শ্রেণিচ্যুত কবি আওলাদ হোসেন

ইমাম গাজ্জালী
প্রবন্ধ
Bengali
শ্রেণিচ্যুত কবি আওলাদ হোসেন
“ভালোবাসা তোমাকে যেমন রাজমুকুট পরিয়ে দেবে, তেমনি তোমাকে ক্রুশবিদ্ধ করবে। … প্রেম তোমাকে শস্যের আঁটি থেকে তোমাকে মাড়াই করবে, তোমার আবরণ খসিয়ে ফেলবে।  তোমার আবরণ থেকে তোমাকে মুক্ত করবে। সে তোমাকে পেষণ করবে, শ্বেত-শুভ্র করে ফেলবে। তোমাকে ডলাই মলাই করে লেই করে দেবে। তারপর তোমাকে ঈশ্বরের পবিত্র আগুনে ছেকে পবিত্র রুটি তৈরি করবে। যেন তুমি ঈশ্বরের পূণ্য ভোজের পূণ্য রুটিতে পরিণত হও।” দ্য প্রফেট, কাহলিল জিবরান।

আওলাদ হোসেন শ্রেণিচ্যুত ও গৃহচ্যুত কবি। তিনি কবিতার জন্য ঘর ছেড়েছিলেন, ছেড়ে ছিলেন নিজ শ্রেণি। সামাজিক, প্রশাসনিক, শিক্ষাগত পদমর্যাদার সকল অহং পায়ে দলে, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে তিনি পথে নেমে এসেছিলেন। সেটাও কবিতার জন্যই, ভালোবাসার জন্যই। সমাজ পরিবার বংশ মর্যাদা আর লোভনীয় সরকারি চাকুরি পদপদবীর খোলস মুক্ত হয়ে, সব ছেড়ে তিনি খুজতে গেছেন মানুষ এবং প্রকৃতি, সেটাও কবিতার জন্য। নিজেকে নামিয়ে এনেছিলেন শিশুর মত সারল্যে, প্রকৃতির মত স্বাভাবিকতায়, মানুষের ভেতর আসল মানুষ খোঁজার নিরলস সাধনার স্তরে। তাকে জায়গা দেয়নি তার সমাজ, তার পরিবার, খোঁজ নেয়নি তার বন্ধু-স্বজন। হয়ে উঠেছিলেন ঈশ্বরের পূণ্য ভোজের পূণ্য রুটি।
আওলাদ হোসেন মারা যান ২৩ মে, সংবাদ পাই তার মাস খানেক পর। তাকে নিয়ে লেখার দায় অনুভব করি প্রবলভাবে। তার এভাাবে চলে যাওয়া মানে আমরা তাকে ধারণ করতে পারিনি। মানে এই সমাজ এই রাষ্ট্র এই মুখুস্ত মানুষ একজন কবিকে ধারণ করতে পারে না। কারণ তিনি স্তাবক কবি নন, ছিলেন না কখনও।
তার ঘনিষ্ট বন্ধুদের অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, অনেককে দেশের মানুষ একনামে চেনে। রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, তসলিমা নাসরিন, সলিমুল্লাহ খান, গোলাম কুদ্দুস, মোহন রায়হান এমন বহু লোক আছেন। যারা কবি আওলাদের খুব ঘনিষ্টজন ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেউ তার খোঁজ নেয়নি। কবি আওলাদও তাদের দারস্থ হননি। কেউ তার পাশে না দাঁড়ালেও তাকে ধারণ করেছেন গ্রামের চাষি আর দিনমজুর।
আমরা একই এলাকার মানুষ। এরশাদ পতন পরবর্তি সময়ে মাঝে মাঝে তার বাড়িতে যাওয়া চলত। বিশাল বাড়ি। বাড়িতে সামন্তীয় ছাপ সুস্পষ্ট। বাড়িতে কেউ থাকত না। বিরান পড়ে থাকত। সেখানেই থাকতেন, যতদিন মন চায়। তারপর উধাও। কোথায়? কেউ জানে না। বিয়ে করেছিলেন টেকেনি, পরে অন্ত্যজজনের ঘরে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। চাকুরি করেছিলেন সরকারি উচ্চ পদে, সেটাও ধাতে সয়নি। বহিমিয়ান বলতে যা বোঝায়, আওলাদ ছিলেন তাই। একই এলাকার বাড়ি বলে তার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। আড্ডা হত বেশুমার। অসংখ্য স্মৃতি ভিড় করে তাকে নিয়ে। তার বহিমিয়ান জীবনের একটি গল্প দিয়ে লেখা শেষ করছি।
একবার ঢাকায় লালন সাইয়ের আঁখড়া রক্ষার জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং কবি শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে। সেই আন্দোলনে অনেকেই সামিল হয়েছিলেন। একদিন সভা হচ্ছে জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে। তখন শীতের দিন। আমিও পেছনের দিকে একটি চেয়ারে বসা। কিছুক্ষণ পর দেখি একজন লোক আমাকে পেছন থেকে টোকা দিয়ে বলছেন, ভাই কেমন আছেন। ফিরে দেখি আওলাদ ভাই। পরে মিটিং বাদ দিয়ে তাকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। জানলাম, দুপুরে খাননি। পাউরুটি কলা চা সিগারেট চলল। জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকায় থাকবেন কোথায়? বললেন জানি না। কিভাবে আসলেন, তার বয়ান দিলেন। রাতে এক সাথে থাকলাম, যেখানে আমি থাকি। তার ঢাকায় আসার গল্পটি দারুন।
বললেন,
“উল্লাপাড়ার বন্যাকান্দি গ্রামে রাতে একটি টং দোকানের মাচানের ওপর শুয়ে ছিলাম। রাতে খাওয়া হয়নি। শীতের সোদনে ঘুম আসছিল না। কখনো শুয়ে কখনো বসে রাত কাবার করেছি। সকালের দিকে একজন ভক্ত আশেকের সঙ্গে দেখা। তিনি নাস্তা করালেন, ডিম পরোটা দিয়ে। এলাকার আরো লোকজন চলে আসল। তুমুল আড্ডা জমে উঠল। সাথে চা সিগারেট আরো কিছু। ভক্ত আশেকানরা বললেন, গুরু ঢাকায় যান, ওখানে লালন রক্ষায় আন্দোলন হচ্ছে, আপনার থাকন দরকার। আমিও সায় দিলাম। এমন সময় উল্লাপাড়া আসনের এমপি কামাল সাব নাকি এমন নামের এক জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তিনি পাজেরো গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। ভক্তদের একজন সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামালেন। গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে বললেন, স্যার কি ঢাকায় যাবেন। কামাল সাব বললেন জী, কেন? তোরা কেউ যাবি নাকি? আমি যামু না, তয় আমাগরে গুরু যাইব। তারে নিতে হইবো আপনার।
কামাল সাব কইলেন গাড়িতে উঠতে ক। তখন সে আমাাকে টেনে এনে গাড়িতে তুলে দিল। ঢাকায় আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়। গাড়ি এসে থামল উত্তরার একটি বড় প্রাসাদ্যোম বাড়ির সামনে। কামাল সাব নামলেন। এক সুন্দরী নারী কামাল সাবকে কোমড় জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমার জন্য কেউই আসল না। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ পর দারোয়ান বলল, আপনি রাতে কোথায় থাকবেন ? আমি বললাম, তাতো জানি না। দারোয়ান বললেন, স্যারের সাথে যখন আইছেন, আপাতত আমার এখানেই থাকেন। পরেরদিন যেখানে ইচ্ছে যান। সেই রাতে ওই দারোয়ানের সঙ্গেই থাকি। পরেরদিন চলে আসলাম প্রেসক্লাবে, এই অনুষ্ঠানে।

ইমাম গাজ্জালী। লেখক ও সাংবাদিক। পেশায় সংবাদকর্মী। ঢাকার একটি দৈনিকে কাজ করেন। এর আগে ছাত্রজীবনে একটি বামপন্থী দলের সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন। এতদিন দেশের বিশিষ্টজনদের লেখা পড়েই সন্তষ্ট থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু তা দিয়ে বাস্তবের হিসেব মেলাতে পারছেন না বলেই হাতে কলম...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..