শূন্য থেকে শূন্যে (৬)

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
শূন্য থেকে শূন্যে (৬)

তৃতীয় পর্ব (আগের সংখ্যার পর)

ছয়

পুরো সুস্থ হতে একসপ্তাহ লেগে গেল সোমের। তারা খচ্চর পালনকারী রাখালদের বিশ্রাম স্থলেই থেকে গেছিল। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে তাদের যাত্রা শুরু হল। এইভাবে তারা এক গ্রামে উপস্থিত হল। প্রায় পঞ্চাশটি ঘর ঘন সন্নিবেশিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই গ্রামের নাম মালতীপুর। এক অতি বৃদ্ধ গ্রামের বাইরে রোদ পোয়াচ্ছিলেন। বললেন, “তোমরা আসছ কোথা থেকে, যাবেই বা কোথা?”

চোমং বললেন, “যাব সেই টিলার মাথায়—সেখানে এক সাধুজী থাকেন, তাঁর কাছে। আপনার কাছে জানতে চাইছি এর সোজা পথ কোনটা?”

তিনি বললেন, “তাঁর কাছে কেন? কী দরকার?”

“বেনেপুতুলের খোঁজে। আপনি কি জানেন তারা কোন ভাঙ্গা মন্দিরে থাকে?”

“না। তা আমি জানি না। তবে দেবতারা জানতে পারেন। তাঁরা বাদুড় হয়ে উড়ে বেড়ান। ওখানে গেলে অবশ্য তোমাদের সাথে দেবতাদের সাক্ষাৎ হবে। একটা কথা আগে ভাগে বলে দিই, তিন দেবতা কিন্তু সুবিধের নন। যা তাঁদের আয়ত্বের বাইরে, তাই নিয়েই বেশি বড়াই করেন। আমার এখানেও দিন কয়েক আতিথেয়তা নিয়ে গেছেন। সেই সময় এখানের এক নারীকে তাঁরা গর্ভবতী করে দিয়ে যান। কেবল দেবতাদের সন্তান বলে আমাদের আদিবাসী সমাজ মেনে নিয়েছে তাদের। নইলে আমরা সেই জাতকদের টিলা থেকে ছুঁড়ে হত্যা করতাম।”

“কেন?”

“ঐ দেবতারা নিচু স্তরের। তবুও তাঁদের ক্ষমতা কমতি ছিল না। মাছি হয়ে অন্য এক নারী দেবতার গয়নাও চুরি করেছিলেন। আবার কখনও অন্য দেবতার নামে মিথ্যা মামলা করেছেন। মোট কথা, অন্যদের তাঁরা নানাভাবে ব্যতিব্যস্ত ও বিরক্ত করতেন। একবার ইন্দ্রের ভোজসভায় গিয়ে অন্য দেবতাদের চরম অপমান করতে শুরু করলেন। দেবতাদের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি, ইন্দ্রের নারী লোলুপতা ইত্যাদি নানা কথা বলতে শুরু করেন রসিয়ে রসিয়ে। দেবতারা ক্ষেপে গিয়ে তাঁদের তাড়া করেন। তিনজনে তখন প্রাণভয়ে ছুটতে শুরু করেন। শেষে এক জলপ্রপাতের কাছে এসে দেবতারা দেখলেন, তাঁদের আর পালাবার পথ নেই। তখন মাছ হয়ে তাঁরা সেই ঝরণার জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অন্য দেবতারাও ছাড়বার পাত্র নন। তাঁরা একটা বৃহৎ জাল এনে সেই তিন মাছকে জালে বন্দি করে ফেললেন ও শূন্য থেকে ছুঁড়ে দিলেন পৃথিবীতে। সেই তিনজন তখন পুঁটিমাছ হয়ে আছড়ে পড়লেন আকাশ নদীর জলে। সাঁতরে তাঁরা এক নির্জন পারে ওঠেন। সেখান থেকে তাঁরা পদব্রজে যেতে থাকেন। পথে এক মন্দির পরে। সেই মন্দিরের পুরোহিত পুজোর নিমিত্তে নদীতে স্নানে গেলে তাঁর কিশোরী কন্যাকে এঁরা ধর্ষণ করেন—এই এঁদের ইতিহাস! এঁদের বিশ্বাস করতে হলে খুব সাধধানে করতে হবে।”

বৃদ্ধের অনুরোধে তারা কয়দিন এখানেই রাত্রি যাপন করবে। সেই অবসরে একটু ঘুরে বেড়িয়ে দেখা যাবে গোটা এলাকাটা। তাছাড়া টানা ক’ দিনের পরিশ্রমে তারা দু’ জনেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। সকালেই বৃদ্ধের বাড়ি থেকে এক মগ লাল চা এসেছিল। তারা তৃপ্তি করে খেল। উপভোগ্য হয়ে উঠল সকালটা। কিন্তু সেটা যে এতটা পেট ভারি করতে পারে, তা বোঝেনি সোম। পনের মিনিট হাঁটার পর বাঁদিকে বাঁক নিল তারা।

এখানেই এমন এক দম্পত্তিকে তারা আবিস্কার করল। তারা আগে চাষ করত। কমরেড কালপুরুষকে পলায়নে সাহায্য করায় শাসকের রোষে পড়ে। ভয়ে প্রাণ হাতে করে পালাতে পালাতে ওদের আশ্রয় হয় এক নৌকায়। নদীর পারে রাখা এক পরিত্যক্ত নৌকায় তাদের সংসার গড়ে ওঠে। এই নিয়ে যখন দৈনিক কাগজে লেখালিখি হয়, মোমবাতি মিছিল হয়, তাদের আবার গ্রামে ফেরার সুযোগ করে দেয় শাসকের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকেরা। কিন্তু দিন কুড়ি পর আবার আক্রমণ। ফলে তারা আর কাছাকাছি কোথাও থাকতে পারেনি। এরা এখান এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যেতে চায়।

পথ চলতে চলতে সবাইকে সোম জিগাসা করেছে কুষ্ঠরোগীদের কথা। ফলে কুষ্ঠ নামক এক অদেখা-অজানা রোগীদের চিকিৎসক বানিয়ে দিল তারা। তাদের দুজনের নামে এলাকায় রটে গেল তারা নাকি কুষ্ঠরোগের দুই ডাক্তার। তিন হাজারের উপর মানুষের চিকিৎসা করেছে! সেই কুষ্ঠরোগীর দল এখানে এসে নাকি ঈস্টার নামক এক দ্বীপের চমৎকার গল্প করে গেছে। যে দ্বীপে তারা কালপুরুষের সঙ্গে বাস করত। তারা বলেছে, ‘সেখানের নারীরা সব পরির মত, আর পুরুষের একমাত্র কাজ মেয়েদের সুখী রাখা আর কিছু নয়। খাও দাও আর ঘুমাও। সুতরাং যদি কখনও নৌকা বেয়ে এই রোগ আসে, তাহলেও তাদের কোন ভয় নেই। আমরা আছি।’

শ্রমিক দম্পত্তি বলল, “আর ফিরে কাজ নাই। এখানেই থেকে যান রাতটা।”

তারাও ভেবে দেখল, সেটাই ঠিক হবে। রাত্রে তাদের সঙ্গে বসে লম্ফের আলোয় রুটি-তরকারি ভোজনপর্ব চলল। এখানে ওরা মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বাইরে ঠান্ডা। ভেতরে একটা আলগা উত্তাপ। পাতার ঘরের অন্যতর জীবন। সাদামাটা পরিস্কার কথায় সে বলে চলেছিল তার কাহিনি। সন্তানকে পড়শী হোমে রেখে আসার কাহিনি। সোম বলল, “তখন কি তোমার কোন কাজ ছিল না?”

সে বললে,  “আমার মায়ের নাম ধবলী পোড়েল। পুলিশের গুলিতে আমার মা শহীদ হন। সেই থেকে আমাদের আন্দোলন চলছে। আসলে সেদিন আমাদের কোন বিক্ষোভ কর্মসূচী ছিল না। চাষের জমি দেব না, এই ছিল পন। কেবলমাত্র মেয়েদের মিছিল ছিল, আর তাই আমরা পুরুষেরা ঘরের ভেতরেই ছিলাম, মিছিলে যোগ দিইনি।  সেদিন কেবল আমাদের গ্রামের মেয়েরাই নয়, আশপাশের সকলের গ্রামেরই মেয়েরা ছিল। সংখ্যায় প্রচুর। যাদের নামে ওয়ারেন্ট ছিল তারা এদিক ওদিক সরে ছিল। আমার দাদার নামেও ওয়ারেন্ট ছিল।

“তখন আমাদের গ্রামে দু’বেলা পুলিশের জিপ আসত। একজন পুলিশকে একা পেয়ে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে মেরে নদীর জলে তার লাশ ভাসিয়ে দেয়। সেই নিয়ে পুলিশেরা ক্ষেপে ছিল। মাহামুদিপুর ব্রিজ টপকে পুলিশ এসেছিল সেদিন। একথাটা এইজন্যে বললাম যে, পুলিশের আসার রাস্তা ওটা নয়। তাই গ্রামের ভলেন্টিয়াররা এটা বললে যে, এদিক দিয়ে যখন পুলিশের গাড়ি আসছে, নিশ্চয় কাউকে না তুলতে নিয়ে যাবে। তখন ঠিক হল, বড়ো মিছিল করা হবে। সব মেয়েদের ওদিকেই ডাকা হল। মেয়েদের টানে আরও মেয়েরা এসে গেল। আমার মা-ও গেছিল ওখানে। গাড়ি থেকে সরাসরি গুলি চলে। গুলির আওয়াজ পাবার পরও কোথায় গুলি চলেছে তা বুঝতে পারিনি। অনেকে ভেবেছে পুলিশের গাড়ির টায়ার রোদে পড়ে থেকে থেকে ফেটে যাচ্ছে। তখন গ্রামের লোক খবর দিল যে, গুলি চলেছে। পরে খবর পেলাম, আমার মা গুলি খেয়ে ধান খেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আমি দৌড়ে যাই। গিয়ে দেখি সত্যি মা পড়ে আছে। মৃত। বাবাকে খুঁজছি তখন। একজন বলল, সে আমার বাবাকে পালাতে দেখেছে। এখানে আসার পর একদিন সাক্ষাৎ হল আর্নেস্তার সঙ্গে। সে বলেছিল, ‘বন্ধু, প্রেসিডেন্টের এই অত্যাচারের পালা শেষ হবে একদিন। সাধারণ মানুষ ক্ষমতা পাবে।”

“এই উপ-নির্বাচনে কি হবে?”

রাত বাড়লে দূরে কুকুরের ডাক ভেসে আসে। অপরিচিত কোন ছায়া পথ সে সচকিত রেখেছে তা কে জানে! আমরা কম্বলে নিজেদের ঢেকে ফেলি। তারা বলে, “কি আবার হবে। চারিদিকে যা দেখছেন তাই হবে।”

“আকাশ বাতাস তো ছেয়ে গেছে প্রেসিডেন্টের বড় বড় কাট আউট আর পোস্টার, ব্যানারে।”

“ওটাই তো এখানের ভোট। ওই ভোটার—প্রেসিডেন্ট! আহা!!”

“এতদিন আছ তোমরা, এখানে কোন বেনেপুতুল দেখেছ?”

রবিন বলে, “না। তবে শুনেছি তারা নাকি নীল চোখের অতীব সুন্দরী উদ্বাস্তু সম্প্রদায়ের মেয়ে।”

সীমা বলে, “আমি বেশ ক’দিন ওদের উড়তে দেখিছি অনেক উঁচু দিয়ে।”

“না, তারা নয়। ওরা উড়তে পারে না। এই জনপদে ওড়ে একমাত্র পক্ষী জাতের মানুষেরা।”

“তোমরাও তাদের খোঁজে এসেছ?”

“হ্যাঁ। কিন্তু তারা আগের জায়গায় আর নেই। জানি না তারা কোথায় গেছে!”

“বেনেপুতুলেরা পুরুষের ছদ্মবেশে থাকে, আমি জানি। অনেকে তাদের চলমান দেবতা ভেবে পুজো দেয়।”

 সাত

ভোরে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা পথে। পথের খানিক দূর গিয়ে দেখে রাস্তা যেখানে ডানদিকে ঘুরেছে সেখানে এক বৌদ্ধ স্তূপ। তবে কি তারা এসে গেল সে বৌদ্ধ ঢিপির কাছে? ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। বাইরে থেকে দেখা যেত একটা মন্দিরের চূড়া। সে সব এখানে নেই।

বড় একটা অশত্থ গাছ। তার পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। কিছুটা উঠেই সামনে দৃষ্টি দিই। এক বৌদ্ধ গুম্ফা। সামনের সমতলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নির্বাক আলখেত। গ্রামের সব বাড়ি জন-মানবহীন। শুধু তাদের সেই পতাকাগুলি নড়ছে। তা হয়ে উঠেছে নিশান। গ্রামের উঠোনের মাঝে এক নলকূপ। হাতল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বেরিয়ে এল ঠান্ডা জল! খেয়ে শরীর তাজা লাগল। সোম বলল, “ঘরগুলোতে কেউ বাস করে না বলে মনে হচ্ছে। একটা পছন্দ করে বাস করলেই তো হয়।”

সে বলে, “না। তা সম্ভব নয়।  কারণ এখানে কিছু মানুষ বাস করে। ওদের বাড়ি আসলে ধূলাটপুর। ওরা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে, ভিটেমাটি ছেড়ে আজ বিবাগী। এক গোষ্ঠী অন্যায় ভাবে ওদের সবকিছু পুড়িয়ে দেয়! যাদের সব পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেওয়া হয়েছে—যাদের মনে-শরীরে সর্বক্ষণ জ্বলজ্বল করে হিংসার ক্ষত, তারা যদি এখনো এখানে সেখানে আবাদ গড়ে তোলে, কষ্ট করে বেঁচে থাকে, নিজেরাই তারা নিজেদের শাসক হয়, তার আত্মা ছাড়া আর কি! ওদের পুর্নবাসন—জানি না কিভাবে সম্ভব!”

সোম কেবল বলল, “অসহিষ্ণুতা!”

“চলো, এখন আমরা ঐ ভাঙ্গা স্তূপের মাথায় চড়ব। সাধুজী ওখানেই থাকেন। আমি একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সময় তিনি এক বিশেষ কাজে বেরিয়েছিলেন। কবে ফিরবেন, কিছুই বলে যান নি, সঙ্গে কাউকে নেননিও। কেউ কিছু প্রশ্নও করেনি তাঁকে এ ব্যাপারে। সেখানে দু’দিন অবস্থান করে আমি ফিরে আসি। তারপর আর যাওয়া হয়নি। এখন তুমি আছ বলে এলাম। সাধুজীর কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। যদি দেখা হয়, তবে নিশ্চয় তার উত্তর পাওয়া যাবে।”

পথের এক অংশে এসে তারা দাঁড়ায় দম নেবার জন্য। এখানে অনেক গাছ আছে। শীতলতা কম। স্তূপটা পথের নিচ থেকে দেখে মনে হয় কাছে। মাত্র কয়েকটি পা হাঁটলেই সেখানে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু তারা যত এগোয়, মনে হয় তা সরে সরে যায়। যেন মনে হয় বর্তমান নামক এই সময়কে পাক দিতে দিতে তারা ফিরে যাচ্ছে অতীতের পথে। সেখানে এখনও হিউ এন সাং হেঁটে যান।

এইভাবে তারা ক্রমে স্তূপের মাথায় পৌঁছল। এখানে নিচ অদৃশ্য। জায়গাটা চাতাল মত। চারিদিকে গাছপালা। কেবল নদির কিছুটা গমনপথ চোখে পড়ে। এক সাধু মহারাজের সঙ্গে আলাপ হল। তারা তাঁকে প্রণাম করল। ভিক্ষু তাঁর সামনে রেখে দিল লাল মদের একটি বোতল। সাধু মহারাজ সেটা সাগ্রহে নিলেন। বোতলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। বললেন, “এ জিনিস তো এদিকের নয়! এমন দুর্লভ সামগ্রী কোথায় পেলেন?”

“এক অভিযাত্রী দিয়ে গেছেন বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে।”

“বসুন ওই আসনে। বলুন আপনারা কারা? কেন এসেছেন এখানে?”

“আমরা এসেছি বেনেপুতুলের খোঁজে। শুনেছি কোন এক গোপন গুহায় বাস করে তারা।”

মহারাজ উঠলেন। পায়চারি করতে করতে বললেন, “তাদের খোঁজ করছেন কেন?”

সোম বলল, “তাদের মধ্যে আমার এক পরিচিত নারী আছে।”

তিনি বললেন, “আপনাদের মত আমি একদিন তাদের সন্ধানে গিয়েছিলাম।” সাধুজী পায়চারী থামিয়ে দাঁড়ালেন। উপরের দিকে তাকালেন। সেখানে আর কিছু নেই, কেবল আকাশ। নানা রকমের মেঘ। সাধুজী আবার বসলেন। বোতল খুলে এক ঢোক তরল মুখে ঢাললেন তিনি। ছিপি এঁটে পাশে রেখে বললেন, “বাঃ, দারুণ স্বাদ! এই শীতে এই পাণীয় আমাকে উষ্ণতা দেবে। ঠান্ডার দাপটে আর আমাকে কুঁকড়ে থাকতে হবে না।”

তারপর দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেনেপুতুলের কথা আমি শুনি ধূলোটপুরের মানুষদের কাছে । তাদের মুখেই শুনি কুড়ি জন অতীব সুন্দরী উদ্বাস্তু সম্প্রদায়ের মেয়ে বেনেপুতুল হয়ে এক ভাঙ্গা মন্দিরের গোপন প্রকষ্ঠে বাস করছে। তাদের সৌন্দর্যের কথা প্রকৃতি বাহিত হয়ে আমার কাছে আসে। সেখানে একটি নয়, অনেকটি গুলি প্রকোষ্ঠ আছে। সেখানেই তারা লুকিয়ে বাস করে। প্রথমে একটি লম্বা ও চওড়া সমতল, সেখানে তারা হাতের কাজ শেখে। বাকি প্রকোষ্ঠে তাদের নিবাসস্থল। সবই একই বিহারের ভিতর।

“আমি জানি এই সকল নারীদের সকলেই নানাভাবে সমাজ দ্বারা অত্যাচারিতা। ওপারের একটি হোমে থাকত তারা। এই যে চারিদিকে লতা-গুল্ম-পুষ্প—সবই তাদের হাতে রচিত। চুনা পাথরের মাটি দিয়ে তারা যে সকল ক্ষুদ্র পাখি তৈরী করে, তারা এখন আকাশে ওড়ে, গাছে গাছে ঘর বাঁধে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম এক অন্য উদ্দেশ্যে। তুমি বলছ বটে হে যুবক, তোমার কাঙ্খিত নারী বেনেপুতুল হয়ে এই জন্মে বিহার করছে, তাকে আমি চিনতাম না। চেনার কথাও নয়। কিন্তু ঘটনা হল সেই বিরাটাকৃতি গুহা আমি যখন আবিস্কার করি, তখন সেখানে কোন বেনেপুতুল ছিল না।

“আমি প্রথমে এই আশংকা করেছিলাম যে তারা হয়ত অপহৃত হয়েছে পক্ষী জাতের মানুষের দ্বারা। পক্ষী শ্রেণির মানুষেরা তাদের দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজছে যৌনদাসী বানাবার জন্য। ওরা এক নারীকে দশজনে মিলে ভোগ করে বলে, ওদের হাতে কেউ মেয়ে দেয় না। ওদের দেশ কেবল পুরুষদের দেশ। ওরা শুনেছে উদ্বাস্তুদের অপরূপ রূপ লাবণ্যের কথা। ওদের এই আকাশের মাথায় আমি চক্কর কাটতে দেখেছি। ওরা আমাকে ঘাঁটায়নি। কিন্তু পক্ষীরা মাটিতে নেমে ওদের ধরার ষড় করছে দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারিনি। ওদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর জন্য চলে আসি। কিন্তু কাউকেই দেখতে পাইনি। পরে বুঝলাম ওরা সকলেই নবজন্ম নিয়েছে।

আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল এক মাঝি। তার নাম হানজালা। তার নৌকায় চাপার প্রথম ও প্রধান শর্তই ছিল, তার গল্প শুনতে হবে। সে সারাক্ষণ নৌকা বায়। নাকি নদীই তাকে বায় তা বলা ভারি শক্ত। ও যেমন এই আকাশ নদীকে চেনে, নদীর কাছেও সে অজানা নয়। নদী জলের প্রতিটি ঢেউ, ঘাত-প্রতিঘাত, বাতাসের প্রবাহ ওর জানা। জলপথে যেতে যেতে ও গল্প করছিল। ওর নিজ বিবাহের গল্প-সংসারের গল্প। যদিও ওর এখন কোন সংসার নেই—ওর স্ত্রী-কন্যার সঙ্গেও ওর কোন যোগাযোগ নেই—তবুও সে তাদের জন্য বেদনা বিধুর হয়। মাঝে মাঝে যখন ও মাটিতে ঠাঁই নেয়, চাষ-আবাদ করে, ফসল ফলায়। আবার অনেকে বলে, সে নাকি আফিমের ফল এপার থেকে ওপারে তার নৌকা করে পাচার করে। সে যে কী খায় না খায়—সবই এক রহস্যে ঢাকা। তবে ওর গাঁজা সাজার হাত খুব ভালো। সে ছিলিমে আমিও টান মেরেছি। অতি উত্তম সেই ধোঁয়ার টান, মস্তিকের কোষে কোষে তার রেশ পৌঁছে যায়।”

আবার এক ভাবনার ভেতর তলিয়ে গেল সোম। সে হালকা করে চক্ষু মুদেই দেখল, এক ন্যাগ্রোধ বৃক্ষের নিচে সে যেন ধ্যানস্থ। ধ্যান ক্রমে গভীর হল। পিছনে এক ছায়া নিবিড় অরণ্য। সীন দেশের পরিব্রাজক তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘যখন কালপুরুষের সঙ্গে তোমার দেখা হবে, তাঁকে একমুঠো শূন্যতা দিও। এতেই তিনি মুক্তি পাবেন।’ সোম তখন বলে, ‘এখানে যে এখন ভোট আছে। গ্রামীণ ভোট। তার কী হবে?’ পরিব্রাজক কিছু বললেন না। সোম দেখে বনের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছেন তিনজন দেবতা—তাঁদের ডানা আছে।

সাধুজী পাশে রাখা পাত্র থেকে উঁচু করে জল খেলেন। এক গভীর শ্বাস ফেলে তিনি আবার শুরু করলেন, “সে আরও বলছিল পক্ষীজাতের মানুষের কথা। কিভাবে ওর নৌকার গলুয়ে বসে ভ্রমণ করে, সেই কথাই বলছিল। ক্রমে ও আমাকে পৌঁছে দেয় গুহার সামনে। তখন আমার শখ হল গুহাটা ঘুরে দেখি। এমন বনের ভেতর সেটা, এই পাহাড়ে আমি শত বছর বাস করেও তা জানতে পারলাম না!

“যাই হোক, মাঝি আমাকে পারে নামিয়ে দিল। যখন ভাবছি পাহাড়ের মুখ অবধি পৌঁছব কী করে, তখন দেখি এক খচ্চর আমার দিকে এগিয়ে এল। এতক্ষণ সেটাকে আমি দেখতে পাইনি। এক লহমায় এমনভাবে সেটি আমার সামনে এসে উপস্থিত হল, যেন মাটি ফুঁড়ে এসেছে বলে মনে হল। যাইহোক, আমি সেটার পিঠে উঠে বসলাম। তাকে কিছুই বলতে হল না। সে আমাকে গুহার মুখের দিকে নিয়ে চলল।”

“তারপর!” সোম বলল।

“সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তা যেমন বলার নয়, ভোলারও নয়। সারা গুহার দেওয়াল জুড়ে এক অসাধারণ দৃশ্য। পরপর নানা চিত্র আঁকা। সবই প্রকৃতিক রঙ-এ আঁকা। খড়িমাটির ব্যবহারও দেখলাম। সে সব চিত্রের যে কী শিল্প সুষমা তা বোঝাব কী আর! দেখি হাজার হাজার মৃগ চাঁদ লক্ষ করে লাফ দিচ্ছে। যেন চাঁদকে তারা ধরতে চায়। আবার কোন চিত্রে বুদ্ধ নবজন্ম নিচ্ছেন। কোথাও তিনি কেবল এক মৃগ। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক বনের ধারে। তিনি ফিরে আসছেন কৃষকের বেশে। কোন চিত্রে তাঁর পরিনির্বাণের চিত্র আঁকা। সেই পরিনির্বানের আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে তিনজন দেবতা!”

সোম বলল, সেই চিত্রের ভেতর কোন খচ্চর ছিল?”

“খচ্চর? হতে পারে। আবার নাও পারে। অজস্র হরিণ চিত্রের ভেতর খচ্চর মিশে থাকতেই পারে।”

এই বলে তিনি একটু থামলেন। একটানা কথাগুলো বলে তাঁর দমে ঘাটতি দেখা দিচ্ছিল। তখন কেউ কোন কথা বলছিল না। সোম কান পেতে নদীর স্রোতের শব্দ শোনার চেষ্টা করছিল।

সাধুজী বলতে থাকলেন, “সেই দেবতারাই এখন এখানে বাস করেন। আসলে ওঁরা উড়ছিলেন এইজন্য যে বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তাঁদের জন্য অনন্ত আকাশ ফিরে এল—এই ভেবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি এঁদের জীবনে। সেক্ষেত্রে তাঁরা আবার দানা ফিরে পাবেন ও আকাশের পুরোটা জুড়ে উড়তে পারবেন। কিন্তু বুদ্ধের আমলে সেই যে তাঁদের ডানা খসে গেছিল, তা আর পূরণ হল না। ফলে তাঁরা খুব বেশিদূর অবধি উড়তে পারেন না। একটু উড়ে মাটিতে নেমে আসেন। তারপর লাফাতে লাফাতে যান। এঁরা আজও ব্রাত্য। বুদ্দের পরিনির্বাণের পর অনেকেই আবার মনুষ্য সমাজে স্বমহিমায় ফিরে আসেন, কিন্তু এরা কোন এক অঞ্জাত কারণে আর  নিজেদের প্রাচীন গৌরব ফিরে পাননি। অনেকে মতে এর জন্য তাঁদের নারী লোলুপতা। কিন্তু হলে কি হবে, এদের যৌনক্ষুধা আগে যেমন ছিল, কমেনি একটুও। এঁরা আবার প্রতিষ্ঠা পেতে উদগ্রীব, কিন্তু নিজেদের স্বভাব পালটাননি। বুদ্ধের আগমণের আগেও এঁরা ছিলেন, এখনও আছেন। তবে মজার কথা কি বলুন তো? বুদ্ধের পরিনির্বাণ আছে, এঁদের নেই!”

আট

তিনি অনেকক্ষণ নীরব থাকলেন। চক্ষু মুদে বার বার ঘাড় নাড়লেন। আলো মরে আসছিল। হালকা শীত ক্রমে বাড়ছিল। নিচের গাছপালা শান্ত হয়ে আসছিল। এবার তাদের ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আমরা সকলে নীরব হয়ে রইলাম। আকাশে নানা রং-এর তারা ফুটে উঠছিল। তিনি শেষে বললেন, “সে নারী আপনার কে হয়?”

“তার নাম রূপাঞ্জনা।”

“ঠিক বুঝলাম না।”

“ও একটা গ্রাম সৃষ্টি করেছিল। ও যেটা করতে চেয়েছিল তা ষোড়শজনপদ-এর মধ্যে বিপুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন হয়েছে তোমার বানানো জনপদ। তাছাড় গ্রাম বসানো ও বুদ্ধের জয়গান ও জন্মের কথা বলাতে প্রেসিডেন্ট মনে করেছেন নতুন কোন বিরোধী নেতার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে প্রকাশ্যে না এনে এইভাবে প্রচার করছি। এই গ্রামীণ নির্বাচনের এলাকায় তুমিও একজন বহিরাগত। এই নির্বাচন উপ নির্বাচনের থেকেও মারাত্মক। অনেকেই ভোটে দাঁড়াতে চেয়ে পারে না। সেহেতু তোমার প্রতিও ওদের চোখ আছে।”

“কিরকম?”

“তুমি যে কুষ্ঠরোগিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চল, সেটা ওরা জানে। কুষ্ঠরোগিরাই হল বিপ্লবের বীজ। তুমি নাকি তাতে হাওয়া দিচ্ছ। ওরা কালপুরুষ রূপে তোমাকেই দেখে। ওদের যে বর্তমান নেত্রী সে একদা তোমার সনেই বাস করত।”

“কিন্তু ওরা তো বৈঠাই ঠিকমত ধরতে পারে না, অস্ত্র কি ধরবে?”

“ওরা গান গায়, কবিতা লেখে, ছবি আঁকে। শাসক এইসবকে ভয় পায়।”

কিছু না বলে সোম হাসল।

“ওই বট গাছ দেখতে পাচ্ছ? ছাদের পিছনে মাথা ঝাঁকিয়ে এই অন্ধকারের আলোকে কেমন দাঁড়িয়ে আছে? যাও সোম, ছাদের উপর ওর অনেক ফল পড়ে আছে। একটি সংগ্রহ করে নিয়ে এস।”

সোম দ্রুত পদে উঠে গেল। ফিরে এল পরক্ষণেই। বলল, “এনেছি, সাধুজী।”

“এনেছ? এবার ভাঙ।”

“ভেঙেছি, সাধুজী।”

“কি দেখছ, বল।”

“কতগুলি বীজ।”

একটি বীজ ভাঙ।”

“ভেঙেছি।”

“এবার কি দেখছ?”

“অতি ক্ষুদ্র কণা।”

“এবার এদের একটা নাম দাও।”

“বুদ্ধকণা।”

“বাঃ, অপূর্ব! জেনে রেখ, এই হল শূন্যতা। আর এত সহজে তুমি যখন শূন্যতাকে চিহ্নিত করলে, তুমি সাধন মার্গের খুব কাছাকাছি এসে গেছ, জেনে রেখ। আর মাত্র একটি কল্প, তারপরই তোমাকে থিতু হতে হবে, এইভাবে ঘুরে বেড়ালে আর চলবে না। থিতু হওয়াই তোমার কাছে মধ্যমপথ। তুমি এক নৌকা পাবে, সেই  নৌকা টেনে নেবে তোমায়, তোমায় উঠে পড়তে হবে সেই নৌকায়, তোমাকে বয়ে যেতে হবে। তুমি সেখানেই থামবে দেখবে ডানাওয়ালা দেবতারা বসে আছেন এক ন্যগ্রোধ বৃক্ষের ডালে। বসে বসে পা দোলাচ্ছেন আর নির্দেশ করছেন, সেখানে নৌকা ভিড়াতে। দেবতারা তোমাকে আশির্বাদ করবেন এই বলে যে, ‘আমাদের যেমন সংকল্প পূর্ণ হয়েছে, তোমারও হোক।’ সেই আশির্বাদ মাথায় নিয়ে তুমি নদীতে নেমে অবগাহন করবে। তখন দেখবে ঈশ্বররেণু আর বুদ্ধকণাদের সংঘর্ষ। তখন জানবে ক্ষমতার বোধীবৃক্ষ নিকটেই।”

“কিন্তু এখানে রূপাঞ্জনা কোথায়?”

“আসবে। এখন জেনে নাও, ধ্যান কী? কীভাবে করবে? তবে জেনে রেখ, অভ্যাস করতে করতেই ধ্যান জমে ওঠে। ধ্যান করতে হলে মানসিক প্রস্তুতি দরকার। তাই এত আগে তোমাকে জানিয়ে দেওয়া হল। আমরা যেটাকে ধ্যান বলি, সেটি হল ধারণা। ধারণা যখন স্থির হয় তাকে বলে ধ্যান। কত গভীরভাবে ধ্যান হয়েছে সেটাই বড় কথা। একটা ধারণা মনের মধ্যে আসছে, আবার চলে যাচ্ছে, আবার একটি আসছে—এমন হয়। বিরামহীন ও অতি দ্রুত গতিতে মনের মধ্যে এটি চলে। আসল কারণ হল অতি দ্রুত গতিতে মনের কাজ ও বৃত্তিগুলির অতি দ্রুত ভাবে উত্থান।

“এজন্য মনকে বশ করতে হবে। চঞ্চলতাই মনের ধর্ম। চেষ্টা করে মনকে বোঝাতে হবে। ধ্যান কি সহজে হয়? ধ্যান শেষ করে উঠে একদিন দেখবে এক গ্রাম্য নারী তোমার জন্য অন্ন নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে এই জন্যে যে, তা তোমাকে দান করবেন নিজের পুণ্যের জন্য। তুমি সে খাদ্য কয়েকটি ভাগে ভাগ করে গ্রহণ করবে। পরিশেষে, সেই পাত্রটি নদীজলে নিক্ষেপ করে এই বলবে যে, ‘আমার যদি মনস্কামনা পূর্ণ হয় তবে পাত্রটি স্রোতের বিপরীতে ধাবিত হবে।’

“সেই কার্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হলে তুমি সেখানেই বসবাস করতে আরম্ভ করবে। বহুজনের হিতায় ও সুখের জন্য, দেব ও মনুষ্যের হিতের জন্য তুমি একজন জনপ্রতিনিধি হবে। তুমি তখন সমাজের জন্য কাজ করে যাবে। এইভাবে ক্রমে হয়ে উঠবে একক। এটা মনে রেখ, যাঁরা বিশেষ শ্রেণির, তাঁরা নিজ বা ক্ষণস্থায়ী সুখের প্রতি উদাসীন। যাঁরা চান জন্ম মৃত্যুর অতীত স্তরে যে পরম সুখ ক্ষরিত হচ্ছে, যা একবার গলাধঃকরণ করতে পারলে আর কোনরকম স্খলন হবে না—সেই সুখ, যেখানে জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, ব্যাধি নেই, জরা নেই—সেই সুখের নাম ক্ষমতা—তা যে অর্জন করে, সে এক চরম এক শাসক—সেই হল তার নির্বাণ। এই যে প্রেসিডেন্ট এবারের ভোটে সেভাবে কোন দলকেই মনোনয়ন জমা করতে দেয়নি। সে কয়জন নির্দল দিয়ে পেরেছে, তারা প্রায় সকলেই শুনেছি প্রেসিডেন্টের লোক।”

“এখানে আমার কী করার আছে?”

“করার আছে অনেক কিছুই। এখানে তোমার সহায় এক যোজনগন্ধা নারী। তার সাহচর্যে ও উপযুক্ত পরামর্শে তুমি হয়ে উঠবে জনগণের দুঃখ মুক্তির প্রতিভূ, হয়ে উঠবে মহা ক্ষমতাধর শাসক—যেখানে বিরোধীর অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ সামান্য বিরোধী থাকলেই গণতন্ত্রের জন্ম দেবে। কারণ একনায়ক কোনরকম বিরোধীতা সহ্য করে না। আর বিরোধীশূন্য থাকার এই যে নিরন্তর ক্ষমতা ভোগ—এর নাম নির্বাণ!”

“সেই নারী কি রূপাঞ্জনা?”

“না। সে এক অন্য নারী, এক অপূর্ব নারী। তাঁর নাম—থাক। তুমি তাকে খুঁজে নিও।”

“তবে সেই নারীকে আমি চিনবে কিভাবে, বলে দিন ভগবন!”

সাধুজী উদাস হয়ে বললেন, “কয়েককল্প আগে সেই নারী এক অসামান্য সুন্দরী হিসেবে পরিগণিত ছিল। কিন্তু সে কেন সেই জন্মে নির্বাণ পেল না, কেনই বা এক অন্ত্যজ শ্রেণিতে তার জন্ম হল, সে এক লম্বা কাহিনি।”

“আমি তার কথা শুনতে চাই, সাধুজী।”

সাধুজী বলতে থাকলেন, “কয়েক কল্প আগে সে জন্মেছিল এক ব্যাধ পল্লিতে। তাদের নগরীর কাছে এক বৌদ্ধ শ্রমণ বাস করতে শুরু করে। সে তাঁর দেখাশোনার ভার নিয়েছিল। শ্রমণ সেই নারীর রূপে মুগ্ধ হন ও তাকে বিবাহ করতে চান। ব্যাধ জানতে চান, বিবাহ দিতে তাঁর কোন আপত্তি নেই কিন্তু সংসার চলবে কিসে? পশুর মাংস বিক্রি করতে সেই শ্রমণ রাজি কিনা। শ্রমণ রাজি হয়ে যান। বিবাহ সম্পন্ন হয়। সেই নারী এখন এই এলাকায় বাস করছে।”

এই বলে সাধু মহারাজ নিজেই ধ্যানে বসলেন। কতক্ষণ যে এভাবে কাটল তার কোন সীমা পরিসীমা নেই। এদিকে চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। অন্ধকার আকাশে ক্রমে ক্রমে একটি একটি করে বাকি তারারাও ফুটে উঠছে। হাজারো নক্ষত্র। অনেকটা উপরে আছি ভূমিতল থেকে। তাই নক্ষত্রদের অবয়ব এখানে অনেক স্পষ্ট। সোম দেখতে চেষ্টা করল মৃগশিরা নক্ষত্রকে। সে আকাশের ইতিউতি তাকাতে লাগল। কিন্তু তাকে কোথাও চোখে পড়ল না। ক্রমে নিকষ কালো অন্ধকার এমন করে ঘিরে ধরল যে, পাশের জনকেও দেখা যায় না। কেবল মন্দিরের ভেতর জ্বলা প্রদীপের আলোয় মনে হয়, অন্ধকারের ওপারেও কিছু আছে।

“তুমি আগে সেই তিন দেবতার সঙ্গে দেখা কর। তাঁরা এখানেই বাস করেন।”

“সে না হয় হল, কিন্তু কালপুরুষের ব্যাপারটা বুঝলাম না। তাঁর সঙ্গে কিভাবে দেখা হবে আমার?”

“সেটা কেউ বলতে পারে না। তুমি কখনও ভেবেছিলে, এই ষোড়শজনপদে এসে পড়বে?”

বলে চোমং বললেন, “এক্ষণে বুঝলাম, কেন তোমার সঙ্গে বুদ্ধের হরিণ বাস করে। সে তোমার আগে আগে যায়, পথ দেখায়, আবার ফিরে আসে। তুমি কয়েক কল্প অতীতে বুদ্ধের সাহচর্য লাভ করেছ, তোমাকে প্রণাম। একমাত্র তুমিই পারবে পৃথিবীব্যাপী এই অসহিষ্ণুতাকে দূর করতে। যাও যুবক, এগিয়ে যাও। তোমার বোধি নিকটেই। তবে একটা ব্যাপারে সাবধানে থেক। ধ্যান! সাধু মহারাজ যেভাবে বিস্তৃত করে ধ্যান মাহাত্ম তোমার সামনে ব্যক্ত করলেন, মনে হয়, ধ্যান আমরা যত সহজে করি, সেটা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না। অথবা দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে অল্প ধ্যান করলেই তুমি এক প্রঞ্জাবান শাসক হয়ে উঠবে।”

নয়

তিন দেবতা একসময় আকাশ থেকে নেমে এলেন। গায়ের রঙ দুধের মত ধপধপে সাদা। মুখটা বড়, চ্যাপ্টা। নাক চ্যাপ্টা। চওড়া কপাল। মাথায় খুব অল্প চুল পেতে আঁচড়ানো। পরনে সাদা ধুতি ও সাদা ফতুয়া। তাঁরা এতটাই লাজুক যে আমাদের কাছে আসতেই চাইছিলেন না। সাধুজী ওদেরকে জোর করলেন। পরিচয় বিনিময় হল। তাঁরা বললেন, “কালভৈরব কৃপা করে আমাদের এই মন্দিরে বসবাসের অনুমতি দিয়েছেন। মন্দিরের কড়িকাঠে আমরা বাদুড় হয়ে বাস করি। বৈদিক যুগে আমাদের খুব চল ছিল। লোকে মান্য করত। মন্দির গড়ে দিত। সে সময় আমাদের অবস্থাও ভাল ছিল। কিন্তু  বুদ্ধ আর্বিভূত হবার পর থেকেই আমাদের এই প্রান্তিক অবস্থা। বুদ্ধের নির্বাণের পর অনেক দেবতা  তাঁদের পুরানো স্থান ফিরে পেলেও আমরা সেই ব্রাত্যই থেকে গেলাম। তাই মূল দেবলোক থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করি। আকাশপথে উড্ডীণ অবস্থান অন্য দেবতাদের সঙ্গে সাক্ষাত হলেও তাঁরা এমনি করে মুখ ঘুরিয়ে নেন যে, যেন আমরা কোনদিনও তাঁদের সমাজভুক্ত ছিলাম না!

“এখন ওড়ার ছলে আমরা এক এক গ্রামে যাই, নিজেদের পরিচয় দিই। তাদেরকে আমাদের পূজা শুরুর কথা বলি। তেমনই একটি গ্রামে আমরা গেছিলাম। সেই গ্রামটি বসিয়েছিল এক রূপসী নারী। সেই নারী সে গ্রামে একাই বাস করত। আমরা হিসেব করে দেখি, যদি এই সুন্দরী নারীটিকে হাত করতে পারি, আমাদের পূজা পেতে অসুবিধা হবে না। তার অনুগত পুরুষেরা এই পুজোর প্রসারে ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সেই গ্রামটি ধ্বংস হয়ে যায় যখন রূপাঞ্জনা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ওর ঘরবাড়ি সব গুঁড়িয়ে গিয়ে সেইস্থান আবার জঙ্গলে পূর্ণ হয়ে ওঠে।”

সোম বলে, “তারপর?”

“আমরা রূপাঞ্জনার অনেক খোঁজ করেছি, পাইনি। আমরা তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, দেবী হবার। হলেই বা নিচু স্তরের—দেবী তো? কয়জন মানুষের তা সাধ হয়, সুযোগ হয়? আমরা তাও করে দিতাম, কিন্তু তার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। তার আগেই রূপাঞ্জনা যেন বাতাসে গায়েব হয়ে যায়।”

সাধু মহারাজ যোগ ব্যায়াম করা শুরু করেছেন । তাঁর শ্বাসের উত্থান পতনের শব্দ আসছে। সোম বলল, “রূপাঞ্জনা এখন আছে কোথায়?”

“শুনেছিলাম সে বেনেপুতুল হয়ে বাস করে। পরে তারা নবজন্ম নেয়। আগে আমরা অপ্সরীদের সম্ভোগ করতাম। কিন্তু তাদের চাহিদা প্রচুর। আমাদের পুজোপাঠ বন্ধ হয়ে যেতে তাদের চাহিদা মত উপঢোকন দিতে না পারায় তারা আর আমাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত না। এ সময় রূপাঞ্জনাকে আমরা আবিস্কার করি। সে আমাদের সঙ্গে যৌনজীবন যাপন করে। ওঃ কি তার রূপ, কি কোমল তার স্তন! তেমনি তার হর্ম যোনি, আঃ।”

সাধু মহারাজ ব্যায়াম করতে করতে কখন যে স্থির হয়ে গেছেন তা কেউই খেয়াল করেনি। তারা তাকাতেই তিনি উঠে দ্রুত ঘুরে গিয়ে তিনি চললেন স্তূপের শেষ মাথায়। তিনি পরনের একমাত্র কৌপিনটা খুলে ফেলে দিলেন। দু’হাতে চেপে ধরলেন লিঙ্গ। তাঁর বীর্যপাত হল। আলোকজ্জ্বল সেই বীর্য সোজা গিয়ে পরল খরস্রোতা নদীর জলে। সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রবল বিস্ফোরণ ও বিহার জুড়ে এক প্রবল কম্পন শুরু হল। যদি ভূমিকম্প  হয় তো বাঁচার কোন রাস্তা থাকবে না।

তিন দেবতা ছাদের উপর উপুড় হলেন। তারাও তাদের অনুসরণ করল। তাঁরা ফিসফিস করে বললেন, “সাধু আমাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছেন। তাঁর দেহ তাই উত্তেজিত হয়েছে। দেখলে না সাধুজী বীর্যপাত করলেন। নদীর সঙ্গে তার মিলন হল। এমন মিলনে রূপসী নারীর জন্ম হয়। তার দিকে তুমি হাত বাড়াবে না। কারণ আমরা দেবতা। নারী প্রথম ভোগের অধিকার আমাদের।”

সোম বলল, “আর যদি রূপাঞ্জনার নবজন্ম হয়ে থাকে?”

“তাহলেও তাকে তুমি পাবে না। ভোগে আমাদের প্রথম অধিকার।”

“সে যদি সত্যিই রূপাঞ্জনা হয়, আমি তোমাদের ছাড়ব না, হে দেবতারা।”

“কি করবে? লড়াই?”

“প্রয়োজনে তাই করতে হবে।”

“পারবে?” তাঁরা ব্যাঙ্গের হাসি হাসলেন। “আমরা তোমাকে ভস্ম করে দেব।”

“তোমাদের ক্ষমতা কত, তা বুঝে গেছি, এই নিয়ে তর্ক কোর না।”

চোমং সোমকে চেপে ধরলেন। সোম চুপ করে গেল। অমনি তিন দেবতা নিচে গেলেন। আমরা বসে রইলাম। সাধু মহারাজের দেহ শান্ত হলে বলল সোম “আপনি এখন ঠিক আছেন?”

“হ্যাঁ।”

“আপনার কাছে আমাদের একটা প্রশ্ন আছে।”

তিনি জিঞ্জাসু মুখে তাদের দিকে চাইলেন।

“কিছু মনে করবে না বলছি বলে। আপনি কি বেনেপুতুলের সঙ্গে সম্ভোগ করেছিলেন?”

শুনে তিনি মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, “না। আমার একটা কৌতুহল ছিল। তাদের দেখে আমি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম, স্বীকার করি। তাদের যা রূপ, তা অপ্সরীদেরও নেই। এখন তিন দেবতার কথা শুনে সেই সব আবার মনে পড়ে গেল। আপনারা এখন নিচে যান। আমি এবার নির্বাণ নেব। নির্বাণের এটিই উপযুক্ত সময়।”

“নির্বাণ লাভ করার পর কিছু থাকবে কি?”

“না।”

“এই দুইয়ের মাঝামাঝি কোন অবস্থানে থাকবেন আপনি?”

তিনি নিরুত্তর রইলেন। তারপর বললেন, “তোমার মধ্য চল্লিশ বয়সে সেই হবে তোমার জীবনের শেষ নারী। আর এটাই তোমার নির্বাণ। অপরিমেয় পূর্বেজন্মে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের জন্য তুমি রূপে আসক্ত হয়েছ। রূপে আসক্ত হবার ফলে তুমি বিভিন্ন রজঃতে আকৃষ্ট হয়েছ। এ স্বত্ত্বেও তুমি চক্ষু মুদলে যে হরিণের ছবি দেখ, তা বুদ্ধের। এই প্রসঙ্গে কেউ বলবে, ‘তুমি বুদ্ধের কথা ভাববে’, কেউ বলবে, ‘তুমি দানের কথা ভাববে’, অন্যরা বলবে, ‘তুমি সঙ্ঘের কথা ভাববে’। এই ছয়টি বিধান বোধিচিত্ত জাগ্রত করে। কিন্তু তখনই বোধিচিত্ত জাগ্রত হবে যখন তুমি ‘ক্ষমতাহীন শূন্যতাকে’ উপলব্ধি করবে। এখন প্রশ্ন জাগে এই ‘ক্ষমতাহীন শূন্যতা’ জিনিসটি কি? এটি এক কথায় বলা সম্ভব নয়। তুমি যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবার কাছাকাছি যাবে, তখন তা উপলব্ধি করবে। মনে রেখ, রাজনীতিতে দ্বিতীয় বলে কিছু হয় না। আবার বিরোধী বলেও কিছু নেই। ফ্যাসিবাদ বলে কিছু নেই, সাম্যবাদও হয় না।”

মরিয়া হয়ে সোম প্রশ্ন করল, “তবে ক্ষমতায় কী আছে?”

সাধুজী কোন উত্তর করলেন না। তিনি ধ্যানে বসলেন আবার। ক্রমে তাঁর ভ্রূ-মধ্যস্থ কেশগুচ্ছ থেকে আলোকররশ্মি বিচ্ছুরিত হল। তাতে পূর্বদিকের লোকধাতুগুলি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তাতে দেখা গেল যে, মশাল হাতে ভিক্ষুরা মিছিল করে এগিয়ে আসছে এই বিহারের দিকে। আলোয় আলোয় ভরে গেছে চারিদিক। কিন্তু কারও মুখে কোন কথা নেই।

এই যে সাধুজী আলৌকিক ক্রিয়া করলেন, এই শুভ সূচনার কারণ কী? সাধুজী এসবের কিছুই খেয়াল করছেন না। কারণ তিনি এখনও ধ্যানমগ্ন। চোমং বললেন, “মনে হয় সাধুজী এবার কোন ভবিষ্যদ্বাণী করবেন। কিন্তু সেটা কিরকম?”

“ওই দূরে দেখতে পাচ্ছ বুদ্ধপুত্রদের, যারা শাসকের বিরোধী শিবিরে বাস করে, খিচুড়ি খায়, অনূঢা কন্যারা শাসকের জন্য বাচ্চা বিয়োয়; শতবাড়ি সহ্য করেও অত্যন্ত সহিষ্ণুতার সঙ্গে বুদ্ধমার্গের অনুসন্ধান করছে?”

“পাচ্ছি না, ভগবন! তবে সেই প্রাচীর দেখতে পাচ্ছি। সেখানে কারখানা হবে বলে একদা গরিবদের, কৃষকদের উতখাত করে কৃষিজমি ঘিরে দেওয়া হয়। সেই ইট রঙ্গা প্রাচীর আমি দেখছি, সাধুজী। ”

“ওখানে কালপুরুষও আছে। সে জানে তুমি এসেছ এই জনপদে। তুমিই আগামীতে পৃথিবী শাসন করবে। তখন তোমার নাম হবে কল্পনাতীত বুদ্ধ। তুমি এখনি নদী পেরিয়ে তোমার গৃহে ফিরে যেও না যুবক। এখানে এসেছ, যা গ্রামগুলি ঘোরা তোমার বাকি আছে, সেগুলি দেখে নাও। সময় তোমাকে দিয়ে তার যা করার করে নেবে।”

দশ

তারা  নিচে নেমে দেখে নদীটা বইছে না আর। দেবতারা আঁতিপাতি করে খুঁজে চলেছেন এক সুন্দরী নারীকে। কিন্তু মিলছে না। তাঁরা অবাক হয়ে বললেন,  “এমন হবার তো কথা নয়। সেই কন্যা গেল কই?”

কিন্তু কেন স্থির হয়ে আছে এই নদী? সোম জল ছোঁয় আর অমনি সে ফেটে যায়। জলের উপরিস্তরের পুরু প্রলেপ এক প্রবল শব্দে ফেটে ছিটকে বেরিয়ে আসে এক জলহরিণ। পরে তার পিছনে একটা তারও পিছনে…কয়েক লক্ষ হরিণ! দেবতারা মুখ ব্যাদান করে বললেন, “ছ্যা, শেষে কিনা সাধুজী এতগুলি হরিণজন্ম দিলেন! ভাবা যায় না। মুনি ঋষিদের তপস্যার বল এখন কত কমে গেছে! তাঁরা আর সুন্দরীর জন্ম দিতে পারছেন না।”

এই বলে অতি দুঃখে তারা হেঃ হেঃ করে মদ্যপান করতে লাগলেন। অবাক চোমং বললেন, “এই বোতল তোমরা পেলে কোথায়?”

“আমাদের যে নজরানা দিতে হয়, কারণ আমরা দেবতা, সেটা আর কেউ মনে রাখে না। তাই সাধুকে আপনারা মদ দিলেন, আমরা বাদ থেকে গেলাম। কিন্তু তাই বলে তো আর মদ্যপান থেকে বিরত হতে পারি না, বিশেষত যখন তা অতি উপাদেয়। তাই সাধুজী যখন বীর্যপাত করতে গেলেন—আমরা না বলে তাঁর থেকে চেয়ে নিলাম—এই আর কি!”

এই বলে দেবতারা খিখি করে হাসতে লাগলেন। বললেন, “পাণীয় অতি উত্তম! ধন্যবাদ। আপনাদের আছে কি আরও নেশার দ্রব্য আছে? নানা, আমরা মদ্যর কথা বলছি না। বলছি অতি উপাদেয় আফিম-গাঁজার কথা। বুদ্ধের জমিতে গাঁজার চাষ ভাল হয়—নির্বাণপ্রাপ্ত গাঁজা কিনা। পেলে আমরা দেবতা, আমাদের ভাল লাগত!”

সোম বুঝল, কেবল নারীর কারণে নয়, এই অত্যধিক সুরাসক্তির কারণেও এরা মনুষ্য সমাজে আর পূজা পান না।

তখন হরিণেরা বলল, “আমরা এখানে এসেছি ভগবানের সাহচর্য পেতে। একদা আমরা জলের ভেতর হরিণ হয়ে বাস করছিলাম, সেই জন্মে আমরা মাঝির নৌকায় নদী পেরুচ্ছিলাম। কিন্তু তার কাহিনি পুরো না শোনায় আমাদের সে হরিণ করে দেয়। এতদিন পর আমাদের নবজন্ম হল!  এখন আমাদের এক সভা আছে। আমরা সেখানে যাচ্ছি। সেখানে উৎপন্ন বু্দ্ধগণ, যাঁরা সংখ্যায় শত সহস্র লক্ষ কোটি নিযুত—গঙ্গার বালুকাসম অসংখ্য ক্ষেত্রে ধর্মের উপদেশ প্রদান করবেন। তখন দশদিক থেকে আগত বুদ্ধগন বৃক্ষের নিচে রক্ষিত আটটি রত্ন চিহ্নিত আসন গ্রহণ করবেন। তাঁরা শাক্যমুনির কুশল জানতে চাইবেন। শাক্যমুনি আমাদের পিতা। আপনি যা অনুমান করছেন, যথার্থ। যে পর্বত থেকে আপনি নেমে এলেন, তা গৃধ্রকূট পর্বত ছিল। সেই জন্মে আমাদের পিতা উনি, ওই তপস্যী। তার আগে শাক্যমুনি।”

দেবতারা বললে, “একদা বুদ্ধ রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বতে  দ্বাদশ সহস্র মহাভিক্ষু সমাগমে অবস্থান করছিলেন। দেব, নাগ, যক্ষ, অসুর কে ছিল না সেই সভায়। কেবল আমরাই দূরে রয়ে গেছি।”

“তবে চল আমাদের সাথে।”

দেবতারা সম্মত হলেন। সঙ্গে এও বললেন, “এতে কী আমরা আমাদের পূর্ব গৌরব ফিরে পাব?”

হরিণেরা বলল, “সে কথা উনিই বলতে পারবেন। তোমরা কি ওঁনাকে স্বীকার কর?”

“…করি।”

চোমং বললেন, “আমি কী আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি? আমি নির্বাণ লাভ করতে চাই।”

“নিশ্চয়। আর যুবক, তুমিও চলো, ওই বনের ভেতর। ওখানে এখন সাজোসাজো রব। চলো, শপথ নেবে।”

সোম বলে, “কিসের শপথ?”

“এই যে, তুমি কখনও অসহিষ্ণু হবে না।”

“কিন্তু আমি তো তা নই।”

তারা বললে, “যে এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছে, সেই বুদ্ধ। তাই তোমার মধ্যে বোধি লাভের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। শূন্যতা আর করুণার মিশেলেই বোধিলাভ সম্ভব। একটু পরেই উঠবে বুদ্ধচাঁদ। সেই আলোয় পথ চিনে আমরা যাত্রা শুরু করব। বুদ্ধচাঁদের আলোতে পৃথিবী হয়ে উঠবে আলোকিত। যাতে স্থিত হতে পারলে জীবনের ঘন অন্ধকার ভেদ করে উপস্থিত হবে বৌদ্ধিকপূর্ণিমা।”

তখনি আকাশে ছিটকে উঠল গোলাপি আভার চাঁদ। সে ছিল পাহাড়ের ওপারে। তখন ছিল হলুদ। যখন উপরে উঠল পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে, তখন চরাচর আলোকিত হল। গোলাপি চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের মাথা থেকে লাফিয়ে উঠল এক বিরাট পাখি। এই বড় তার দুই ডানা। মস্ত চঞ্চু। গলা থেকে বুক অবধি সাদা। পাখিটা আকাশে ছিটকে উঠে চিৎকার করল, এক বিকট চিৎকার। তাতে সমস্ত হরিণের চোখ তার দিকে ঘুরে গেল। তারা একযোগে চিৎকার করে উঠল, “পিতা! পিতা!!”

এক দেবতা বললে, “ওই দেখ সকলে, সাধু পাখি হয়ে উঠলেন।”

আর এক দেবতা বললেন, “কেবল বীর্যপাতটি তিনি শিখতে পারেননি। ধ্বিক!”

অপরজন তীব্র শ্লেষের সঙ্গে বললেন, “পাখি হয়ে কী ঘন্টাটি তিনি নাড়বেন?”

আকাশ থেকে পাখিটি তীব্র শিসের গলায় বলে উঠল, “তোমরা বনের পথ চেন? তবে আমাকে অনুসরণ কর। হে মৃগগণ, তোমরা যা অর্জন করেছ, তা অন্তিম নয়। তোমাদের এই অনুভব মিথ্যে। তাই সেই শূন্যতা বিষয়েই এখন তোমরা শিক্ষা লাভ করবে।”

সকলে পাখির নির্দেশিত পথ ধরে চলতে লাগল। চোমং আমার হাত দুটি ধরে বললেন, “আমি এবার নির্বাণ নেব। বিদায়, বন্ধু। আমার সময় এসে গেছে।”

“আমি তবে একা কোন পথে যাত্রা শুরু করব? কাউকেই যে চিনি না।”

“কেন? বুদ্ধের হরিণ তোমার সঙ্গে আছে। সেই তোমাকে পথ দেখিয়ে রৈক্যের স্তরে নিয়ে যাবে। তুমি চলতে থাক। আর কিছু না হোক, এইভাবে চলতে চলতে একদিন তুমি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে। সামনে একটি গ্রাম আছে সোম। অনেকটা হেঁটে বা নদীতে খেয়া বেয়ে তোমাকে সেখানে পৌঁছতে হবে। সেই গ্রামের নাম চর্যাপুর।”

আবার সোম একাকি হয়ে উঠল। নদীর যে বেগ ছিল, যে উত্তাপ ছিল, শান্ত হয়ে এল একটু একটু করে। দেখি কোথাও কোন আলো জ্বলছে না। ধূলায় মিশে গেছে নির্জন বিহার। না দেবতা, না মনুষ্য—চরাচরে একটি পাখিও নেই। সকলে গেছে সেই সমাবেশে। এই নিরন্তর পরিবেশে সোম একাকী আবার পথ চলা শুরু করল। সাধুজী বলে দিয়েছেন, আগামীতে সাক্ষাৎ হবে পাঁচজন বুদ্ধের সঙ্গে। ধূলাপুর থেকে আসবে তারা। শাসকের কোপে বিধর্মীরা তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। কিন্তু তাঁরা কারা?

সোম আগ্রহী হয়ে উঠল সেই পাঁচ বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য।

(ক্রমশ…)

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। গল্পকার। লেখকের দেশ-ভারতবর্ষ। জন্ম ১৯৭৬ সালে, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার ছোটচৌঘরা গ্রামে। পড়াশুনো- বাংলা সাহিত্যে এম এ। জীবিকা- চাকুরি। প্রকাশিত বই- একটি। 'মশাট ইস্টিশনের মার্টিন রেল' (১৫টি গল্পের একটি সংকলন)।  প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা দুইশত। পশ্চিমবঙ্গের নানা পত্র পত্রিকায়...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ