শূন্যস্থান

নন্দিনী সেনগুপ্ত
ছোটগল্প
Bengali
শূন্যস্থান

-‘চোখ গেলে দেবো!’ বিড়বিড় করে তারক। রিঙ্কি খুকখুক করে হাসে।

তারক চাপা গলায় ধমকায়… ‘হাসির কী হল?’

-‘আচ্ছা, এত রেগে যাও কেন? ওরও মুখ মাস্কে ঢাকা এখন, আমারও। দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে কীই বা করবে?’

-‘সেটাই তো। এত খারাপ সময় যাচ্ছে। তবু ব্যাটার বদামি কমেনা!’

-‘তুমি বেশি বেশি ভাবো। বদামি কেন হবে? গপ্পো করতে ভালোবাসে। তাই একটু তাকায়, তুমি যদি কথা বলো।’

-‘গল্প করতে হলে নিজের আত্মীয়কুটুম্ব ডেকে আনুক না।’

-‘দোকানে লোক ডেকে আনবে গপ্পো করার জন্য? তাছাড়া লোকটা ভারি দুঃখী। বউ মরে গেছে দু’বছর হল। পাঁচ বছরের ছেলেটাকে পাশের বাড়িতে দাদাবউদির জিম্মায় রেখে আসে।’

-‘এত খুঁটিনাটি খবর তুমি জানলে কীভাবে?’ নিচুস্বরে বললেও ‘তুমি’ শব্দে বেশ জোর দেয় তারক। বোঝা যায় যে রাগে ফুটছে।

-‘আমি একা কেন? এই গলির সবাই জানে। তুমি তো আর লকডাউনের আগে দোকানে বসতেনা রোজ। তাই জানোনা।’

-‘না, বসতাম না। চাকরি ছিল, তাই বসতাম না। তুমি একাই সামলাতে, আর ওই ব্যাটা সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে দেখতো আর ছোঁকছোঁক করতো।’

-‘দ্যাখো, আমি একা বসতামনা। বিউটি থাকতো আমার সঙ্গে। এখন ট্রেন বন্ধ, তাই বিউটি আসতে পারছে না। আর তখন তো স্কুলকলেজ সব খোলা ছিল। কী চাপ থাকতো দোকানে!

-‘হ্যাঁ, তোমরা কাজে ব্যস্ত থাকতে, আর ওই ব্যাটা দুইচক্ষে ডাবল বিউটি গিলতো।’

-‘ডাবল বিউটি!!’- রিঙ্কি হাসিতে ফেটে পড়ে।

-‘চুপ, চুপ, জোরে হাসবে না। ব্যাটা আবার উঁকিঝুঁকি মারছে…’ তারক একটু জোরেই বলে ওঠে … ‘চোখ গেলে দেবো একদিন!’

-‘এবার তুমি চুপ করো! মাথা গরম কোরো না। একটা কাণ্ড বাঁধাতে চাও নাকি?’ রিঙ্কি চাপা ধমক দেয় বরকে।

রাস্তার উলটোদিকে ছোট মুদির দোকান থেকে বিশু তাকিয়ে দেখে। বরাবরই দেখতো। নিজের দোকানে কাস্টমার না থাকলেই হাঁ করে রাস্তার এপারে জেরক্সের দোকান ‘গোল্ডেন কপিয়ার’ এর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে বিশু; না, দোকানের দিকে ঠিক নয়। বেশির ভাগ সময়ে সামনের দিকে বসে থাকা তারককে টপকে বিশুর চোখ দোকানের ভিতরের অংশে কাচের কাউন্‌টারের ওপারে বসে থাকা রিঙ্কির দিকে ঘুরপাক খায়। মাস্কে ঢাকা মুখের শুধু চোখগুলো বাইরে থাকে বলে, আজকাল আরও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে বিশুর দৃষ্টি ঠিক কোনদিকে। তারক এমনিতেই রগচটা। রিঙ্কি সামলে রাখছে। কোনদিন নাহলে গায়ে হাত তুলবে।

-*-*-

-‘কী করবে? এমনিতেও তো এখন চাপ কম। স্কুলকলেজ সব বন্ধ। কটা দিন নাহয় বাড়িতে থাকো। আমি একাই দোকানে বসি।’ – রাতে খেতে বসে বলে তারক।

-‘ছাড়ো তো! ওর ভয়ে বাড়িতে বসে থাকবো?’- রিঙ্কি দু আঙ্গুলে রুটি ছিঁড়ে সব্জি থেকে বেছে একটা আলুর টুকরো পেঁচিয়ে মুখে দেয়।

-‘এই দ্যাখ্‌! এত আলু দিয়েছিস ক্যানো সব্জিতে?’ তারক রিঙ্কির উপরে খেপে গেলে তুইতুকারি করে।

-‘মোটে ছোট একখানা দিয়েছি তো!’ – রিঙ্কি মুখে খাবার নিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে। রিঙ্কি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা যে আজ তারকের রাগটা সব্জিতে আলু দেবার জন্য, নাকি সে বাড়িতে থাকতে রাজি হয়নি বলে।’

-‘কী রেন্ধেছিস এগুলো ছাইপাঁশ! মন নেই তোর কোনও কাজে!’- তারকের রাগ যেন বেড়েই চলে।

রিঙ্কির মনে হয়েছিল যে খাবারের স্বাদ না পাওয়াটা তারকের রাগের প্রকাশ; কিন্তু রাত ঘনিয়ে এলে জ্বর আসাটা যে রাগের থেকে নয়, সেটা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল।

-‘হচ্ছে তো অনেকের! বাড়িতে থেকে সেরেও যাচ্ছে। বেকার টেস্ট করে কী লাভ!’ তারক হাত নাড়ে। দুদিন পরে রিঙ্কির ভয় করে। জ্বরটা কমছেনা। কাশির দমক ক্রমেই বাড়ছে। ফোন করে দাদাকে খবর দেয়। দাদার অনেক চেনাজানা আছে। যদি সরকারি হাসপাতালে একটা ব্যবস্থা হয়। ব্যবস্থা করতে খুব যে দেরি হল, তা নয়। তবে তারক আর ফিরলো না। তারকের ডায়বেটিস, বেশি বেশি রাগ, মানে হাইপারটেনশান, এগুলোই যে আসল রোগ, সেটা রিঙ্কি জানতোই না। ওগুলো না থাকলেই নাকি বিচ্ছিরি মারণরোগটা সেরে যেতো। রিঙ্কিরও টেস্ট হলো। তারো পজিটিভ, কিন্তু তার তো জ্বর, কাশি কিছুই হয়নি।

রিঙ্কি এক মাস পরে দোকান খুললো আবার। শাটার তুলে দিলো বিশু এসে।

-‘খুব খারাপ লাগছে বউদি খবরটা জেনে।’

রিঙ্কি কী বলবে ভেবে পায়না। হঠাৎ একা হয়ে গিয়ে দিশেহারা লেগেছিল প্রথমে। তারপর ভাবলো দোকানে না বসলে চলবে কীভাবে! ফোন বাজতে থাকে। বিউটি। তারক চলে যাওয়ার পর থেকে প্রায়ই ফোনে খবর নেয়।

-‘দিদি, ঠিক আছ তো?’

-‘আছি রে। ঠিকই আছি।’ ফোনে কথা বলতে বলতে রিঙ্কি দেখতে পায় বিশু দাঁড়িয়ে আছে। নিজের দোকানে চলে যায়নি। বিউটিকে ‘পরে কল করছি’ বলে লাইনটা কেটে দিয়ে সে সরাসরি তাকায় বিশুর ড্যাবডেবে চোখের দিকে।

-‘কিছু বলবে বিশুদা?’

-‘বলছি বউদি, আমার দোকানঘরটা খুব ছোট। একবারে বেশি মাল কিনে রাখতে পারিনা। এদিকে আবার বেশিরভাগ কাস্টমার আজকাল হোম ডেলিভারি চায়। তোমার দোকানের এই ফাঁকা জায়গাটায় যদি কিছু মাল… ‘ বিশু কথাটা শেষ করেনা, কাচের কাউন্‌টারের সামনের ফাঁকা জায়গাটার দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে গত ক’দিন ধরে টুল পেতে তারক বসে থাকতো।

রিঙ্কির আবার কেমন যেন দিশেহারা লাগতে থাকে। কীভাবে নিজেকে সামলাবে ভেবে পায়না। কীভাবে মানা করবে? আবার ফোনটা বাজতে থাকায় সুবিধে হয়। এবারে দাদা। তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে। ইচ্ছে করেই ফোনের বার্তালাপে ব্যস্ত হয়ে ওঠার ভান করে। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পায় বিশু রাস্তা পেরিয়ে নিজের দোকানে যাচ্ছে। কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে।

-*-*-

কিছু ইমিটেশান আর পোড়ামাটির গয়না, সঙ্গে ম্যাচিং মাস্ক- সুন্দর করে মোড়া প্লাস্টিকের প্যাকেটগুলো ক্লিপ দিয়ে একটা স্ট্যান্ডের সঙ্গে দোকানের সামনের ফাঁকা জায়গায় ঝুলিয়ে সাজিয়ে রাখতে থাকে রিঙ্কি। বিশু মুখোশটা থুৎনির কাছে নামিয়ে ড্যাবডেবে চোখে দেখতে থাকে। সেদিনের পর থেকে আর বলেনি সে ফাঁকা জায়গাটার কথা।

শাটার তোলা, নামানো রিঙ্কি নিজেই করে এখন। শাড়ির বদলে সালওয়ার কামিজ পরে আসে আজকাল। যে টুলটায় তারক বসে থাকতো, ফুটপাথের উপরে সেটা রেখে নিজে নিজেই শাটার তোলে, নামায়। সেদিন যখন সে টুলে উঠছিল, তখন হঠাৎ বিশু জোরে বলে উঠলো, ‘দেখো বাপু, সাবধানে। উল্টে পড়ে যাও যদি!’

রিঙ্কি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে বিশু তাকে ‘বউদি’ বলে সম্বোধন করলো না। অদ্ভুত লাগলো তার।

রিঙ্কি একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল কাচের কাউন্‌টারের ভেতরে বসে। গলির মধ্যেও দুপুর নেমে এসেছে। তাছাড়া কাস্টমারের চাপ কম এখন। কে যেন ঢুকলো দোকানে। রিঙ্কি সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে। বিশু দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে পোড়ামাটির গয়নার একটা সেট।

-কত?

রিঙ্কি দামটা বলে। বিশু পার্স বের করে টাকাটা মিটিয়ে দেয়। রিঙ্কি ব্রাউনপেপারের খামে মুড়ে দেয় সেটটা। কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করে যে বিশু জিনিসটা নিতে ভুলে গেছে। উঁকি দিয়ে দেখে উল্টোদিকে দোকানের ঝাঁপ পড়ে গেছে। হয়তো বাড়িতে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে এসে বিকেলে খুলবে দোকান।

সন্ধেবেলায় দোকান বন্ধ করে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে রিঙ্কি দাঁড়ায় বিশুর দোকানের সামনে।

-‘বিশুদা, এটা ফেলে এসেছ দুপুরে।’ -বিশু হাত বাড়ায় না। সরাসরি তাকায় ড্যাবডেবে চোখে।

-‘ওটা তো তোমাকে দিলাম।’

রিঙ্কি অবাক হতেও ভুলে যায়। বুঝতে পারে আশেপাশের দোকান থেকে অনেকেই তাকিয়ে আছে। প্রাথমিক হতভম্ব ভাব কাটিয়ে বিশুর দোকানের সামনে সাজানো ডিমের পেটিগুলোর উপরে প্যাকেটটা রেখে দিয়ে উলের চাদরটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকে বাড়ির রাস্তায়। অঘ্রাণের হাওয়ায় বেশ শিরশিরে ভাব আছে। ফেরবার পথে বাজার থেকে অনেকদিন পরে কেজিখানেক আলু কেনে রিঙ্কি। বাজারে নতুন আলু উঠছে। বেশ কষা করে আলুর দম করবে রাত্তিরে রুটির সঙ্গে।

-*-*-

বিশুর হাবভাব সুবিধের ঠেকছে না রিঙ্কির। ড্যাবড্যাব করে দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেটা নতুন কিছু নয়। যেটা নতুন বদল চোখে পড়ছে, সেটা হল মাঝেমধ্যে এদিকে তাকিয়ে গুণগুণ করে গান গায়। বাজারের গলির কথা চাপা থাকেনা। কীভাবে যেন কথাটা রিঙ্কির দাদার কানে গিয়ে পৌঁছায়। বিশুর আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। লোক মারফত একেবারে রিঙ্কির দাদার কাছে গিয়ে প্রস্তাব রেখেছে। না, দোকানের ফাঁকা জায়গার কথা কিছু বলেনি। জানিয়েছে যে সে রিঙ্কিকে বিয়ে করতে চায়।

-‘ভেবে দ্যাখ তুই! এমন কিছু বয়স নয় তোর। বাকি জীবনটা একা থাকতে পারবি?’ দাদার গলায় উদ্বেগ।

-‘মাথা খারাপ হয়েছে তোর?’ রিঙ্কির গলার সুর চড়ে… ‘তারক চলে গেছে তিন মাসও হয়নি। তাছাড়া আমার বয়স এমন কিছু কমও নয়। আসছে বৈশাখে চল্লিশ পূর্ণ হবে। বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। তুই বিশুকে না করে দিবি। যদি না পারিস, আমিই জানিয়ে দেবো।’

-‘না, ঠিক আছে। আমি ধীরে সুস্থে জানিয়ে দেবো। অত তাড়া কিসের? কিছু না জানালে অমনিতেই বুঝে যাবে যে মত নেই।’

রিঙ্কি দোকানে বসে অপেক্ষা করে। না, বিশেষ কারো জন্য নয়। কাস্টমারের জন্য। আনলক শুরু হয়েছে, লোক আসছে। তবে সামলানো যায়না এমন নয়। কাজেই বিউটিকে ডেকে পাঠানোর প্রয়োজন এখনই নেই তার। শাটার নামানোর সময়ে বিশু এগিয়ে এল একদিন।

-‘ধরবো?’

-‘নাহ, ঠিক আছে।

-‘কোনো দরকার হলে জানিও।’

রিঙ্কি উত্তরে হ্যাঁ, না কিছুই বলেনা। মাথা নিচু করে মন দিয়ে শাটারের তালায় চাবি লাগাতে থাকে।

বেশি কাস্টমারের চাপ নেই আজকাল। তবুও একেকদিন বাড়ি ফিরে রাজ্যের ক্লান্তি চেপে ধরে তাকে। খাটে হাত পা ছড়িয়ে এলিয়ে পড়ে সে। বিছানায় যেখানে তারক ঘুমাতো, সেই জায়গাটাও বিশেষ ফাঁকা মনে হয়না তার। মনে হয় যে পুরো জায়গাটাই এখন তার দরকার।

বিশু আজকাল আর গুণগুণ করে গান গায়না। তবে দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকা বন্ধ হয়নি তার।

দোকানের সামনে ক্লিপ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা কলমকারি কাজের মাস্ক, ইমিটেশান গয়না কিছু বিক্রি হয়েছে। ফাঁকা জায়গাটায় আরও কটা প্যাকেট ঝুলিয়ে দেয় রিঙ্কি। যদ্দিন না স্কুলকলেজ খুলছে, এগুলো থাক; খুললে অবশ্য এগুলো বিক্রি হবার চান্স বাড়বে… রিঙ্কি ভাবে। বিউটি ফোন করেছিল। ওর বিয়ে। তবে বিয়ের পরেও আবার কাজে জয়েন করতে চায়। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলে, স্কুল কলেজ খুললে বিউটিকে ডেকে নেবে আবার। তখন একা সামলাতে পারবে না।

মাস্কটা নাক অবধি টেনে বিশুর দোকানের দিকে তাকায় রিঙ্কি। বিড়বিড় করে বলে… ‘চোখ গেলে দেবো।’

নন্দিনী সেনগুপ্ত। কবি ও ভূতাত্বিক। কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে যায়। তাঁর লেখা কবিতা গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়মিত প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং ওয়েবম্যাগে। মৌলিক লেখা ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষার লেখালেখি অনুবাদ করা তাঁর বিশেষ পছন্দের কাজ। এছাড়াও দূরদর্শনে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ