শেষ খেয়া

অরবিন্দ ভট্টাচার্য
ছোটগল্প
Bengali
শেষ খেয়া

শীতের বেলা। বিকেলের স্বপ্নমেদুর রোদ্দুরটা কালজানি পারের পাকুড় গাছটার আড়ালে একটু একটু করে  হেলে পড়েছে। বিলম্বিত লয়ে সন্ধ্যে নেমে এসেছে ভুচুংমারির ঘাটে।  আলো আঁধারিতে সুজনের অপেক্ষায় তখনো নৌকো নিয়ে বসে আছে সোহাগী। কালো গড়ন সমর্থ যুবক   সুজন দেউড়ি,  জন মজুরি খাটতে গেছে সিদ্ধেশ্বরীতে। সকালে সোহাগির নৌকোয়   শীর্ণকায়া কালজানি পার হয়ে সাইকেলে  চেপে চলে গেছে সুজন। যাবার সময় বলে গেছে,  “ফিরতে সন্ধ্যে হবে, পার করে দিস সোহাগী”। তাই সন্ধ্যে নামতেই, যারা ওপারে যাবার, তাদের সবাইকে বলরাম ঘাটে পৌছে দিয়ে  খালি নৌকো নিয়ে আবার এপারে ফিরে এসেছে সোহাগী। সুজনকে বলরাম ঘাটে নিয়ে যেতে হবে যে।

কৈশোরে উজ্জল শ্যামবর্ণা সোহাগী রোদে পুড়ে পুড়ে  তামাটে বরণ ধারণ করেছে রামকিঙ্করের ভাস্কর্যের মতো। কালজানি তাঁর কৈশোরের উচ্ছলতা নিংড়ে নিলেও   যৌবনের লাবণ্য এখনো কেড়ে নিতে পারে নি। হারভাঙা পরিশ্রমেও হার মানেনি তার নিটোল শরীর। বছরের পর বছর ধরে এ পথে কত মানুষকে  নিত্যদিন  পারাপার করে চলেছে  সোহাগী। ঘাটের কড়ি বুঝিয়ে দিয়ে সবাই চলে যায়,  যে যার মতো। কারো সময় নেই তাঁর সাথে একটু কথা বলার;  খোঁজ খবর নেয়া তো দূরের কথা!   দিনের ক্লান্তিতে হয়তো সে ইচ্ছে  উবেও যায় সবার। সবাই তখন ঘর মুখো। কেউ মজবে সিরিয়ালে আবার কেউ ছুটে চলেছে নাটাবাড়ি গঞ্জে লাল নীল ছাতার নিচে   এলইডি আলোয় বাবা লোকনাথের ছবিতে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে ছোট্ট টেবিল পেতে বসা লটারি কাউন্টারে নিজের ভাগ্য ফেরানোর হাতছানিতে। নৌকো বাইতে বাইতে সোহাগী শোনে ওদের কথা –  কাল ভানুকুমারীর ভূটভূটি চালক জব্বার আলী নাকি দশ লাখ টাকা পেয়েছে “ইভিনিং ডিয়ারে”! মাত্র তিন নম্বরের জন্য ছিটকে  গেছে বুদারু।  বুদারু কপাল চাপরায়! আজ সে নয় নম্বরে খেলবে। খাপইডাঙার বাজারে দুধ বিক্রি করে সাইকেলে খালি ড্রাম চাপিয়ে চাড়ালজানি ফিরছে  নিরু ঘোষ।  নৌকোয় উঠে  বসে নিরু। মাধব বলে ওঠে, “ও কাকা কাগজে দেখলাম কাঁকরিবাড়িতে ভেজাল দুধের করবারি ধরা পড়েছে।  দেখেছো তুমি খবরটা?”  ঝাঁজালো স্বরে  উত্তর দেয় নিরু, “শোন মাধব, ছানা কেটে তবে দাম দেয় খাপইডাঙার“মিষ্টি মুখের” মালিক সুদেব হালুই। আমরা দাদনে করবার করি”। আমাকে ওসব কথা শোনাতে আসবি না। তোর কাকা নরেশের  মতো আমি বালু বজরি চুরি করে ধরা পড়ে পঞ্চায়েতের কাছে নাক ছেচুর দিয়ে খালাস পাই নি”। চুপ করে যায় বেচারা মাধব। এমন কথা অনেক শোনে সোহাগী, প্রতিদিন।  কেউ বলে বৌয়ের বেআদপীর কথা।   আবার কেউ বলে সোনাপুর হাট থেকে গরু তাড়িয়ে  পকেট রুটে বালাভূত বর্ডারে পৌছে দিয়ে নবিরুদ্দিনদের   হাজার হাজার টাকা কামানোর  গল্প।  কেউ শোনায় জালধোয়া ঘাটে রায়ডাকের চরে   গাঁজা চাষে কিশোরী মোহন আর আকবর আলীদের ফুলে ফেপে ওঠার কাহিনী। এরই  মধ্যে দুএকটি চোখ  ইশারার  জরিপ করে সোহাগীর  শরীর –  বেশ বুঝতে পারে সোহাগী। বৈঠা হাতে চোখ বড় করতেই ওরা দৃষ্টি ফেরায় আকাশে। নদী পথের নিত্যযাত্রী এই সব মুখই সোহাগীর ভীষণ পরিচিত।  সুজনই  শুধু  ব্যতিক্রম।  কখনো সে নিজের কথা বলে না। বরং সোহাগীর সুখ দু:খের খবর নেয় মাঝে মাঝে। সুজন তাঁকে পছন্দ করে বেশ বুঝতে পারে সোহাগী। একবার গদাধরের মেলা থেকে সিটি গোল্ডের এক জোড়া বালা নিয়ে এসেছিল সোহাগীর জন্য। লগি টানা শক্ত হাতে সোহাগী ওসব পড়ে না। সুজন বলেছিল “রেখে দে,  বেড়াতে গেলে পড়বি”। ভুচুংমারির ঘাট ছেড়ে   কোথায় কার সাথে  বেড়াতে যাবে সোহাগী,  ভেবে পায় নি। তবু রেখে দিয়েছিল।   ফেরায় নি,  সুজন ব্যাথা পাবে বলে।

বলরাম ঘাটের বালিয়াড়িতে বাঁশের খুটি, কাশের বেড়া আর ছনের ছাউনি দেওয়া সোহাগীদের  ছোট্ট  দুটো কুড়েঘর । কাজ থেকে ফেরার পথে  কোন কোন দিন সোহাগীদের ছনের ঘরে বালুর ওপর পাতা খাটিয়াতে গিয়ে বসতো সুজন।   বাবা   পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায়।    এক ঘরে অসুস্থ বাবার পরিচর্যায় দিন রাত কেটে যায় তার মা সোনামনির। অন্য  ঘরে রাত কাটে সোহাগীর।

সুজনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া  ছেলে রাঘবকে খুঁজে পেত সোনামণি। পড়শীদের তাড়নায় বাধ্য হয়ে পাগল ছেলে রাঘবকে তুফানগঞ্জের মানসিক হাসপাতালে রেখে এসেছিল সোনামণি। বছর না ঘুরতেই সেখান থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় রাঘব। থানা পুলিশ করে কোন লাভ হয় নি। গাঁ গঞ্জ রেলস্টেশন মেলা উত্সবে ভবঘুরেদের ভিড়ে অনেক খুঁজেছে হারিয়ে যাওয়া  ছেলেকে।   খোঁজ পায় নি। কেউ বলে মরে গেছে,  কেউ বলে কিডনি কাটার দল পাচার করে দিয়েছে  ভিন রাজ্যে। আশা ছাড়ে নি সোনামনি। বলিয়াড়ির পর্ণ কুঠিরে  লণ্ঠনের মৃদু আলোয় আজ সুজন আর রাঘব একাকার  হয়ে যায় সোনামনির ঝাপসা দৃষ্টিতে।   আপন মনে সোনামণি বলে চলে,  “ওর   ঠাকুর্দা রূপকুমার চৌধুরী  ছিল রাজার ঘাটিয়াল। নিজেদের অনেক নৌকো ছিল, মাঝি ছিল, চাষের জমি ছিল বিস্তর। খাওয়া পড়ার কোন অভাব ছিল না। ভাঙনে বাড়ি ঘর  জমি জিরেত সব গেছে কালজানির পেটে”।  বিয়ের পর শশুরের মুখে শুনেছে নাগুরহাট জঙ্গল থেকে শিকার করে ফেরার পথে কালজানির ঘাটে মেজ রাজকুমারী নাকি একবার তাঁর নৌকোয় উঠেছিলেন। তুফানগঞ্জের নায়েব কদিন পর একটি মোহর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রূপকুমারের কাছে।   মাঝ পথে ছন্দ কেটে দেয়  সোহাগী – “এ সব কথা আর কতো বলবে মা ? এ সব শুনতে  আর ভাল লাগে না আমার”। এবার থামো। সোনামণি চুপ করে।  অতীত গরিমা আর বিস্মৃত  বৈভব,   সোহাগীর   ঘটমান বর্তমানের ক্ষতে প্রলেপ জমাতে পারে না।  মায়ের স্মৃতিচারণে বিরক্ত হয়।  সুজনের জন্য চা করে আনে সোহাগী। মেয়েকে খুশি করতে  এবার সুজনের কথা জানতে চায় সোনামনি। “বলো বাবা তুমি কেমন আছো?”  মৃদুভাষী সুজন বলে,  “তিন তিনটে বোনের বিয়ে দিতে জমি গুলো বেচে  বাবা নিস্ব: হয়ে যায়। সামান্য বেতনে  চিলাখানা সমবায় সমিতিতে ফায় ফর্মাস খাটতো। ওতে কি আর সংসার চলে! আমি  সিকস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি।  গ্রামে কাজ নেই। বছর কয়েক আগে  মারুগঞ্জের  মজিদ ভাই আমাদের চোদ্দ জনকে নিয়ে গিয়েছিল রাজস্থানের মাকরানায়। পাথর খাদানে কাজ করতাম সাড়ে পাঁচশো  টাকা দিন হাজিরায়। ভারী কাজ,  তবে দিনে চার পাঁচ ঘণ্টা মাত্র। থাকার জায়গা আর দিনের খাবার ফক্টরি থেকেই মিলতো। ছয়/সাত  হাজার টাকা করে বাড়িতে পাঠাতাম প্রতি মাসে।  বেশ  ছিলাম মাসি। বাবা অসুখে পড়লো। মায়ের কান্নাকটিতে কাজ ছেড়ে চলে এলাম। এক ছেলে হওয়ার বিড়ম্বনা অনেক! পেটে জল এসে গিয়েছিল। বাঁচাতে পারলাম না বাপটাকে। খাব কি?  পঞ্চায়েতকে আগাম দিয়ে একশো দিনের কাজ নিয়েছিলাম। খেটে মরি আমি,  আর ও আরো চায়! ছেড়ে দিলাম। এখন রাজমিস্ত্রীর যোগানদারের কাজ করে দুটো খেয়ে বেঁচে আছি”।  সোহাগী জানে এ সব কথা।  তবুও সে  সুজনকে ভালবাসে।

সুজন বলে, এবার  ভিটেটা বেচে দিয়ে  মা কে সঙ্গে নিয়ে আবার রাজস্থান ফিরে যাবো।  সুজনের কথায় চমকে ওঠে সোহাগী। এ কি বলছে সুজন! মূহুর্তে বিদ্যুত্‍  তরঙ্গ বয়ে যায় তাঁর সর্বাঙ্গে। এই মধ্য ত্রিশে সুজনকে নিয়ে একটু একটু করে গড়ে তোলা তার স্বপ্নের  নিলয়টি    এক নিমেষে ভেঙে চুরমার  হয়ে যায় কালজানি গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া অজস্র জনপদের মত। শৈশবে রাসের মেলায়   নাগড়দোলায় চেপে আকাশ থেকে নিচে ঝাপ দেয়ার শূন্যতার স্মৃতিতে  জড়িয়ে যায় শরীর। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না সোহাগী। খুব ছোট থাকতে বাবার মুখে শুনেছিল এক প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণি ঝড়ের কথা। সেবার নাকি হাতির শুরের মতো কালজানির জল ফুলে উঠে আকাশ ছুয়েছিল। ঝড়ের তাণ্ডবে কালজানির ঘাটে বাঁধা নৌকো গুলো উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল দূরের বাঁশ বনে। বার বার কেন সেই সব স্মৃতি ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে। সে যে অনন্ত বাঁধনে বাঁধা পড়ে আছে ভূচুংমারির ঘাটে। নিরাবলম্ব মা আর জরাগ্রস্ত বাপটাকে ছেড়ে যাবে কোথায় ?  হটাত্‍ নিরবতা ভাঙে সুজন। মাসিমা  উঠি আজ তাহলে ।

“ওকে একটু এগিয়ে দিয়ায়  মা”,  বলে সোনামণি। লন্ঠনের আলোয় অন্ধকার বলিয়াড়ি ভেঙে সোহাগী এগিয়ে যায়  সুজনকে নিয়ে। তুমি  সত্যিই চলে যাবে সুজন দা ? প্রশ্ন করে সোহাগী। তুই যাবি আমার সাথে সোহাগী? থমকে যায় সোহাগী, উত্তর দিতে পারে না।    ওড়নায় মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কান্না থামাতে সোহাগীকে বুকে জড়িয়ে ধরে সুজন। কাছে দূরে পাকুড় গাছটার উপর রাত জাগা পাখিদের সমবেত  কলরবে  চাপা পড়ে যায় সোহাগীর কান্নার গুমরানো আওয়াজ। বলরাম  ঘাটের নিকষ কালো  অন্ধকারে ছায়া মূর্তির মতো একটু একটু  করে  বিলীন হয়ে  যায় পলাশতলির সুজন দেউড়ি।

অরবিন্দ ভট্টাচার্য। লেখক। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কোচবিহার।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

সুমন্তদা ও সাইকোভেগাসের গল্প

সুমন্তদা ও সাইকোভেগাসের গল্প

গোয়েন্দা সুমন বাবু শুধু গোয়েন্দা নন। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী,গোয়েন্দা বিচক্ষণ ব্যক্তি।তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আপডেট সংবাদ…..

এই আমি

এই আমি

ছোটবেলায় একবার রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা হয়েছিল। মেলা-বান্নিতে ধবধবে শঙ্খসাদা তুলার দাড়িগোঁফে আবৃত মাথাঝুলানি রবীন্দ্রনাথ বিক্রি…..