শুদ্ধি

ফারজানা নীলা
গল্প
শুদ্ধি

আমার কি দৌড়ানো উচিত? নাকি স্বাভাবিক ভাবে হেটে যাওয়া উচিত?আমার পাশ দিয়ে একের পর এক গাড়ি ছুটে চলছে।কার ট্যাক্সি রিক্সাট্রাক ।আমার কি কোন গাড়ি নেওয়া উচিত? ট্যাক্সি বা রিক্সা? কিসেযাওয়া উচিত বাসায়?

সন্ধ্যা বেলায় চারিদিকে উজ্জ্বল আলো। প্রতিটি দোকান চমৎকারআলোতে আলোকিত। আমার এখন কেমন লাগছে? কিছুক্ষণ আগে যাহল তা কি আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা? জীবন পালটে দেওয়ারমত কোন ঘটনা? কি হয়েছে ? আমার শরীর কি খসে পড়েছে? কোন অঙ্গনিঃসাড় হয়ে গেছে? কোথাও নোংরা লেগেছে? কোথাও চাপ পড়েছে? কোথাও ব্যাথা পেয়েছি? এমন কিছু কি হয়েছে যাতে আমার জীবন কালথেকে আর ঠিক ভাবে চলবে না? থেমে যাবে এখানে? যেমন ভাবে আমিথেমে আছি এখন মাঝ রাস্তায়। ঠিক কতক্ষন আছি রাস্তার ধারে জানিনা। বাসায় যাওয়ার জন্য আমাকে কিছু একটা নিতে হবে, নেওয়ার জন্যরাস্তা পার হতে হবে। একবার রাস্তা দেখি, গাড়ি দেখি, বিশাল আকারেরট্রাক দেখি, ক্ষুদ্রাকারের রিক্সা দেখি। চলমান ধাবমান একে অপরকেটপকিয়ে যেতে সদা ব্যগ্র, বিশালাকার ক্ষুদ্রাকারকে পিষে ফেলতে চাচ্ছে। হাত এখনো কাঁপছে, শরীর এখনো কাঁপছে, তবে পা সচল। ঘটনাস্থলথেকে যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি তার দূরত্ব অনেক। এই পর্যন্ত আমিহেঁটেই এসেছি। কোন রকম স্থিরতা ছাড়া কোন রকম পিছু ফেরা ছাড়া, কোন রকম কম্পন ছাড়া কোন রকম কান্না ছাড়া।

আমার পা’কে আবার জাগিয়ে তুলি। হেঁটে রাস্তা পার হই। ট্যাক্সিতে উঠি। হাতে একটা ব্যাগ । সেটাকে বুকের মাঝে আঁকড়ে আছি। ব্যাগেএমন কোন মূল্যবান কিছু নেই যেটাকে বুকের মাঝে আগলে রাখতে হবে।তবে কিছু একটাকে আগলে রাখতে চাচ্ছি। বুকের সাথে লাগিয়ে রাখতেচাচ্ছি। যেন একটা কিছু আমাকে ধরে আছে এই বোধটা জাগাতে চাচ্ছি।আমি একা নই। আমাকে জড়িয়ে কেউ আছে। এই মুহূর্তে তাই ব্যাগটিইভরসা। ব্যাগটি যেন খুব আপন । আগলে রাখছে, জড়িয়ে ধরছে, শক্তকরে । ছাড়বে না কখনো। আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাসায় দিয়ে আসবে।এই ব্যাগটি আমার সঙ্গি আমার অবলম্বন।হঠাৎ ব্রেক কষল ট্যাক্সি।

“তোমার কারো অবলম্বন কেন দরকার”

দরকার নেই?

“না তুমি স্বাবলম্বী, তোমার কোন অবলম্বন দরকার নেই”

দরকার নেই?

“ এই রাস্তা কি তোমার অপরিচিত?

না

“বহুবার এই রাস্তা দিয়ে তুমি এসেছ গিয়েছ, তবে আজ কেন কারোঅবলম্বন চাচ্ছো?”

আমি কাঁপছি

“ না তুমি কাঁপছ না, ভাব তুমি কাঁপছ না।

-কিন্তু আমি কাঁপছি

“ কাঁপার মত কিছু হয় নি”

কিছু হয় নি?

“ না”

কিছু হয় নি?

“ না”

কিছু হয় নি।

***

ছুটির দিনে আমি বই পড়ি। আজ পড়া হবে না। বিদেশ থেকে ডেলিগেটসএসেছে। পাচ তারকা হোটেলে মিটিং।

হোটেলে দারুণ খাবার খেয়ে মিটিং শুরু হয়। সময় মত শেষও হয়। চলেযাওয়ার পালা। স্যার বললেন একটু পরে যাও। আমি পৌঁছিয়ে দিবো।নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলাম। আমার বস মানুষটি চমৎকার। মানসিকশারীরিক দুই দিকেই পরিপাটী। তাঁর সাথে কাজ করছি ৫ বছর। আমারকাজে তিনি যথেষ্ট সন্তুষ্ট। তাঁকেও অফিসের সবাই খুব পছন্দ করে।কর্মচারীদের সব দিকেই তিনি অভিভাবক সুলভ যত্ন রাখেন।

“কিছ খাবে”

“না স্যার ক্ষুধা নেই”

“তো, বল কেমন যাচ্ছে জীবন”

কিছুটা চমক লাগে আমার। স্যার আমার সাথে এমন কথা বলছে! চমকলুকিয়ে আমি উত্তর দেই “ভালই চলছে সব”

“ তোমার কাজ খুব ভাল হয়, রিপোর্টও ভালই রেডি কর”

আমি হেসে সাই দেই। এরপর নিরবতা নেমে আসে রুম জুড়ে। স্বভাবতইকিছু খুজে পাই না বলার, কারন তিনি আমার বস,কাজের বাইরে কি কথাবলতে পারি তাঁর সাথে!

“ মাঝে মাঝে কাজ করতে করতে একঘেয়েমি লাগে, তোমার লাগে না”

“তা লাগে মাঝে মাঝে”

“চল কোথাও বেড়িয়ে আসি”

এবার আর চমকে যাই না, বরং কোথাও একটু সন্দেহ লাগে। একটুকোথাও খোঁচা লাগে। এতক্ষণ কথার মধ্যে মসৃণতা ছিল এখন কিছুটারুক্ষতা টের পাই।

“ভয় পেলে?”

আমি হালকা হাসি। হাসি ছাড়া কি বলা যায় জানি না।

“একটা কথা কি জানো, যত উন্নতি কর না কেন, মনের শান্তি আসলকথা, মনে শান্তি না থাকলে হাজার টাকা দিয়ে কিছু হয় না।

আমি তাকাই স্যারের দিকে। তাঁকে কেমন বিসন্ন মনে হয়। সাথে এও মনেহয় আমাকে দিয়ে কি মনের শান্তি আনতে চাচ্ছেন?

হঠাৎ দেখি উনি আমার খুব কাছে চলে এসেছেন। আমি নড়ে বসি। তিনিহাত ধরেন। ভয় পাচ্ছ?

আমার সরল স্বীকার, “কিছুটা তো পাচ্ছি স্যার”

“ভয় পেয়ো না, তোমাকে আমার ভাল লাগে, তুমি ভীষণ আলাদা, সবাইআমার সামনে কথা বলতে ১০০ বার ভাবে, ভয় পায় আমাকে, আর তুমিখুব স্বাভাবিক ভাবে আমার সাথে কথা বল, কোন ভয় নেই, কোন সংকোচনেই, কোন দ্বিধা নেই। তুমি আমাকে আকর্ষণ কর”

“জি স্যার? কিন্তু স্যার আমি তো আপনাকে সেভাবে দেখি না”

“আমাকে পছন্দ কর না?

“করি স্যার, কিন্তু সেভাবে নয় যেভাবে আপনি করছেন”

“আমি কিভাবে করছি”

তিনি আরও কাছে আসতে থাকেন।আমাকে টেনে নেন তাঁর অত্যন্তকাছে। আমি মুঢ় হয়ে যাই,স্তব্ধ হয়ে যাই, অনুভূতি শুন্য হয়ে যাই যখনউনি আমার ঠোঁটে উনার ঠোঁট লাগিয়ে দেন। এও যে সম্ভব সেটা বুঝেনিতে কিছুক্ষণ সময় লাগে আমার। বুঝে নেওয়ার পর ছিটকে বের হয়েযেতে চাই তাঁর হাতের শেকল থেকে। ব্যর্থ হই। উনার হাতের শেকল ক্রমশজোরালো হল। প্রচণ্ড বিস্ময় আমাকে বোধ শুন্য করে দেয়। আমারশরীরে এই যে আমি একজন পুরুষের ভার অনুভব করছি এই কি আমারস্যার!? যাকে আমি সহ পুরো অফিস ভয়ংকর শ্রদ্ধা করে?

কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি? নাকি নোংরা কোন বাস্তবের সম্মুখীন হচ্ছি? তারঠোঁট যখন আমার উষ্ঠকে পিশে ফেলছিল মনে হচ্ছিল চেতনা হারাবো।কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ কামড় বসিয়ে দেই উনার ঠোঁটে।তিনি সেটিকে হয়তো আমার সম্মতি মনে করেছিলেন, তাই তার হাতেরবাঁধন ক্রমশ আমার বুকের দিকে নামতে থাকে। সীমাহীন বিস্ময়ের গণ্ডিপেরিয়ে তাঁকে ধাক্কা দেই। তিনি ছিটকে পরে যান, কিন্তু পর মুহূর্তেই আবারজড়িয়ে ধরেন আমাকে। ভীষণ ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে। যেন শরীরে একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। ভয়ের মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এখন কান্নারূপে চোখে টলমল। তিনি জড়িয়েই শুয়ে থাকেন বুকে। স্তব্ধ নির্বাক আমি থরথর কাঁপতে থাকি। তিনি আবারো আগ্রসর হন।

“তোমাকে চাই”

মনে হয় যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দাবলী শুনছি।

“তোমাকে চাই”

মনে হয় যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কর্কশ সঙ্গীত শুনছি

“তোমাকে চাই”

মনে হয় যেন আমার কানে কেউ ফুটন্ত এসিড ঢেলে দিচ্ছে।

“না” এই শব্দ ছাড়া যেন আর কোন শব্দ বলতে কোনদিন শিখি নি।“না” আমার একমাত্র শব্দ, একমাত্র প্রতিবাদ, একমাত্র হাতিয়ার। বিস্ময়ভয় হতভম্বতার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আমি তীব্র চিৎকার ছুড়ি। যতটাগলায় শক্তি আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করি। তারস্বরে তীব্র গগনবিদারীচিৎকার ।

“চুপ প্লিস চুপ”

তার কণ্ঠস্বর যতই আমার কানে যায় ততই গলা ছিঁড়ে চিৎকার করি।তিনি মুখ চেপে ধরেন। এবার আমার চোখে তিনি চোখ রাখেন। আমারতীব্র জল আর ঘৃণায় ভরা চোখ দেখে তিনি কি ভাবলেন আমি জানি না। শুধু তার চেহারা দেখে কল্পনা করতে চেয়েছি এই কি সেই স্যার যাকেকোনদিন খারাপ মানুষ ভাবতে সাহস হয় নি? এই কি সেই মানুষ যারএকটি কথায় আমি দিনের পর দিন ওভারটাইম করেছি কোন বাহানা নাদিয়েই? এই কি সেই যার মুখে আমি আমার কাজের প্রশংসা শুনার জন্যব্যগ্র থাকতাম? এই কি সেই যে মানুষটি আমাকে কিছুক্ষণ আগে যখনবলল “পরে যেও” আমি নির্দ্বিধায় রাজি হয়েছি? এই কি সেই যার ভরসায়নিজেকে নিরাপদ মনে করেছি? এই কি সেই যার কাছে আজ আমিনিষ্পেষিত শোষিত নির্যাতিত ?

তিনি তাকিয়েই থাকলেন আমার দিকে। আমি জলভরা চোখে আকুলআবেদন নিবেদন করলাম।

“তুমি চাও না আমাকে”

“না না না না না”

তিনি ছিটকে উঠে গেলেন আমার উপর থেকে। কিন্তু আমি উঠতেপারলাম না। শরীরে আমি একফোঁটা শক্তি সঞ্চয় করতে পারছি না। বড্ডক্লান্ত বিধ্বস্ত অসহায় দুর্বল লাগছে নিজেকে। সোফা থেকে উঠতে গিয়েমনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি কাজটি করছি। ঠিক চেতনা বলা যাবেনা এটিকে যখন আমি উঠে দাড়াই টলমল পায়ে। লাল চোখে অস্পষ্টদেখছি সব। শক্তিহীন শরীরে আজন্মের পিপাসা জাগছে। বেশিক্ষনদাঁড়াতে পারি না। দুর্বল পায়ে বার বার পড়ে যাচ্ছিলাম। অবিন্যস্ত কাপড়বিন্যস্ত করার বোধ নেই আমার। প্রচণ্ড চেষ্টায় আক্রোশের চোখে তাকিয়েআছি স্যারের দিকে। তার দৃষ্টিতে হঠাৎ কেমন যেন অপরাধীর দৃষ্টি দেখতেপাই ।

“আমি দুঃখিত” বলে তিনি আবার এগিয়ে আসেন। এবার তার অগ্রসরেকোন কামনা দেখি না। কিন্তু আমি আবার ভয়ে কেঁপে উঠি। উনি বুঝতেপেরে আমাকে শক্ত করে আবার জড়িয়ে ধরে। বিমূঢ় আমি আর কিছুকরার শক্তি পাই না। না চিৎকার না প্রতিবাদ না বাঁধা। নেতিয়ে পড়িতারই কাঁধে। তিনি ধরে আমাকে বসান।

“তুমি বাসায় চলে যাও। আমি পৌঁছে দিয়ে আসব”

বাসা শব্দ শুনে যেন আমি প্রান ফিরে পাই। নিথর শরীর কিছুটা সচলতাফিরে পায়। অদ্ভুত রকমের শক্তি ভর করে আমার উপর।

টলমল পায়ে হোটেল থেকে বের হই। বের হয়েই মনে হয় আমার কিদৌড়ানো উচিত?

রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেই। জানলার পর্দা টেনে দেই। এসে আয়নারসামনে দাড়াই। একে একে সব কাপড় খুলি। নিরাবৃত নিজেকে খুঁটিয়েখুঁটিয়ে দেখি। শুধু বুকের মাঝে কয়েকটি আঁচড়ের দাগ ছাড়া আর কোনপরিবর্তন দেখি না। যেমন কয়েক ঘণ্টা আগে ছিলাম এখনও তেমনআছি।

তবে কি কিছুই হয় নি? এই যে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি তাও তোকিছু হওয়ার জন্যই দেখছি। কি হয়েছে? যা হয়েছে তা যদি ভয়ংকর কিছুহত তবে আমি কি এমন শান্ত থাকতে পারতাম। অন্য দিন তো ভেতরেকোনও নিরব অস্থিরতা বোধ করি না। ভেতরে বরফ শীতল নিস্তব্ধতাজমাট বেধে আছে। একটা ব্যাকুল অস্থিরতা যেন দম বন্ধ করে আছে।ভেতরে কোন একটা অন্ধকার কুঠিরে একটা ঝড় থমকে আছে, অথচচাচ্ছি ঝড়টা বয়ে যাক।

আলো নিভিয়ে দেই। মাটিতে লুটে পড়ি। আমার শুকনো চোখে জলআনতে চাই, কিন্তু পারি না। বড্ড ঘুম পায়। বড্ড বেশি।

মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।জেগে দেখি সকাল হতে এখনো অনেক

আজ আর গতকাল কি পার্থক্য? বাকি দিনের যেমন ঘুম থেকেই উঠেইঅফিসে দৌড় দেই আজকেও তেমন করার কথা । আমার কি আজঅফিস যাওয়া উচিত? আমার কি আর কখনো ওই অফিসে যাওয়াউচিত?

উত্তর খুঁজি। নিজেকেই প্রশ্ন করি , আমি নিজেকে ধর্ষিত মনে করছি?

ধর্ষণ? আমি গতকাল ধর্ষিত হয়েছি?

কাঁপতে থাকি, অস্থির উত্তেজনা আবশ করে দেয় হাত পা। চোখ মুখ বন্ধকরে কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নেই, একটি অস্পষ্ট চিৎকার বেড়িয়েআসে গলা দিয়ে ।

“আমি ধর্ষিত হই নি। কিছুই হয় নি আমার সাথে গতকাল। যা হয়েছে তাদুর্ঘটনা। কেউ আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে পেতে চেয়েছিল, অগ্রসর হয়েছিল। শরীরের কিছু অংশ নিয়ে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছিল, তাতেআমি আঘাত প্রাপ্ত হই, দুর্বল হই, ভীত হই, ভেঙ্গে পড়ি। এছাড়া আরকিছুই হয় নি। আমার ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে পারে নি”

হঠাৎ কেউ যেন বলে উঠে “ যদি কেউ প্রবেশ করতে পারত তোমার ভেতরেতবে?

“তবে?”

“তবে কি ভাবতে তুমি ধর্ষিতা নও”

“তবে কি আমি ভাবতাম আমি ধর্ষিতা নই?”

“হ্যা আমি ভাবতাম, যদি গতকাল তিনি সফলও হতেন তখনও ভাবতামআমি ধর্ষিত নই। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ যদি জোর করে তবে আমিকেন ধর্ষিত হবো?

“তুমি ধর্ষিতা হতে না?”

এবার আমি আরও শক্ত হয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়াই। “না আমিধর্ষিতা হতাম না। কেউ যখন চুরি করে তবে কি যার চুরি হয় তাকে চোরবলে নাকি যে চুরি করেছে তাকে চোর বলবে?

“ সমাজ এই থিউরি মানে না”

“সমাজ মানা না মানার সাথে আমার জীবন সম্পৃক্ত নয়। আজ যদিকোথাও দুর্ঘটনায় আঘাত প্রাপ্ত হই এমনকি আমার কোন অঙ্গহানি ঘটেতবে কি সেটা আমার দোষে হবে? হবে না। তবে এখানেও তো আমার কোনহস্তক্ষেপ নেই, কোন অংশীদারিত্ব নেই। এখানে সমাজ আমাকে দায়ীকরতে পারে না”

“কিন্তু এমনটাই হয়ে এসেছে এতদিন, সবাই মেয়ের দিকেই আঙ্গুল তুলে”

“মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে ভণ্ড সমাজ, আর আঙ্গুল তুললেই যে মেয়েরদোষ হবে তা আমি মানি নি কখনো , মানবও না ”

তবে কি তুমি বলতে চাচ্ছ, ধর্ষণ কিছুই না তোমার কাছে?”

“ধর্ষণ আঘাত, প্রচণ্ড আঘাত, ভয়ংকর আঘাত, অকল্পনীয় আঘাত।যদি শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকা যায় তবে একে দুর্ঘটনার বেশি কিছু ভাবাউচিত না। যতই একে গুরুত্ব দেওয়া হবে ততই এই স্মৃতি জীবনকে দুর্বিষহকরে দিবে।

“এই স্মৃতি ভোলা খুব সহজ?”

“না কঠিন, তবে একেই যেভাবে মেয়েরা আঁকড়ে ধরে জীবনকে শেষ মনেকরে সেরকম মনে করা মানে নিজেকে দুর্বল মনে করা।

“তবে এই সব ঘটনা কিছুই না?”

“ অবশ্যই কিছু। যেভাবে একটি দুর্ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ সেভাবে। কিন্তু দুর্ঘটনামানেই জীবন শেষ নয়। কিছুদিন থেমে থাকা, কিন্তু স্থিরতা নয়। কোনভাবেই নয়। স্থিরতা মানেই ওই সব পিশাচদের জয় যারা মেয়েদের আঘাতকরতে চায়, ছিঁড়তে চায়, ধ্বংস করতে চায়”

“ এভাবে বললেই কি সমাজ মেনে নেয়, নাকি সব স্বাভাবিক করা যায়?”

“সমাজ বলছে তুমি নষ্টা , তুমি ধ্বংস হয়ে গেছ, আর ওমনি এই ভেবেকপাল আছড়ে পড়ে থাকা মানেই তো হল সমাজকে জয় করা, নিজেকে হারিয়ে দেওয়া। সমাজ তো বরাবরই আমাদের বিপক্ষে, আহত হলে এতো আরও তীব্র বেগে আক্রমন করে , তবে একে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়”

“এড়িয়ে চলা সম্ভব?”

“অসম্ভব কিছু তো না। কঠিন, অনেক কঠিন, তবে মনোবল থাকলেসম্ভব।

“তুমি যদি গতকাল এমন তীব্র কিছুর শিকার হতে তবে?”

আক্রোশে কেঁপে উঠি। “গতকাল কিছুই হয় নি,গতকাল মনে রাখার মতকিছুই না, কিছু আঘাত পেয়েছি, সময়ের সাথে সেই আঘাত ঠিক হয়ে যাবেএর বেশি কিছু না”

“যদি তোমার স্যার জোর করে তোমার ভেতর প্রবেশ করত তবে?”

প্রশ্নটি আমাকে হিম করে দেয়। ভেতরটা কেমন যেন স্তব্ধ করে দেয়।

“যদি আমার সাথে এমন হত!”

টলমল কিছু জল উঁকি দিল। গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে ফেললাম।

“আমার সাথে এমন হলে অথবা হতে পারত গতকাল, আমিও থমকেযেতাম। থরথরে কেঁপে উঠতাম যখনই ওই দুর্বিষহ স্মৃতির কথা মনেপড়ত। আমিও হয়তো ভাবতাম আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে,। আমিওলজ্জায় ডুবে যেতাম ভেবে কেউ আমার শরীর খুব নোংরা ভাবে ছুঁয়েছে।আমিও হয়তো জীবনকে শেষ করার চিন্তা করতাম যেভাবে অনেকমেয়েরাই করে। আমিও মনে করতাম আমি অকুল পাথারে পড়েছি, উদ্ধারঅসম্ভব।

“তুমিও ধ্বংস হয়ে যেতে”

“আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম?

“ হ্যা ধ্বংস হয়ে যেতে”

আরও কিছু জল আসি আসি করছিল চোখে , তীব্র ভাবে পিছন ফিরেশূন্যের দিকে তাকিয়ে বলি;

“ আমার জীবন কেন ধ্বংস হবে, আমি পড়েছি শ্রম দিয়েছি চাকরি করেছিজীবনে একটি লক্ষ্যে পৌঁছানর জন্য, হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনারজন্য আমার সকল পরিশ্রমকে এভাবেই ড্রেনে ফেলে দিবো? একটাসাময়িক যন্ত্রণার জন্য এতদিনের ত্যাগ নিষ্ঠা অপেক্ষার বিসর্জন দিয়েআজীবন কপালকে দোষ দিবো? পুরো জীবনে শুধু একটি দুর্ঘটনাকেই প্রাধান্য দিয়ে জীবনকে চিতায় উঠিয়ে দিবো? পুরো জীবনে এত আনন্দএত আশা এত আকাঙ্ক্ষা এত চাহিদা এত ইচ্ছে এত বিলাসিতা এতসম্পর্ক এত ভালোবাসা এত দায়িত্ব এত অধিকার সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েশুধু এক নিকৃষ্ট স্মৃতিকেই সবার প্রথমে স্থান দিবো? কখনই না। কোনঅবস্থাতেই না”

বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যাই। একটু হাঁপিয়ে উঠি।

***

গোসল সারি, নাস্তা করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধেই কিছু খাই।পোশাক পরি। যেমনটা অন্য দিন সাজি আজও তেমন সাজি। বের হই।হঠাৎ সূর্যের আলোকে বড্ড কড়া মনে হল। হঠাৎ বুক কেমন ধক করেউঠল। হঠাৎ একটু কেঁপে উঠে শরীর। হঠাৎ অজানা এক ক্ষীণ ভয় মনেরগহিনে কোথাও উঁকি দেয়। হঠাৎ শরীর গুলিয়ে উঠল যখন চোখে ভেসেউঠল কেউ ঝাপটে ধরে আছে আমাকে। এবং কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিকহই। সময়মত অফিসে পৌঁছই।

কাজ করতে গিয়ে বহুবার আমার শরীর গুলিয়ে উঠেছে, ক্ষীণ ভয় ভেতরেউঁকি মারে, বুকে ধক করে উঠে। এবং ফোন এক্টেনশনে একটি নাম্বারভেসে উঠে। স্যারের নাম্বার। অবশ এবং কম্পিত হাতে ফোন তুলে কানেলাগায়।

প্রয়োজনীয় ফাইল নিয়ে আমি রওনা দেই স্যারের রুমে।

মাঝ পথে একটু যেন শ্বাস কষ্ট হয় আমার। যেন অক্সিজেনের অভাবদেখা দিচ্ছে জগত জুড়ে। আবার সেই গা গুলান অনুভূতি, আবার সেইক্ষীণ ভয়ের উঁকি দেওয়া।

বুক ভরে নিঃশ্বাস নেই। মাথা উঁচু করে যেভাবে হাঁটি সেভাবে হেঁটেস্যারের রুমে প্রবেশ করি।

এক জোড়া বিস্ময়ে মাখা চোখ আমাকে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করছে। কাজেরবিষয় নিয়ে যা যা বলার কথা স্যারকে ,তা স্পষ্ট অকম্পিত ভাষায় বলেযাই।

কথা বলা শেষ হয়। একটা জমাট শ্বাস হালকা করে বের করে দেই। ভেতরটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে, আলোকিত হয়ে যায় আমার ভেতরেরঅন্ধকার। ক্ষীণ ভয়ের উঁকি আর নেই। দীর্ঘ সময় নাড়াচাড়া করতে নাপেরে যখন হঠাৎ নড়তে পারা যায় তখন যে অনুভূতি হয় আমারও সেইঅনুভূতি। দিন শেষে কাজের সমাপ্তির পর নরম বিছানায় শরীর এলিয়েদিলে যে অনুভূতি আমারও সেই অনুভূতি।

আমি পেরেছি। জয়ী হয়েছি। জীবন জয় পেয়েছে একটি নোংরা কুৎসিতকদর্য স্মৃতির বিরুদ্ধে।

“স্যার আমি যাব?”

স্যার যেন ঘোর থেকে জেগে উঠলেন। চমক লাগা চোখে আমাকে অবাকদৃষ্টিতে দেখছেন।

তাকে দেখে আমার করুনা জাগে। একটু অহংকার জাগে। একটুআত্মতৃপ্তি জাগে। নিজেই বলি,

“স্যার আমি যাই”

“আমাকে ক্ষমা করো। আমি সত্যি লজ্জিত” স্যারের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর।

আমার তৃপ্তি আরও বেড়ে যায়। ফিরে তাকিয়ে দেখি স্যার মেঝেরদিকে তাকিয়ে, মাথা নত, মুখ বিধ্বস্ত।

ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি ফুটে উঠে আমার।

ফারজানা নীলা। গল্পকার, নারী ও প্রাণি সংরক্ষণ অধিকারকর্মী।  

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..