ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
ছয়
মাস্টার নৌকায় উঠল না। সে যাবে না। অবাক হয়ে সোম বলল, “এসো মাস্টার, ভয় পেও না। কীসের ভয়? সেই-ই ত আমাদের ডেকেছে, আমাদের কী-ই বা করার আছে? যাব। আর যাব বলেই তো এতখানি আসা।”
“না হে তুমি যাও।”
“কি বাজে বকো? এতটা পথ এসে ফিরে যাবে? এসো!”
“না। মন সায় দিচ্ছে না।”
“নদীর হলুদ জল্ দেখে ভয় পেলে?”
“না।”
“সে আমাদের সঙ্গে কম দিন তো মিশছে না।”
“আমি সে কথা বলছি না, সোম। সে আমাদের ডেকেছে—সেটা সত্যি তো? এই নিয়ে আমার ভেতর সত্যি এক সংশয় আছে। তুমি হয়ত বলবে, আমি তাহলে সেটা আগে বলিনি কেন? কেন এতটা পথ এলাম। আসলে এসেছি সেই নারীর মোহিনী মায়ায়। এখন মনে হচ্ছে, যাওয়া ঠিক হবে না। অমন অনেকেই যেতে বলে। কিন্তু সেটাকে সত্যি বলে ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। তুমি তবে যাও সোম, আমি যাচ্ছি না।”
“তুমি কি সত্যিই ভয় পাচ্ছ? রূপাঞ্জনা অমন মেয়ে নয়। আর যদি তেমনি মনে হয়, সেখানে যে যেতেই হবে তার কোন মানে নেই। আমরা এখানে যা দেখছি, সেই চন্দ্রালোকিত ভূমি বা দিগন্তহীনতার কথা সে বলেনি হয়ত। হতে পারে এটা তাঁর কাছে সহজীয়। এটার যে আলাদা গুরুত্ব আছে, তা সে বোঝেনি বলেই বলেনি। আমরা না হয় ওর ঘরে দু’ মিনিট বসে আমরা বৌদ্ধ বিহারের ঢিপিগুলি দেখে চলে আসব। সে সবের কত কথা তোমাকে বলেছি। এই ফাঁকে সে সবও দেখা হয়ে যাবে। নৌকা থাকবে আমাদের পার থেকে ফিরিয়ে নেবার অপেক্ষায়। অসুবিধে কি?”
“এদিকে যখন আর কোন বৌদ্ধ নেই, তখন কারা মশাল হাতে মিছিল করে যায় সেখানে—ভেবে দেখেছ একবার? তারা সব বৌদ্ধ—এমন প্রচার করা হয়। আসলে তারা কারা? আমরা যদি হঠাৎ তাদের খপ্পরে পড়ি আর বেঘোরে প্রাণ হারাতে হ্য়, তখন? ওরা আফিম পার্টির সদস্য হতে পারে। মশাল জ্বেলে অস্ত্র হাতে ফসলের পাহারা দেয়। তার মাঝে গিয়ে পড়লে আমাদের আর আস্ত রাখবে বলে ভেবেছ? আমরা আবেগের বশে এসেছিলাম, আবার ফিরে যাব। বিশেষত সেখানের ভুমিখন্ড মধ্যরাতে স্থান বদল করে, তখন ভাবনার অবকাশ থাকে বইকি! তুমিও আমার সঙ্গে ফিরে চল। অমন নারী অনেক মিলবে।”
“ওই ঢিপিগুলির ভেতর এক দ্বার আছে। বৌদ্ধদ্বার। তার ভেতর দিয়ে একবার প্রবেশ করলেই তুমি বুদ্ধের সেই সময়ের যাবতীয় উপদেশ, সত্যের উপদেশ ও বুদ্ধত্বে প্রবেশ করতে পারবে। আজ আকাশে যখন এত বড় চাঁদ আছে, হানজালা মাঝি আছে, আমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না।”
“তুমি একবার আমাকে বলেছিলে তোমাদের বাড়ির পিছনের এক মৃত বৃক্ষে এক প্রেত বাস করে। আমি তখন তা নেহাতই গল্পকথা বলেই মনে করেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝছি, তুমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস কর।তুমি তোমার দাদুর গল্পের ভেতর জীবন অতিবাহিত করছ, সোম। নইলে রাতে যে পথ সকলে এড়িয়ে চলে, তুমি তাতে পা দিতে পারতে না। ওখানের পৃথিবী রাতে অন্য।”
“হতে পারে এই নদীপথ ও ভূমিপথ দুর্গম ও ভীতিপ্রদ। যাইহোক, আমাদের এখানে ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ এখানে হানজালার মত একজন মাঝি আছে, যে আমাদের পথ প্রদর্শক। চলো মাঝি—”
মাঝি বিনা বাক্যব্যয়ে নৌকা ছেড়ে দিল। সোম বল, “এখানে প্রচুর আলো! যেন মনে হয় একটি নয়, দুটি চাঁদ আছে আকাশে।”
“আমি দেখেছি হাজার হাজার বৌদ্ধকে মিছিল করে ঐ স্তূপের দিকে যেতে। তাদের হাতে জ্বলন্ত মশাল। এলাকার অনেকে মনে করে তারা যাচ্ছে ঐ আফিমের খেত, গাঁজার চাষ পুড়িয়ে দিতে। অনেকে বলে, প্রেসিডেন্টের লোক অমনি মিছিল করে এসেই পুড়িয়ে দেয় খেত। খবর হয়। ভোট হয়। ভোট বাড়ে তখন। আর ঐ যে বৌদ্ধরা মিছিল করে যায়, লোকে ভাবে এরাই বুঝি সেই লোক, অবৈধ ফসল পোড়াতে যাচ্ছে।”
“এমনটা যে হয়, আমি শুনেছি হানজালা। দাদুই বলেছে। দাদু বলে, বৌদ্ধরা মিছিল করে বুদ্ধের জন্য। কোথায় নাকি বুদ্ধের জন্ম হচ্ছে তা ঐ বৌদ্ধ বিহারের কোন এক দেওয়ালে প্রতিবিম্বিত হয়। তাই গ্রহ নক্ষত্র মিলিয়ে তারা দেখতে যায় বুদ্ধ জন্ম নিলেন কিনা। আমি সেসব শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি ওসব দাদুর ছেলেভুলানো গল্প কথা। এত বৌদ্ধ এখন কোথায় যে মিছিল করে যাবে? এদেশে বৌদ্ধ কই আর? বৌদ্ধবিহারই বা কই? তাই যত ওসব শুনি, ছোটবেলায় যেমন বিস্মিত হতাম, পরে হাসি আসতে লাগল। এখন ভাবি হাসি আসে কেন? হাসি আসার কথা ছিল না। বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। আরও যক্তি দেখান উচিত ছিল। তাই এখন দেখি ব্যাপারটা দেখছি তা নয়! পুরাকালে পুরোহিতগণ বুদ্ধদেবের নিয়মাবলি মেনে বর্ষাকালে দুইবার বিশ্রাম করতেন। দাদুকে আমি মাঝেমাঝে দেখতে পাই, হানজালা।”
“কীরকম?”
“দাদু যে মিশে যাচ্ছেন কুয়াশায়—! সে এমন এক চন্দ্রকুয়াশা, যার ভেতর কোন কথা চলে না। তার ওপারে সেই স্তূপ, যেখানে এসে শেষ হয়ে যাচ্ছে বৌদ্ধধর্ম এই পৃথিবীর মাটি থেকে!! আর তখনই চাঁদ থেকে চাঁদ জন্ম নিল আকাশে।”
শিশির কুয়াশায় মিলেমিশে এক গন্ধ উঠে আসে। চাঁদের আলো, বুক কেমন করা বাতাস—যেন এক অনন্ত রাত্রি ও কুয়াশার যুগে তারা এসে গেছে। রাত্রিই এখানে সত্য, আর সত্য এক ছন্দ্রলোকিত নারী, যার লাগি তাদের এই রাত্রিকালীন ভ্রমণ। একটু পরেই প্রবল এক বিস্ফোরণে এক নতুন পৃথিবীর জন্ম হবে। তবেই এই দিগন্তহীন মাটিতে দিনের আলো এসে লাগবে। তাই, এই রাতে সবকিছু হলুদ হয়ে আছে জ্যোৎস্নায়। নদীর জল সেই হলুদকে ধরেছে আলতো করে। হাত দিয়ে নদী ছোঁয়। আঁচলা ভরে তোলে। জল নয়, হাতময় তরল চাঁদআলো। কুয়াশার স্তর, ঠান্ডার আমেজ যত যত বাড়ে, বাড়ছে তত আলোর প্রকোপ। হলুদ মাটি, হলদে জল, বাতাসের ভেতর চুপ করে থাকে নীলবর্ণের গাছ সকল।
“আমাদের বাড়ি তো এখানে নয়। কিন্তু দাদুর কাছে এই ষোড়শজনপদের নাম অনেক শুনেছি। দাদু কোথা থেকে জেনেছিল বা এখানে কখনও এসেছে কিনা, জানি না। অত কথা সেই সময় জানা হয়নি। ফলে এই কেনর উত্তর আমার কাছে নেই। হয়ত দাদু বলেছিল কখনও, কিন্তু মনে নেই। এখন মনে হচ্ছে সেটা জেনে রাখা খুব দরকার ছিল। তাছাড়া আমাদের বড়িতে এক শ্রমণ আসতেন। আমি বড় হতে তাঁকে আর আসতে দেখিনি। তাঁর কাছেও কিছু জানা হয়নি। যাক, আজ তবে এখানে আসতে পারলাম।”
“তবে তো ভাল হল। আপনার দাদু বুঝি গত হয়েছেন?”
“বহুদিন। কিন্তু যখন দাদুর কাছে এই জনপদের গল্প শুনতাম, তখন তেমন কিছু মনে হয়নি। গল্প হিসেবেই নিয়েছি। কিন্তু এখন দেখছি গল্পেরও কিছু ভিত্তি আছে। এখানে চাকরি করতে এসেও শুনিনি যে এই জনপদ এখানের এত কাছে। কিন্তু নামটা চাপা ছিল।”
“চাপা যে রাখতেই হবে।”
“বৌদ্ধবিহার কি জেগে ওঠে মাঝি?”
“চাঁদের ক্রিয়ায় ওখানে কী হয়, বলা যায় না। আপনার দাদুর কথা শুনতে চাই।”
“দাদু আমাকে কেবল গল্প বলে গেছেন—আসলে আমাদের আগের বাড়ি ছিল ওপার বাংলায়। দাদুর চাষের জমি যখন লিখিয়ে নেওয়া হল, দাদুরা অনেকে মিলে রাতের অন্ধকারে এক মশাল জ্বেলে এপারে চলে এলেন চোখের জল ফেলতে ফেলতে। ঠাকুমা বলে সেই থেকে দাদু অতিতচারী হয়ে গেল। বাস্তবের সঙ্গে কোন যোগ রাখত না দাদু। কাজ করত, ঘুমাত, খেত—কিন্তু কোথাও যেন পিছনে সরে যেত দাদুর সময়। দাদুর মনে হোত, তিনি চলেছেন সেই খচ্চরটার পিঠে চেপে—অনেকদূরে চলেছেন। পিছুপিছু আমি চলেছি। আমি যাচ্ছি তো আসলে দাদুর সেই গল্পের পিছুপিছু। যেতে যেতে খেয়াল করতাম, একটা সময় পর আমার প্রপিতামহের সেই খচ্চরটা আর খচ্ছর নেই, গোটাটাই একটা গল্প হয়ে গেছে!”
মাঝি এখানে একটু ভাও নিয়ে বলে, “এখানে খচ্চর এল কোত্থেকে, একটু বলবেন?”
সোম বলে চলে, “আমাদের এখানের বাড়িতে কোন খচ্চর ছিল না। ছিল ও দেশে, কিন্তু সে দেশ আমি যেমন দেখিনি, খচ্চরও দেখার কথা নয়। আর এখানেই বা খচ্চরের পিঠে কে চাপছে? খচ্চর ছিল দাদুর কিশোরবেলার কথা। দাদুর দাদু ছিলেন ডাক্তার। খচ্চরের পিঠে চেপে তিনি গ্রামে গ্রামে রুগি দেখতে যেতেন। একদিন রুগি দেখতে বেরিয়ে তিনি আর ফিরলেন না। ওদেশে তখন দাঙ্গা লেগেছিল। তিনি খচ্চরের পিঠে চেপে ফেরার পথে খুন হলেন।”
“আর খচ্চরটা?”
“তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
“তারপর?”
“ছিন্নমূল হয়ে, এপারে। বাংলাদেশে কিন্তু অনেক বড় বড় বিহার আছে। পাল রাজাদের যুগে সেগুলি নির্মিত হয়েছিল। এপারে মোগলমারী যখন আবিস্কৃত হল, দাদু আর বেঁচে নেই। আমার মনে হয়, এই ঢিপিগুলি খুঁড়লে মোগলমারীর মত এখানেও অমন বিহার মিলতে পারে।”
“ষোড়শজনপদ কিন্তু একটুখানি জায়গা নয়। তার বিস্তার অনেক। আর ওখানে একটা ব্যাপার আছে। প্রবল চাঁদের রাতে ওখানের ষোলটি গ্রামের ভূখন্ড স্থান পরিবর্তন করে।”
সাত
লগি ঠেলতে ঠেলতে হানজালা বললে, “তা ষোল গ্রামের কোন গাঁয়ে যাবেন?”
“তখন যে বললাম নামটা—খাজুরগড়। ওপারে গেলেই হবে। সেখানে একটা নতুন গ্রাম সৃষ্টি হয়েছে। সেটা ঐ খাজুরগড়ের পাশেই।”
“তাহলে ত মুসকিল হল।”
“কেন? সেখানের খাজুরগড় গ্রামটা তুমি চেন না?”
“আহা, ওখানের সব গ্রামই আমার চেনা। আমি যাই সেখানে। আপনার মত যারা ওখানে যেতে চায় তাদের ছেড়ে দিয়ে আসি। সেই হিসেবে খেজুরগড় গ্রামটাও আমার পরিচিত। কিন্তু মুসকিলের ব্যাপার কি বলুন দেখি, সেই গ্রামটা এখন কার পাশে আসে, কিভাবে সেখানে পৌঁছন যাবে, সেটাই রহস্য! তখন গ্রাম ভেঙ্গে পাড়া, পাড়া ভেঙ্গে মহল্লা আবার মহল্লা ভেঙ্গে এক একটি ঘর হয়ে যায়। সেই হাজারটা গাঁয়ের ফাঁকে, ঘরের মাঝে তাকে চিনবেন কী করে? খাজুরগড় কেবল একটা গ্রামের নাম নয়, একটা এলাকার নাম। সেখানে কতশত যে মানুষের বাস, এখান থেকে তার কোন ধারণাই করতে পারবে না। তার উপর আছে সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোকজনের ভিড়! তারা যেমন প্র্যোজনে আসে তেমনি অপ্র্যজনেও আসে। তারা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আসে, ধর্মের কারণে আসে আবার আসে গোলমাল পাকানোর জন্য। আবার যেমন পাগল আছে, বেশ্যা আছে, চোর-ডাকাতও কমতি নেই। আবার সেখানে উপ-নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়েছে। সেই নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষের ঝামেলাও লেগে আছে। এই নিয়েই ষোড়শজনপদই চলছে। সেখানে যেমন বুদ্ধের যে কাহিনি আপনি বললেন, আমি বললাম—সবই আছে; তেমনি আছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। সে এমনই ঘুরন্ত জায়গা যে বাইরের লোকে সেই বিহারের ভগ্নস্তূপ চিনতে পারে না।”
“সেখানে আছে একটা জাম গাছ, তার নিচে একখানা ঘর। তার সেই ঘর ঘিরে গড়ে উঠছে গ্রাম। এই যারা বিহার খুঁজতে যায়, যারা বিহারের মায়ায় পড়ে, যারা আর ফিরত আসতে চায় না—তারা, তাকে ঘিরে গ্রাম গড়ে তুলছে। মায়ার সাহায্যে সে গ্রামখানা গড়ে তোলে। সেখানে সৃষ্টি করে উপবন, পুকুর ও জলের স্রোত। সেসবের পিছনেই খাজুরগড় গ্রাম।”
“বা-হে, দারুণ কথা কন তো আপনি। যেন আমারই চোখের সম্মুখে একটা একটা করে ফুটে উঠছে সব। ভাল, ভাল, খুব ভাল। বৌদ্ধরা হলে বলত, সাধু সাধু। আচ্ছা, এখন কার বাড়ি সেটা বলুন দিকি—দেখি চিনতে পারি কিনা। ওপারের অনেককেই তো চিনি, নদীপার করে দিই। কি যেন নাম বললেন তখন?”
কথা ঘুরিয়ে বলল সোম, “তখন বলছিলে গল্পের সাথে সময়ের সম্পর্কর কথা। সেটা কী?”
একগাল হেসে মাঝি বলে, “গল্প মানে সময়, আবার সময় মানে গল্প। এটা যদি না থাকত তো গ্রহজগত মিথ্যা হয়ে যেত। ছায়াপথ, নক্ষত্র, আকাশ খসে পড়ত। ছায়াপথ হল কোন এক নারীর মত। আর এটাই হল কোন নারীকে কাছে পাবার এক আশ্চর্য সময়। চাঁদটা দেখুন। পাগল করা চাঁদ। এবার চাঁদটা ফেটে যাবে।”
“মানে!”
“দেখবেন দেখবেন চাঁদ কিভাবে ফেটে গিয়ে দিকবিদিক ছড়িয়ে যায় ডিমের কুসুমের মত, এখানে থেকেই তা প্রত্যক্ষ করবেন। সকলে এটা বোঝে না। তারা চাঁদকে চাঁদ হিসেবেই দেখে। কিন্তু এমন বড় চাঁদ যে একসময় ফেটে যেতে পারে, সেটা তাদের ধারণাই নেই। যারা বোঝে তারা চাঁদের প্রতি লাফ দেয়।”
অবাক হয়ে সোম বলে, “কিরকম?”
“অনেকে বলে, চাঁদের কণা পান করলেই এই কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। তখন তারা আর জন্ম নেয় না, স্বর্গর বাগানে খেলা করে। আবার এই চাঁদের সঙ্গে নারীর কেমন যেন মিল আছে। নদীকেও আমার নারী বলে মনে হয়। আবার চাঁদকেও। আপনি কী বলেন?”
“গোটা দুনিয়াই তো একটা নারী, হানজালা।”
“উঃ, যা কথা বললে একখানা! তা সে নারীর নাম কি?” বলে হানজালা যেন নৌকা থেকে নদী থেকে ছিটকে উঠতে চায়। নৌকা এমনভাবে জলের উপর গোঁত্তা খায়, মনে হয় সেটা যেন ডুবে যাবে। কিন্তু দোবে না সে। জলকে খানিক শাসন করে ভেসে ওঠে যেন। সে স্থির হয় সেই তীব্র জলের উপর, আর মুখটা ডানপাশে ঘুরিয়ে নেয়।
তখন হানজালা যেন আপন মনেই লগি ঠেলতে ঠেলতে বলে যায়, “নারী যে কী জিনিস তা বুঝাব কেমনে! সে হল অতি রহস্যময়ী। খানিক ভাসে শূন্যের উপর, খানিক ভাসে নীরে। নারী ধিল্যা লয়ে নীরে ভাসে। সে নারী হল আগে বেশ্যে, পরে দাস্যে, মধ্যে মধ্যে বোষ্টমী। আরও রহস্যময় হল তার শরীর। নারী হল বাউল গান। যেমন ধিল্যা নিয়ে নারী রহস্য করে বড়। যাক, এই বার আমার কাহিনি বলি। তার আগে একখান লালনের গান আপনাকে শুনাতে মনটা চায়, সোমবাবু। সেটা হবে গৌরচন্দ্রিকা। তাছাড়া—”
অতি কৌতুহলে সোম প্রশ্ন করে, “তাছাড়া—কী?”
বৈঠা ছেড়ে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দেয় হানজালা। তার মুখে যেন এক আলো ফুটে ওঠে। সে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে, “ তাছাড়া নদীকে জাগাতে না পারলে নারী জাগবে না যে! সে জন্য গান লাগবে। সে নারী যতই দূরে থাকুক না কেন, গান তার প্রাণে পৌঁছবেই। সে তখন তার একফালি উঠোনে নেচে উঠবে হরিণীর মত। কিংবা সে নিজেও হরিণী হয়ে গেয়ে উঠতে পারে বুদ্ধসঙ্গীত। এই গান না শোনালে নারী যেমন ঝিলমিল করে ওঠে না তেমনি নদীও বান ডাকে না।”
অত্যন্ত সন্তপর্ণে সোম জানতে চায়, “এ কোন নারীর কথা বলছ, হানজালা? সে কে?”
“তার নাম রূপজান। তার কাহিনি বলি, শোনেন—।”
হানজালা বলতে থাকল, “এ হল এক সাধারণ ঘরের বউ এর কিসসা। আবার এ কে বলতে পারেন নদী জাগানিয়া গান বা গল্পকথা। কারণ আগেই আপনাকে বলে দিয়েছি—নদীকে জাগাতে হবে। এই কাহিনি শুনে নদী জাগে, পুরুষ জাগে; নারীরাও ঘুম থেকে জেগে উঠে পাশ ফিরে শোয়—এ কাহিনি এমনিই।”
এই বলে সে হাঁ করে বাতাস টানে। আমি দেখি বাতাস নয়, তার মুখের ভেতর লক্ষ-কোটি-নিযুত কুয়াশার কণা ঢুকে যায়। সে অনেকটা কুয়াশা পান করে বলতে শুরু করে, “সব পেয়েও তার কি যেন ছিল না। এসময় এক বাউল তাদের গ্রামে ডেরা বাঁধল। বাউল গ্রাম ঘোরে, দোরে দোরে ভিখ মাগে। আর মাঠের ধারে বানানো কুটিরে সকাল সন্ধেতে গান করে। কিছু চ্যালাও জুটে গেল। সকলেই গাঁজাখোর বা নিস্কর্মা শ্রেণীর লোকজন।
“একদিন সন্ধেতে হল কি, বাউল এক বাড়ির কিনার দিয়ে ফিরছে। তখন সে শুনতে পেল এক গান ভেসে আসছে এক বাড়ির ভেতর থেকে। সে অনুভব করল, এই নারীর জীবন সংসারে নয়, পথে। সাধিকা হিসেবে। সে সময় মোহান্তর কোন সাধন সঙ্গিনী ছিল না। তার মনে হল, এই সেই নারী যে তার উপযুক্ত সাধন-সঙ্গিনী হতে পারে।
সে পরদিন থেকে মাধুকরী ছেড়ে দিল। সেই নারী যখন কলস কাঁখে জল আনতে না বা নাইতে পুকুরঘাটে যায়, সে তখন সেই সময় সেই পথেই থাকে, গান গায়। সবই দেহ মিলনের গান। এরপর যা হবার তাই হল। সেই নারী একদিন ভেগে গেল মোহান্তর সঙ্গে। সে-ই হল রূপজান। আর এদের সঙ্গে জুড়ে গেলাম আমি।
“বাউলের তখন তার সেই তেজ ছিল না। সে আর মাধুকরী করে আনতে পারে না। সঙ্গীনী যায় বটে, তবে তাকে একা ছেড়ে দিতে মন সরে না; তার ভয় হল এই যে সেই নারী যদি আবার নতুন কোন বাউলের হাত ধরা পিঠঠান দেয়! সে সময় ঘুরতে ঘুরতে আমি এসে পড়লাম এদের জীবনের ভেতর। মোহান্ত একদিন আমায় বললে, ‘গান জানো?’ আমি বলি, ‘না। কেবল দুনিয়াদারি করতে মন চায়।’ মোহান্ত বলে, ‘তবে তুমি আমার এখানে থাক। ও গান গায় ভালো। কিন্তু ওর সঙ্গে আমি আর ঘুরতে পারি না। ও গাইবে, তুমি বাজাবে।’
“মোহান্তর অগোচরে আমরা মিলিত হতে লাগলাম। ওঃ, সে কি নারী তা আপনাকে বলে বোঝান যাবে না, সোমবাবু। এত কামনা তার। এই যে নদীতে আমরা ভেসে আছি, মনে হয় এ আর কি এমন নদী, কিন্তু ঘটনা হল কি বলুন দিকি, এর চোরা টান। জলের উপরে দেখলেন যে কোন কিছু নাই, কিন্তু ভেতরের টান সে খুব। তাই নারী হল নদীর মতন। যত দিন যেতে লাগল বর্ষার নদীর মত সে উদ্দাম হয়ে উঠতে লাগল। পুরো দুনিয়া লোপাট হয়ে গেল আমার সামনে থেকে! একদিন মোহান্ত সব জানতে পেরে গেল।
একদিন এত আলো যে মাঝ রাতেও কোকিল ডাকে। এমনি সেই ডাক যে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। দুয়ারে পাতা চ্যাটাই আর কাঁথার বিছানায় উঠে বসি। ঘরের দিকে তাকালাম। ওরা ঘরে শোয়। মোহান্ত মাটিতে আর রূপজান চৌকিতে। টিনের দরজা ভিজিয়ে রাখে। সেই ভেজান দরজা হালকা ফাঁক ছিল। ভেতরে তাকিয়ে দেখি, খড়ের চাল ফুড়ে আলো আসছে। চারিচন্দ্র ভেদী সে চাঁদের আলোয়—ওঃ, কি যৈবন! ঝাঁপ দিলাম ধিল্যার ভেতর।”
“আবার সেই ধিল্যা! যেন ধেই ধেই নাচ!”
হিহি করে পাগলের মত এক নদী হাসতে হাসতে আবার হাতে এক খিলি পান তুলে নিল মাঝি। সঙ্গে একদানা মাটির তলায় পুঁতে রাখা পচা সুপারি। “চলে নাকি?’ বসে একদলা সুপারি সে বাড়িয়ে দিল সোমের দিকে। সেটা মুখে পুরে সোমের দেহ মাটি গন্ধে-স্বাদে ভরে গেল। তখনই তার মনে হল, চাঁদটাকে যেন কেউ পাম্প করে হঠাৎ এতটা বড় করে দিল। আর সেই আনন্দে চাঁদ হয়ে উঠল লাল!
আট
নৌকা চলছে মন্থর গতিতে। ধীরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি বাতাস এখানে হিমযুক্ত। তাতে মেশান কুয়াশার কনা। নদীকে এখানে দেখা যাচ্ছে না এই কুয়াশারই কারণে। কুয়াশা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে নদীকে শীতলতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। চাঁদের আলো তার কাছে ওম! আহা!
এদিকে সোমের মনে হচ্ছে, যেন মনে হচ্ছে ঘুরে চলেছে একই স্থানে। খুব আলগা হাতে দাঁড় বাইছে হানজালা। ওদিকে মাথার উপর পুষ্ট হয়েছে চাঁদ। কেবল আলো আর আলো। এই সময় মাঝি বলতে শুরু করল, “ওদিকে রূপজান প্রথমটায় বেশ চমকে উঠলেও পরে দেখা গেল সে সামলে নিয়েছে। একেবারে সবকিছু উজাড় করে দিল আমায়। আগে আমরা দুপুরে সম্ভোগ করতাম। যখন মহান্ত থাকত না। গরমের দিন, ঠা ঠা রোদ, মাটি সব ফুটিফাটা, কাক ডাকে, হুতাশনে বাতাস বয় আর গরম ধরে যায় শরীরে—ও, কী বলব আর!
“আমার কি মনে হয় জানেন, পুরুষ কামের ঘরে টোকা দেয় এই প্রকৃতির টানে, নারীর দেহ সে কারণ নয়। নারী দেহ হল গরল, তারে মন্থন করে পুরুষ তোলে হলাহল, সেই হলাহলের ধারণ ক্ষমতা সে পায় কি করে? না প্রকৃতি তাকে সেই গুণ দেয়। কিন্তু মোহন্তর সামনেই এই মিলন প্রথম। অমনি চাঁদের আলো, রাতচরা পাখি আর কোকিলের ডাক, আমার মনে যে কাম জাগিয়ে তুলল তা আর বলার নয়।
ঝটাপটিতে মোহান্তর ঘুম চটে গেল। সে সবের দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসত আমার নাই। আমরা তখন রসের নাগরিতে কেবলি ডুব দিই আর ডুব গালি। আগে অনেকবার মিলন ঘটলেও তার বেগ এমন না। সে সময় মনে হচ্ছিল, আগেরগুলি ছিল খেলা। ভাবের ঘরে চুরি কর্ম। কিন্তু এটি এক্কেরে আসল। এমনি করে কতক্ষণ যে কাটল তার কোন খেয়াল নাই আমাদের। যত ঝটপটি করি, কোকিক তত ডাকে। রূপজানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কোকিলও ডাকে। সে যে কি অবস্থা তা বুঝাব কেমনে! মনে হল ঘরে যেন আলো বেড়ে গেছে। এত আলো কেন? ক্রমে বুঝলাম, চাঁদ আর কোথাও নাই সে ঢুকে বসেছে যোনিগর্ভে।”
মাথার উপর চাঁদ দিব্যি গোল। নক্ষত্র খচিত আকাশ। কথা কথায়, গল্পে গল্পে কতদূর এসে গেছি আমরা? পথ ভুলে কি তবে অন্যত্র এসে পড়লাম? নাকি নদীর ভেতর নদী, আলোর ভেতর আলোর জন্ম হয়? চাঁদের আলোয়, গল্পের ঘোরে সে কি পথের ঠিকানা লাগাতে পারল না?
অঘ্রাণে নক্ষত্র দেখা যায়? সোম চাঁদ দেখার পাশাপাশি তাদের দেখতে থাকে। আকাশ হলুদ বর্ণ, আবার স্থানে স্থানে কুয়াশা মেখে সে হয়ে ওঠে শীলতলার সাদা। তখন নক্ষত্ররা কুচিকুচি হয়ে যেতে থাকে। সন্ধের পর যখন তারা একত্রে ফিরত; সে-মাস্টার-রূপাঞ্জনা, চাঁদ উঠত। সাদা কাগজের মত ঘষা, থালার মত, কখনো একবারে হলুদ সে চাঁদের বাহার। কিন্তু এমন স্ফিত না চাঁদ। রূপাঞ্জনা বলত, ‘আকাশের ঘরে যে চাঁদ আছে, আমার ঘরেও সেই চাঁদ আছে।’ তারা দুইজন নিজেদের মধ্যে গা টেপাটিপি করত। রূপাঞ্জনার কথা-ছোঁওয়া-তাকানো—সবই কেমন যৌনগন্ধী, এই নিয়ে মাঝে মাঝে আলগা কথা বার্তাও চলত বইকি।
মাঝিকে বলল সোম, “তারপর?”
“দুই ধিল্যা শুষে নিল গোল চাঁদকে। বলা যায় লুটে নিল চাঁদ। ভাগাভাগি করে নিল পরস্পরের মধ্যে।”
এবার সে বিরক্ত হয়ে বলে, “আবার সেই ধিল্যা!”
হানজালা সরস হেসে বলে, “এখনো বোঝ নাই, ধিল্যা কি? কলস! কলস!!”
“তাতে কি হল?”
সে হা হা করে হেসে বলে, “নারীর কলস কি? তার দু’খান স্তন, নাকি? মিলল কিনা?”
নৌকা স্থির। জলের ঢেউ-এ নাচে মৃদু মৃদু। চারিদিক একেবারে নিশ্চুপ। মাথার উপর দিয়ে সাঁ সাঁ করে পাখিরা উড়ে যায়। একটা শীতবোধ, বাতাসে অন্যতর গন্ধ। আমার মাথার মধ্যে জমাট বেঁধেছে কুয়াশা। মাস্টার যা বলছিল, এ যেন সেই এক অন্যতর জগত। অবশ্য রাতের বেলা সবকিছুই মোহিনী মায়ার লাগে। এক বিভ্রম! সোম ভাবল, সে যেন একই সঙ্গে মাঝির কাছে আর কুয়াশার কাছে নতজানু হয়ে আছি।
এই সময়, ঠান্ডার এই চাপ কমাবার জন্য হানজালা নৌকার ভেতর থেকে গাঁজা ও কলকে বার করে। নিজেই সাজতে বসে যায়। মুখ নিচু করে সাজতে সাজতে বলে, “টানা অব্যেস আছে? তা প্রথম টান দিলেন কবে, শুনি?”
“কলেজে পড়ার সময়। সেখানে পার্টি করতে আর…এই পাতা কি গোপন চাষের খেত থেকে আনা?”
“এ চাষ আর গোপন কোথায়, কাগজে মাঝেমাঝে ছবি বেরুয়…। সকলে জানে, কিন্তু কেউ জানে না—এই!”
“ফেরার সময় তাও দেখা যাবে।”
“আর নারী? নারী টানা অব্যেস নেই?”
একটু থেমে সোম বলল, “টানিনি কোনদিন।”
মাঝি মুখ ঘুরিয়ে বলল, “নারীকে টানা অত সোজা নয় সোমবাবু। সবাই তা পারে না। যেমন আমি পারিনি। আপনি পারবেন কিনা—তা আমার জানা নেই।”
সোম নীরব রইল। হানজালা বলে, “আমার একদিন সব ছিল বুঝলেন। কিন্তু আমি একা এখন। তবে একা হলেও প্রতি মানুষের কিছু একটা অবলম্বন চাই। আমার যেমন আছে নদী। একসময় যা সব ছিল, কিন্তু কিছুই রাখতে পারিনি। নদীর প্রতি টান আমার সব্বোনাশ করে দিল। আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে গেছে সে অনেকদিন। তাদের সঙ্গে আর দেখা হয় না। পরে পরে খুঁজেছি অনেক, কিন্তু মেলেনি। শুনেছি ওরা ভিখারি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি নিজেকে ফেরাতে পারিনি। সেই নদীর পদে পদে ঘুরি। যেমন আগে ঘুরতাম নারীর পদে পদে।”
দু’ চারবার কেশে নিয়ে সোম বলে, “কাহিনির কী হল? আর বলবে না?”
“বলব, বলব। এই তো শুরু হল। এই ঠান্ডায় একটু গাঁজার টান না হলে গল্প জমবে কেমনে?”
“ষোড়শজনপদের গাঁজা?”
“না হে। আমি ঘরে চাষ করি। নিজের হাতে। এর পাতাও কম সরেস নয়।”
“সেটা কীরকম?”
“নদী আমার ঘর হতে পারে, সোমবাবু। কিন্তু জল তো জলই, সেখানে মাটি কই? তাই মানুষের জীবনে ডাঙ্গা চাই। আমার আগে সব ছিল। এখন আছে এক ভাঙ্গা বাড়ি। আর বাড়িই বা বলি কেন তাকে, সে হল কুটির। গোলপাতায় ছাওয়া। সেখানেই জমি কুপিয়ে চাষ করিছি। পাঁচ সাতটি গাছ। চারা কিন্তু এপারেরই। আমি পেয়ে যাই। নিয়ে গিয়ে বসাই। নিজের হাতে চাষ করলে নিজের হাতেই ইচ্ছেমত পাতা তুলে খেতে পারব—এই আর কি। তাই ঘরে গিয়ে মাঝে মাঝে ঠাঁই নিই। সেও দুই একদিনের জন্য। তারপর নদীতে ফিরে আসি। মাসের পর মাস কেটে যায়। তা সোমবাবুর কাজ করা হয় কিসে? সরকারি চাকরি?”
“না হে। হোমে কাজ করি। এক এনজিও। সেই হোমে অনেক দুঃস্থ মেয়ে থাকে।”
“রামবাবুর হোম?”
“চেনেন?”
“চিনি তাকে। বুড়োও আমাকে চেনে। রামকমলবাবু। সে অনেকদিন আগের কথা। তখনও হোম খোলেনি। রামবাবু একটা প্রাইমারিতে মাস্টারি করত। তখন আমরা দুইজনের পার্টি করতাম। এক দল না হলেও সদ্ভাব ছিল। এখন তার খুব অভাব হে সোম। যাইহোক, মাস্টারি করতে করতেই সে হোম খুলল। প্রথম প্রথম এটাসেটা কাজ করত। আমি কয়েক বছর সেখানে দারোয়ানের কাজ করেছি। পরে ছেড়ে দিই। ও সব বাঁধা থাকা আমাদের মত ভবঘুরে মানুষদের পোষায় না। রামবাবু ফাঁক পেলে আমার সঙ্গে নদীতে ঘুরতে বেরুত। আমি তখন তাকে বাউল গান শোনাতাম। পরে মাস্টারির শেষ দিকে রামবাবু হোম করার কাজটা সরকার থেকে পেল। তখন মাঠের ধারে যে একটা পতিত জায়গা ছিল, সেটা রামবাবু কিনে নেয় ও প্রথমে একতলা ও পরে দোতলা করে। তখন এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে আর বেরুতে পারত না। আমি মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে সেখেনে বসতাম, সে অনেককাল হল; এখন আমারও আর হয় না,—নদীতেই সময় কেটে যায়। লোকজন এলে পারাপার করে দিই। বাকি সময় নিজের খেয়ালে নৌকা বাই। তখন গল্প করতাম রামবাবুর সাথে। কত গল্প হোত। ঠাকুরের দিক্ষিত রামবাবুর পরনে হলুদ লুঙ্গি আর হাতওয়ালা স্যান্ডো গেঞ্জি—ওর মার্কামারা পোশাক। হোমের ঘরের রঙ সব হলুদ আছে, নাকি বদলে গেছে সব? সেই পুকুরটা—যাকে দিঘির পার বলা হোত—আছে?”
“সব আছে। হোম, দিঘি, পিছনের আকাশ-বাতাস আছে—সব নিয়েই রামস্যার হোম চালায়।”
“রামবাবু ভোগী মানুষ। সে যেমন নারীকে ভোগ করেছে, এই মাটিকেও ভোগ করেছে। কিন্তু তার মনখানা ভাল। বিকেলের দিকে উনি মৌন, গুরুর আদেশ! আর ওঁনার যে পাওনাদাররা বিকেলে আসে, তারা ফিরে যায়—কত দেখেছি।”
নদীতে জল ক্রমে বাড়ছে। এত ঢেউ উঠছে যে বলার নয়। ওপার মাঝির চেনা। কিন্তু এই ঢেউ ও প্রবল স্রোত সামলে কি করে পৌঁছব সেখানে? এই নদীর প্রতিটি জল-স্রোত কে কী মাঝি চেনে? ছোট্ট এক গ্রাম্য নদী, এত জোয়ার পায় কোথা থেকে?
সোম বলল, “কাহিনির কী হল, মাঝি?”
দু’টি টান দিয়ে হানজালা তাই আবার তার কাহিনি বলতে লাগল, “রূপজানকে নিয়ে আমি চলে আসলাম। নতুন বসতি গড়ে তুললাম। প্রেম পিরিতি সবাই করে, সেই অনলে ক’জন মরে? আমি কিন্তু মরলাম। অনেক পরে আবার সেই রূপজানকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।”
এই বলে সে হাতে বৈঠা তুলে নিল। থেমে গেল তার গল্প। বাকি গল্পের প্রতি সোমের উত্তেজনা হচ্ছে প্রবল। তাই মরিয়া হয়ে সে বলল, “এখন চলা থামাও। যতটুকু এগিয়েছি এই নদীর, সেখানেই স্থির কর না কেন। গল্প যখন শেষের দিকে আসবে, তখন আবার চলা যাবে। নদী কি খুব চওড়া?”
“আসলে গল্পে গল্পে নদী বেড়ে যায়। বদলে যায় নদী। এক মানুষ যেমন এক জীবনে অনেক জীবন যাপন করে, এও তেমনি। এক নদীর ভেতর অনেক নদী।”
কুয়াশার বেগ এত প্রবল যে, দৃষ্টি বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমনি আলো রূপাঞ্জনা ভালোবাসে। জ্যোৎস্না মুকুলিত দিনে ট্রেনপথে তাদের কত আলোচনা হয়েছে। এমন হয়েছে, যে যার গন্তব্যে যাবার আগে তারা একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে কোন গাছের নিচে। স্টেশনেরই কোন এক প্রাচীন গাছ। সেখানে আলো জমে থাকে, আলো পরে থাকে। তারারা মৃদু স্বরে কথা বলেছে, নীরব থেকেছে প্রকৃতি। আসলে সেই সব দিনে তারারা এটা দেখাতে চেয়েছে—চাঁদ—তার এমত আলো মানুষের জীবনের ভেতর সম্পর্কর ভিতর কেমন প্রভাব বিস্তার করে।
“আমি ওকে নিয়ে পালাই। মোহন্ত আমাকে বলেছিল, ওকে নিয়ে কেউই সুখী হতে পারেনি। তোর এখন সুদিন আছে, তুই পারছিস। কিন্তু বেশিদিন এই অবস্থা তোর থাকবে না। তুই আমারই মত এক জ্বলন্ত ঢোঁড়া সাপে পরিণত হবি। আর সত্যি তাই হল এক বছর পর। এত তাড়াতাড়ি আমি অবশ হয়ে যাব, বুঝিনি। দৈব তেলে কাজ হয়নি। তারপর যা হয়! একদিন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল।”
নয়
এ যেন এক অনন্ত নদী। পাড় ঠাহর হয় না, এমনি সে দূর, এমনি তার সীমান্ত, এতটাই তার রূপরেখা, পুরো নদী যেন দিগন্ত অধিকার করে আছে। হলুদ সে জলরাশি, সে হলুদ মাস—অগ্রহায়ণ, মনে হয়, কেবল এই হলুদের প্রবাহ, এই নৌকা আর লাল চাঁদটুকু ছাড়া বাকি পৃথিবী এক মিথ্যা বসন পরে দাঁড়িয়ে আছে। তাই আকাশ বাতাস ও ভূলোক দ্যুলোক ছাপিয়ে কেবল এই নদীই হয়ে ওঠে একক। যেমন হানজালার কাহিনির প্রবাহ।
“এখনকার এ নদীর নাম কী, হানজালা? যে নদীতে আমরা ভেসেছিলাম, সেই নদী এর এই নদী কি একই?”
“যে নদী বর্ষায় ভাসে। কতশত এলাকা নদীর তলায় চলে যায়। আগেরটিকে যদিও আমরা ধরে নিয়েছি ঘিয়া নদী বলে, কিন্তু সত্যিই সেটা ঘিয়া কিনা, সেটা দেখার ব্যাপার আছে। দীর্ঘক্ষণ ওক নদী বাইলে হয় কি, তখন এক নদীর বুকের ভেতর শত শত নদী ঢুকে যায়। তখন এক নদীর তলদেশে আরও কত যে নদী চলাচল করে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। নদী তয়াই হয়ে ওঠে নদীময়। একদা সেই নদী বেয়ে চাঁদ সওদাগরেরা বাণিজ্যযাত্রা করে। এখনও নদীর পারের মাটি খুঁড়লে কতশত নৌকার কংকাল বেরিয়ে আসে।”
“তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি?”
“হয়, মাঝে মাঝেই হয়। সে পারাপার করে আমার নৌকাতেই।”
তারপর তাদের গল্প গল্পের দিকে মোড় নেয়। নদী, রমণী ও নারীকে ছাড়িয়ে গল্প ক্রমশ ছড়িয়ে নেমে আসে গল্পের ভেতর। তখন দেখা যায় কেবল অসীমতার বিস্তার। তা ক্রমে এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে পড়ে সে যে, যেন এক অনন্ত শূন্যের ভেতর তারা বসে আছে। তারা তখন আর নদীতে ভাসছে না। বরং পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে, দু’জনেরই গালে হাত, মুখোমুখি। নদী ভেসে যাচ্ছে তাদের দুই পাশ দিয়ে।
“সে কী বিয়ে করেছে আবার?”
চাঁদনী রাত কি সোম আগে দেখেনি? কিন্তু তবু আজকে এমন আকুলি বিকুলি করে কেন তার দেহের ভেতর? অগ্রহায়ণ, ধান উঠে যাওয়া মাঠের ভেতর, মাঠ, কুয়াশার এও অনুভূতি। এত নতুন, এত অনন্ত বিস্ময় কেন সঞ্চারিত থাকে তার মধ্যে? তবে কি এর মূল কারণ এই যে সেই আশ্চর্যময়ীর সুঘ্রাণের অনুভবে রণিত হয় মথিত হয় হৃদয়? এসময় কি জন্ম পালটিপালটি করে ফেলা যায়? হানজালা চন্দ্রালোক গুলে নারীর শরীরে যেন এমনি করে মাখে যেন মাটির প্রলেপ দিচ্ছে মাটির গৃহে, ঘর দালানে। তাই সেই নারী হয়ে ওঠে চন্দ্রাময়ী। নারী হয়ে ওঠে গৃহ। নারীই তখন নিকোনো উঠোন, মাটির দেওয়াল, রঙের প্রলেপ ও চাঁদ। সেই চাঁদ; যে লাল হতে পারে, বেগুলি বা নীল। এমন হতে পারে, সেই চাঁদ পনের দিন পূর্ণিমা কাটিয়ে আবার পররাত্রেই আকাশে ফিরে আসে গোল বড় নীল চাঁদ হয়ে। সেই আলোয় এই যে চারিদিকে যে বৃক্ষ সকল কথার ফাঁকে ফাকে গজিয়ে উঠছে, তারাও কী নারী নয়?
হানজালা বলে, “না। সে আলাদা থাকে। একা থাকে। প্রতিটি নারী তো একাই। যে নারী পুরুষের দেহে মাখামাখি করে থাকে, প্রতিরাতে যে সঙ্গমে স্থিত হয়, সেও একা। তাই তার পুরুষ লাগে। যে পুরুষ তাকে মথিত করে তোলে। সেই মন্থনের পর আবার নারী একা হয়ে ওঠে আর তখনই তার কৌমার্য শুরু হয়।”
এরপর তারা চুপ করে যায়। অনেকক্ষণ পর সোম খেয়াল করে, লগিও চুপ। তাই নৌকাও চুপ। তবু নদী বয়ে যায়, জল বয়ে যায় আর প্রবাহিত হয় সেই নীল চাঁদের হলুদ আলোরা। নৌকা যখন মাঝ নদীতে স্থির, তখনি সোম দেখে আলো পাকিয়ে উঠছে আর সেই জল ফুঁড়ে বার হয়ে এল এক দল হরিণ! প্রথম বেরিয়ে এল একটা, পরে পরে আরও আরও। সে যে কতশত হরিণ খপখপ আওয়াজ তুলে দৌড়ে বেড়ায় জলের উপর দিয়ে নদীর উপর দিয়ে সে কথা আর বলার নয়। সোম বিস্মিত। চরাচর জুড়ে ঝরে পড়ে চাঁদের আলো। জলের উপর ঠান্ডার স্তর। চাঁদ অজস্র আলোকবর্ষণ করছে। উজ্জ্বল কুয়াশা হয়ে ঘিরে ধরছে তাদের। নদীর বাইরের কিছুই দেখতে পাই না। মনটা কেমন যেন অলস হয়ে যায়। একটা মৃদু অথচ মনোমুগ্ধকর নারীগন্ধ সোমের দেহ মন ভরে যেতে থাকে। সে বলে, “আমি যার কাছে যাচ্ছি, সে যাত্রা করে। চেনো তাকে?”
হানজালা চুপ করে থাকে। মৃদু হাসে।
সোম বলে, “তাকে অপূর্ব দেখতে। আমার সঙ্গে আলাপ ট্রেনে। অনেক করে যেতে বলেছিল।”
মাঝি বলল, “চাঁদের আলো জমে জমে যেমন হয় রূপজান, তেমনি ভাবে নারী দেহও গঠিত হয়। নারী বড় রহস্যময়ী সোমবাবু। নক্ষত্রর আলো দিয়েও নারী শরীর গঠিত হয়। তখন সেই আলো নদী হয়ে বয়ে যায়।”
সোম নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকায়। মনটা খুশিতে দুলে ওঠে। সে দেখে নক্ষত্ররা নিজেদের মধ্যে স্থান বদল করছে। আকাশ জুড়ে সে কি দাপাদাপি তাদের। হানজালা বলে, “এদিকে আকাশে অমনি হয়। খেয়াল করতে পারেন, নাও পারেন—আপনার ইচ্ছে।”
“আর কতপথ, মাঝি?”
“এসেই গেলাম বলতে পারেন। এই তার বাড়ি—যেখানে আপনাকে নামিয়ে দেব, আর খানিকটা পথ বলে দেব। জানি না সে আজ আলো জ্বালবে কিনা, কারণ নক্ষত্রদের দাপাদাপি শুরু হয়েছে। একটু পরেই কোন না কোন নক্ষত্র নেমে আসবে আর কাছাকাছি থাকা নারীরা নিজ যোনিতে ভরে নেবে তাকে। তাদের রূপ খুলে যাবে।”
রাত কটা সেটা আর খেয়াল নেই সোমের। গাছেদের পাতারা নড়ছে। নদী হয়ে উঠছে উদ্দাম। আবার নদীজল দিয়ে খলবল খলবল করে দৌড়ে গেল এক ঝাঁক হরিণ। সোম কি ভুল দেখল? হানজালা কি দেখল না? সে কোন কথা বলল না কেন? ওদিকের মাটি থেকে বড় বড় নক্ষত্ররা উঠে স্থির হয়ে যাচ্ছে আকাশে। আকাশ হয়ে যাচ্ছে তীব্র নীলবর্ণ।
সোম পাড়ে নামে।
দশ
“বৌদ্ধ ঢিপিগুলি এখান থেকে কতদূর, হানজালা?”
“সে কথা এভাবে বলা যায় না। কারণ আজ যেখানে আছে, কাল হয়ত সেখানে তা ছিল না। কিন্তু আপনি যার কাছে এসেছেন, সেখানেই যান—তাহলেই হবে।”
“কেন?”
“অজস্র বৌদ্ধমশাল জ্বালিয়ে মুন্ডিত মস্তক মানুষেরা ষোড়শজনপদের ঐ দূর ভূমির আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হেঁটে আসছে। তাদের মুখে বুদ্ধের মন্ত্র। ঐ সব ঢিপিগুলি একটার পর একটা জেগে উঠছে। ফিরে যাচ্ছে তাদের আগের রূপে। এদিকের রঙ্গিন আকাশে অজস্র প্রেত উড়ে বেড়ায়। সেই স্থান আর সেখানে থাকে না, যেন পিছিয়ে যায় সহস্রকল্প। আমি যে একেবারেই যাবার চেষ্টা করিনি, তা নয়। কিন্তু সেই স্থান কেন জানি আমার দুরাধিগম্য হয়ে রয়ে যায়। তাই ওদিকের যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”
“কই, আর কারও মুখে ত এমনি শুনিনি, মাঝি? কোথায় গোলমাল হয় তবে?”
“সামনে ভোট আছে সেখানে। তাই সাবধানে থাকবেন।”
“কবে?”
“কেন? কাগজে পড়েননি? সেই যে নির্বাচিত এক প্রতিনিধি মারা গেল হার্ট ফেল করে, সেই থেকে ওই পদটা খালিই পড়ে আছে। সরকার এখন কিছুটা ব্যাকফুটে, কিছুদিন আগে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেল, তাই নিয়ে। ধর্ষণের ফলে যাদের ধরেছে পুলিশ, কিছু উত্তেজিত লোকজন সেই সব অভিযুক্তের বাড়ি পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেয়। সেটাও শাসকের বিরুদ্ধে গেছে। তাই প্রেসিডেন্ট ভোট পিছিয়ে দিতে চায়। কিন্তু বিরোধীরা লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এই নিয়ে। সেখানে ভোট হওয়া দরকার। তাই নিয়ে খুব শিগগিরি দিনক্ষণ ঘোষণা হবে।”
“হুম!”
“খানিক আগে একটি পাখি ডাকল, বলুন দেখি সেটি কি পাখি?”
“পাখির ডাক? খানিক আগে? কই!”
“আমি কিন্তু শুনেছি। ঐ স্তূপও তেমন। কেউ দেখে, কেউ দেখে না। আপনি আমি যা দেখি, আপনার হোমের বুড়ো মালিক তা দেখে না।”
“আমার দাদু বলতেন, বৌদ্ধ ধর্ম তার শেষ আশ্রয় পেয়েছে এই বঙ্গদেশে। তাই এই ভূমির নাম বুদ্ধভূমি। তাই তুমি দেখ একদল ভিক্ষু বৌদ্ধমশাল হাতে বুদ্ধমন নিয়ে বুদ্ধচাঁদের মায়ায় পড়ে হেঁটে যাচ্ছে ঐ বৌদ্ধবিহারের দিকে। হয়ত ওরা নির্বাণ নিতে যাচ্ছে। দাদুর হয়ত এমনিই ইচ্ছে ছিল।”
“আপনি যার কাছে যাবেন বলেছিলেন, সেখানে পৌঁছতে পারবেন ত? কথায় কথায় দেরি হয়ে যাচ্ছে নাতো আপনার?”
“কোনদিকে যাব, মাঝি? এত চাঁদ এত আলো, এমনি বাতাসের প্রবাহ, এত রঙ্গিন বৃক্ষ ও তার পত্র সকল, বাতাসে মিষ্ট স্বাদ—আমার যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে!”
“শুনুন, উত্তরবাহিনী পথে সে নারী থাকে। হ্যাঁ, একাই। যান। তার কাছে থাকুন আজকের রাত, ভাল লাগবে। তারপর ফিরে আসুন। কাল সকালে আমি এখানেই নৌকা লাগিয়ে রাখব। আপনি এলেই তবে খুলব। যান, যান।”
এই বলে মাঝি ক্রমে নদীর দিকে নেমে যেতে থাকে। পেছন ঘুরে সোম ডাকে, “হানজালা!”
সে থমকে দাঁড়ায়। ঘাড় ফিরিয়ে বলে, “বলুন, সোমবাবু।”
“তুমি কোন দেশের মানুষ, হানজালা?”
সে শব্দ করে হাসে। বলে, “আমার আবার দেশ! দুনিয়ার যার কিছুই নেই, তার আবার দেশ কী? গোটা দুনিয়াই আমার দেশ। আর যদি সত্যি করে বলি, দেশ বলে কোনকিছু নেই, যা আছে কেবল মাটি আর মাটি। পৃথিবীতর সমস্ত দেশ হল মানুষের কল্পনা, সোমবাবু। নদীতে থাকতে আমার ভাললাগে, সোমবাবু। নদীই আমার জীবন। মনে হয়, পৃথিবী যদি কেবল নদী হোত, বেশ হোত। তখন গোটা পৃথিবীকেই বাইতে পারতুম। কিন্তু আমি চাইলেই যে তা হবে, তেমন হবেই বা কেন?”
“ষোড়োশজনপদের কোথাও তোমার কোন ঘর নেই?”
“তা হল কই আর!”
“তুমি কি একজন দরবেশ, হানজালা? তোমার সঙ্গে এতটা সময় নৌকায় কাটিয়ে আমার এমনই মনে হচ্ছে। তুমি সারা পৃথিবীর মানুষকে কেবল সুখ বিলিয়ে বেড়াও? তাকে অলৌকিকের স্বপ্ন দেখাও? তুমি এমন এক চাঁদের দেশে এনে ফেললে আমাকে, আহা চাঁদ! এমন অতি উজ্জ্বল, বড় ও বৃহৎ চাঁদ যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, আমার জানা ছিল না। তোমার হাবভাব, কথাবার্তা আমাকে এমন ভাবতে বাধ্য করছে, হানজালা। আমার মনে হচ্ছে সুদূর অতীতে এই ষোলটি গ্রামের কোন একটি গ্রামেই হয়ত তোমার গৃহটি অবস্থিত। সেই গৃহে এখনও আলো জ্বলে, পাখিরা উড়ে যায় সেই আকাশ দিয়ে। দাদুর কাছে আমি শুনেছি চার হাজার দরবেশ সকলের অলক্ষ্যে থেকে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। হয়ত আমি যেখানে যাচ্ছি, গিয়ে দেখব সেখানে তুমি কোন মুরগির খামারে কাজ করছ। কিংবা যারা বেতের চুপড়ি বানায়, হয়ত তুমি তাদের একজন।”
“হা হা হা। আমি তোমার সামনেই আছি, সোমবাবু। আর আমার দরবেশপনার কথা বললে না? সেই মন আছে তোমার, তাই এতক্ষণ ধরে তুমি আমার কথা শুনেছ। আমার কাহিনিকে গল্প বলনি। আর তাই বড় নিজের করে পেলায় তোমায়, সোমবাবু। তাই তুমি বলে সম্বোধন করে ফেললাম।”
“তবে ঐ কথাই রইল—” বলে জল কেটে কেটে নৌকা নিয়ে সে এগিয়ে যেতে থাকে। একটু একটু করে সেই বৈঠার শব্দ আর হলুদ জলের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে থাকে। শীতল মৃদু বাতাসে গাছের পাতারা থেমে থেমে নড়ে। চাঁদের আলোয় লম্বা হয়ে পড়ে বৃক্ষছায়া। বৃক্ষছায়া যে এতটা লম্বা হতে পারে, জানা ছিল না সোমের। সে অবাক হয়ে ছায়া দেখছিল। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের, চাঁদ নেমে এসেছে যেন একদম মাথার উপর যে তাকে ইচ্ছে মত পালটে ফেলা যায় কোন রুপোর থালার সাথে। মাস্টারের কথা মনে পরে।
না, আর নয়। আজ রাত সে থেকেই যাবে রূপাঞ্জনার গৃহে। একত্রে না হয় রাত্রিবাসও করল, অসুবিধে কিসের? কত সবাই ই তো করে। এখন তার গ্রামের খোঁজে বেরুন যাক।
আর তখনি বাতাসে শোনা গেল এক সুর, ‘বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি…’
যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সুরটা। মন্দ্রিত কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে বারংবার। এই শব্দ আসছে কোথা থেকে? কে বুদ্ধর শরণ নিচ্ছে এমনি আকুল করে? সে কান পাতল। নানা রকম পোকা ডাকছে। চারিদিক থেকে অদ্ভূত শব্দ উঠছে। সে ঘুরে ঘুরে অন্ধকার দেখল, আলো দেখল। আর দেখল দূরে আলোর মালা। বিন্দু বিন্দ আলো একত্র হয়ে সারিবব্ধ ভাবে চলেছে আলোর মালা হয়ে। যেন মনে হয়, নক্ষত্রপুঞ্জেরা নেমে এসেছে। তখনও আরও উজ্জীবীত হয়ে উঠেছে সেই কন্ঠস্বরঃ ধম্মং শরনং গচ্ছামি…’
সোমের মনে পড়ে গেল দাদুর গলার স্বর। কাল্পনিক এক খচ্চরের পিঠে চেপে চুপিসাড়ে সীমান্ত পেরুবার সময় দাদু গুনগুন করছিল এই সুরই। দাদু আত্মা কী রয়েছে ষোড়শজনপদের ঐ ঢিপির কোথাও? নির্বাণ পেয়েছে দাদু? আর সেই খচ্চর? এইসব ভাবতে ভাবতে আচ্ছন্নের মত সোম চলতে শুরু করল এলোমেলো পায়ে।
(ক্রমশ…)
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..