প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
গন্তব্য মনময়পুরের শ্রীপুর। বাস এ মুহূর্তে শাক্তপাড়ার আধমরা এক ইস্টিশনে এঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রেক কষার ঝাঁকুনিতেই বুঝি তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। অবশ্য ভেঙে যাওয়ায় বেঁচে গিয়েছি। খুব করে চাইছিলাম, কেউ আমাকে উদ্ধার করুক।
বাইরে তাকাতেই দেখি, কড়া রোদের ভেতর মিড়মিড়িয়ে পুড়ছে কিছু হতশ্রী দোকানপাট- কী কাণ্ড। কারো কোনো বিকার নেই কেন রে ভাই। ভেতরে মলিন মুখ করে বসে আছে ক’জন নারী পুরষ। ওরা তো অন্তত কোনো বিকারের চিহ্ন দেখাতে পারে। দোকানের ভেতরে বা বাইরে কোনো ক্রেতা নেই, দুয়েকজন ভবঘুরে পরনের যাচ্ছেতাই কাপড়জামায় রোদ মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুড়তে থাকা দোকানগুলোর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। জায়গাটা আমার জন্যে নতুন, তাই গলা বাড়িয়ে স্বর না তুলে চেপে যাওয়াই ভালো। এখানে বোধয় এ-ই নিয়ম।
নাকে রুমাল চেপে ধরে খুব বেশিক্ষণ বসে থাকতে হলো না। যাবে এমন কেউ নেই বুঝতে পেরে বাস চলতে শুরু করল। তন্দ্রার দেবী তো বর কেড়ে নিয়েছেন আরো আগেই। চোখের পাতায় তন্দ্রার শেষ প্রলেপটাও শুকিয়ে টুকিয়ে গেছে। তাই বোধয় আরেকজন প্রসন্ন হলেন- তিনি রহস্যের দেবতা। প্রতিটি নতুন এবং একাকী যাত্রায় এ দেবতা আমাকে তার ভক্তে পরিণত করার চেষ্টা করেন। আমি কি এতো সহজে ধরা দিই? দেবতার ভক্তে পরিণত হলাম তো বোকা বনে গেলাম; আমাকে মুগ্ধ করার কোনো দায়ই আর তখন তার থাকবে না।
বাতাসে একটা বনজ সুঘ্রাণ পেলাম কি? বোধয়। এই সুঘ্রাণটা বোধ করি আমি তন্দ্রার ঘোরেও পাচ্ছিলাম; হতেই পারে। এছাড়া তো স্নায়ুর কোনো অচিন পরত থেকে আমার বাবার শৈশবে বনের ভেতর পথহারানোর স্মৃতি এই শ্রীপুরযাত্রায় স্বপ্ন হয়ে দেখা দিতো না। দেখছিলাম, বাবা নয়, যেন আমিই সম্মোহিতের মতো বনের ভেতর হাঁটছি। ক্রমশ গভীর থেকে আরো গভীরে।
মনের ভেতর কেউ একজন বলছে, ‘এইতো আর খানিকটা খোকা, আর একটুখানি এগোও। ফিরে যাওয়া নিয়ে ভেবো না, পথ থাকবে। খুঁজে পাবে। ’
পাতার ফাঁক গলে আসা রোদ আমার ঘাড় গলা হাত পায়ের পাতা পুড়িয়ে দিচ্ছিল। মনে পড়ছে, বনের ভেতর থোকা থোকা সবুজ অন্ধকার সব কোণ। ওইসমস্ত কোণে চোখ চষে আমি নাকি একটা কালো ভালুক খুঁজে বেড়াচ্ছি। ভীষণ শক্তিমত্ত ওই ভালুক, পেলেই থাবার ঘায়ে মুখ ঘুরিয়ে দেবে। তবু আমি তাকে খুঁজছি কারণ সে নাকি আমার বন্ধুও হতে পারে। ভয় আমাকে জেঁকে ধরেছে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড ধসছে সেকেন্ডপ্রতি দু’বার, সজোরে, সরোষে- ধকধক, ধকধক! পেছন ফিরে মনে হলো এই বন আমি পেরিয়ে আসিনি, কোনো ক্রমেই এই বন নয়! আমি বললাম, ‘ফিরে যেতে চাই আমি ফিরে যাব!’ কিন্তু কেউ আর কোনো কথা বলল না কোথাও; একটা শব্দও নয়।
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বাস গতি তুলেছে ভালোই। পথের দু পাশে বনের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। সুরবঙ্গের এদিকটায় শালবনের রাজত্ব। রাস্তায় অনিয়মিত বিরতিতে আমি জীবিত বা মৃত শালগাছ দেখতে পারছিলাম। বোঝা যায়, বনের দেহ আরো আগেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু মানুষের কিরিচে কাটা পড়েছে। তবে চিহ্ন রেখে গেছে বন। কখনো সুযোগ পেলে আবার গজিয়ে উঠবে। মানুষ এসেছে আর ক’দিন, বন তারও আদিম, মানুষেরও দূরগামী।
হঠাৎ আমার চক্ষুস্থির। পথের দুপাশে হনহনিয়ে দৌড়াচ্ছে নিঃশব্দ বন। এই সেই বন, আশৈশব যার গল্প শুনে এসেছি।
শীতকাল পেরোনোর ধকলটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বোধয়, এখনও ন্যাড়া। দেখা যাচ্ছে কেবল ঘন সন্নিবিষ্ট মিশকালো কাণ্ড আর নদীর মত আঁকাবাঁকা শাখা প্রশাখা সব। মাটিতে ঘাস নেই, আছে মেটে রঙা শুকনো পাতার মাদুর। চলে গেছে পুবে পশ্চিমে দু’দিকেই। ওই নির্জন বন, আলোর রহস্যঘন রঙে হঠাৎ কী যে হলো, ভুলেই বসলাম- শ্রীপুরে আমার মস্ত বড় কাজ পড়ে আছে, এবং সেখানে কিছু কেজো মানুষ, খুউব গুরুত্বপূর্ণ কেজো কিছু মানুষ আমার অপেক্ষায় আছে। আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলাম- ‘আরে রাখো ভাই, রাখো! আমি যে নামব এখানে!’
ওমনি তুমি বোকার মত বাস থেকে নেমে গিয়ে তারও বড় বোকা ব’নে গেলে। চুম্বক যেমন করে লোহাকে টানে, রহস্যময়নগ্ন বনটা তোমাকে তেমনই করে টানতে থাগল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল বনের ভেতর। ঢুকে কী দেখতে পেলে?
বন বটে, কিন্তু ছায়া নেই। আসবে কোথা থেকে, গাছে তো পাতাই নেই। রোদে শরীর চিড়বিড় করছে, জলতেষ্টা পেয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলে যতদূর চোখ যায় কোন জনচিহ্ন নেই। দেখে তুমি আশ^স্ত হয়েছ। কারণ এমনটাই চাইছিলে তুমি। গাছের দিকে তাকিয়ে ঘোলা জলের শীর্ণ নদীর মত ডালপালা দেখে হয়ত চলার পথও তেমনই নকশায় তুমি এঁকে নিলে। এঁকে বেঁকে পথ চলতে চলতে হঠাত কি বনের একাংশের প্রান্তে চলে এলে তুমি?
সামনে একটা সরু নদী পড়েছে। শুকিয়ে গেছে, জল নেই এক ফোঁটাও। দুই পারের শাল গাছগুলোর বয়েস তুলনাবিচারে আরো বেশি মনে হলো। যদিও সমস্ত শাখীই এখানে পাতাবিহীন, তবু কম বয়েসের লালিত্য শুষ্ক কাণ্ডেও যেমন ধরা পড়ে, তেমনই বয়োবার্ধক্য বাকলের হৃষ্টতায়ও ঢাকা পড়ে না। খানিকটা এগিয়ে মোড়টুকু ঘুরেই চোখের আড়াল হয়ে গেছে।
এরপর, তুমি এমন এক নদী পেরুতে নামলে, যে নদী পেরুতে সাঁতারের প্রয়োজন নেই। তুমি দুপুরের সূর্যের দিকে তাকালে। এ সূর্য কতকাল ধরে ঠিক এভাবে তাপ দিয়ে চলেছে? এখানকার মাটি ঠিক কতকাল হলো এমন বৃষ্টিব্যাকুল?
নদীর তলার চাড় চাড় শুকনো মাটি দ্রুত পেরিয়ে আমি ওপারের বনভূমি স্পর্শ করলাম। এখানে গাছগুলো আরও ঘন নিবিষ্ট, কিন্তু আলোর অভাব দেখতে পেলাম না। বনে পাখির ডাক নেই, যা আছে তা ডাকের ছায়া। এডাল ওডাল খুঁজতেই পাখির ডাকের একটা ধূসর ছায়া চোখে পড়ল। সেটা উড়ে মাটিতে নেমে কবুতরের মত সামনে পেছনে মাথা দোলাতে দোলাতে পথ চলছে। আমিও চললাম তার পেছন পেছন। কোথা থেকে কোথায় চলেছি কিছুই অনুমানে ধরছে না। বহুক্ষণ হলো নিজেকে নির্ভার লাগছে রহস্য কী ধরতে পারছি না; হঠাৎ শূন্য কাঁধ আমার বোধে এলো। ব্যাগ কোথায়? বাস থেকে নামার সময়ও তো ছিল সঙ্গে। তবে? জানে কেবল এই বন।
ব্যাগে কিছু খাবার আর জল ছিল। খাবার, জল তো এই সুরবঙ্গে, তদুপরি কোনো বনের ভেতর, সুলভ ছাড়া কোনোদিন দুর্লভ হওয়ার কথা ছিল না। বনের কাছে চাইলেই সে খাবার দিতে, জল দিতে প্রস্তুত থাকে। সৎ দাতার বিনয় সেখানে থাকে না। সম্পন্ন গৃহস্থের ঔদ্ধত্য থাকে। অবশ্য এসব কথা কি এ বনের জন্যে খাটে? মন বলছে, এ বনের কথা আলাদা। অবশ্য কোন পথে আলাদা তা বুঝতে পারছি না এখনও। খাবারের যোগান দিতে আগ্রহী মনে না হলেও অন্য কী যেন সে আমাকে দিতে চায়।
পথ চলতে চলতে দেখছিলাম, শুকনো পাতার মাদুর এখানে ওখানে ছেঁড়া। তারই একটির ফাঁক গলে দেখা গেল লালচে মাটির ওপর আধেকটা বেরিয়ে থেকে ‘এই যে আমি, এই যে আমি’ বলে চিৎকার করছে কাগজের একটা কোণ। আমি সভ্য মানুষ, কাগজ চিনতে পারব না তা হয় না। কিন্তু, এই বিজন বনে মানুষিক সাক্ষ্য বহন করে এমন কাগজ মেলার কোনো কারণ কি আছে? এই বনে কি তবে লোকবাস ছিল কখনো যারা কাগজ ব্যবহার করত? না, একটা কাগজকে মাটির খাঁজ গলে মাথা বের করে রাখতে হলে লোকবাস থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। ঝুঁকে বসে নখে খামচে মাটি তুলে কাগজটা বের করে আনলাম। হাতের তালুর ওপর সাবধানে মৃদু চাপে সমান করার পর দেখি- কিছু স্বগোতোক্তি লেখা অদ্ভুত এক কাগজ! গুটি গুটি বাংলা অক্ষর চিনতে পেরেছিলাম, পড়তে গিয়ে টের পেলাম কোনো যতি চিহ্নের বালাই নেই। এতো সাংঘাতিক ব্যাপার রে ভাই; এ চিঠি কবেকার? তর্কালঙ্কার যুগের কোন শিক্ষিত লোক এখানে এই ভয়ানক বনের ভেতর এসে কাকেই বা এমন চিঠি লিখে গেল! নাকি এ চিঠি পরে এখানে এসেছে! মনের ভেতর এমন আশ্চর্যবোধক যতি চিহ্নের অনেক প্রশ্ন খেলে গেল আমার।
এখানে আসিয়া বৎসরাধিকাল ঘুরিয়া যাইতেছি তথাপি পথের দিশা পাইতেছি না পদব্রজে যাত্রা করিয়াছিলাম গন্তব্য শ্রীপুর পথিমধ্যে এই বন নজরে আসিলো এমন সুশোভিত পত্রশাখ আমা দ্বারা অদৃষ্টপূর্ব ছিল বিধায় বিমোহিত হইয়া অন্দরে প্রবেশ করিলাম সেই হইতে অদ্যাবধি বনের কোন কূল কিনারা পাইতেছি না আজ মাসাধিক কাল গত হইয়াছে বোধ করি বনে খাদ্য কি বা জলের কোন কমতি নাই গাছে মিষ্ট ফল ধরিয়া আছে পাড়িয়া খাইবার অপেক্ষা নদীতে মিষ্ট জল গড়াইতেছে আঁজলায় তুলিয়া পান করিবার অপেক্ষা যাহা আশ্চর্য তাহা এই বনে হিংস্র পশুর আনাগোনা অদ্যাবধি দেখি নাই যে নয়নাভিরাম চোখভুলানো রূপের দ্বারা আদিষ্ট হইয়া এই বনে প্রবেশ করিয়াছিলাম পূর্বেকার রূপমুগ্ধতার কিছুই আর অবশিষ্ট নাই বনে কোন হিংস্র জন্তু হয়তবা নাই কিন্তু ইহার হিংস্রতা অন্য কোথাও উদ্ভিদের এই রূপের সহিত আমার ইতোপূর্বে পরিচয় ঘটে নাই এখানে লাখে লাখে বৃক্ষ দাঁড়াইয়া উদ্বাহু নৃত্য করিতেছে কোথাও কোন নৃজন নাই আমি একজন নর অতএব আমার সঙ্গতৃষা বাগতৃষা তো শাখীরা মিটাইতে পারে না বনের ভিতর সূর্যালোক পশিবার উপায় নাই পরণের কাপড় ছিঁড়িয়া গিয়াছে স্যাঁতস্যাঁতে বায়ুতে ভারি শৈত্য অনুভূত হয় নদীর বহমানা জলে সূর্যের আলো বিকিরিত হইয়া দিনের বেলায় খানিক উত্তাপ ছড়ায় তখন তাহাই অনন্যোপায় হইয়া গায়ে মাখিয়া লই বেলা পড়ে গেলেই হাওয়া নিজের স্বরে কথা কয় কোন দূর প্রবাসে মাতা স্ত্রী কন্যা রাখিয়া আসিয়া নৈশে কোথায় কাটাইতেছি তাহাদের কথা শূন্য বুকে বড় বাজে আর দিন কয়েকের ভিতর কোন রূপ কুল কিনারা করিতে না পারিলে ঠিক কী করিব বলিতে পারি না হয়ত জলে ডুবিয়া মরিব অনন্যোপায় এ ভুবনে তাহাদের সহিত দেখা আর নাইবা হইল পরপারে ঠিকটি হইবে
চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকি। এ বন তাহলে দারুণ পত্রশোভিত ছিল, নদীতে ডুবে মরার মত যথেষ্ট জল ছিল। এবং সে তার সেই রূপে ধাবমান আরও এক শ্রীপুরের পথিককে ভুলিয়েওছিল; অদ্ভুত যোগ!
শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল লোকটার? সে কী বনের ভেতর-বাহির সমাধান করতে পেরেছিল? নাকি নদীর জলে ডুবে মরেছিল শেষটায়।
আমি ঘুরে আবার নদীর পাড়ে চলে আসি। চিঠির নদী আর পেরিয়ে আসা নদীটা কি এক? চিঠিটা যেহেতু কাছেই পেয়েছি, সেহেতু লোকটার নদী হয়ত এটাই ছিল। অথবা আসলে নদীটা ছিল আসলে সেটা, যেটা পেরিয়ে আসার পর আমি এ চিঠি পেলাম। আমি কি তবে অন্য কোনো নদী পেরিয়ে এসেছিলাম? ব্যাপারটা উল্টো-সিধা কোনো এক দিক দিয়ে কি যুক্ত? চিঠি থেকে মুখ তুলে আমি নদীর দিকে তাকালাম আবার। এ নদীই কি পেরোলাম মাত্র? নাকি এটা অন্য কোনো। কই, তেমন তো লাগছে না! কোথায় ওই জলহীন তবু কমনীয় মাটি? বরং কেমন শুকনো পাথুর সব চাড়। জলে ডুবে মরে গেলে লোকটার কোন দেহাবশেষ বা কোনো প্রকার চিহ্ন কি এই খটখটে মাটিতে পাওয়া যাবে?
লোকটি বলেছিল এ বনে কোন হিংস্র পশু নেই; পাখির কথা লেখেনি কিছু। তবে গাছে ফল যখন ছিল তখন পরাগায়নও ছিল; পরাগায়ন যখন ছিল তখন বাতাসই কেবল নয়, নিশ্চয়ই পতঙ্গও উড়েছে; বাতাসে যদি বাতাস-সাঁতারি পতঙ্গ থাকে তো জলে নিশ্চয়ই জল-সাঁতারি পতঙ্গ ছিল! জলসাঁতারি পতঙ্গ খেত যত উভচর, আর জলচর মাছও নির্ঘাৎ! আর জলপতঙ্গভুক পুষ্ট ও ভাসমান সে মাছকে উদরস্থ করতে নিশ্চয়ই পাখি ছিল! আর পাখি কি আর পোকাও খায় না! হ্যাঁ, পাখি যেমন পোকাকে খায়, পোকাও তেমনই পাখিকে খায়। তাদের সাথে সাথে পাখির দেহাবশেষ ভক্ষণে প্রস্তুত থাকে পতঙ্গ আর মাছ।
এসব আমি কী ভাবছি?
তোমার ভেতরে খুব ধীরে বিদঘুটে অপ্রকৃতস্থতা তৈরি হচ্ছে এবং তা তৈরি করছে এই রহস্যঘন বন।
হতভাগ্য লোকটি কি এ বন থেকে বেরুতে পেরেছিলো? নাকি তার শুষ্ক শ্বেত কঙ্কাল পাওয়া যাবে কোনো একদাসলিল অধুনায়েঁটেল, অথবা একদায়েঁটেল অধুনাপ্রস্তর পুরমৃত্তিকায়।
খুঁজতে হবে। তুমি নদীর পেটে নেমে গেলে। এদিক সেদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করলে এমন কোন চিহ্ন- যে চিহ্ন একটা মৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করে। ডান দিকে নদীটি কিছুদূর গিয়ে বামে মোড় নিয়েছে। তুমি সেদিকে এগোতে লাগলে। তোমার মনে হতে লাগল, বাঁয়ে মোড় ঘুরতেই দেখবে মাটি ফুঁড়ে খলখল করে হাসতে থাকা একটা করোটি বেরিয়ে আছে। তোমার দিকে দাঁতের খাঁজপাটি বিকশিত করে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে।
তোমার হৃদপিণ্ড ভীতিপ্রদ কিছু দেখবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। বনের প্রাকৃতিক শব্দগুলো তোমার কানে আর আসছে না। তোমার শ্রবণ দুর্বল হয়ে এসেছে। তুমি কি মারা যেতে চলেছ?
তোমার জন্যে শ্রীপুরে ভীষণ কেজো কিছু লোক অপেক্ষা করে আছে। তুমি পৌঁছুলেই ওরা বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করে দেবে। তোমার মত অকেজো লোকের জন্য কত আয়োজন থেমে আছে। সে লোকটির জন্যেও শ্রীপুরে কিছু কেজো লোক অপেক্ষা করে ছিল। কেউ আসলে অপেক্ষা করে থাকে না কোথাও, এটা একটা ফাঁদ।
তুমি বাঁয়ে মোড় নিলে, সেখানে মাটির স্ফীত বুক কেটে শাদা একটা কিছু বেরিয়ে আছে। হেলে পড়া সূর্য কমলা আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে বনভূমি। তুমি বস্তুটির কাছে পৌঁছে স্পর্শ করলে। গাছেরই শেকড় বিশেষ। তুমি আশস্ত হলে। নদীটা এখান থেকে ফের সম্মুখে গিয়ে এবার ডানে চোখের আড়াল হয়ে গাছে। তোমার মনে হল ডানে ঘুরতেই দেখতে পাবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে আঙুলের কঙ্কাল। কঙ্কাল শব্দটা দারুণ ভয়প্রদ। কঙ্কাল! কঙ্কাল! এবং কঙ্কাল! এই অশুভ শব্দটা যতবার তোমার মনে পড়ে, ততবার সূর্য এক হাত করে নিচে নেমে যায়।
এখানে এ নদীর মাঝে রাত নামলে খুব বেকায়দায় পড়বে তুমি। উঠে গিয়ে একটা আশ্রয় খুঁজে নেবার কথা ভাবছ? পা জোড়া কি আদৌ শুনলো তোমার কথা? যাহোক, মোড়ে পৌঁছুলে কোনোক্রমে। সেখানে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে একটা কিছু। এই ‘একটা কিছু’ বড় অভিশপ্ত শব্দ। হাতের অস্থিই বটে; তবে মানুষের নয়। পাখির ডানার। কোন পাখি হয়ত মাছ শিকারে জলে নেমেছিল এরপর মাছের ঝাঁক তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে থাকবে। দেখলে, নদী সামনে কিছুদূর এগিয়ে আবার ডানে মোড় নিয়েছে। এগোতে গিয়ে একটা ভাঙা শামুকে তোমার পা কেটে গেল। ধীরে রক্ত ফুটল ক্ষতে। তোমার চোখজোড়া দুর্ব্বা খুঁজে বেড়াচ্ছে নাকি! হাসালে। জুতো জোড়া কোথায় হারিয়েছে? হারিয়েছে না কী হারিয়ে যেতে দিয়েছ- মনে করতে পারলে না।
কী বোকা আমি, নদী ধরে এগোলেই তো বনের শেষ পাব। সামান্য এ কথা এতোটাক্ষণ মনে এলো না! নদী ধরে এগোলে একসময় বনের শেষ তুমি পাবেই। এ মরা নদী নিশ্চয়ই কখনও কোন বড় নদীর সঙ্গে মিশেছে, যেখানে মানুুষের আসা যাওয়া আছে! না মিশে পারেই না। এক মিনিট! কিন্তু এ নদী যে বনের আরও দুর্লঙ্ঘ অংশে নিয়ে যাবে না- তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?
তবুও আশাকে ধ্রুবতারা মনে করে চলতে শুরু করেছি। নদীতল ভীষণ এবড়ো খেবড়ো, শুকনো এঁটেল ফসিলয়েড। তর্কালঙ্কারের যুগের মানুষটির ভীষণ করুণ মৃত্যু ঘটেছিল হয়ত। এরপর কি বহুকাল কেটে গেছে? এ বনেরও বোধ করি মৃত্যু ঘটেছে। তাই তো মৃত্যুর পর বনপ্রেতাত্মা জেগে উঠেছে! হিসেব তো নিকেশের পথে, মিলেছে কিছু? বুঝি ঠিক এভাবেই আকৃষ্ট করে চলেছে শিকার? অরণ্য!
আর কত জনার প্রাণ নিয়েছ, কোথায় লুকিয়ে রেখেছ তাদের দেহের অবশেষ? ওহ, ওহ! আমি নদীপথে দৌড়ুতে থাকি। আর ওদিকে সূর্যটাও দিগন্তে ডুবে যেতে থাকে, ডুবে যেতে থাকে। আমি হাঁপিয়ে উঠি, হাঁপিয়ে উঠি। আমার ধড়ের ভরের ওপর পায়ে গিঁটগুলোর বুঝি আর কোনো দখল থাকল না। হাতগুলোর ওপর তো কম নির্যাতন হয়নি। আমার হাত! আমার হাতের পাতা! আমার হাতের পাতার এ কী দশা, এ যে, এ যে চেনাই যায় না আর। বহুকাল ধরে, যেন বহুকাল ধরে ক্ষুধা তৃষ্ণায় আমি কাতর হয়ে আছি। ওহ, ওহ! কী আশ্চর্য, আমার হাতের রেখা বদলে গেছে। ওহ, ওহ এবার বুঝি একেবারেই অবরূদ্ধ হয়ে পড়লাম তর্কালঙ্কার! একেবারেই!
আমার পা জোড়া থরথর করে কাঁপতে থাকে। আমার বুকে তেষ্টা, আমার বুকে হাহাকার। শুষ্ক জিহ্বা মূর্ধার সাথে আঠার মত সেঁটে আছে। বারবার চোখের পাতা ফেলেও স্পষ্ট দেখতে পারছি না। কোথাও কি এসেছি নাকি একটিমাত্র চক্রেই কেবল ঘুরে ঘুরে মরছি, পারি না।
হিংস্র এ বনটাকে সব দিক থেকে দেখতে একই রকম লাগছে। রাত নামছে নাকি আবার। তাই বলে এতো দ্রুত? কী এক ভূতুড়ে ঝিঝিপোকা বনকে খইয়ের মত ফোটাচ্ছে। ক্ষুদ্র কীট কী করে এমন শব্দ তৈরি করতে পারে? বিস্ময়, বিস্ময়। যদিও, যদিও পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণি, প্রতিটা প্রাণি, তার সাধ্যের চেয়ে, সাধ্যের চেয়ে, খুব কম দক্ষতা দেখায়। খুব, খুউব কম দক্ষতা দেখায়!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..