শূন্য থেকে শূন্যে (১)

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
শূন্য থেকে শূন্যে (১)

 সূচনা পর্ব

এইভাবে রাস্তার পর রাস্তা পেরিয়ে পথে চলে যেতে যেতে তাদের মধ্যে হল কী; রূপাঞ্জনা থেকে তারা প্রসঙ্গান্তরে গেল। সুদেহী, সুবেশা, যোজনগন্ধা সেই নারীর থেকেও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল মন। এমন এক মন আছে রূপাঞ্জনারও। সেই মন, যা সে আদানপ্রদান করে নিতে পারে কোন যুবকের সহিত। এমন সেই মন, যা স্পর্শর সুযোগ পাবার নিমিত্তে যে কোন যুবক কোটিকল্প জন্ম নিতে দ্বিধা করবে না। পৃথিবী বর্হিভূত এই চরাচরের আঁকাবাঁকা, পথহীন নানা পথ পেরুতে পেরুতে এই প্রথম তাদের মনে হল, আসলে কে এই রূপাঞ্জনা? কী-ই বা তার সত্যিকারের পরিচয়? এই যে সে তাদের ডেকেছে একত্রে, আজ; একই সঙ্গে দুই পুরুষ এই সন্ধ্যায় তার একাকী গৃহে যাচ্ছে—এই কী তবে সেই অভিসার যা যুগে যুগে কথিত হয়ে এসেছে কাব্যে গাথায় গল্পে লোক-কাহিনিতে? এই ভূমি, যা দখলে রেখেছে কুয়াশার গাঢ সর আর মেঠো ইঁদুরের নির্ভীক চলাচল; শিয়ালের উপস্থিতিতে তবে কী সেসব সরে যাবে তাদের মিলনক্ষেত্র রচনার জন্য? এই বন্ধুরভূমি হয়ে উঠবে এক অভিসারভূমি?

মাস্টার বলল, “ওটা কি সত্যি শিয়াল ছিল? আমার কিন্তু তেমন লাগল না!”

সোম বলল, “ওটাকে তবে কি মনে করছ তুমি?”

“হরিণ।”

অনেকক্ষণ ধরে এই মেঠো ও বন্ধুর পথের ঝাঁকুনিতে চলে ক্লান্ত তারা একসময় থেমে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ে তারা হাঁ মুখের ভেতর পুরে নিল অনন্ত কুয়াশা। দেখল, অচেনা সেই কুয়াশারা ধীর গতিতে নামতে চাইল মাটির প্রতি, হয়ত বা চাঁদের ইশারায়। মাটি এখানে ভূমি, যা দিগন্ত বিস্তার করেছে; তাই তাঁর কোন রূপরেখা নেই—ফলত হল কী, দিগন্ত এখানে মুছে গেল; আর আ-ভূমি সেই মাটি তৈরি করে দিল চাঁদ। চন্দ্রভূমি এখানে নিশ্চল। মাটি তখনই সচল হয় যখন সোমেরা চলতে শুরু করে। আহা চাঁদ! সে কি রূপাঞ্জনার মত নয়?

অবাক হয়ে সোম বলল, “হরিণ! এদিকে? কী করে হয়? হরিণ বাস করে এখানে, কোনদিন শুনি ত!”

“যাক গে, বাদ দাও ওসব। এই কুয়াশার ভেতর কি দেখতে কি দেখেছি, তার কোন ঠিক নেই। এখন ও চলে গেছে। চলো, আমরা আমাদের পথে যাই। রূপাঞ্জনা অনেকক্ষণ ধরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।”

“তাই চলো।”

সাইকেলে উঠে মাস্টার বলল, “সেদিন ট্রেনপথে আমরা যে আলোচনাটা করছিলাম, রূপাঞ্জনা হঠাত নেমে যাওয়াতে তা থেমে গেছিল, মনে আছে তোমার? নাও, আবার শুরু কর সেই কাহিনি। এই পরিবেশ সেই ফেলে আসা গল্পের জন্য অতি চমৎকার। গল্পে গল্পেই আমরা এই পথ পার হয়ে যাব।”

সাইকেল চালাতে চালাতে উদাসীন গলায় সোম বলল, “বুদ্ধের নির্বাণ নিয়ে আর নতুন করে কী-ই বলব তোমায় বল, মাস্টার! আমি একদিনের কথা বলতে পারি, যেখানে একদা বুদ্ধ বৈশালীর মহাবন বিহারের দ্বিতল কূটাগারশালায় বাস করছিলেন। তখন একদিন বুদ্ধগণকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তিনমাস পর আমি পরিনির্বাণে প্রবেশ করব। তোমরা তাঁর জন্য সময়কে প্রস্তুত কর।’

পাশাপাশি সাইকেল চালাতে চালাতে মুখ ফিরিয়ে মাস্টার সামনের দিকে তাকায়। বলে, “তারপর?”

সোম আবার বলতে শুরু করে, “বুদ্ধের মুখে এ কথা শুনে বুদ্ধগণ বুদ্ধকে বললেন, ‘আপনার পরিনির্বাণের পর কিভাবে বুদ্ধগণ মনের মধ্যে বোধী জাগ্রত করবে? কামনা-বাসনাকে বর্জন না করলে কিভাবে জীবনের সত্যকে আবিস্কার করবে?’

বুদ্ধের শেষ জীবনের কথাগুলি বলে সোম থামল। মাস্টার বলল, “তোমার মুখে এইসব কথা শুনতে বেশ লাগে সোম।”

সোম বলল, “বোধী এখানে উত্তরণ, মাস্টার। মন থেকে মনের উত্তরণ। অথচ দেখ, দেহের কোথাও মন বলে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। মন হল শূন্য!”

“মন আছে, সোম। আমাদের দেহের ভিতর আছে। আমাদের মনের ভেতরেও মনের বাস। মন আছে রূপাঞ্জনার। আচ্ছা সোম, একটা সত্যি কথা বলত, এই যে আমরা মিলনের লাগি এক নারীর প্রতি ছুটে চলেছি, সেটা কী মনেরই খেলা? মন তো শূন্য!”

“মাস্টার, এখন কী এইসব কথা শোনার সময়! আমরা যাচ্ছি এক নারীর কাছে। সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। এই সব কথায় কথায় দেরি হয়ে যাচ্ছে না?”

প্রথম পর্ব

                              সার কল্প                             

এক

সোম আর মাস্টার। অঘ্রাণের কুয়াশা ঘেরা সন্ধেবেলার পথ পেরিয়ে তারা দুইজন চলেছে সাইকেলে। ট্রেন থেকে নেমে যে পথে এই সাইকেল চেপেই তারা অফিস যায়, সেই পথ ছেড়ে দিয়েছে তারা অনেকক্ষণ। এই পথ তাদের কাছে নতুন। খাঁপুর মোড় থেকে বাঁহাতি বেঁকে মোরাম পথ। কিন্তু বর্ষার পর মোরাম  গলে গেছে। দেখে মনে হয় রাস্তাটা অনেকদিন মেরামত করা হয়নি। অন্তত দুটি বর্ষার জল  না খেলে রাস্তার এই হাল হয় না। স্থানে স্থানে বেরিয়ে পরেছে টুকরো ইঁট হাঁ করে আছে। কোথাও রাস্তা ভেঙ্গে ঢুকে গেছে পাশের নালার ভেতর। সাইকেল এত লাফাচ্ছে যে হ্যান্ডেল ঠিক রাখাই দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাস্তার মাঝে মাঝে নানা আকারের ছোট বড় অজস্র গর্ত। সেই অচেনা পথে সাইকেল গড়িয়ে চলেছে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে।

তারা চলেছে রূপাঞ্জনার কাছে। রূপাঞ্জনা যাত্রা করে। গ্রামে-গঞ্জে যে সব আমেচার নাটক হয়, তাতে সে ‘ফিমেল’ হিসেবে ভাড়া খাটে। তার সঙ্গে ওদের আলাপ ট্রেন পথেই। সে কোন এক গ্রামে যাত্রার জন্য মহড়া দিতে যাচ্ছে, এরকম সময় তাদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। তারা একসঙ্গে গল্প করতে করতে যেত। কত যে কথা হোত বলার নয়। এইভাবে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। একটু একটু করে তার কাছ থেকেই জানা যায় সে এক স্বামী পরিত্যক্তা নারী। একদিন বললে, “এসো না আমার গ্রামে, আমার বাড়িতে।”

তখন মাস্টার বলেছিল, “শীতের বেলা, অফিস করে যেতে যেতেই তো সন্ধে হয়ে যাবে। তাহলে?”

“তাহলে কী?” বলে এক রহস্যময় হাসি এসেছিল রূপাঞ্জনা। সোমের চোখে পড়েছিল তখন, নাভির অনেক নিচে শাড়ি পড়েছে সে। বর্তুল নাভি ও পেটের কোমলতা কেমন যেন বিবশ করে দিল তাকে। সে কোন কথা বলল না।

মাস্টার বললে, “তুমি একা থাক, ওই সময় যাওয়া কি ঠিক হবে?”

এইবার হাহা করে হেসেছিল রূপাঞ্জনা। আহা রূপাঞ্জনা আমার! গায়ের শাল খসে গেলে তার অদ্ভূত সুন্দর স্তনাগ্র চোখে পরেছিল দু’জনেরই। সেই ভাঁজকে অগ্রাহ্য করার সাহস কারও ছিল না। তাদের ঘোর কাটাতে রূপাঞ্জনা বলল, “দেখ  মাস্টার, সেই বাড়িতে আমি একা থাকি বটে, কিন্তু সেটা আমার বাড়ি। কে কখন আমার বাড়িতে আসবে, সেটা আমি ঠিক করব, অন্যরা নয়। আর সত্যি কথাটা কি বলত—।”

বলে সে লাল মাফলারটা খুলে সোমের হাতে দিল। কারণ শীতের দিনের ট্রেনের বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সে গুছিয়ে নেবে, কথা বলবে তারপর। মেয়েলি এই মাফলার হাতে নিয়ে এক ভাললাগায় ডুবে গেল সোম। বুঝল এই হল রূপাঞ্জনার স্পর্শ। মাফলারে যদি দুই একটি চুল লেগে থাকে, সে খুঁজতে লাগল গোপনে।

আজ বেশিদূর এই ট্রেন সফর করবে না সে। মাত্র দু’টি স্টেশন পরই নেমে যাবে। একঘন্টার মহড়া আছে সেখানে। ফিরে আসবে তারপর। আজই তাই কথার হিসেব পাকা করে নেওয়া ভাল। হয়ত তাই, রূপাঞ্জনা সময় নিচ্ছে অনেক। অন্যদিন ও যেমন একা একাই বকে যায় কত কথা, আর ওরা দু’জন সবিস্বয়ে ওর বাহুর উত্থান পতন, স্তনের কম্পন, ঠোঁট নাড়া দেখে, দেখে কিভাবে সে আলগছে বাতাসের অভিঘাত থেকে সামলে নিচ্ছে দূরন্ত এলোচুল-চূর্ণ।  বাইরের দৃশ্যপট সরে যাচ্ছে দ্রুত। দাদুর কাছে শোনা ছেলেবেলায় দেশের গল্পের ঝুলিতে মন হাতড়াচ্ছে সোম—কি এমন কথা তুলে আনা যেতে পারে, যাতে সে শুনে খুশি হয়, আর হাসিতে সেই ঝলক ওঠে।  অনেকটা সময় তার নীরবতায় দুই যুবককে মুগ্ধ করে রূপাঞ্জনা বলে, “আমি যেখানে থাকি সেটা এমনই এক গ্রাম, যা কেবল আমাকে নিয়েই।”

“মানে?”

“আমিই সেই গ্রাম সৃষ্টি করেছি। আমারই জন্য সে গ্রাম জন্মেছে, বেঁচে আছে। আমি সরে গেলে সে গ্রাম মুছে যাবে। আমাকে ঘিরেই সেখানের পশুপাখি ও নানান কীটপতঙ্গেরা বেঁচে থাকে। আমার যেদিন ঘুম আসে না, করি কী বাইরে বেরিয়ে আসি। চাঁদ থাকলে ভালই, রাত হলেও অসুবিধা কিছু নেই, আলো আসে সেই ভাঙ্গা বৌদ্ধবিহার থেকে। কিসের আলো, কেন আলো বুঝি না। তবে আমার মনে হয়, বুদ্ধ যেহেতু চাঁদের মানুষ, সেহেতু সব সময় তাঁর নামের আশেপাশে চাঁদ ঘোরাফেরা করে। তিনিই আলো পাঠান। তাই কে আমার ঘরে এল, থাকল, তা দেখার কেউ নেই।”

“হয় এমন?”

“হয় হয়। সব হয়। নইলে কীভাবে এখনও চারলক্ষ দরবেশ মানুষের অগোচরে থেকে মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারে, এখনও?”

এই সব কথা হতে হতে সেদিন নিজের স্টেশন আসতে হাসি মুখ দেখিয়ে নেমে গেল রূপাঞ্জনা। সোম তাকিয়ে দেখল মাস্টার স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। মৃদু হেসে সোম মাস্টারকে ধরে নাড়া দিল।

দুই

তাদের সাইকেল এই সন্ধের অন্ধকারে গড়িয়ে চলেছে, লাফিয়ে চলেছে মাঠের উপর দিয়ে। হ্যাঁ, মাঠ! জানা ছিল না, রূপাঞ্জনার কাছে যেতে হলে এই মাঠ পার হতে হবে। এই মাঠের গল্প সে করত না কখনো। সে কখনও তাদের জানায়নি, মাঠ বা ভূমি, যাই নামেই কথিত হোক সেই দিগন্তহীন ভুমি; তা হল এক চন্দ্রভূমি। সে কেবল বলত আকাশের কথা। একাকী রাত্রির ফাঁকে আকাশ পর্যবেক্ষণের কাহিনি। কত যে রাতচরা পক্ষীরা উড়ে যেত ডানা ঝাপটে, তার একেবারে দেহের কাছ দিয়ে, সেই গল্প করত। সে বলত, ওই সব পাখিরা নাকি মানুষ! তারা বলত, এমন রূপ যার তাকে দেখার জন্য, ছোঁবার জন্য মানুষ কেবল পক্ষী কেন, ধূলিকণাও হতে পারে। শুনে রূপাঞ্জনার গাল লাল হয়ে উঠত।

তারা ছোট ছোট জনপদ বা গ্রাম পেরুচ্ছিল। এতটুকু এলাকা নিয়ে গ্রাম? কয়টি ঘর, ছোটছোট গাছপালা, খড়ের গাদা, লাউয়ের মাচা খাড়া করে বাড়ির পিছন। হয়ত এগুলি কোন গ্রাম নয়, বসতি মাত্র। হয়ত এভাবেই মানুষ বাসা বেঁধেছে সেই বুদ্ধের জন্মের আগে থেকেই। তিনি নির্বাণ নিলেন, ঘর কিন্তু তেমনই রয়ে গেল। মানুষের মন হয়ে উঠল শূন্যতার আকর!

এই সন্ধেতেই তাদের বাড়িতে আঁধার নেমে গেছে, ঘুম নেমেছে তাদের দুই চোখ জুড়ে। চাঁদ উঠেই তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়। খুব ভোরে উঠে তারাই মাঠে গিয়ে সূর্যকে ডেকে তুলবে যে! তাদের বিস্ময় বাড়ছিল।

মাস্টার বললে, “তুমি যে বুদ্ধের কথা বলছিলে—থামলে কেন, বল। বুদ্ধের কাহিনি শুনতে আমার বেশ লাগে।”

সোম হেসে বলে, “তোমার কি কোন কারণে টেনশন হচ্ছে?”

“না, তা কেন। টেনশন কীসের?”

“হঠাৎ এত বুদ্ধের কথা কেন শুনতে চাইছ বলত? আগে তো অনেক বলেছি। ট্রেনে যেতে যেতেই কত কথা হয়েছে। দাদুর কথাও বলেছি, তাঁর নির্বাণ জীবনে প্রবেশের ইচ্ছার কথাও তোমার অজানা নয়। সে সব রূপাঞ্জনাও শুনেছে। আসলে বুদ্ধের কাহিনিতে সব টেনশন দূর হয়ে যায়। মনের, শরীরের। বুদ্ধ এক ওষুধ।”

গাছপালা কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে এগোতে হচ্ছিল। এখন এই হা হা করে নিঃসৃম সীমারেখার দিকে ছুটে চলা এই মাঠের শুরুর প্রান্তে তারা থমকে গেল। এখানে কোন পথ নেই। পৌষের ধান উঠে গেছে। ধানের নাড়ার ফাঁকে জেগে থাকে কুয়াশার স্তর। শীতের এইসব দিনে সেই দুপুর থেকেই মাটিতে থাবা গাড়তে থাকে কুয়াশার দল। একটু একটু করে জমতে থাকে তারা এবং দিন শেষ হবার আগেই এমনি করে বৃদ্ধি পায় যে, চাঁদ-মাটি-মায়া আর শীতলতাকে ধরে রাখে কোলের ভেতর। তার ভেতর চাঁদের আলো। তাতে কুয়াশা হয়ে ওঠে শ্রাবস্তী নগরীর মত স্থবির!

শীতের মাটিতে ফাট। প্রচন্ড কড়া মাটি। আর উঁচুনিচু। খালি পায়ে অনভ্যস্ত লোকজন চলাচল করলে পা কেটে ফালাফালা হয়ে যাবে। সাইকেল চলে না। তখন সাইকেল মাঠের ভেতর শুইয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে তারা। নির্জন, নিস্ত্ব্ধ চরাচরে প্যাঁচা ডাকে। তারা ভাবল হয়ত এখনই এই পথ শেষ হয়ে যাবে আর তারা অমনি পৌঁছে যাবে সেই নারীগৃহে।

“কেমন সে গৃহ?”

মাস্টার বলল, “হতে পারে তার একটাই ঘর, কিন্তু যেহেতু তার মনটা বড় তাই সেখানে স্থানের কোন অভাব নেই। তার ঘরের চাল ঘিরে জোনাকিরা পাক খায়। আমার মনে হয়” –এইটুকু বলে মাস্টার থামল। একবুক কুয়াশা নিয়ে বলল, “তার ঘরের আশেপাশে বনের হরিণ থাকতে পারে। কারণ সে একাকি থাকে, বনমধ্যে।”

“বনের কথা তো সে বলেনি।”

“ঠিক। সে এই মাঠের কথাও বলেনি আমাদের। সেই হসেবে হরিণের কথা আমাদের ধরে নিতে দোষ কী? আর ধরে নিলে ব্যাপারটা আবার অন্যরকম মনে হয় না?”

“হুম! কিন্তু হরিণ? এই বাজারে সেটা কি একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”

“হয়ত। তবে মনে রেখ, তার নাম রূপাঞ্জনা।”

“আবার ধরে নাও, এই সব ভাবনা কেবল ভাবনাই, এর কোন সারবস্তু নেই। যেমন আমরা ভেবে নিচ্ছি ও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি এই চন্দ্রভূমি নিয়ে যার কোন রূপরেখা নেই।”

এবার সোম বলল, “হুম!”

কিন্তু দেখা গেল পথ অনেকটাই। রূপাঞ্জনা বলেছিল, মোরাম রাস্তা ছেড়ে খাঁ-পুর মোড় থেকে বেঁকে যাবে বাঁদিকে। তারপর সোজা যাবে নাক বরাবর। গিয়ে থামবে সেখানেই যেখানে পথ তোমাদের থামতে বলবে। দেখবে এক কুটির, পাশে এক জামগাছ। পিছনে টলটলে জলের পুকুর। জলের পিছনে আকাশ জেগে আছে। চাঁদ যদি উঠে যায় তখন, সে তোমাদের চিনিয়ে দেবে বাড়ি। দেখবে, কুয়াশার লম্বা সর কেমন আগলে রেখেছে আমার গৃহ। ভেতরে আমি আলো জ্বালিয়ে রাখব। আর তোমরা না চাইলে যতটা পারি ঘর মধ্যে দিনের আলো সেঁধিয়ে রাখব। দিন যদিও তখন থাকবে না, কিন্তু আমাকে যখন তোমরা দেখবে, মনে হবে বাইরে যতই আঁধার নামুক, এই ঘরে আলো আছে এখনও।

হ্যাঁ, আলো আছে বটে চরাচরে। তারা দু’জনেই দাঁড়িয়ে পড়ে ও তাকিয়ে দেখে মাঝেমধ্যে—এই হল আলোর বাহার। চাঁদ যে এত বড় ও উজ্জ্বল হতে পারে, উত্তুঙ্গ চাঁদের আলো। আলো আসতে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, তবু আলো নেমে আসছে। মাঠ যখন সমান হয়ে গেল, সোম পারলে দৌড়ে যায় বাকি পথটুকু। মাস্টার তাকে টেনে ধরে বলে, “আমরা কিছু ভুল করছি নাতো সোম? এটা কোন ফাঁদ নয় তো?”

“ফাঁদ! কিসের?”

“মোবাইলে আমাদের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করে টাকা নিতে চায়।”

“কত টাকা আছে তোমার যে তাকে দিতে পারবে? দেখ মাস্টার, আমার মনে হয়, ওর একার কাছে যা টাকা আছে, আমাদের দুইজনের কাছে তা নেই। আর হোমের কাজ করে আমরা যা মাইনে পাই, তাতে একটা সংসারও চলবে না। কত পরীক্ষা দিলাম, একটাও চাকরি মিলল কি আমাদের? দুই একটাতে যাও বা পাশ করি, ভাইভাতে কেটে যায়। এই অবস্থায় বাড়ির লোকের কাছে টাকা চাইতে গেলে তারা হাত উলটে দেবে। বলবে, আপদগুলো গেছে ভালই হয়েছে। তাহলে?”

ম্লান হেসে মাস্টার চুপ করে গেল। বলল, “আসলে কাগজে অনেককিছু পড় তো এইসব নিয়ে—।”

সোম বলল, “সে তো আমিও পড়ি। কিন্তু তাতে কী হল? ডেকেছে যখন, চলো না। তারপর যা হবে, দেখা যাবে।”

মাস্টার চুপ।

মাস্টার দাঁড়িয়ে পড়ল। কোন কথা বলছে না। কী ভাবছে সে? সোম ভাবল। এদিকে প্রবল বাতাস দিচ্ছে। তারা যখন মূল রাস্তা দিয়ে আসছিল, এমন শীত বোধ বা এমন প্রবল বাতাস ছিল না সেখানে। কিন্তু এখানে যেন পাগলের মত বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। শীতের দাপটে কুঁকড়ে যাচ্ছে শরীরের অভ্যন্তর।

তিন

সোম এগিয়ে গেছিল। পিছু ফিরে দেখল, মাস্টার তখনও থেমে আছে। সুতরাং সে আবার পিছিয়ে গেল। ফিরিয়ে নিতে গেল মাস্টারকে। তার মনে হল, মাস্টারকে যেন ঠিক দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের আলোর প্রতিসরণ কি ঠিকমত ঘটছে না সেখানে যে মাস্টারের অবয়ব মুছে যেতে থাকে? নাকি অত্যধিক পরিমানের কুয়াশা গ্রাস করেছে তাকে? কুয়াশার ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে মাস্টার যেন হয়ে উঠেছে কুয়াশারই প্রতিরূপ। সে কাছে গিয়ে ডাকল, “এসো মাস্টার—।”

মাস্টার বলল, “সামনে দেখ।”

শুনে ঘুরে সামনে তাকাল সোম। তাদের সামনে এক নদী! সে মাস্টারের হাত আঁকড়ে ধরল। কী করে হল এমন? কীভাবে? কথার তোড়ে ঘুরলেও নদীকে নদী বলে খেয়াল করেনি। সে ভেবেছিল, কুয়াশার মায়া। মাঠের সঞ্চিত কুয়াশা স্রোত বয়ে চলেছে। ভাল করে তাকিয়ে তারা দেখল, চন্দ্রকণারা দুই হাত তুলে কেন জানি পিছিয়ে যাচ্ছে স্তর থেকে স্তরান্তরে। আহ, এত জলের প্রবাহ! শীতের সন্ধেতে এমন এক যুবতী নদীকে যে তারা আবিস্কার করেবে, সে কি তারা ভেবেছিল? তারা কেবল কথা কয়ে গেছে এক যুবতীকে নিয়ে। এখন নদীকে দেখে আচমকা সোমের মনে হল, যেন রূপাঞ্জনা তার নগ্ন দেহ নিয়ে বয়ে চলেছে। কুয়াশা দিয়ে ঢাকা রেখেছে তার প্রকট যৌবন। তার মন স্থাপন করেছে চাঁদকে। তাই চাঁদ এত প্রকট, এরূপ তার রঙ যে মনে হয় বুঝি নতুন এক চাঁদ পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন বুদ্ধদেব। এই পৃথিবীতে যতগুলি চন্দ্রালোকিত দিন আছে বা যতগুলি চাঁদ আছে, সবই বুদ্ধের। তার সেই দেহ খুঁজে নিতে হলে, কুয়াশাকে আত্মস্থ করতে হবে সোমকে।

এমন এক নদীকে নদীছাড়া এক অন্যতর মাত্রায় আবিস্কার করতে পেরে তার দু’হাত উঠে গেল কোমরে। আশ্চর্য, এটার তো থাকার কথা ছিল না। ট্রেনের মধ্যে লাখো কথার ভীড়ে কখনও ছিল না নদীর প্রবাহ, নৌকা, চাঁদ ভেসে ভেসে গোটা নদীকেই চন্দ্রময় করে দেয়—এই সব কথা। তাহলে? এখানে এতবড় নদী কোথা থেকে এল?

ও কিন্তু নদীর কথা বলেনি কোনদিন। বলেনি সে নিজে নদী পারাপার করে। তার কথায় খেয়ার কথা, জলছোঁয়া তার আঁচলের কথা ওঠেনি কখনও। তবে এই নদী এল কোথা থেকে? সে কখনো বলেনি নদী পেরুতে হবে! সে যখন ট্রেনে চেপে মহড়ায় যায়, সেখানে নৌকার কোন কথা থাকে না। সে বলেছিল, মোরাম রাস্তা পেরুলেই তার বাড়ি। সেখানে এই যে অনন্ত বিস্তৃত মাঠ, তার কোন হিসেব ছিল না। যেমন ছিল না এই নদীর কথা। এটা তবে ভুল পথ? নদী ভরা জল। কুলকুল স্রোত। কতটা গভীর, তাই বা কে জানে! নদী পেরুবার কোন উপায় নেই। এদিকে যা আছে তা হল মাঠ আর মাঠ। কোন বসতি নেই। তাই ঘাট নেই। শীতের রাতে কি নদী যৌবন প্রাপ্ত হয়। সে তখন উচ্ছ্বল, অনন্ত। নদী নিজেকে বাড়িতে নেয় কয়েকগুণ। তার পারে বসত করে এক অসাধারণ নারী। যার হাসিতে টোল পড়ে। কিন্তু কোন নদী এটি? নদীর কথা কেন বলেনি রূপাঞ্জনা!

এই জায়গারই বা নাম কি? তারা কখনও আসেনি এখানে। আসার কোন প্রয়োজন পরেনি। সোজা রাস্তা দিয়ে অফিস গেছে, সাইকেল ছুটিয়ে ফের সেই রাস্তাতেই ফেরা। একটা ট্রেন বেরিয়ে গেলে আবার পরের ট্রেনের জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। তাই কোথাও আর যাওয়া হোত না।

এতক্ষণ অনেকক্ষণ বকবক করে সোম একটু থমকে গেছে। এমনটা যে হতে পারে, সে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না! তার চলনের মধ্যে ‘অভিসার পথে যাত্রা’ একটা ভাব ছিল। সেটা এখন উধাও।

চার

নদীর বাতাসে তারা দুইজন তখন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, সোম খুবই মূহ্যমান হয়ে পড়েছে। তবে কি সত্যি ফিরে যেতে হবে? মাস্টার তো নদীর কাছে আসা ইস্তক সেই থেকে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে, “এবার চলো সোম। রাত বাড়ছে? এই সময়ের ডাউনটা পেয়ে যাব, আর দেরি কোর না। এরপর যখন রূপাঞ্জনার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে, এই সব অভিযোগ নিয়ে পরে কথা যাবে।”

সোম বলে, “আর একটু দেখি। এত কাছে এসে ফিরে যাব?”

“এরা এমনই হয় সোম। আমার মনে হয়, ওর ঠিকানাও সম্পূর্ণ মিথ্যে। কত সবাইকে আসল ঠিকানা দেবে? তাই যখন যার সঙ্গে আলাপ হয়, যেরকম মনে আসে, ঠিকানার হিসেব দিয়ে দেয়। আমি টুকটাক যাত্রা করি সোম, নিজের গ্রামে—সে তুমি জান। আমাদের ক্লাবের ছেলেরাও করে। আমাদের  ফিমেল ভাড়া করতে হয়। ওদের আমি চিনি। ওরা এমনই হয়, সোম।”

“আরে মাস্টার, এতটা ক্ষেপে যাচ্ছ কেন বাড়ি ফিরবে বলে? এই তো সবে সন্ধে। এখানে যেহেতু কোন মানুষ নেই, কোন কিছুর শব্দ হচ্ছে না—কেবল চাঁদ আর কুয়াশার বাড়বাড়ন্ত; তাদের সঙ্গ দিচ্ছে শিয়াল—তাই মনে হচ্ছে আমরা কোথায় না কোথায় এসেছি। আর একটু দেখি না। নদী যখন আছে, খেয়াও থাকবে। আমাদের এতটাই ভুল বলবে সে? এতদিনের আলাপ তাহলে যে পুরোটাই মিথ্যে হয়ে যাবে!”

“তুমি কি নদী পেরুবার কথা ভাবছ? ভুলে যাও। এদিকের নদীতে খেয়া চলে না। তাহলে কোন দোকানপাট থাকত। নিদেনপক্ষে একটা না একটা নৌকা মিলতই। বা বাঁশকাঠ সহযোগে কোন না কোন ঘাট বানানো থাকত। সেটা যদি নাও মানি, তাহলে অন্তত এমন কিছু একটা নিদর্শন থাকত, যেটা দেখে মনে হপ্তে পারে, এখানে মানুষ আসে, পারাপার হয়। কিন্তু এই স্থান দেখে তো মনে হচ্ছে, এখানে পশুপাখিরাও বাস করে না। একটাও রাতপাখি দেখলে উড়ছে মাথার উপর? একটাও আওয়াজ শুনলে তাদের? ডানা ঝাপটালো কেউ? সব বেবাক ফাঁকা, সোম। এমন জনমানবহীন শূন্য স্থান এটা; এখানে কেউ যদি  কুপিয়ে দিয়ে যায় আমাদের, কেউ টের পাবে না।”

সোম কিছুই বলল না। নদীর জল ফুলে ফুলে উঠতে থাকল। তাদের অফিসের এত কাছে এমন যে একটা নদী আছে, সেটা তারা জানতই না! অফিসের লোক ত কম নেই। শতরূপা, শ্যামলরা তো এখানের ভূমিপুত্র। কই, তারাও তো কখনও বলেনি এই নদীর কথা!

তখন ঈশ্বরের আশির্বাদের মত এসে হাজির হল একটি লোক। মাঝবয়েসী, রোগা,  গালে বেশ ক’দিনের আলগা দাড়ি। পরনে লুঙ্গি, ফতুয়া, পাতলা চাদর! তাকে দেখে সোমদের শীত লাগলেও তার ভেতরে কিন্তু কোন শীত বোধ নেই। তার নাম হানজালা মোল্লা। সে যেন কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, কেবলমাত্র তাদেরই জন্য। সে বলে, “ওপারে যাবেন বাবুরা? আমি এই নদী পার করে দেব। এখন কথা হল নদী নিয়ে। এইরকম কুয়াশার রাতে নদী করে কি, কুয়াশার চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমায়। পারাপার করতে হলে নদীকে জাগাতে হবে। জাগাতে হবে নদীকে সচল করার জন্য। নদী সচল না হলে ঢেউ জাগবে না যে! আর ঢেউ না থাকলে নদীকে পেরুবেন কেমনে?”

খুবই রহস্য আছে তার কথায়। সে কি পারাপারের জন্য বেশি টাকা দাবি করার কৌশল করছে?  সোম লোকটাকে বুঝে নিতে চাইছিল। তার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকে মাস্টার। সে বলে, “কিন্তু এই যে এত স্রোত বইছে? সেটা তবে কী?”

মাঝি বলে, “তবে আপনি দেখি নদীর কিছুই চেনেন না। যারা সর্বক্ষণ নদী পারাপার করে, কাজে যায়-কাজে আসে; তারাই চেনে জানে। বাকিদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।”

“এই নদীর নাম কি?”

“ধরে নিন এর নাম ঘিয়া নদী।”

বলে লোকটা একটু থামল। সোম বলল, “ধরে নিতে হবে কেন? নদীর কী সত্যিই কোন নাম নেই নাকি?”

“আছে। কিন্তু রাত হলে এখানের সবকিছু পালটে যায়। ফলে নদী কেবল নদীই থাকে। নাম দিয়ে কি হবে, বাবু? নদী কি জানে তার নাম এই? নাকি নাম অন্য হলে তার নদী-চরিত্র বদলে যাবে? তেমন তো নয়। তাই নাম নিয়ে ভাববেন না, নদীর কথা বলুন। এই যে দেখছেন নদীর বুকে আলগা ঢেউ; এ কি ঢেউ নাকি? এ হল নদীর শ্বাস-প্রশ্বাসের উত্থান-পতন। ঘুমন্ত আমাদের যেমন বাতাস টানলে দেহ ফুলে ফুলে ওঠে, তেমনি নদীরই অমনি হয়। আপনি হয়ত বলবেন, নদীর কি প্রাণ আছে? আমি বলব, আছে। নইলে সে শ্বাস নেয় কি করে? মানুষের সুখ-দুখে তার ভূমিকা থাকে কি করে?”

‘এই নদীর ওদিকে, নদীকে ছাড়িয়ে অনেকটা ভেতরে প্রবেশ করলে বেশ কিছু এলাকা ছেড়ে ঢিপি আছে না?”

“তা আছে, মিথ্যে বলব না।”

“দেখেছ নাকি? গেছিলে কখনও?”

“না। তবে শুনেছি ভেতর দিয়ে অনেকটা হাঁটতে হয়। অনেকে যায় তো—কলকাতা পার্টি। নৌকা নিয়ে কতবার পৌঁছে দিয়েছি সেখানে। নদীর ঘাটে অপেক্ষা করেছি—ওরা ফিরে এলে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। লোকে বলে ওগুলি নাকি বৌদ্ধদের ছিল।”

“কিছু খোঁড়াখুড়ি হয়নি?”

“না। এমন জায়গায় অভাব কী আমাদের দেশে? গরমেন্ট কত আর করবে? শুনেছি, প্রাচীন কালে এই নদীপথে বাণিজ্য চলত। সিঙ্ঘলরাজ সিংহবাহুর রাজধানী ছিল এই নদীর ধারেই। সেই জায়গার নাম সিংহলপাটন। এখন আর সেই রমরমা নেই বটে, তবে ফি বছরের বন্যায় নদী দু’কুল উপচায়। অনেকের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে।  এই তো সেবার চন্দনপুরের নদীবাঁধ ভাঙ্গল। ভেসে গেল কতশত মানুষের ঘরবাড়ি-ফসল-গৃহপালিত পশুরা।”

এটা জানে তারা। সোমেরা জলের কারণে অফিসই আসতে পারেনি কতদিন। কিন্তু সেটা কি এই নদীরই জল? তারা তখন যে নদীর কথা শুনেছিল, সেটা ভাগীরথীর শাখা। সেই জল উপচে দেয়।

“আপনারা কি সেই ঢিপি দেখতে যাবেন?”

“না। আমরা যাব আমাদের বন্ধুর বাড়ি। তোমার নৌকা কই?”

“নৌকা আছে, এখানেই আছে, এখুনি আনছি।” মাঝি বলে চলে, “এখানে আমার কথা আছে। পার তো করে দিব। কিন্তু আমি এট্টা গল্প বলব। সেটা শুনতে হবে। তবেই কিনা ওপারে যেতে পারবেন।”

“মানে?” তারা দুইজন অবাক হয়ে গেল।

“আরে কাহিনি—কিসসা! শুনবেন না? পুরোটা শুনলে আর ফিরতে ইচ্ছে হবে না বাবুরা; মনে হয় নৌকাতেই থেকে যাই আজীবন—হুঁহুঁ বাবা!”

বলে সে সময় নিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। কড়া গন্ধ। সোম বুঝল, পাকা লোক।  তার কথায় রাজি না হয়ে উপায় নেই। সে বলল,  “কত কি লাগবে?”

মাঝি বলল, “টাকা পয়সার কথা বলছেন? ঐ যে বললুম, না বাবু, যারা কাহিনি শোনে তাদের থেকে কিছু লাগে না। যে পথ বেয়ে আপনারা এলেন, এই পথেই যারা আসে, তারা দূর দূর দেশে খাটতে যায়। যাকে বলে পুবখাটা। তারা আমার কাহিনি শোনে। তবেই যে মাগনায় যাতায়াত করা যাবে। আর আমিও তেমনই; গল্পের প্র গল্প শুনিয়ে যাই। আচ্ছা দাঁড়ান, নৌকা — টেনে বার করি ঐ ঝোপের ভিতর থেকে।”

পাঁচ

সে লুকানো নৌকা বের করতে যায়। যেন জ্যোৎস্নার ভেতর লুকানো সেটা। অথবা জ্যোৎস্না জুড়ে জুড়ে তৈরি সেই অলৌকিক জলযান। সোম আসতে আসতে দেখেছে এই আলো, আহা, তা কিভাবে ডুবিয়ে দেয় মাঠ ঘাট অরণ্যকে। ফাঁকা মাঠের ভেতর যে জ্যোৎস্না তারা দেখে খানিক থমকে গেছিল, এখানে সেই আলোর প্রাবাল্য এত বেশ যে সে কথা আর বলার নয়। এত দীর্ঘ লম্বা কুয়াশার স্তর পরপর স্থাপিত, পল্লবিত; এখন মিলমিশে তা আলো-আঁধারের ভেতর। এতে যে আলোর প্রতি প্রেম-আচ্ছন্নতা জাগে; এত মদিরতা বাসা বেঁধে আছে, তা কে জানত! তাই যখন হা হা করে জ্যোৎস্না ছুটে এল গ্রাম পেরিয়ে ধূধূ মাঠের ভেতর, তারা অবাক হয়ে সেই জ্যোৎস্না ও হিমেলতা গিলে নিয়েছে।

নৌকা জলে নামাল হানজালা। বলল, “এত রাতে আপনারা যাচ্ছেন—এই সময় কেউ যায় না কিন্তু।”

মাস্টার বলল, “এখন রাত কোথায়, সবে সন্ধে।”

“সে তো কাগজে কলমে। আসলে এখানে রাত নেমে গেছে। রাত গভীর হলে তবেই এই নদীর জল হলুদ হয়ে ওঠে—দেখছেন না। এর নাম চন্দ্রজল। এই জলে স্নান সারলে নারী হয়ে ওঠে চন্দ্রনারী।”

তাকিয়ে দেখে সোম, তাই তো! এই নদী কি দিনের বেলা সত্যিই এই রকম থাকে? থাকে না। এক গ্রাম্য নদী কিভাবে এত করে আবিল করে দেয় মানুষকে? জলের রঙ—হলুদ। যতই তাতে চাঁদের আলো পড়ুক, এমন জলরং—হয় না। এ কোন চাঁদ? ওদিকে এমন বিচিত্র বর্ণের গাছ—অন্ধকার এখানে নেই—কেবল শীতলতা—একটি মানুষ খেয়া নিয়ে যেন তাদেরই প্রতীক্ষায় আছে। মনে হয়, এ নদী সেই নদী নয়, এ ভূমি সে ভূমি নয়। এখানের গাছ-ফুল-নদী—সকলই আলাদা। এ কী তবে এক অন্য পৃথিবী, অন্য চাঁদকে ধারণ করে আছে?

“এখানে নারীর কথা এল কেন?” সোম বলল।

“নারী মানেই তো পৃথিবী।”

সোম বলে, “ইচ্ছে আছে বন্ধুর  বাড়ি থেকে ওই বৌদ্ধ ঢিপি একদিন দেখে আসব।”

হানজালা বলে, “রাতের দিকে সেখানে আলো দেখা যায়। তাই দূরের গ্রামের লোকও ভয়ে সেখানে যায় না।”

“কিসের ভয় তাদের?”

“ভূতের। যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, তারা ভাবে চোরাচালান হয়।”

“মানে?”

“ওদিকে গাঁজার চাষ হয়। বিঘের পর বিঘে, মাইলের পর মাইল। আর আফিম। ধানের পাট তুলে দিয়ে ওদিকের লোক এই সবের চাষ করে এখন লাল হয়ে যাচ্ছে।”

“এই দুই চাষই বেআইনি। গরমেন্ট কিছু বলে না?”

“প্রেসিডেন্টের লোক মাঝে মাঝে এসে নষ্ট করে দেয় বটে, তবে নষ্ট লোকে বলে, সেটা নাকি লোক দেখান। বর্তমানে ওখানের যা পরিস্থিতি, গাঁজার চাষ ছাড়া দেশ পরিচালনা করা খুবই মুশকিল। নইলে সরকার যেভাবে দু’হাতে ‘ব্যাঙের বিয়ে’তেও অর্থ খরচ করছে, সেটা যোগাবে কে?”

“জায়গাটার নাম কি?”

“ষোড়শজনপদ।”

“হুম!”

 

(ক্রমশ…)

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। গল্পকার। লেখকের দেশ-ভারতবর্ষ। জন্ম ১৯৭৬ সালে, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার ছোটচৌঘরা গ্রামে। পড়াশুনো- বাংলা সাহিত্যে এম এ। জীবিকা- চাকুরি। প্রকাশিত বই- একটি। 'মশাট ইস্টিশনের মার্টিন রেল' (১৫টি গল্পের একটি সংকলন)।  প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা দুইশত। পশ্চিমবঙ্গের নানা পত্র পত্রিকায়...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ