ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
এক
একটু বেশি পথই চলে ফেলেছিল সোম? নইলে জনপদ বিস্মৃত এই চরাচরে সে এসে পড়বে কেন? আর এসেই যদি পড়ব, কিভাবেই বা চুপ করে দাঁড়িয়ে যাবে কেবলমাত্র আলোকিত ভূমি দেখে? কেন তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যাবে সে এখানে আসার উদ্দেশ্য?
চাঁদের আলো কিভাবে মাটি ছোঁয়, প্রকৃতি ছোঁয় তা সে মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে। আলো নামে অনুভবে, অনুরূপে। আলোর মাঝে সে এক হরিণের দেখা পেল। সংখ্যায় তারা হাজার হাজার। এত অজস্র যেন মনে হয় আলোর ভেতর অজস্র পতঙ্গ উড়ছে। সেখানে কোন মানুষ নেই, আশপাশে কোন গাছ নেই, নদীটাও কত দূরে চলে গেল কে জানে—কিংবা এও হয়ত সত্যি যে, উলফ চাঁদের ঐ আলোর প্রকোপে জল হয়ে উঠল আলোর হরিণ! কত কি যে হতে পারে এই আলোর পৃথিবীতে! নইলে এখানে যে এত হরিণের বাস, তা কে জানত! ধান কাটা ফাঁকা মাঠে হরিণেরা লাফায়। শীতের এই মায়াবী চাঁদের অপরূপ জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে কেবলই সেই অজুত –লক্ষ- নিযুত- কোটি হরিণের খেলা দেখছে সে।
কিন্তু এই মাঠে এত হরিণ কেন? কেনই বা তারা সোমকে দেখে ভয় পেয়ে দূরে দূরে না গিয়ে আশেপাশেই ঘুরঘুর করে? এটা কোন সংরক্ষিত অঞ্চল? আবার এমনও হতে পারে, এই কুয়াশার মায়াবি খেলায়, চন্দ্রালোকের মোহিনী মায়ায় তাকে যে গল্পকথারা আচ্ছন্ন করেছিল—তার ঘোর থেকে বেরিয়েছি মনে হলেও সোম আসলে তা পারেনি। সে সেই গল্পের ঘোরের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছে—এখনও! যা সে আজগুবি বলে মনে মনে বিশ্বাস করেছে, যা ভেবেছে—এক গাঁজাখোরের অলস মস্তিকের কল্পনা—তা সে মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছি কী করে? গল্প কিভাবে রূপ পাচ্ছে বাস্তবে? এই কি তবে অঘ্রাণের নিখাদ মায়া?
এক হরিণ এসে দাঁড়াল তার সমুখে। হ্যাঁ, সে নিজের এই বলেই পরিচয় দিল, সে হরিণ। কিন্তু তার পিছনে তার যে ছায়া পড়ে, তা মানুষের! সে বলে, “আমার নাম মৃগলেখ। তোমাকে মৃগজন্মে স্বাগত জানাই।”
ধাতস্থ হয়ে সোম বলল, “এই জায়গাটার নাম কি?”
“এটা হরিণগঞ্জ।”
“আমি এই গ্রাম নিয়ে জানতে চাই। কারা বাস করে এখানে?”
“এই যে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ, এখানে কেবল হরিণ বাস করে। তাদের সমস্ত ছায়া মানুষের। এখানে কোন গ্রাম নেই, বসতি নেই। বিশ্রামের যে যেখানে পারে আশ্রয় নেয়। এখানে কেউ যেমন কারও নয়, তেমনি তুমি নিজেরও নয়।”
“তোমরা সকলে তবে রাত কাটাও কী করে?”
“কেন? গাছের নিচে, আলোর নিচে। আমাদের এই গ্রামে কেবল আছে গাছ আর গাছ। ইচ্ছে মত কচি পাতা, ফলমূল খাই, আর পানের জন্য নদীর জল তো আছেই।”
এত আলো, আহা, কি উষ্ণতা সেই আলোয়, এত আলো আসছে যে, সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই আলো দেখে। আলোর সঙ্গে কেবলই চোখে পরে আলোর পতঙ্গ। কত হাজার হাজার পতঙ্গ যে সেই আলোর প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সেই দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সে, তখনই আসে এই হরিণ। তার কথায় অবাক হয়ে বলে, “মৃগজন্ম বলতে কী বলতে চাইছ?”
“মনুষ্যজন্ম ছেড়ে মৃগজন্ম নেওয়া হে নতুন মৃগ, তোমাকে স্বাগত এই হরিণগঞ্জ-এ। আশা করি একজন হরিণ নাগরিক হয়ে তুমি সফলতার সঙ্গে জীবন কাটাবে।”
সোম চারিদিকে তাকাল। হলুদ চরাচরে সকল গাছের পাতারাও হলুদ। আকাশ, বাতাস সবই হলুদময়। এখানে কি কখনো কোন মানুষ আসেনি? নইলে সে সোমকে অন্য প্রাণীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে কেন? সে বলল, “তুমি নিজেকে মৃগ বলে দাবি করলেও, তুমি একজন মানুষ—সেটা যেমন তুমি জান, আমিও জানি। নইলে তোমার পিছনের ছায়া মানুষের হয়ে পড়ত না।”
হরিণ বলে, “এখানে যারা আসে তারা মাটির দাবি মেনে হরিণজীবনে অভ্যস্থ হয়ে যায়। এ কথা তোমাকে বিশ্বাস করে নিতে হবে যে, এখানের পরিবেশই এরকম। আমরা সকলেই উদ্বাস্তু। আমাদের বাড়ি নেই, ঘর নেই, উঠোন নেই—মোটকথা পৃথিবীই নেই। এরকম উদ্বাস্তু কলোনী তুমি অনেক পাবে। যেখানে বিভিন্ন দেশের মানুষ একত্র হয়ে দিন গুজরান করে কোনক্রমে।”
“কোন কল্পে এসেছিলে তোমরা?”
“সেটা বললে রোষে পড়তে হবে। তুমি এমন একা এসেছ, আমরাও তাই। এখন আমাদের লক্ষ্য, ভোটার লিস্তে নাম তোলা, যাতে ভোটটা ঠিকঠাক দিতে পারি আর এদেশের নাগরিক হয়ে যাই।”
“হুম! জানি না, কেন, নদী পেরুনোর কথা ছিল না, পেরুতে হল। তখন দেখি জল বেয়ে দৌড়ে যায় অজস্র হরিণ। এখানে এসে দেখি দূরে পতঙ্গ লাফায়। পরে দেখি আসলে তারা হরিণ! এইভাবে, আমিও কখন হরিণ হয়ে উঠলাম, বুঝিনি। এই ভূমিতে পা রাখলেই সে হরিণ হয়ে যাবে; কিন্তু তার ছায়া পড়বে মানুষের! কিভাবে সম্ভব? কোন ভূমি এটা? কেন হয় এমন?”
সেই হরিণ মুখ বিকৃত করে বলল, “কী আর বলব বল। আগে এখানে বিশুদ্ধ হরিণেরা বাস করত। কিন্তু এখন? ভেজাল, ভেজাল!”
“তার মানে?” সোম অবাক হয়ে গেল।
সে বলল, “হরিণের রূপ নিয়ে অনেক খচ্চর এখানে অনুপ্রবেশ করেছে। তারাই এখানের পরিবেশ নষ্ট করে দিতে চায়।”
“কেন? কী চায় তারা?”
প্রশ্ন করেই সোমের মনে হল, এই হরিণ যে সত্যি বলছে তারই কি মানে আছে? এই যে সে হরিণের বেশ নিয়েছে, কিন্তু মানুষের ছায়া সে আটকাতে পারেনি! সোমের মনে হল, এই সব হল ভ্রান্তি। নিশ্চই আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পথ ঠিক খুঁজে পাবে। তখন সে যেন হানজালাকে দেখতে পেল। অতক্ষণ চাঁদ নিয়ে ভাসছে। আসলে তার ভেলাটা ছোট ছোট ঐ ঢেউ, আর স্রোতের চাপে যেন আধখানা নৌকার রূপ পেয়েছে। তাতে চড়ে তারা বহমান চন্দ্রালোকে। পরপর সেই গাঁজা টেনে আমি নিঃসৃম হলুদের ভেতর তারা চুপ করে বসে আছে। আর হানজালা তার ওই একরত্তি পলকা যান নিয়ে রওনা দিয়েছে শূন্যে।
কিন্তু এই নগরীতে চাঁদ এত নিচে কেন? সে এত বৃহৎ-ই বা কেন? সব সময়ই এত আলোই বা সে ধার নেয় কোত্থেকে! ভগবান বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ পছন্দ করেন। এই কী পূর্ণিমাস্থান? তবে এই কী সেই বুদ্ধভূমি?
দুই
কয়দিন বা ক’মুহূর্ত এখানে কাটল সেটা হিসেবের মধ্যে আসল না সোমের। কিন্তু অবাক হয়ে সোম দেখল এই প্রবল অঘ্রাণেও তার আর শীত বোধ নেই! সে অন্য মৃগের মত স্বাভাবিক জীবনযাপন করে এখন। ক্রমে মৃগেলেখর সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা হল। সে বললে, “তবে শুনেছি তিনি আসছেন। সেই কোন সুদুর বামিয়ান থেকে এক ভাঙ্গা নৌকায় চড়ে আসছেন তিনি। বামিয়ান তো আসলে এক নদী। খানিক দূরে আরও এক নদী আমুদরিয়া। সেখানে থেকেই এক নৌকায় যাত্রা। আহা মৃগদাব, সে যে কি সুদৃশ্য এক মৃগের আবাস তা কি বলব আর। এ সব দেখে ভগবানের ইচ্ছে হল তিনিও বর্তমান পৃথিবীর অসহিষ্ণুতা ঘোচাতে মৃগ হয়ে জন্ম নেবেন। হ্যাঁ, এটা সত্যি, পৃথিবী দিন দিন খুবই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে, দিকে দিকে ধর্মের নামে মানুষ খুন হচ্ছে, আর আমরা কিছুই করছি না! এই সময় তিনি থাকলে—আমাদের শোনাতে পারতেন সেই শান্তির বার্তা। তাই আমরা তাঁকে আহ্বান করেছি। অর্থাৎ তিনি আসছেন। তিনি এলে আমরা সকলে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে জোরকদমে প্রচারে লাগব।”
“কিন্তু এখানে শাসক প্রেসিডেন্ট শুনেছি খুব উদ্ধত?”
“সেটা কোন দেশেই বা নয় বলতে পার? সারা দুনিয়ায় এখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ফ্যাসিবাদ। আমাদের দেশও এবং এই ষোড়শজনপদও তা থেকে মুক্ত নয়। গণতন্ত্রের আড়ালে একনায়কবাদ। তবু এর ভেতর ভাল কিছুর জন্য কাজ করে যেতে হবে আমাদের।”
অঘ্রাণের এই কুয়াশা ঘেরা মায়াবী আলোকে সোম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, হরিণের দল তাকে ঘিরে পাক খায়, নেচে নেচে চলে যায় তারা। আর সোমের ভেতর সেই অগ্রহায়ণ জেগে ওঠে একটু একটু করে। ধানের আঁটি, খড়গাদা, ধান তোলা মাঠ, কুয়াশার লম্বা সর, আলপথ, ধেয়ে আসতে থাকা জ্যোৎস্না, ইঁদুরের গর্ত, মাটি কামড়ে বসে থাকা শামুকের সারি—ধেয়ে আসা অগ্রহায়ণের আকাশ! সোম ভাবে সেই মাস কত দূরে যখন আকাশে বাতাসে রঙের আগুন লাগে, পাখিরা গান গায়, ফুল ফোটে? সেই ফাল্গুনের আগে কি সে এই ষোড়শজনপদের পুরোটা দেখে ফেলতে পারবে?
এই সময় একটি হরিণ উপর দিকে লাফ দেয়। আর সে কি লাফ! মনে হল সে মিলিয়ে গেল আকাশে। পরে দেখা গেল সে নেমে আসছে উল্কার গতিতে। নামতে নামতে তার দেহ প্রচন্ড ফুলে ওঠে। বাতাসের সঙ্গে সংর্ঘষে তার দেহে আগুন লেগে যায়, সে ফেটে যায় শতটুকরো হয়ে। সেই সব টুকরো চাঁদের আলো ভরে নিয়ে হয়ে যায় এক একটি পূর্ণ হরিণ!
কথা ছিল, নদীর পাড়েই সেই ঘর, সেই গ্রাম, সেই নারী! এখানে সে সব কিছু নেই। কেবল আলো আছে। চাঁদের আলো। এক প্রবল আলোয় ফেটে যাচ্ছে আকাশ-মাটি- চরাচর। আর কেউ নেই, কিছু নেই। চন্দ্রালোকে হরিণ খেলে বেড়ায়। তারা সকলে মিলে বলে যায়, “তাই লাফাও, দাও লাফ! বলে তারাই লাফ দেয় আর পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে। তারা বলে যত লাফ যত লাফ দেবে কেবল আলো—আরো আলো। এই আলোই তোমাকে তোমার পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবে।”
সোম মৃগলেখর দিকে তাকায়। বলে, “সবাই চাঁদের প্রতি এত আগ্রহী কেন?”
“চাঁদকে ধরতে পারলেই তুমি জিতে গেলে। এক লাফে পৌঁছে যাবে নির্বাণ স্তরে। সবাই তো তাই চায়।”
“কী চায়?”
“এদেশের নাগরিক হওয়া। আমরা আর পালিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাই না।”
“আর এখানে এত বড় চাঁদ কেন?”
“এ হল উলফ মুন। মরা পৃথিবীর চেয়ে শূন্য এই পৃথিবীর চাঁদ চল্লিশ গুন বড়।”
“তাই চাঁদের ঘরবাড়ি-গাছপালা-মাঠ-ঘাট অরণ্য সবই দেখা যায়। জলের নিচ অবধি!”
এই শুনেই এক হরিণ এত উঁচুতে লাফ দেয় যে সে শূন্য হয়ে গেল। সে একসময় ফেটে গেল। কিন্তু তার টুকরোগুলো নিচে নেমে এলো না আর। বদলে অজস্র সাদা সাদা কণা নেমে আসছে তড়িৎগতিতে। এমনি মারাত্মক তাদের পতনের বেগ যে মনে হল ওটা যদি সোজাসুজি এসে ঘাড়ে পড়ে তো প্রাণ হারাতে হবে। সোম সেখান থেকে সরে যেতেই জলপ্রপাতের মত বারিধারা লাফিয়ে নামে। হরিণেরা সরে গিয়ে সেই জলধারার গতিপথ ছেড়ে দেয়। এত জল, যেন গোটা এই মৃগভূমিই লোপাট হয়ে যাবে জলের নিচে।
সোমের সামনে এক হরিণ দাঁড়িয়ে। তার এমনই রূপ, হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে হয়। এখানে আসা অবধি যত হরিণ দেখেছে সে, এমন ছিল না কেউ। মনের আনন্দে বলেই ফেলল, “রূপাঞ্জনা, তুমি! জানতাম তোমার দেখা ঠিক একদিন পাব। আমি তোমাকে খুঁজে পাইনি বটে, কিন্তু পথ ভুলেছি দেখে তুমি নিজেই চলে এসেছ খুঁজে খুঁজে। কিন্তু কিন্তু তোমার পিছনে তোমার যে ছায়া, তা দেখি মৃগের!”
সে বলে, “হে যুবক, আমি রূপাঞ্জনা নই। আমি মৃগশিরা। আমি টিলার ওদিকের এক গ্রামে থাকি। আমাদের গ্রামের নাম নীরবনগরী। এই যে স্ফটিক-জলপ্রবাহ দেখলে, এমনটিকে বলে হড়পা বান। এ না হলে আমি কিছুতেই ওই টিলার ওদিক থেকে এখানে আসতে পারতাম না। আমার সামনে এখন খুব বিপদ। আমার একটা গোপন আশ্রয় চাই। তুমি আমায় আশ্রয় দিতে পার?”
“এখানে যে সব হরিণেরা আছে তারা কেবল নেচে বেড়াচ্ছে। ছুটে চলেছে। কোন দিকে তাকাবার ফুরসত নেই। যদি তাদের দলে ভীড়ে যেতে পার তো হয়ে গেল, নইলে তুমি থাক তোমার মত। ওরা আর ফিরেও তাকাবে না। তারপর তুমি লাফ দাও। হও মথ, ফড়িং বা যা তোমার মন চায়। আলোর ভেতর ঘুরে ঘুরে আলো খেয়ে বাঁচ।”
তখন তার মনে পড়ল রূপাঞ্জনার সেই আকাশ-বৃক্ষ-কুটির নিয়ে একটি গ্রামের কথা। বলল, “একটা জায়গার কথা আমি বলতে পারি, যেখানে তুমি শান্তিতে থাকতে পারবে। সেখানে এক নদী আছে। নদীর ধারে গাছ। তার নিচে এক কুটির। যা ইচ্ছে যায় তাই তুমি রাঁধলে খেলে।”
“সে নদীর নাম কি?”
“নাম নিয়ে কি করবে তুমি? নদী তো নদীই।”
“ঠিক ঠিক, নদী হল নদীই—তবে কি জান, নদীর ধারে থাকতে থাকতে কেমন যেন মায়া পড়ে যায় মানুষের উপর। এখন বল, কোথায় কোথায় সেই জায়গাটা কোথায়? আমি এখুনি যেতে চাই। আমি শান্তি চাই। সব তোমায় পরে বলব। একটু বিশ্রাম, খাদ্য আর পানীয় চাই।”
দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। জায়গাটা নির্জন। নদীর ধার। পথে যেতে যেতে মৃগশিরা বললে, “আমরা তো নক্ষত্র জাতের মানুষ। আমাদের রীতিনীতি আলাদা। এখানের কায়দা কানুন আমরা জানি না, তুমি শিখিয়ে দিও।”
নদীর জল কুলকুল করে বয়ে চলেছে। তাদের পথ দেখিয়ে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে এল এক হরিণ। সে অন্যদের মত না। কথা কম বলে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সোমের মনে হয়, এ অন্যের মত নয়, আলাদা জাতের হরিণ। আর এখানে এই জাতের হরিণ তার কখনো চোখে পড়েনি। সোমের মনে হল, তাকে বিশ্বাস করা চলে। মনে হল, তার ভেতর অজস্র হরিণজন্ম বারংবার ঘটে চলেছে।
সেই হরিণ অত্যন্ত শান্ত গলায় মৃদুস্বরে বলে, “সকলের সময় একসঙ্গে আসে না। এই পথে সোজা চলে যাও।”
সোম বলে, “এটাই তবে সঠিক পথ?”
হরিণ বললে, “আমি তা বললাম মাত্র। তুমি নিজে সিদ্ধান্ত নেবে।”
“এই পথ গেছে কোথায়?”
“পথ যেমন হয়, শেষ বলে কিছু নেই—এও তেমন। পথের শেষে গিয়েও দেখবে, সেখানেও কিছু নেই। যে পথ ফেলে গেছ, সেটাও কোন পথ নয়, কিছু নয়। আসলে পথ বলেই কিছু ছিল না। পৃথিবী বলেই আসলে কিছু নেই। আকাশ তো ফাঁকা স্থান মাত্র। তাই তাকে নীল দেখায়। বাতাসকেও কেউ দেখেনি কোনদিন। আর দেশ? ষোড়শজনপদ? সে তো মাটি মাত্র।”
মৃগশিরা বলে, “তোমার পরিচয় কি?”
সে মৃদু হেসে বলে, “আমি এক মৃগ কেবল।”
তিন
নদীর পারে কেবল তারা দু’জন। সোম তাদের ঘিয়া নদীর কথা বলে, বন্যার কথা বলে। নদীকে মেরে ফেলছে মানুষ, বন্যা আসছে তাই। যত পুকুর খাল বিল বুজিয়ে ফেলছে আর দোষ হচ্ছে নদীর –কেন সে অতিরিক্ত জল ধরে রাখতে পারে না! আশপাশে কিছু গাছ, কয়েকটি পাখি। তার কুজন করছে। সোমেরা নিজেদের ভেতর এত নিবিষ্ট মনে কথা বলছে যে মনেই হয় না এই মাত্র তাদের আলাপ। তাকে সোম কত কথা বলে যায়। সোম থামলে সে বকবক করে। তার কাছে এসব কথা বলে কেন জানি সোমের এক আরাম বোধ করতে থাকে। মন হয়ে ওঠে পাখি। তার মনে হয় একটু দৌড়ে যাই, নেচে নিই একপাক। একসময় মৃগশিরা বলে, “এই ভরা নদীর ঠান্ডা জলে আমরা পাশাপাশি সাঁতার দেব, বেশ হবে না?”
এইভাবে টানা ক’দিন যে তারা হাঁটল তার কোন ঠিক নেই। তাদের কথা আর ফুরায় না। একসময় মৃগশিরা প্রবেশ করল তার গোপন জীবনে। তাদের এলাকার বৃদ্ধ গোষ্ঠীপ্রধান তাকে কামনা করে। এদিকে সে পাড়ারই এক সুদর্শন যুবক চন্দ্রের প্রেমিকা। কিন্তু উঠতি নেতা চন্দ্রর সাহস নেই প্রবীণ এই নেতাকে চটানোর। চন্দ্র তৎক্ষণাৎ মৃগশিরাকে বিবাহ করতে অরাজি হয়। ফলে মৃগশিরা কোথাও আশ্রয় পায় না।
সোম আর রূপাঞ্জনা পথ পেরুচ্ছে। পথ না, মাঠ। পথের তো একটা বাধা নিষের আছে। যেখানে সেখানে প্রবেশ করতে দেয় না। কিন্তু মাঠ তেমন নয়। তার কোন আগল নেই। সে কাউকে কোথাও বেঁধে রাখে না। যার যেখানে ইছে সেখানে পা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে চলে যেতে পারে। আমরাও তেমন করে এসেছি। এখানে ফসল উঠে যাবার উঁচুনিচু মাটি। সেখানে দাঁড়িয়ে সোম তার চুলের গন্ধ নেয় তারই অগোচরে। তার পায়ের পাতায় মুখ রাখে, জিভের ডগায় তুলে নেয় নাভি। তখন এত আনন্দ হল যে বলার কথা নয়।
সোম লুকিয়ে দেখে তার অপরূপ রূপ। সে ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারে এই নারীটি তাকে কেমন যেন বশ করে ফেলছে—ঘিয়া নদীর মতন। সোম ওর গায়ের গন্ধ পেতে শুরু করে। ওর সম্পূর্ণ স্তনের যে কি অপূর্ব গড়ণ, এমন কোমল যে জোরে বাতাস লাগলে স্তন দেবে যায় যেমন ধিল্যা ঢেউ এর ধাক্কায় ডোবে আর ভাসে। তার মসৃণ টানটান পেট, বড় বড় হরিণ চোখের এই সৌন্দর্য তাকে মোহিত করে দেয়। একসময় এমন অবস্থার মধ্যে তারা এসে দাঁড়ায় যে তার ফুল্ল অধর দেখে সোম কামমোহিত হয়ে পড়ে। এতটাই যে, কখন তার মুখ দু’ হাতে নিয়ে অধরের স্বাদ নিতে শুরু করেছে তা নিজেই জানে না। সেও এমন নিঃশেষ করে শুষে নিতে বাধা দেয় না, বরং নিজেকে আরও মেলে ধরতে থাকে। সেই দীর্ঘ চুম্বন যখন শেষ হল, তারা দু’জনে যখন বিচ্ছিন্ন হল, তখন চারপাশে মেদুর আলো। মনের ভেতর কুহক ডেকে গেল। সোম আনন্দে তার স্তনে হাত রাখে। কানে মুখ রেখে বলে সে, “এই হল ধিল্যা, জেনে নাও।”
সে লজ্জা পেয়ে বলে, “তুমি খুব বাজে লোক!”
কত জল সেখানে! সে জলে তার হাত ভিজে যায়, মুখ সিক্ত হয়ে ওঠে। সোম অনুভব করে অজস্র হাজার হাজার ফুল ফুটে উঠছে তার চারপাশে। লতাপাতা ঘিরে ফেলছে তাকে। আকাশটা হয়ে উঠছে রামধনু রঙের। সে সম্পূর্ণভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়ে, মিশে যেতে থাকে তার ভিতর; মনে হয় কখন যেন সে এক মাঝি হয়ে উঠেছে, চন্দ্রালোকের ভেতর ক্রমাগ্রত নৌকা বেয়ে চলেছে। সে আবিষ্ট সেই দুই ধিল্যার প্রতি, এমন স্বাদ তার, এই দুটি অপূর্ব গড়ণের কারুকাজ করে ধিলায় নিয়ে নারী যে কী আশ্চর্য কৌশলে আলোকিত করে রাখে এই মাঠ-ঘাট-অরণ্যকে তার এক বড় বিস্ময়! তখন মাথার উপর সূর্য উঠে গেছে! কতদিন পর সূর্যর আলো দেখল তারা। মৃগুও অবাক হয়েছে। খুশিও। তার গালে মুখ ঘসে বলে, “জানো, আমার না খুব ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করছে!”
দীর্ঘ পথ একসঙ্গে চলন ও একটি অনন্ত চুম্বন যে তাদের এভাবে বেঁধে ফেলবে তা কেউ ভাবেনি। ও এখন একান্ত ভাবেই কেবল সোমের। তেমনি উল্টোদিক দিয়ে দেখতে গেলে সেও ওর ছাড়া কিছু নয়। রূপাঞ্জনা হয়ে গেল সুদূর অতীত। প্রেমিক চন্দ্রের কথাও আর বলে না মৃগশিরা। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে একজন আর একজনকে ছেড়ে বাঁচার কোন উপায় নেই। কাতর স্বরে সে সোমের হাত ধরে সে কথাই বলল, “এমন তো হবার কথা ছিল না! কেন হল?”
সোম বলে, এই নদী সব জানে। এতে ভেলা বেয়েই তুমি এলে, নদীকে নিয়ে এল তুমি।”
সে সোমের পাশে বসে। দু’হাতের বেড় দিয়ে সোম তাকে শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। হাতের একটা আঙ্গুল দিয়ে ওর চোখ-মুখ-নাক আঁকতে আঁকতে বলে, “আমি জানি কেবল একজনকে। সে তুমি!”
তারা আবার চুম্বনে ব্যাপৃত হয়। এবার এক আশ্চর্য অনুভূতি হয় সোমের। ওর অধরে অধর স্থাপন করতেই বাইরের জগত সব কিছু অন্ধকার হয়ে ওঠে। যেন তার দেহের মধ্যে এক বিস্ফোরণ হল! মনে হল মনের গহীন কোন এক অন্ধকারে সেই বিন্দুটি লুক্কায়িত ছিল, সেই নিকষ অন্ধকারের ভেতর সেটি ফেটে গেল। সেটি এই নারীর অধরের স্বাদ-বর্ণে-গন্ধে-রূপে-রঙ্গে ফেটে পড়ল এবার। সোম বুঝল, চুম্বনও শেখার বস্তু!
তারা নদীর পাড়ে ঘর গড়ে তোলে। সেখানে মহাসুখে বসবাস করতে আরম্ভ করে। তারা দু’জনার ভেতর এমনি মগ্ন হয় যে মনেই পড়ে না আগের সম্পর্কের কথা। এই পৃথিবীতে সীমানাটুকু পার করে সন্ধের পর আমি বিপুল মহাকাশ দেখি। পাশে বসে থাকে মৃগশিরা। বলে, “এখানে এসে আমি ঠকিনি। তুমি আমার জীব্নকে এল লহমায় ভরিয়ে দিলে। নিজের হাতে তুলে নিলে আমার চোখের জল। এত সুন্দর এক পুরুষ তুমি। আমি কখনও ভাবিনি এমন কাউকে জীবনে পাব।”
সোম তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে সেই হরিণের কথা, যে তাদের পথ দেখিয়েছিল। সে কী কেবলমাত্র এক পথ-প্রদর্শক হরিণ? নাকি অন্য কিছু? মন কেন তার কথা ভাবে? কেন তার পিছু পিছু ধাওয়া করে সমস্ত চিন্তা সকল? সে হরিণ অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। সে তবে কে ছিল?
চার
এই প্রথম সোম কোন নারীদেহ আবেগ ভরে ছুঁল। এই প্রথম কোনো নারীকে নিয়ে ঘনিষ্ট ভাবে বসে আছে জল টইটই নদীর ধারে। সে সোমের কাঁধে মাথা রেখেছে। হালকা বাতাসে তাদের চোখ জুড়িয়ে আসছে। তার গায়ের এমন অপূর্ব গন্ধ! সোম ওর মুখটি দু’হাতে তুলে ধরে সোজাসুজি ওর ঠোঁটে চুম্বন করে। সোম বুঝেছে, এ হল প্রকৃতির মায়া। এই চরাচর জুড়ে যে সূর্যের আলোর খেলা, ছায়া মেঘমেলা, নদীর শব্দ, উড়ন্ত প্রজাপতির ঝাঁক, লাল পাতার গাছ; তা মায়া ছাড়া আর কী? তার মনে পড়তে থাকল হানজালার কথা। সে বলেছিল, প্রকৃতির জন্য, আলোর আঘাতেই মানুষের দেহে কাম আসে। দেখি, নদীর যেন কোন সীমা পরিসীমা নেই, সে অনন্ত আকাশ একমাত্র তার উপমাস্থল। তাদের নদীপথ আর পথ শেষ হয় না। জল, জল, কত জল! কেবল জলের স্রোত, প্রবাহ আর টান। মনে হচ্ছিল কতক্ষণে নৌকা ভিড়বে ঘাটে; আর চাঁদজল দিয়ে মুছিয়ে দেব তাকে। জল বলতেই ভেসে ওঠে হানজালার কত কথা, কত রূপকল্প, যার জলেই বসত।
সোম এই নদীতীরে বসে দিব্যি দেখতে পায়, হানজালা তার নৌকা নিয়ে এপার ওপার করছে। টানা বকবক করে চলেছে ঘিয়া নদীর সঙ্গে; এখানে সে ঘিয়া— এবং একাকী। একের পর এক মানুষকে সে পার করে দিতে থাকে। যারা তার গল্প শুনতে রাজি হয় না তাদের জলে ফেলে দেয়। ফলত জলের ভেতর থেকে উঠে আসে এক ঝাঁক হরিণ।
মৃগশিরা তার গ্রামের গল্প বলতে থাকে। কালপুরুষের কথা বলে। বলে, “অসহায় দূর্বলদের প্রতি তার যে কী ভালোবাসা তা না বলে বোঝানো যাবে না। আমি যখন চলে আসি এখানে তখন কালপুরুষ তার ঘরে ছিল না। সে তখন চলে এসেছে বিষুবরেখা অঞ্চলে। দিনরাত কাটায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। সেখানে শতছিন্ন পোষাকে একদল কুষ্ঠরোগী বাস করে। সে একজন ডাক্তার। নিজের নৌকা নিয়ে একাকী পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পরে। সে রোগীদের নিরন্তর সেবা করে। সে বলে, ‘দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন সম্বন্ধে বিশদভাবে জানতে গেলে পৃথিবী ভ্রমণ করতে হবে।’ এ যুক্তি মানা না মানা তোমার উপর। সে আমাদের গ্রামে উপস্থিত থাকলে আমাকে হয়ত নাও এখানে আসতে হতে পারত। আনের্স্তা একটা সমাধান বার করে দিত।”
সোম বলে, “তার মানে তোমাদের ওখানে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল নয়।”
“তারপর তো তুমি সব জান। আমি কয়েকজন বান্ধবী নিয়ে অন্য নদীদের সঙ্গে সংযোগ করতে থাকি। তাতে সমস্ত জল এক হয়ে তীব্র স্রোত হয়ে বয়ে যেতে থাকে। সেই বেয়ে আমি চলে আসি রবারের নৌকায়। বিপদজ্জনক পথে খুবই মারাত্মক যাত্রা ছিল সেটা। আমরা মোট সতেরজন এসেছিলাম। ঈশ্বর সহায়, আমরা অল্পবিস্তর আহত হলেও নিরাপদে চলে আসতে পেরেছিলাম। এখানে এসে আমি ভাবিনি তোমার মত এক প্রেমিকের সাক্ষাৎ পাব। আমার জীবনটা আবার ভরে উঠবে আলোয়। ভাবিনি এক প্রেম হারিয়ে অপর প্রেমকে এমন করে আঁকড়ে ধরব। ভাবিনি সেই প্রেম ভুলিয়ে দেবে আমার আগের স্বপ্ন, ইতিহাস। আমি এক গৃহবধূ হয়ে উঠব।”
জগতপুত গ্রাম থেকে একটু তফাতে তাদের ঘর তৈরি হয়ে গেল। সোম খেয়াল করে দেখেছে, লাগোয়া জগতপুরের অধিবাসীরা তাদের কাজে কোন ব্যাঘাত করেনি। তারা অতি সহজ সরল অধিবাসী। ধর্মভীরু। রুক্ষ মাটিতে টুকটাক চাষ, পশুপালন ও মাংস বেচে তাদের দিন চলে। পড়াশুনোর চল তেমন নেই। একটি ছোট ইস্কুল আছে বটে, সরকার পরিচালিত, সেখানে প্রেসিডেন্টের একজন আত্মীয় পড়াতে আসে। কিছু বাচ্চা পড়তে যায়। তাদের কেবল মাঝেমাঝে এসে দেখে গেছে তারা কি করছে। শুধু জানতে চেয়েছে, প্রেসিডেন্ট কিছু জানে কিনা তাদের ব্যাপারে। তারা ঘর গড়ার অনুমতি নিয়েছে কি না ইত্যাদি। সোম বুঝেছে, তারা প্রেসিডেন্টকে ভয় পায়। প্রেসিডেন্টের কথা ঘড়ির কাঁটা মেনে পালন করে চলে। সংবিধান রাখা থাকে রান্নাঘরের চালে। কিন্তু মজা হল, তারা প্রেসিডেন্টকে কখনো দেখেনি! কিন্তু তাকে বলে দিয়েছে, প্রেসিডেন্টের সামনে বুদ্ধের কথা না বলতে। কারণ? প্রেসিডেন্ট আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়। দরকারে সে সংবিধানের বদলও ঘটাতে প্রস্তুত! তাই সোম তাদের নানা গল্প বলেছে, জাতকের কাহিনি শুনিয়েছে।
মৃগু নদীর ধারের এই ঘরের নাম দিল, ‘আকাশ নিবাস’। সোম প্রবল পরিশ্রম করতে লাগল। জঙ্গলের ভেতর ঢুকে কাঠ কাটা, ফল সংগ্রহ, মধু খুঁজে আনা, মাটি কুপিয়ে চাষ। সোম কোনদিন চাষাবাদ করেনি। তাদের জমি নেই। জমি আছে মাস্টারদের। তার কাছে সে চাষের নানা গল্প শুনত। বীজ ফেলা, বপন করা, এবার সেই সব প্রয়োগ করা শুরু করল। এরা আধুনিক চাষের কিছুই জানে না। ফলে যা ফসল উৎপন্ন করে, তার পরিমান কম। তাছাড়া অনাবাদী জমিও এখানে প্রচুর। বোঝা যায় সরকারি কোন উদ্যোগ নেই। সোম নিজের উৎসাহে সেখানে চাষজমি নিয়ে এল। চাষে যে এত আনন্দ তা সোম বোঝেনি আগে। যারা চাষে উৎসাহী নয় বা চাষের কাজে অনুপযোগী তাদের জন্য সে নিয়ে এল জরির কাজ। সেই জন্য তাকে কয়েকবার এই তল্লাটের বাইরেও যেতে হয়েছে। নইলে সে উপকরণ পাবে কোথা? কে শেখাবে কাজ? ওস্তাগরও এল। মেয়েরা এইভাবে স্বনির্ভর হল। সোম এখন অবসরে নদীতে মাছ ধরতে যায়। এটা তার শখ। এই শখ তার আগেও ছিল। মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধবদের পুকুরে ছুটির দিনে ছিপ নিয়ে বসে যেত।
কতগুলি মৃগ, যারা একদা ধীবর ছিল, যারা দিন গুজরান করত নদীতে মাছ ধরে। তারা দিনের পর দিন সেই নদী বেয়ে, পথ তারা রূপাঞ্জনাকে অনুসরণ করেছে ছায়ার মত। অনুকরণ করেছে তাকে। অবশেষে মাঝির কাছে টুকরো টুকরো গল্প শুনে একদিন চেপে বসেছে সেই নৌকায়, যেখানে চাঁদ উঠে আসে। নিজের বাড়ির পিছনেই গাঁজার চাষ আছে হানজালার। তার নিজের হাতে লালন পালন করা সেই সব গাছের পাতাদের সে ইচ্ছে মতন তুলে আনতে পারে। গঞ্জিকা সেবন মাগনায় তার নৌকায়। তার সঙ্গে অনেকেই থাকে এই সময়। হতে পারে তারা মানুষ বা অশরীরী। বা কোন বৌদ্ধ শ্রমণ। মশাল নিভিয়ে তিনি মশালের আলোতেই কলকেতে আগুন দিয়ে টেনে নিচ্ছেন সুখ।
সোম অনুমান করে, সেই ধীবরের দল ঝুপ মেরে একত্র হয়ে বসে আছে এক কোণে, আর তাদের সামনে লগি ঠেলতে ঠেলতে হানজালা তেমনি করে বলে চলেছে রূপজানের কথা। এই সব ধীবরেরা কতজন জলহরিণ হয়েছিল, কতজনই বা সোজাসুজি পৌঁছেছিল মৃগভূমিতে, তার হিসেব তার জানা নেই। তারা এখন সোমের গ্রামে বাস করে। তারা যখন এক এক করে আসে, আমি জিগাসা করেছি, সেই পথ—প্রদর্শক হরিণের কথা। কিন্তু না, তারা কেউই তাকে দেখেনি। তাদের কেউ পথ দেখিয়ে দেয়নি। একদল কুষ্ঠরোগী তাদের আমাদের কথা বলেছে। আর বলেছে এক মাঝি। তার নাম হানজালা মোল্লা!
সোমের গ্রামের পরিধি এইভাবে বেড়ে চলেছে। নক্ষত্রজাতের কিছু মেয়ে—যারা নিজেদের সমাজচ্যুত হয়ে পাহাড়ের এপারে চলে এসেছে, তাদেরকে তারা বিবাহ করেছে। কয়েকজন করেছে আদিবাসী মেয়ে। আছে পাহাড়ী মেয়ের দল। আর যারা করেনি, তারা করবে না বলেই করেনি। কেবল এক সুস্থ ও গৃহস্থ পরিবেশে তারা থাকতে চেয়েছে। যাদের কাজ বেতের চুপড়ি বোনা আর খাপলা জালে মাছ ধরা, বাচ্চাদের গল্প বলা, চায়ের দোকান দেওয়া ও নানা রূপকথার কাহিনি তুলে আনা মাটি থেকে। ওরা প্রথম প্রথম সোমকে মাছ এনে দিত। পরে ওদের থেকে একটা খাপলা জাল বুনে সে নিজেই মাছে ধরার কাজটা শুরু করে।
সে সেদিনও মাছ ধরতে গেছে। লাগাতার চেষ্টাতেও যখন কোন মাছকে জালবন্দি করতে পারেনি। শেষবার ‘জয় বুদ্ধ’ বলে জাল ফেলে টেনে দেখে তিনটি ঝকঝকে পুঁটি মাছ। তার বর্ণ সোনালি। যেন সে স্বর্ণ দিয়ে গঠিত। কিন্তু তাদের মুখে বড্ড দুর্গন্ধ! তখন নদীতে ভীষণ কলরোল। একটা নৌকা যাচ্ছে। তাতে কুষ্ঠ রোগীর দল। তারা সোমকে দেখে ঢেউ এর ফাঁকে তাদের গতিশীল নৌকা থামিয়ে পারের কাছে এসে বলল, “তুমি এখানে কি করছ? এখন বসে থাকার সময় নয়, চলো আমাদের সঙ্গে। কালপুরুষকে খুন করা হয়েছে!”
সোমের তখন মাছের দিকে খেয়াল। সে বলে, “পুঁটিমাছ নেবে? এই দেখ আমার পায়ের কাছে পড়ে কেমন ছটছট করছে। ওদের দোষ একটাই; মুখে বড্ড বাজে গন্ধ।”
ওরা বলল, “মাছ না হয় তুমি দিলে, কিন্তু আমরা নেব কীভাবে? আমাদের আঙ্গুলগুলো দেখেছ? নেই। কবেই যে তা ক্ষয়ে গেছে আমরাই জানি না। বন্ধু কালপুরুষ আমাদের চিকিৎসা করত। তাতে আমরা কিছুটা ভালো হচ্ছিলাম। কালপুরুষ তখন বলল, ‘ক্ষমতা এবার দখল করত হবে। সকলে খেতে পাবে, কোন বৈষম্য থাকবে না—অসহিষ্ণুতা থাকবে না; এই ফ্যাসিবাদী সরকারকে আমরা উৎখাত করবই!’
“কিন্তু আমাদের দেশে কোন বিল্পব সম্ভব নয়।”
“কেন? নকশালরা কী বিপ্লবী নন? আমরা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। এই যে বুকের কাছে লগি আঁকড়ে আমরা নদী বাই, সেই শিখিয়েছে। সে বলেছে, ‘নিজেদের কখনও একা ভাববে না, বঞ্চিত রাখবে না। আর পাঁচটা মানুষের মত সকলের উপরই তোমাদের অধিকার। নিজের শাসক নিজেই হবে।’
“তাহলে তাকে খুন করা হল কখন?”
তারা উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকল, “প্রেসিডেন্টের গুপ্ত বাহিনী তাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছে। অথচ সে কিন্তু কারও উপর অত্যাচার চালায়নি। যা করেছে তা শান্তিপূর্ণ ভাবে। তাকে বাড়তে দিলে শাসকের বাড়া ভাতে ছাই পড়ত। তুমি একটি গ্রাম গঠন করেছ, যাযাবর এক গোষ্ঠীকে চাষাবাদ শিখিয়েছ, তাদের সংসার করে দিয়েছ নিষাদ শ্রেণির কন্যাদের সঙ্গে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার জগদ্দল পাথরটাকে এইভাবে তুমি নড়িয়ে দিয়েছ। তুমি আসার পর এই এলাকার চিত্রই পালটে গেছে। তাই প্রেসিডেন্ট তোমাকে ভয় পায়—আমরা জানতে পেরেছি। তুমি চলে এসো আমাদের সাথে। কত কল্প জন্ম, কত নতুন পৃথিবী দেখবে আমাদের নৌকায়। সেখানের সমাজ ব্যবস্থা পাল্টাতে হবে। যেমন আমরা যাচ্ছি বন্ধু আর্নেস্তার দেহ উদ্ধার করতে। তাকে গোপনে খুন করে নদীর কোন চরে যে পুঁতেছে তা কেউ জানে না। সঙ্গে নুন ঢেলে দিয়েছে। তুমি চল। তারপর একসঙ্গে একটা প্রতিবাদ করা যাবে।”
নিরুত্তাপ গলায় সোম বলে, “আমি যেতে পারব না। সে তো আর আমার জন্য বিপ্লব করেনি, তোমাদের জন্য করেছে। তোমরাই যাও না।”
“এখানে এসে তুমি কোন ঝামেলায় পড়নি? লোক এসে চমকায়নি তোমায়?”
“কেন?”
“তুমি যে বহিরাগত।”
“এটাই আমার দেশ। একজন স্বাধীন দেশবাসী হিসেবে আমি দেশের যে কোন প্রান্তে যেতে পারি। এখানে বহিরাগত ব্যাপারটা আসছে কেন?”
“সেটা ওরা বোঝে না। তুমি চুপচাপ আছ, তাই কিছু বলছে না। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকালে তুমি বহিরাগত হিসেবে গোপনে খুন হয়ে যেত পার কালপুরুষের মত, মনে রেখ।”
“তুমি কেবল নিজের স্বার্থের কথাই বলে যাচ্ছ! তুমি না একজন বুদ্ধিজীবী!! চাষিদের জমি আমরা আর দখল হতে দেব না। চাষি বীজ বুনবে, ফসল ফলাবে, সেই ফসল গোলায় তুলবে—এই তো স্বপ্ন তার, এই পারে সে। তার ফসল কেড়ে নেওয়া চলবে না। সে নিজে হাটে বসে বেচবে।”
(ক্রমশ…)
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
দ্বিতীয় পর্ব মইদুল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।রাতে মনে হয়েছিল প্রেসার বেড়েছে। হাইপ্রেসার আছে ওর বাবারও।বাড়ি…..
পরিচ্ছেদ- ১ সুবীরেশ সেন। কবি। সদ্য নর্থবেঙ্গল এসেছে।এখানেই শহীদুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। শহীদুল বিএ…..
পর্ব – চার ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে মাটির উপর খড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। খড়ের উপর মোস্তাগের…..