সুমনদা ও মাসির কথা
সুমনদা বললেন,আমরা চারজন বন্ধু ভবরঞ্জন,অসীম,তারকেশ্বর ও আমি দীঘা বেড়াতে গেলাম কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস…..
“তোর ছেলের রেজাল্ট কেমন হল!“ রান্না করতে করতে পদ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন সুপ্রিয়া। দিনের বেশীরভাগ সময়টা একাই কাটে এখন। ছেলে মেয়ে দু জনেই বিদেশে সেটলড। স্বামী মারা গিয়েছেন বছর পাঁচেক হল। নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে সুপ্রিয়ার একার সংসার। রিটায়ার্ড জীবনে এমনিতেই সময় কাটানো অসুবিধে, তার মধ্যে একা সংসার। মাঝে মধ্যেই খুব কান্নাকাটি করেন তিনি। ছেলে মেয়েদের ওপর অভিমান করেন। এই নিঃসঙ্গ সময়ে একমাত্র সঙ্গী বলতে পদ্মা। ঘরের কাজ, রান্না বান্না সবই করে। সারাটা দিন এখানেই কাজ করে। সম্পর্কগুলো কেমন করে সময়ের সাথে বদলে যায়! এই যেমন পদ্মা এখানে বছর দশেক কাজ করছে। যখন অফিস ছিল,সবাইকে নিয়ে একটা ভরা সংসার ছিল তখন পদ্মাকে শুধু একজন কাজের মেয়ে বলেই মনে হত। এখন এই একা সংসারে পদ্মা অনেকটা অক্সিজেনের মত। একদিন পদ্মা না এলেই সুপ্রিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসে।
“ দিদি তুমি একটু দেখ ওকে! নইলে আমার ছেলেটা ভেসে যাবে! ওকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় গো! ” পদ্মার হাতে হাত রাখলেন সুপ্রিয়া। নিজের সন্তান কে নিয়ে তো ওনারও একই রকম চিন্তা ছিল। এরপর একসময় সেই সন্তান রা স্বনির্ভর হয়, ওদের নিজেদের পৃথিবী গড়ে ওঠে। “ দিদি কি ভাবছ! “সুপ্রিয়া হাসলেন, “ না কিছু না! তুই পাঠিয়ে দিস তোর ছেলে কে কাল থেকে। “
বিকেল হলেই বাড়িতে যেন একটা বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পদ্মা আবার পরের দিন সকালে আসে। সিরিয়াল গুলো দেখতেও আজকাল ভালো লাগে না। অগত্যা অনলাইনে নানারকম রান্নাবানা শিখে প্রত্যেকদিন রাতে একটা নূতন আইটেম বানান। রান্না র সখ সুপ্রিয়ার অনেক দিনের পুরোনো। কতক্ষণ আর নিজে নিজে কথা বলা যায়।
সেদিন রাতে হঠাতই একটা ফোন এল, এ সময়ে সাধারণত ফোন তেমন আসে না। ইউ এস থেকে ফোন আসে সকালের দিকে। “ হ্যালো, চিনতে পারছিস! আমি সঙ্গীতা। “সুপ্রিয়ার ছেলেবেলার বন্ধু সঙ্গীতা। একদম পাশাপাশি বাড়ি। শান্তিনিকেতনেই থাকেন। যোগাযোগ আছে কিন্তু অনিয়মিত। “ হ্যাঁ বল, কেমন আছিস! ছেলে বৌমা কেমন আছে! “ভালোই আছে, এখন ত ওরা সিঙ্গাপুরে থাকে। শোন না আগামী বুধবার আমার নাতনির অন্নপ্রাশন, তুই এলে খুব ভালো লাগবে! “কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনে! সেখানে গেলে এই একঘেয়েমি টা তো কিছুটা কাটবে!“ অবশ্যই যাব! কতদিন যাই না শান্তিনিকেতন!”
শান্তিনিকেতনে এলেই একটা মন ভালো করা অনুভূতি হয় সুপ্রিয়ার, সেটা যে কেবল বাপের বাড়ি বলে হয় তা নয়, জায়গাটার মধ্যে একটা অসাধারণ স্পিরিট আছে। সুসময় সুপ্রিয়াকে দেখে এগিয়ে এলেন “কোন অসুবিধে হয় নি তো! “না, ট্রেন টা যা একটু লেট ছিল!” সুসময় সুপ্রিয়ার ভাই।
বাড়িটা সেই একই রকম রয়ে গেল। যদিও সুসময় পেছনে একটা বড় বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে কিন্তু সামনের অংশ টা একদম আগের মতই আছে। মা এর একটা বড় বাগান ছিল। বিকেল হলেই সেখানে চলে যেত সুপ্রিয়া। গান হত, আড্ডা হত। সামনের ঘর টা দেখলে খুব বাবার কথা মনে পড়ে সুপ্রিয়ার। বাবা ওখানে টিউশন পড়াতেন, সে কত ছাত্র। এখানে এলে গলা বুজে আসে, আরও খারাপ লাগে ইউনিভারসিটিতে গেলে। সেখানেই প্রতুলের সাথে প্রথম দেখা সুপ্রিয়ার। জীবনের সবচাইতে সুখের সময়। বিশ্বভারতীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে সেসব স্মৃতি। ওদের প্রায় সাত বছরের প্রেম তারপর ত্রিশ বছরের দাম্পত্য। জীবনের অজস্র ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গোটা সময়টা এক নিমেষেই যেন কেটে গেল। কত প্ল্যান ছিল দুজনের। রিটায়ারমেণ্টের পর শুধু ঘুরবে দু জন। আর সঞ্চয়ের চিন্তা করবে না। অনেক হয়েছে দায়িত্বপালন, এবার শুধুই জীবনকে উপভোগ করার সময়। কোথায় কি! ফাঁকি দিয়ে লোকটা চলে গেল! “কেমন আছ বৌদি” শতরূপা, সুপ্রিয়ার ভাই বৌ। প্রথম দিকে ওনার সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ ভালই ছিল, তারপর পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলায় সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল। মাঝে তো অনেকদিন কথাবার্তাও বন্ধ ছিল। এখনও শীতলতাটা রয়ে গিয়েছে। “আমার চলে যাচ্ছে, তুমি কেমন আছ। “ ভালই! কিন্তু টুকি টা কে নিয়ে টেনশনে আছি, তিরিশ বছর হয়ে গেল এখনও বিয়ে করতে চাইছে না! তুমি একটু বুঝিয়ো তো! তোমার কথা যদি শোনে! “ হ্যাঁ সে বোঝাব! আজকালকার ছেলে মেয়ে! ওদের কি আর বোঝানো যায়!“তা যা বলেছ! চল কথা পরে হবে। আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
টুকি কলকাতায় সেক্টর ফাইভের একজন আই টি প্রফেশনাল। জীবন নিয়ে ওর ভাবনাচিন্তা গুলো একদম অন্য রকম। যেমন বিদেশ যাওয়ার প্রচুর সুযোগ আর প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও ও বিদেশে যেতে চায় না। সুযোগ পেলেই লেখালিখি করে। চাকরি টা যে ও মন থেকে করে তা নয়! অন্য কোন অপশন নেই বলে করে। উইকেনডে বাড়ি চলে আসে টুকি। বলে যে শান্তিনিকেতন ছাড়া অন্য কোথাও ওর মনের পুষ্টি হয় না।
দিনটা গল্পে গল্পে দিব্যি কেটে গেল। বহুদিন পরে পাড়ার সকলের সাথে আড্ডা, গান। “কেমন আছ পুসুন!” বহুদিন বাদে এই ডাকটা শুনল সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়া পেছনে তাকালেন। টুকি ওকে এই নামেই সম্বোধন করে। ছোটবেলায় যখন কলকাতার স্কুলে পড়ত তখন টুকি সুপ্রিয়ার বাড়িতেই থাকত। সুসময়ের চাকরি ছিল লখনউ তে। টুকিও পুসুন বলতে প্রায় পাগল ছিল, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে সম্পর্কে একটা দূরত্ব আসে। টুকিও লখনও চলে যায়। “আমি তো দিব্যি আছি। তুই বেশ ডাকাবুকো হয়ে গিয়েছিস যে! “টুকি হাসল“ তা বটে! তুমি আমাকে আর পাপন কে ক্যারাটে তে ভর্তি করিয়েছিলে মনে আছে! “অনেকদিন পর এমন কারোর সাথে দেখা হলে সব স্মৃতিগুলো মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে। “চল! জার্নি করে এসেছিস। রাতে গল্প করা যাবে।”
কোপাই। কত ঘটনার সাক্ষী যে তার হিসেব নেই। নদীরা এমনি হয়। সুপ্রিয়া কাল ফিরে যাবেন কলকাতায়। আবার সেই একাকীত্ব। পদ্মার ছেলেটা আছে, ওকে নিয়ে একটু ব্যস্ততা থাকবে। কিন্তু মনের কথা বলার লোক কই! “কি পুসুন! এখানে কি করছ। মা ডাকছে তো তোমায়! “এই হাঁটছি! খুব ভালো লাগছে জানিস! এখানে থেকে যেতে পারলে বেশ হত! “তা বেশ তো! এখানেই থেকে যাও না, ওখানে তো তুমি একদম একা। এখানে তাও মা বাবা আছে! “এই সদবুদ্ধি অনেকেই দিয়ে থাকে, কিন্তু সেটা হয় না। এত কথা আর বুঝিয়ে বলতে ইচ্ছে করে না সুপ্রিয়ার। “ না ফিরতে তো হবেই। উদ্দেশ্যহীন জীবন। যতদিন আছি কেটে যাবে। “তোমার এমন কেন বল বল তো! তোমার মত বয়সে লোকজন কি সব করে বেরোচ্ছে আর তুমি এমন পেসিমিস্টিক হয়ে যাচ্ছ। “সুপ্রিয়া একটু ঘাবড়ে গেলেন যেন। “কাম অন্ পুসুন! পাপন বলে তুমি সারাক্ষণ নাকি ডিপ্রেশনেই থাক। এমন কেন করছ! “কি আর করব রে! দুজন বাইরে। তেমন কোন সোসাইটি নেই আমার। কি করে সময় কাটে বল তো! “স্টার্ট আপ করবে! লোক পাচ্ছি না। মাথায় একটা ভালো প্ল্যান রয়েছে!”
টুকি এমনই। ঝড়ের মত। কি যে বলে তার কোন ঠিক নেই। প্রথমটায় সুপ্রিয়া সোজাসুজি না বলে দিয়েছিলেন। এ বয়সে আবার নূতন ঝামেলা, কেউ যেচে নেয় নাকি! তার থেকে একাকীত্ব শতগুণে ভালো। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে বেশ শান্তিপূর্ণ জীবনই কাটাচ্ছিলেন। নিঃসঙ্গতা আগের মতই ছিল, তবে নিজেকে তিনি বুঝিয়েছিলেন আজকের সময়ে এটা একটা সাধারণ সমস্যা। মানিয়ে নেওয়াই ভালো। হঠাৎ একদিন আবার সেই ঝড় উপস্থিত। টুকি কে সুপ্রিয়া কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না। টুকিও নাছোড়বান্দা। “পুসুন! তুমি শুনে দেখ, প্ল্যান টা একঘর। আচ্ছা তুমি প্ল্যান টা শোন। তারপর ডিসিশন নিও। “শেষ পর্যন্ত সুপ্রিয়া প্ল্যান টা শুনতে সম্মত হলেন। টুকিও প্রায় মুখস্থের মত প্ল্যান টা বলে গেল। সুপ্রিয়া খুব একটা প্রভাবিত হলেন না। সুস্বাদু রান্নার অনলাইন বিজনেস। মানে অনলাইনে অর্ডার নাও, তারপর তা পাঠিয়ে দাও কাস্টমারের ঠিকানায়। আজকাল এমন কাজ বেশ কিছু হচ্ছে। প্ল্যান টা মন্দ না। কিন্তু এখন এত সব কাজের ভার নেওয়া একপ্রকার অসম্ভব। টুকির বয়স কম। ও চাইলে এসব করতেই পারে।
“ আচ্ছা তোর ফান্ড লাগলে আমি ইনভেস্ট করছি। কিন্তু আমায় বিজনেসে থাকতে রিকোয়েস্ট করিস না। “ আমার ফাণ্ড আছে পুসুন। আমি চেয়েছিলাম তুমি থাক। আমি আর তুমি মিলে একটা ভাল কিছু করি।”
সুপ্রিয়া একটু ইমোশনাল হয়ে গেলেন। হঠাৎ মনে হল ক্ষতি তো নেই কিছু। ব্যবসাটা করলে টুকি এখানেই থাকবে। হাতে কিছু এনগেঞ্জমেনটও থাকবে। খারাপ তো কিছু হবে না। হয়ত একটু দায়িত্ব হয়ত নিতে হবে। সিরিয়ালের নেশাটা ছাড়তে হবে। কনস্ট্রাকটিভ কিছু তো হবে। পাশাপাশি রান্নার সখ টাও ষোলোআনা পূর্ণতা পাবে।
আছে, আমি থাকব কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে! “টুকির চোখ মুখ যেন হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। “ কি শর্ত বল! “ তোকে এখানেই থাকতে হবে! “টুকি জড়িয়ে ধরল সুপ্রিয়াকে।
হ্যাঁ তো করে দিলেন। কিন্তু একটা স্টার্টআপ শুরু করা কি আর মুখের কথা। অফিস ভাড়া নেওয়া, রিক্রুট করা, মার্কেটিং রাজ্যের সমস্যা। কিছুদিন যাওয়ার পর সুপ্রিয়া দায়িত্বগুলোকে ক্রমশ উপভোগ করা শুরু করলেন। এ যেন একটা নূতন জগৎ। অনলাইনে অর্ডার নেওয়া, এমপ্লয়িদের কোঅরনিডেট করা ইত্যাদি কাজগুলোকে ক্রমশ ভালোবেসে ফেললেন সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়া এই ব্যবসার সাথে একদম জড়িয়ে গেলেন। দুজনের যুগলবন্দীতে ব্যবসা এগোতে লাগল। যে সুপ্রিয়ার সময় কাটত না এখন তার সময় বের করতে অসুবিধে হয়। লাভও হচ্ছে বেশ ভালো। কাস্টমারও বাড়ছে ধীরে ধীরে। ব্যস্ততা এমন একটা আশ্চর্য প্রহেলিকা যা না থাকলে ওর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী বোঝা যায়।
কিছু মাসের মধ্যেই স্টার্টআপ টা বেশ পপুলার হয়ে গিয়েছে। দু এক জায়গা থেকে সুপ্রিয়াকে ইন্টারভিউ এর জন্যও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। “থ্যাঙ্ক ইউ টুকি!” টুকি হাসল “ থ্যাংকস টা পাপন আর তন্বীর প্রাপ্য!”
সুপ্রিয়া ভুল বুঝেছিলেন নিজের ছেলে মেয়েদের। একটা তীব্র অভিমান তৈরি হয়েছিল। সত্যি আজকের প্রজন্ম কে নিজের কাছে ধরে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু ওরা যে মা বাবার কথা ভাবে না তা হয়ত ঠিক নয়। এই স্টার্ট আপের কথা প্রথম পাপনই টুকি কে বলে। তিনজনে মিলে ফান্ড ডেভেলপ করে। প্ল্যানিং করে। আর সবশেষে টুকির ওপর দায়িত্ব পরে সুপ্রিয়া কে রাজি করানোর। সব অভিমান আজ নিঃশেষিত, এই বয়সেও একটা প্রচণ্ড উদ্যম অনুভব করছেন তিনি। সত্যি বয়স শুধুই একটা সংখ্যা।
সুমনদা বললেন,আমরা চারজন বন্ধু ভবরঞ্জন,অসীম,তারকেশ্বর ও আমি দীঘা বেড়াতে গেলাম কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস…..
গোয়েন্দা সুমন বাবু শুধু গোয়েন্দা নন। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী,গোয়েন্দা বিচক্ষণ ব্যক্তি।তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আপডেট সংবাদ…..
মফিজ সাহেব বসে আছেন। অভি মনে মনে ভাবে হয়তো তিনি বড় ধরনের কোনো সমস্যার…..
অসীম ও মাসির কথা সুমনদা বললেন,আমরা চারজন বন্ধু চিনু, ভব,অসীম,তারকেশ্বর ও আমি দীঘা বেড়াতে গেলাম…..