শ্যামাতন্বী

অনসূয়া যূথিকা
ছোটগল্প
Bengali
শ্যামাতন্বী

মধ্য মাঘের হিম হিম হাড় হিম করা এক সন্ধ্যা। কুয়াশার চারদিক আচ্ছন্ন, একনহাত দূরেও দৃষ্টি চলেনা৷ কথা বলতে গেলে মুখে যেনো উনুন জ্বলছে, এমন বোধ হচ্ছে। তাপে না, ধোঁয়াতে। ছেলেবেলায় যেমন ছোট সব কুঁচোরা মিলে কার মেখে কতোটা ধোঁয়া বেরোয় তা পরীক্ষা করে ;তেমন সময়! চট্টগ্রামে সাগর আছে বলে ঠান্ডা কম বলে অনেকে ভাবেন৷ কিন্তু তারা জানেন কী, পাহাড় যেখানে একজোট হয়ে সংঘ বাঁধে সেখানে ঠান্ডা আর কোন এলাকার মতো নয়৷ ঐরকম ঠান্ডায় যখন জিভের ডগা জমে যায়, আমার জিভ বের করে কুয়াশা খাচ্ছিলাম!

তখনই দেখি তাকে! মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই বেশ মিষ্টি লাগলো। বছর চৌদ্দ বয়স হবে বড়জোর, শ্যামাঙ্গী। তবে ত্বকের জেল্লায় যে কোন হেমাঙ্গি লজ্জা পাবেন।

কালীদাসের ভাষায় তন্বী শ্যামা শিখরি দশনা পক্ক বিম্বাধরোষ্ঠি.. ইত্যাদি।

যদিও তখন সেই প্রাক যৌবন ছুঁই ছুঁই বয়সে এমন শ্লোক কেইবা মনে রাখে। মেয়েটা বাঙালীর চোখে সেই হিসেবে প্রথাগত সুন্দরী নয় বটে, কিন্তু তাকে দেখে সৌন্দর্য্যের সব সংজ্ঞা গুবলেট হবে নিশ্চিত।

বাংলাদেশের নামী এক শিশু সংগঠনের চট্টগ্রাম মহানগর শাখা, যাচ্ছে বিজয় দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে রাঙ্গুনিয়ায়। এখন যাকে চুয়েট বলে সেটা তখন কেবলই প্রকৌশল কলেজ। ছাত্র সংগঠনের আমন্ত্রণে শিশু কিশোর সংগঠনের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে অনুষ্ঠান সাজানো হলো মনোমুগ্ধকর ভাবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তুতি হিসেবে পুরো অনুষ্ঠানটাই বারবার মহড়া দেয়া হয়েছিল। মোটামুটিভাবে সবারই সব কিছু মুখস্ত বলা যাবে। কার কখন একক সঙ্গীত কার একক নৃত্য কার বাঁশি করবে কার আবৃত্তির সাথে সঙ্গত সব ঠিক করা শেষ।

নির্দিষ্ট দিনে বেশ হৈ হুল্লোড় করে সবাই বাসে করে রওনা দিল। পৌঁছানো মাত্রই সবাই ছুটলো স্টেজের পিছনের  গ্রীনরুমে। আর এসব প্রোগ্রামে যা ঘটে কারো মা নাচের মেয়েদের শাড়ি পরাতে ব্যস্ত তো  কারো বোন করছেন চুলের সাজ। এর মেকাপ বক্স, তার গয়না, ওর চুড়ি এভাবেই চলছে মিলিয়ে মিশিয়ে সাজগোজ। আমার মা আমাকে কস্টিউম পরিয়ে বাকীদের সাজাতে ব্যস্ত।

সেই নতুন আসা মেয়েটি কিন্তু এই দলে নাই। সে সাজছে বটে, সাজাচ্ছেন সঙ্গে আসা তারই বড়  বোন। ততোক্ষণে জানা গেলো,এই এলাকারই  এক বড়সড়  নেতার আত্মীয় তারা। কলেজের প্রোগ্রামের আকর্ষণ বাড়াতে এই মেয়ে নাচবে। তখনও আসলে আমরা কিছুই বুঝিনি, বুঝবার মতো বয়সও না এটা। নিজেরাই নিজেদের আনন্দে বুঁদ ছিলাম। প্রোগ্রামের জন্য উত্তেজনাও কাজ করছিল সেই উঠতি বয়সে। নেতার আত্মীয় শব্দটার ভিতরগত মানে বুঝিনি।

মোটামুটি সবাই তৈরী, শেষ মুহূর্তের মেকাপ টাচআপ চলছে। কারো চুলে ফুল পাতা বসানো চলছে তো কারো ঘুঙুর পরতে ফের গলদঘর্ম দশা। এরিমধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো, ছেলেমেয়েরা একেক করে মঞ্চে উঠছে। করতালি আর ওয়ান্স মোরের উল্লাসে ভাসছে মাঘের সন্ধ্যা উৎরানো রাত।

একটা সময় সেই মেয়েটি রিঙ্কু যার নাম তার পালা এলো। কী ভীষণ সুন্দর যে লাগছে তাকে। খুবই প্রচলিত একটা নজরুল সঙ্গীতের সঙ্গে নাচলো সে, দর্শকের উন্মত্ততা গ্রীন রুমে বসেও টের পাচ্ছিলো সকলেই। একবার দুইবার তিন তিনবার মেয়েটা নাচলো, দর্শকের উল্লাস তবু কমে না। স্টেজের উপরে কে যেনো একটা স্টিলের থালা বসিয়ে দিয়েছে। তাতে টাকার স্তুপ জমে গেছে!!! মফস্বল না গ্রামই বলা চলে কিন্তু সেখানে পড়তে আসা ছেলেদের সাথে বাইরের প্রচুর মানুষ ছিলেন, যারা রিঙ্কুর নাচ দেখে খুশি হয়ে টাকা দিয়েছেন তাকে৷ আমাদের অভিজ্ঞতার পারদ চড়ছিল সত্যি, এরকম আগে কখনো জানা হয়নি তো!!

এরপর কয়েকটা গান, কবিতার পরে আমার পালা এলো। ওয়ান্স মোর ধ্বনি শুনেছি বটে তবে সেরকম নয় যেমনটা রিঙ্কুর বেলায় ছিল। তিল্লানার বোলই আমার  কান ভরানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। ভূমি প্রণাম করে নাচ শুরু করলে আমার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান নাচেই থাকে। শেষ করে,

করজোরে নমস্কার জানিয়ে ; নেমে এসেছিলাম মঞ্চ থেকে।

স্টেজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে যেতে মাথাটা একটু টলে গেলো কেন কে জানে। নেমে এসে শাল জড়িয়ে খেতে কোনক্রমে মেকাপ একটু তুলেই খেতে ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। হাতে আলতা থাকায় চামচে দিয়ে খেতে হচ্ছিল, মনযোগ সেদিকেই ছিল। রিঙ্কু যে তখন কোথায় বা কি করছে তা আর দেখা হলো না। আমি জানতামও না যে সে আমাদের সঙ্গে নেই বা খায়নি৷

রিঙ্কু আর তার সঙ্গে আসা বোনটি তখন কলেজের নেতাদের মনোরঞ্জনের খোরাক জোগাতে ব্যস্ত!

রাত তখন প্রায় তিনটা কি সাড়ে তিনটা হবে। আমাদের দল নিয়ে বাস ছুটছে রাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে।

ফিরতি পথে রিঙ্কুকে দেখলাম তবে আগের সেই জৌলুশ হারিয়ে কেমন যেনো ম্রিয়মাণ। সে  আর তার বোন দেখি বসেছে আমাদের গ্রুপের ভীষণ জনপ্রিয় এক বাঁশীওয়ালা ভাইয়ের সঙ্গে । খুবই ক্লান্ত সবাই, বাসের সিটে গা ছেড়ে দিয়েছেন সকলেই প্রায়।  তবু টের পেলাম, রিঙ্কুআর তার বোনের সঙ্গে বেশ আড্ডা চলছে। সংগঠনের সভাপতি সহ আরো কয়েকজন ভাই জুটেছেন। এই গ্রুপটা আগে থেকে চেনেন এদের, এরাই সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন দুই বোনকে। কী সব টাকা পয়সার কথাও চলছিল ওদের।

আমাদের এই বাঁশিওয়ালা মাসুদ ভাই ভীষণ ফরসা ছিলেন।এইসব আড্ডার মধ্যে  রিঙ্কু দেখি তাকে মেকাপ করাচ্ছে আর তিনি মজা পেয়ে হাসছেন ।

এর কয়েকদিন পর রিহার্সালে দেখি রিঙ্কুকে নিয়ে খুব সমালোচনা চলছে। বড়রা ভীষণ বিরক্ত, বিব্রত!!

আমি মনে করার চেস্টা করলাম রিঙ্কুর সাজ!  তাকে শ্যামলা বলা হলেই সে তা  না, রঙটা কালোর দিকে না কালোই। কিন্তু তার জন্য তার সৌন্দর্য কমে নাই। কোমর ছাপানো চুল, বেণী করেছিল নাচের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। বাসন্তী রঙের জড়িপাড় কাতান শাড়ি , জড়োয়ার গহনা। অস্বাভাবিকতা কিছু মনে এলোনা। নাহ!! সে তার গায়ের রঙ ঢাকতে মেকাপ করে নাই, সেজেছিল মাত্র। তাতে তার রূপ খুলেছিলোই বটে যদিও ফেরার পথে তাকে ভীষণ ক্লান্ত লেগেছিল।

সেই সময়কার মন নিয়ে বুঝিই নাই, শাড়ি পরার ধরনের কারণে কেউ সমালোচিত কেন হবে!!  এখনও বড়দের সেই কথাগুলো কানে বাজে!  রিঙ্কুর নাচের ভঙ্গীমা, মূদ্রাতেও দোষ ছিল। পুরুষকে আহ্বান জানানো ছিল!  তাদের ভাষায় শরীর দেখানো!

আমি রিঙ্কুর শাড়ি পরা চেহারাটা মনে করার চেস্টা করি, চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ের শরীর কল্পনা করার চেস্টায় আকুল হই। কিশোরী শরীরে জড়ানো শাড়ি, মাদকতা আনার চেষ্টা ছিল কি!! জানিনা, আমি রিঙ্কুর নাচ দেখিনি কেবল জনতার আদিমতম তাড়না থেকে উৎসারিত উল্লাস ভরা চীৎকার শুনেছি। স্হানীয় নেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য কেবলমাত্র কিশোর কিশোরীদের নাচগান যথেষ্ট ছিল না। যেজন্য রিঙ্কু আর তার বোনকে আমাদের সঙ্গে আমাদের দলের করে নিয়ে যেতে হলো। পরে আরো বহু পরে অবশ্য জেনেছিলাম রিঙ্কুর সমস্ত খরচ এক নেতা বহন করেন এবং তিনি এরকম বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তাকে একেক সময় একেক অনুষ্ঠানের পিছনের কর্তা ব্যক্তিদের মনের খোরাক যোগান। তবে সেসব জানতে জানতে অনেক দেরি, তখন সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেছিলাম। তো আমাদের সংগঠনের কিছু বড়দের খুব রাগ হলো রিঙ্কুর উপরে, ফলত সংগঠন ভাঙলো। সব কিছুর দায় পড়লো রিঙ্কুর উপরেই।

রিঙ্কুর সেই অনুষ্ঠানে যাওয়া, তার অংশগ্রহণ, তার পারফরম্যান্স সবটাই দোষযুক্ত!

যদি তাই হয় তবে তার জন্য দায়ী কারা!  যারা শিল্পের মোড়কে আদিমতার আফিম নিয়ে গেলো তারা তো দেবতা না!

অনসূয়া যূথিকা। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। জন্ম ও নিবাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ