ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
প্রচণ্ড অস্হির হয়ে বিশ্রম্ভালাপ করছে এক নারী! ছানাকাটা জলের মতো আলোতে তার অবয়ব পরিষ্কার না। না পোশাকের রঙ না শরীরের। কেবল বোঝা যায় সে নারী! সে ফালাক! সে এক অপশক্তি!
মাংডাঙরির ব্যাটা তর চ্যাট মুই কাটি নিমো! বারোভাতারি ছিনালের বেটা, লোটি মাগির ছাও… এ সত্যি সত্যি এক নরক যন্ত্রণা, দুঃসহ দুঃস্বপ্ন!
মহল্লার সব কয়টা মসজিদ থেকে ফযরের আযান ভেসে আসছে৷ ভোরের আবছা আলোর সাথে পাঞ্জা লড়ে কাহিল সড়ক বাতিরা। শাহ আলীর মাজার থেকে এক নম্বর গোলচক্কর, ফের মাজার রোড, গাবতলী, বিরুলিয়া সব এলাকার সোডিয়াম আর টিউবের আলো ক্রমে ম্লান, আরো ম্লান হবে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম্ ধ্বনির সঙ্গে আবাসনের প্রায় সব ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠছে। কারো ঘরে আবার এইটাই আলো নেভানোর সময় বটে। প্রাজ্ঞজনেরা বলেন, রাত জাগে তিনধরনের মানুষ। রোগী, ভোগী আর যোগী। রোগী এই সমাজে প্রচুর, ভোগীও কিন্তু যোগী মেলে কচিৎ কদাচিত।
ফযরের আযানের আরো বহু আগে উঠে পড়েন আশ্রাফুজ্জামান। সত্যি বলতে গেলে তিনি সারারাত জেগেই কাটান। বয়সের কারণ সামান্য এক আধটু ক্লান্তি যা আসে শরীরে তা তিনি হালকা কোন গান বিশেষত পুরানো আশি বা নব্বই দশকের ব্যান্ডের গান বা হিন্দি সিনেমার গান শুনে কাটিয়ে নেন। অপেক্ষা করেন ফযরের আযান ভেসে আসবার, এর পরপরই তিনি ঘর ছেড়ে বেরোয়৷
মহল্লার কোন মসজিদে আশ্রাফুজ্জামান নামাজ পড়েন না। কলওয়ালা পাড়া থেকে হেঁটে হেঁটে শাহ আলীর মাজার পর্যন্ত আসেন রোজ, ওয়াক্তিয়া নামাজের জন্য। বহুবছর ধরে তার এটাই অভ্যাস গড়ে উঠেছে। একসময় স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকার মসজিদে নামাজ আদায় করতেন, ছাত্রজীবন থেকে এটাই তার নিজের এলাকা ছিল এখন আর নাই। যে কোন একটা মসজিদে নামাজ সারেন, সংলগ্ন কবরস্হান জিয়ারত করেন৷
কোন একটা হোটেল থেকে দুটো পরেটা কিনে বাসায় ফিরে একটা ডিমভাজি করেন আশ্রাফ, কাঁচা আকালির বদলে বগুড়ার গুঁড়োমরিচে। একটা সময় সে কেবল কাঁচামরিচের সালুন খেতো, সে কবেকার কোন বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে আছে আজ। সে একটাসময় ছিল যখন স্বপ্নে বিভোর থাকতো ভবিষ্যৎ সুখের। স্ত্রী জমিলা, দুই পুত্র পুতুলের মতো এক কন্যা পরিবার নিয়ে সাজানো ছবির মতো সুখের সংসার ছিল তার। সরকারি চাকুরে, বদলির চাকরি ছিল জমিলার। হঠাৎই জমিলার অনুপস্থিতির সুযোগে আশ্রাফের জীবনে আসে অনিন্দ্য সুন্দরী ফালাক! নিজেকে বহুবার বহুভাবে প্রবোধ দিয়ে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল বটে আশ্রাফ, কিন্তু বিধি বাম।
সে কখন কিভাবে দিনাজপুর পৌঁছে, কীভাবে বিয়ের আসরে বসে কীভাবে তার ভাইবোন এসে জড়ো হয়ে বিয়ে ভণ্ডুল করতে চায় সেসব তার মনে পড়েনা। কীভাবে নরম শান্ত স্বভাবের বউ জমিলার আলমিরাহ থেকে তারই শাড়ি গহণা কাপড় জামা নিয়ে সুটকেসবন্দী করে নিয়ে আসে নতুন বউয়ের জন্য, তাও অজানা।
কী এক ঘোরে, কী এক মায়াজাল টেনে নিয়ে গেছিল আশ্রাফকে সুন্দরী ফালাকের কাছে; তা সত্যি এক রহস্য!
ঢাকা শহরে ফিরে আসে আশ্রাফুজ্জামান, ফালাককে নিয়ে। একটা দিনের মধ্যেই যেনো দূরন্ত টর্পেডো বয়ে যায় তার জীবনে৷ জানতো না এটা স্রেফ হিন্দি সিনেমার টিজারের মতো, পিকচার আভি ভি বাকি থা! দিনাজপুর থেকে ঢাকা, দীর্ঘযাত্রার সারাটা ফালাকের বিষোদগার কুৎসা নিন্দা গালাগালি শুনতে শুনতে এসছে বাসের সবকয়টা মানুষ! কনে বউয়ের অপরূপ সাজে সজ্জিত এক দারুণ সুন্দর পরীর মতো মেয়ে আশ্রাফকে অবলীলায় গালাগাল করছে! সারা বাসের সবকয়জন মানুষের বোঝা কঠিন ছিল না সংসারটা কেমন হবে! সবাই জেনে গেছিল ফালাক কেন আশ্রাফকে পলিয়া বলে তাচ্ছিল্য করছিল, কেবল সে বাদে!
ফালাক সুন্দরী ছিল, মধ্য ত্রিশের ফালাক তখনো কেন কুমারী ছিল সেটা সে বেশ ভালো করেই জানতো, আশ্রাফকেও জানালো৷ সুন্দরী, শিক্ষিতা, আশ্রাফ খান্দান শরীফজাদি ফালাক কেন আশ্রাফকে বিয়ে করে সতীনের ঘর করতে এলো তা বোঝা গেলোনা৷ দুই-চার মাস বাদে হয়তো বোঝা কঠিন হতোনা কিন্তু সে ঘনঘন বাপের বাড়ি থাকতে লাগলো। বছর দুয়েক গেলো এরকমই, তারপরে তার জাঁদরেল চেয়ারম্যান বাপ এসে তাকে নিয়ে চলে গেলো!
একা মানুষের একার জীবন চলে যায় বেশ, নিস্পৃহ গতিতে। পেশা বলতে কিছু নাই আশ্রাফের, ঝড়ের পরে ঝড়ে কোন পেশাই তার গড়ে উঠলোনা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর আরো সব সনদ কোন কাজে লাগলো না।
অল্প কিছু জমানো টাকায় কৃচ্ছসাধনের জীবন তার। এর তার নষ্ট ঘড়ি, টিভি, পুরানো আমলের ট্রানজিস্টার, রেডিও মেরামতের কাজ করে সে। দুইরুমের ঘরে আদ্যিকালের পেল্লায় বর্মা সেগুনের পালঙ্ক, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল দেখে যদিও তার বংশ কৌলিন্য আন্দাজ করা যায় না।
এইসব আসবাব আশ্রাফের না, ফালাকেরও না৷ ছিল জমিলার, তার নানির বাপের বাড়ি থেকে দেয়া স্ত্রীধন। বড় আদর করে বংশের প্রথম নাতনিকে তারা দিয়েছিলেন, সেই আমলের সব ভারি ভারি গহণাসমেত। বাপ মা মরা জমিলাকে তার নানা নানীই বড় করেছিলেন তাদের বয়স্ক হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে! জমিলা এখন কোথায় আছে? কোথায় তাদের সন্তানেরা! আশ্রাফ জানে না, জানার উপায় নাই আর! ফালাক আর আশ্রাফ সুখে শান্তিতে বসবাস করুক, এই শুভ কামনা পাঠিয়েছিল জমিলা। সেই তার সাথে শেষ যোগাযোগ!
“আমার সাথে এক ডাক্তারের বিয়ের কথা ছিল! কতো এঞ্জিনিয়ার, উকিল ব্যারিস্টার বিয়ে করতে চেয়েছে আমাকে পায়নি৷ তোমাকে তো আমার বিয়ে করার কথাই না! আমি জানি তোমার সাথে সংসার হবেনা। কি হয় সেটা দেখার জন্য জানার জন্য বিয়ে করেছি তোমাকে সবার অমতে!”
সকাল সন্ধ্যা দুপুর রাত মাঝরাত ভোর সুবহে সাদিক সুবহে কাজিব একটানা বেজে চলতো ফালাকের মুখে মনে মগজে! সত্যি সে সুন্দরী ছিল, ছিল সত্যি সত্যি সকলের আরাধ্যা। মিথ্যা না, একেবারে নির্যস সত্য যে আশ্রাফের মতো দোজোবরের ঘরে তার আসবার কথা না। কিন্তু কেন এলো! এলো কেন? আর কেনোইবা গেলো!
ফালাক চলে গেলো! সংসার হবেনা জেনেও সে এসেছিল আশ্রাফের ঘরে বটে, কিন্তু সে থাকলোনা। বেশ কয়েকবার চলে যাচ্ছি চলে যাবো আর আসবোনা সংসার করবোনা ভাব দেখিয়ে সে একেবারে গেলো। ফালাকের বাবা এসে জামাতার কাছে কন্যার হয়ে ক্ষমা চাইবার পরে তাকে নিয়ে গেলেন। ফালাক তার সর্বস্ব, তার সবটুকু নিয়ে চলে গেলো। সত্যি সত্যি কি গেলো! গেলো কি?
ওঁম মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ
মাধ্বীর্ণ সন্তো ওষধী মধুনক্তো মুতোষসো
মধুমৎ পার্থিবং রজঃ মধু দৌরস্তনো পিতাঃ
মধুমানোর্নং বনস্পতিরং
মধুমাঁ অস্ত সূর্য্যঃ মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নং
ওঁম মধু ওঁম মধু ওঁম মধু!
যতোবারই পুরানো কথা মনে পড়ে ততোবারই আশ্রাফ স্নান করেন। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে গ্রেফতার হবার পর বাড়ি ফিরেই কেন যেন তার মনে পড়েছিল এই শ্রাদ্ধ মন্ত্র। বৃহদারণ্য উপনিষদের এই শ্লোক যদিও আরো বহু পুজা বা বিধিতেও ব্যবহৃত হয়। তবুও ইসলাম ধর্মাবলম্বী একজন পরহেজগার মুসলমান হয়েও আশ্রাফের এই শ্লোক জানা ছিল। সে জানে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকো মোট পঞ্চাশটি উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন। এটাই উদার ভারতবর্ষের উদাহরণ, ওহাবি সালাফি খারিজিদের কট্টরপন্থী ইসলাম এ উপমহাদেশের প্রকৃত চেহারা না।
ফালাকে আক্রোশ শান্ত করতে কী করতে হতো জানেন না আশ্রাফ, বহু ভেবেও কূল কিনারা মিলে নাই আক্রোশের কী কারণ! সংসার তাদের হলো না, শান্তিও মিললো না। ফালাক ও তার পরিবারের ইচ্ছে অনুসারে আশ্রাফ ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিয়ম মেনে ইসলাম মতে তালাক দিয়ে নিস্তার পেতে চাইলেন। ফালাকের বাবা দশ লক্ষ টাকা যৌতুকের দাবিতে মামলা করলেন তার বিরুদ্ধে। সাক্ষী হিসেবে ফালাক বিজ্ঞ আদালতের কাছে কেঁদে কেঁদে তার সাথে হওয়া অকথ্য নির্যাতনের কথা জানালেন। স্রেফ আশ্রাফের ঘরে আগেই বউ বাচ্চা ছিল তা কোন এক রহস্যময় কারণে চেপে গেলেন তারা। একে একে ফালাক ও তার পরিবারের সবাই জানালেন তাদের আদরের ফালাক কতো কতোভাবে নির্যাতিত হয়েছে কেবলমাত্র যৌতুকের টাকা না দিতে পারার কারণে!
দিনরাত কাজই করে আশ্রাফ, কানে যখনই কোন শোক সংবাদ ভেসে আসে আশ্রাফ প্রস্তুত হোন। সে মুর্দা কে, কোথাকার ইত্যাদি খবর ছাপিয়ে আশ্রাফের মনে কঠিন প্রতিজ্ঞা ভেসে আসে এর জানাযায় উপস্হিত হবার৷ জানাযার পরে কবর, অধিকাংশ সময় পুরুষ মুর্দা হলে আশ্রাফই বাকিদের সাথে কবরে নামেন, মুর্দাকে উত্তর শিয়র করে কবরে শায়িত করেন। পবিত্র ক্বাবার দিকে মুখ করে শায়িত মুর্দার পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য দোয়া করেন। সঙ্গে সঙ্গে যেনো কোন জন্তু জানোয়ার কবর থেকে লাশ না তুলতে পারে সেজন্য সুরা বাকারা থেকে আয়াত নির্বাচন করে সমবেত কণ্ঠে আউড়ে চলেন। চেনা অচেনা আধাচেনা লাওয়ারিশ বেওয়ারিশ পোস্টমর্টেম করা কাটা ছেড়া লাশ সবরকম সবলাশেরই কাজে লাগেন আশ্রাফ। পাপ খণ্ডন হবে কীনা জানেন না তবুও করেন। নিজের মা একলা ঘরে পনেরোদিন মরে পড়ে ছিলেন, ফৌজদারি মামলার আসামি হিসেবে প্রথম গ্রেফতারের পরে জামিনে মুক্তি পায় আশ্রাফ। তাকে সামাল দিতে মা এসেছিলেন, ঘুমন্ত অবস্থায় মাকে রেখেই সে গ্রেফতার হয়েছিল। তার সাথে কারো যোগাযোগ ছিল না, কেউ খবরও পায় নাই। সেসময় এখনকার মতো এমন ঘরে ঘরে সেলফোন ছিল না। দুইসপ্তাহে জামিন পেলো আশ্রাফ! পনেরোটাদিন লেগেছিল তার মায়ের সেই মুর্দার মাটি পেতে। এই ছবিটা চোখ থেকে সরাতে চান আশ্রাফ, তাই কবর খুঁড়ে চলেন চেনা অচেনা লাশের জন্য!
সম্পাদনা: রাখি রশিদ
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..