। কারন হুট করে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার মত অবস্থায় সে নেই।

চাকরিটা তার খুব দরকার। সাত বছরের একটি ছেলে সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার।

স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে আরও পাঁচ বছর আগে। ডিভোর্সের পর দুই বছরের শিশু সন্তান নিয়ে ভাইয়ের সংসারে আশ্রয় মিলে তাঁর। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হতে পারে।

বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের খবরদারিতে হাপিয়ে উঠে একসময়। এম এ পাশ করে ঢাকার বাহিরে একটি বেসরকারি এনজিওতে তার চাকরি হয় কিন্তু ছেলের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে ঐ চাকরিটা বেশীদিন করতে পারেনি।

ছয় মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে সে এই অফিসে পঁচিশ হাজার টাকা বেতনে জয়েন করে। এটা একটি ওষুধ কোম্পানির কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। অফিসে মোট ষাট জন কর্মচারী। বিদেশী সংস্খার সাথেও অনেক রকমের ডিল করতে হয়। সব মিলিয়ে অফিসে প্রচুর কাজের চাপ।

তাহের সাহেবের কামুক দৃষ্টি কৌশলে উপেক্ষা করে সব কাজ সামলাতে তাকে গলদঘর্ম হতে হয় প্রতিদিন ।

পঁচিশ হাজার টাকার দশ হাজার টাকা চলে যায় রুম ভাড়ায়। উত্তরা ১৪ নাম্বার সেক্টরের শেষের দিকে পরিচিত একজনের সাথে এক রুম সাবলেট নিয়েছে। পাঁচ হাজার টাকা ছেলের লেখাপড়ার খরচ। বাকি দশ হাজার টাকায় সংসার আর হাত খরচ। সেখান থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে জমিয়ে রাখছে বিপদ আপদের জন্য।

অনেকে জানতে চায়, ডিভোর্সের পর ছোট একটি বাচ্চা নিয়ে একা থাকে কেমন করে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব তার জানা নেই ।

তবে এটি তাঁর কাছে অবাক করা কোনো ব্যাপারও নয়। বিশ বছর বয়স থেকেই সে জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়াই করতে শিখে গেছে।

পেছন ফিরে যত দূর মনে পড়ে, অপদার্থ এডিকটেড স্বামী থাকার চেয়ে শিশু সন্তানের হাত ধরে একাকী জীবন অনেক বেশী স্বস্তির।

তবে আশেপাশে সুখী পরিবার দেখে তারও যে এমন ইচ্ছে করেনা তা নয় । কিন্তু সেসব তার কাছে প্রায় রূপকথার মত লাগে।

সাত বছরের ছেলে নিয়ে এই জীবনটাই তার খুব চেনা। ছেলেকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে নিরবে চোখের পানি ফেলে। এমন চোখের পানি তাকে আরও বেশী লড়াকু করে তোলে ।

রাজ্যের উৎকণ্ঠা আর চাপ চাপ অস্বস্তি নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এসে তাহের সাহেবের পাশে দাঁড়ায় শীলা ।

তাহের সাহেব গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলেন

“ তোমার বেতন কত”

শিলা ভাবলেশহীন উত্তর করলো

“ আপনি জানেন স্যার”

তাহের সাহেব মোটা জোড়া ভ্রু কুঁচকে প্রায় ধমকের স্বরে বললেন

“আমি সরাসরি উত্তর পছন্দ করি” ।

“পঁচিশ হাজার টাকা স্যার” — শীলার গলা কিছুটা ধরে আসে।

“এই টাকায় তোমার সংসার চালাতে সমস্যা হওয়ার কথা”

শীলার দুঃখভরা কাহিনী জানার আগ্রহ নিয়ে তিনি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

শীলা শঙ্কতি উত্তর করে— “কিন্তু আমার পোস্টে বেতন স্কেল এটাই”-

–“তুমি চাইলে বেতন তিনগুন বেড়ে যেতে পারে”

তাহের সাহেব বিজয়ীর মত বলে উঠেন । তাঁর ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ফুটে উঠে

শীলা কোন কথা বললো না। সে চুপচাপ নখ খুঁটে যাচ্ছে। ভেতরে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করলো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে । এই মানুষ হজম করা কঠিন। কিন্তু সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাকে হজম করতে। তার মাথার ভেতরটা চিনচিন করছে।

আচমকা তাহের সাহেব এক ঝটকায় শীলার হাল্কা শরীরটাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসে। নিকোটিনের ঝাঁঝালো গন্ধে শীলার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

হাল্কা আলোতে তাহের সাহেবের দাঁতের সারিতে লেগে থাকা নিকটিনের হলুদাভ দাগ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। চোখ বন্ধ করে সেকেন্ডের জন্য ।

ততক্ষণে জ্বলন্ত সিগারেট ধরা বাম হাতে দিয়ে শীলার পিঠে ঠিক ব্রেসিয়ারের হুকের উপর হাত রেখে তাঁকে তার বুকের কাছে জাপ্টে ধরে রাখে তাহের সাহেব ।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব শীলা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কয়েক মূহুর্ত কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারেনা সে।

জলন্ত সিগারেটে সিল্কের কামিজ পুড়ে পিঠের চামড়ায় জলুনি শুরু হওয়াতে সম্বিত ফিরে পায় শীলা, এভাবে পুড়ে আত্মসমর্পণ করার জন্যই কি সে গত পাঁচ বছর ধরে লড়াই করে চলেছে! এভাবে পুড়তে নয়! ওকে কিচ্ছু একটা করতে হবে ।

এই সময়টার জন্য সে প্রস্তুতই ছিলো। কেবল ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষা। ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে জোরে ধাক্কা দেয় সে। অপ্রত্যাশিত আচরণে তাহের সাহেব কিছুটা টলে গিয়ে আরো শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে।

এইবার শীলার অঝোর কান্নার বেগ দমকে উঠে । কান্নার সাথে শরীরে যতটা শক্তি আছে সমস্ত প্রয়োগ করে জোরে ভীষন জোরে এক চিৎকার দিয়ে উঠে।

চিৎকারের তীব্রতায় তাহের সাহেব দমে যান ।বাউন্ডারির ওপারেই মুরগির একটি ফার্ম । সেখানে আলো জলছে। সেদিকে চোখ যায় তার। শীলাকে ছেড়ে দেন তিনি।

শীলা ছুটতে থাকে সোজা গেটের দিকে। গেটের এক কোণে দাঁড়িয়ে ইদ্রিস আলী ছলছল চোখে গেট খুলে দেয় তার জন্য।

এইবার সে ছুটতে থাকে। দিগ্বিদিক জ্ঞাণ শূন্য যেন সে এখন। আসার সময় ভালো করে লক্ষ্য করেছিলো মেইন রোড থেকে মোটেলের দুরত্ব বড়জোর আড়াইশত গজ।

এখানে আসার সময়ের একমাত্র চেনা পথ ধরে শীলা ছুটতে থাকে।

অদূরেই গাজীপুর টু ঢাকার বাস স্ট্যান্ডের আলো দেখা যাচ্ছে। তাঁর চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে কীভাবে সময় কেটে যাচ্ছে সে জানেনা ।

চারদিকে শুনশান নিরবতার ভেতর ছুটতে ছুটতে ঘরে অপেক্ষমাণ সাত বছরের ছেলের নিষ্পাপ মুখটি ভেসে উঠে আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে শীলা।

রাবেয়া রাহীম। কবি। জন্ম ২০ মার্চ, ময়মনসিংহ; বাংলাদেশ। বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। বর্তমান নিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। জীবনকে খুব সহজভাবে দেখতে ভালবাসেন। যা কিছু মন ছুঁয়ে যায় তাই নিয়ে তাঁর ভাবনা প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতায়। কৈশোর থেকেই কবিতার সাথে তাঁর বন্ধুত্ব।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..