শুভ বিবাহ, অসহায় অভিমান ও অন্যান্য

মল্লিকা বিশ্বাস
কবিতা
Bengali
শুভ বিবাহ, অসহায় অভিমান ও অন্যান্য

আমার অসহায় অভিমান

আমার শিউলী গাছটায়, সজনে ডালে
দিনমান অজস্র পাখী এসে বসে
তারা কথা কয় তাইতো তেমন দেখি
তাদের কূজন কলগীতি হয়ে ওঠে গান।
ঝরা পাতার মর্মরে
বেজে ওঠে ভৈরবী বেহাগ।
বাতাস বয়ে গেলে
পাতার আন্দোলনে
শুনি যেনো ব্যাথিত বেহালার সুর।
সারারাত সুবাস ছড়িয়ে
ভোরের আলোয় লুটিয়ে পড়ে শিউলী, বকুল
ওদের কণ্ঠে অভিমানের সুর।
নিরব শিশিরের শব্দে মায়াবী সন্ধ্যা নামে
কদম ফুটলে শোনা যায়
মেঘ মল্লার রাগ।
ঝর্ণার জলে বাজে নূপুরের ধ্বনি
ঝড়ের তান্ডব আর
সমুদ্রের গর্জনে শুনি শঙ্খের নাদ,
নদী বয়ে যায় কুলুকুলু রবে।
শুধু যেনো মনে হয়
আমার কথারা নিরুপায় অসহায়।
আমার ঠোঁটে কল্লোলিত হয়না গান
কন্ঠে লতিয়ে ওঠে না সুর,
শিউলী কিংবা বকুল ফুলের মতো ঝরে পড়ে না
অভিমান সুরভিত কলগীতি।

 

আমার স্বপ্নেরা

আধো ঘুম আধো জাগরনে
মশারির ঘেরাটোপ থেকে
চোখ মেলে দেখি-
আলো ঝলমল উজ্জল দিন,
বারান্দায় শুনতে পাই অজস্র টুনটুনি পাখীর
সানন্দ কলরব।
ওরা আমার মাধবী কুঞ্জের
মধু খেতে ব্যস্ত।
শিউলি, মহুয়া আর জারুল পাতায়
রোদের ঝিলিমিলি।
লিভিং রুম থেকে ভেসে আসে
খবরের কাগজের চেনা গন্ধ,
চায়ের সোনালী ঘ্রাণ।
প্লেটে রুটি আর ডিম পোচ,
লেখার টেবিলে গিয়ে বসি
শব্দের কাছে নতজানু হই।
মায়া, ভালোবাসা, বিষন্নতা,
আনন্দের স্মৃতি বা স্বপ্নের কোনো কথা
শব্দে গাঁথতে পারি না।
আমি আজ সারা দিনমান
শব্দের কথাই ভাবি।
প্রয়োজনে প্রয়োজনহীন শব্দ খুঁজি নিরুদ্দেশ।
স্বপ্নের কথামালা শব্দে সাজাতে গিয়ে দেখি
আমার স্বপ্নের আছে ঘুরঘুটি আঁধারের ভয়,
আমার স্বপ্নেরা একা ঘুমুতে পারে না।
আমার স্বপ্নেরা তোমায় ছাড়া যেনো অবয়বহীন।
আমার স্বপ্নের আছে রাতে পোকামাকড়ের ভয়,
আমার স্বপ্নের ভয় যদি মাথায় বাজ পড়ে
আমার স্বপ্নের ভয় যদি সুনামিতে সলীল সমাধি হয়।
কিছু স্বপ্ন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেই

আলোয় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
কোনো কোনো স্বপ্ন আবার
ফিনিক্স পাখির মতোই জন্মান্তরলোভী,
ওরা ভস্ম থেকে জেগে ওঠে,
চেতনার গান গায়
সজীব ক্ষিপ্র ডানা ঝাপটায়।
চারিদিকে নানা ছদ্মবেশে স্বপ্নহননের
জন্মান্ধ লিপ্সায় ঘোরে
কতিপয় হত্যাকারী রাত্রিদিন।
ওদের নিঃশ্বাসে বয় আজরাইলের তিমির নিঃশ্বাস,
ওদের সান্নিধ্যে ওড়ে রক্তচোষা বাদুর শত শত,
ওদের নিঃশ্বাসে ঝরে আগুন
পোড়ে নগর
গ্রামের সকল ঘাস
হাজার বস্তি হয় বিধ্বস্ত গোরস্থান,
পয়মন্ত স্বপ্নের গ্রাম হয় মহাশ্মশান।
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় স্বপ্নের লাশের সারি।
আমার স্বপ্নেরা যেনো চেয়ে থাকে
উপদ্রুত মানুষের মতো।
আমার স্বপ্নেরা যেনো শিরোনামহীন কবিতার মতো রয়ে যায়।
কোনো কোনো স্বপ্ন ব্যর্থ মানুষের চোখের জলের মতো
ঝরে পড়ে বারে বারে
নিদ্রাছুট মলিন আহত বালিশে।
স্বপ্ন সেতো স্বপ্নই নয়
কিছু তার যদি না সত্যি হয়।
প্রহরে প্রহরে দুঃখ পান করেও
আমি সোনালী স্বপ্নের তটরেখা ছুঁয়ে বাঁচতে চাই।

 

হাসপাতাল হোক আরোগ্য উদ্যান

এই হাসপাতালের সি সি ইউ, আই সি ইউ
কিংবা প্রাত্যহিক রোগী দেখবার সময়ও
কেবলি মনে হয়
আমরা সকলেই থোকা থোকা মৃত্যুপান করে
বেঁচে থাকতে চাই।
সুস্থ থাকতে চাই।
মৃত্যুর মৃন্ময় মুখ থেকে ঝরে পড়ে
ব্যথিত বিহ্বল ভৈরবী বেহাগ
তবু তার সুরে মিশে রয় জীবনতৃষ্ণা।
হাসপাতালে এলেই মনে হয়
আত্মা অবিনশ্বর জেনেও
আমরা অনন্তের পাত্র ভরে
মৃত্যু করি পান।
হাসপাতালের ইর্মাজেন্সীতে, সিঁড়িতে, লিফ্টে
করিডোরে, সি সি ইউ, আ ই সি ইউ
কিংবা অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর মর্মরধ্বনি শুনি,
তবুও প্রায়শই ভগ্ন কালশিটে পড়া হৃদয়ও
হয়ে ওঠে সুস্থ কান্তিময়
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সহৃদয় স্পর্শে।
অপারেশন থিয়েটারে রক্তের ফোঁটা ফুল হয়ে ফোটে।
সদ্যোজাত শিশুর কান্নায় মুখরিত,
আনন্দিত হয় হাসপাতাল।
হৃদয়ের গহীনে লালন করি আশা ভালোবাসা-
এই হাসপাতাল যেনো হয়ে ওঠে
আরোগ্যদায়ী কোনো পান্থশালা,
রোগীরা রাত্রিবাস শেষে সুস্থ হয়ে ফিরে যাবে ঘরে।
অসুস্থ অঙ্কুর ভেদ প্রবাহিত হোক জীবনের দ্যুতি,
রোগীর শরীরে চলুক রক্ত সঞ্চালন,
গ্লুকোজের নগ্ন ফোঁটা আর স্যালাইনে
দেয়া হোক পথ্য পরমায়ু।
চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীরা
আয়ুষ্মান হয়ে উঠুক।
হয়ে উঠুক স্বাস্থ্যশীল, দীর্ঘ কমনীয়
যেন ঋজু শাল্মলী বৃক্ষ।
হাসপাতালের সেবিকাদের খোঁপা জুড়ে থাক
ধবল শান্তির মেঘমালা,
হৃদয়ে থাকুক করুণাধারা,
উজ্জ্বল রূপালী ট্রেতে পরিপাটি সুস্থতা
বিলিয়ে যাক ঘড়ি ধরে।
রোগক্লিষ্ট ম্লান মুখ লাবণ্যমণ্ডিত হোক
হাসপাতাল হয়ে উঠুক আরোগ্য উদ্যান।

 

রবীন্দ্রনাথের প্রতি

তোমাতে আমাতে হয়নিতো দেখা কোনদিন
তবু প্রতিদিন প্রতিনিয়ত তোমায় আমি দেখি।
তোমায় দেখি সূর্যোদয়ে,
মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্যালোকে
অস্তগামী সূর্যের কনে দেখা আলোয়
কিশোরী সন্ধ্যায়,
লেবু ফুলের গন্ধমাখা
জামরুল,কামরাঙা আর নারকেল গাছের ছায়াময়
সবুজ পুকুরের বিম্বিত জলে,
যখন গান হয়ে যায় ঝরা পাতারা।
তোমায় দেখবো বলে অন্তরে জোনাক জ্বেলে রাখি।
তোমায় আমি স্পর্শ করিনি কোনোদিন
তবু যখন গাছের পাতায় জমে থাকা
বৃষ্টির একফোঁটা জল
কিংবা দূর্বাঘাসে লুটিয়ে পরা
শিউলি ফুলে জমে থাকা শিশির বিন্দু স্পর্শ করি
তখন তোমার পেলব স্পর্শ অনুভব করি।
তোমাতে আমাতে হয়নিতো কথা কোনোদিন
তবুও পাখির কলগানে, পাতার মর্মরে,
ঝর্ণার কলতানে, বৈশাখী ঝড়ের উদ্দাম উল্লাসে,
সমুদ্রের বিপুল জলরাশির গর্জনে
তেমনি এস্রাজ কিংবা খোল, পাখওয়াজের
বাদনেও তোমায় শুনতে পাই।
তুমি মিশে আছো বাংলার ধুলিকণায়, কাদা-মাটি-জলে
বৈশাখে আম্রমুকুলের মৌ মৌ গন্ধ ভরা বাতাসে
বর্ষায় কদম ফুলের গন্ধে
শরতে শিউলী ফুলের সুবাসে
অঘ্রাণে ধানের শীষের মিষ্টি মৌতাতে
শীতে খেজুর রসের সুমিষ্ট ঘ্রাণে
বসন্তে শিমুল, পলাশ,
কৃষ্ণচূড়ার আগুন রাঙা উত্তাপে
আমাদের প্রতিদিনের জাতীয় সঙ্গীতে।

 

শুভ বিবাহ

প্রণয়ের বিনি সুতোঁয় গাঁথা এই শুভ পরিণয়
শুভক্ষণে শুভযাত্রা শুভধ্বনি সুখময়
বহতা নদীর স্রােত নিরবধি।
শুভদৃষ্টিতে দুটি হৃদয় বিনিময় তবু-
যুগলের মাঝে যেন
পারিজাতের সুবাসমাখা
অমরাবতীয় সুবাতাস বয়ে যায়।
এভাবেই অনন্তকাল ধরে
অনাদি কালের ভালোবাসার উৎস হতে
চিরকালের মানব ও মানবী গন্তব্য খুঁজে নেয়
সন্ধ্যার চিবুক ছুঁয়ে।
মধুর মিলনের শুভরাত্রি বলে ওঠে-
আমাদের উৎসবের এই আয়োজন
ভোরের আলোয় ফুটে ওঠা
পুষ্পের প্রণয়।

 

মল্লিকা বিশ্বাস। কবি ও চিকিৎসক। উচ্চশিক্ষা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে, বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লায় সনোলজিস্ট ও শিক্ষকতায় নিয়োজিত। কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সেবামূলক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের সাথে জড়িত। নারীদের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনার-হুইলের সাথেও যুক্ত। প্রবন্ধ ও গদ্য লেখার পাশাপাশি...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..