করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
‘সংস্কৃতিঃ জাতীয় মুখশ্রী’ বইটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে একেবারে শেষে এসে থমকে গেলাম। সেখানে ছোট্ট একটি চিরকুট সাঁটা। তারিখ-২৯/০৫/০৮। তাতে লেখা,
‘স্নেহের জুনান নাশিত, বই উল্টাতে গিয়ে দেখলাম তোমার মাহবুব ভাই এই দু’টি বই তোমার জন্য রেখে গেছেন। ২০০৭ এর জানুয়ারিতে। তাই পাঠিয়ে দিলাম। প্রাপ্তি সংবাদ জানাবে আশা করি– ভাবী জওশন আরা রহমান।’
মনে আছে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবীকে ফোন করে প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়েছিলাম। মাহবুব ভাইয়ের পাঠানো আরো কয়েকটি বইয়ের সঙ্গে এটিকেও যত্ন করে রেখেছিলাম। বইটি হাতে নিয়ে সেদিন যেমন বুকটা বেদনায় উঠেছিল আজও ঠিক তেমনি হৃদয় স্তব্ধ হলো। চোখের কোণে উঁকি দিল বিষন্নতার নম্র ঝিলিক। তবু মন সান্ত্বনা পেল এই ভেবে, তিনিতো একবারই মরেছেন। বারবারতো মরেন নি। তিনিতো নির্ভীক যোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন এক দেশাত্মা সৈনিক। মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথা,
‘সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে
মরিস নে তুই ভয়ে ভয়ে
জীবনকে তোর ভরে নিতে
মরণ-আঘাত খেতেই হবে।’
সে মরণ আঘাত তাঁকে খেতে হয়েছিল জীবনে বহুবার। তিনি পিছু হটেননি। লড়াকু বীরের মতো লড়ে গেছেন। আজীবন সংগ্রাম করেছেন। Frederick Douglas বলেছেন, “If there is no struggle, there is no progress”। এ কথাকে সত্য মেনে জীবনের ডালি পূর্ণ করেছেন নানা বিচিত্রতায়। তৈরি করে গেছেন বহুবর্ণ ও কর্মময় পথ। এঁকে গেছেন স্বপ্নের অসীম সীমানা।
তিনি একজন কবি, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সংগঠক, বিপ্লবী, সম্পাদক, মানবতাবাদী ও রাজনীতি সচেতন প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাদের একুশের প্রথম কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সীমান্তের সম্পাদক। জন্মেছেন ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে। ২০০৭ এর ২৩ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন সেই কবিতার কথা,‘যতো বড়ো হও/তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।’ বড়ো কি হতে চেয়েছিলেন তিনি? হয়তো চেয়েছিলেন, হয়তো নয়। আজ আর সে কথা কোনভাবেই কি জানা সম্ভব?
‘সংস্কৃতিঃ জাতীয় মুখশ্রী’ বইটি প্রকাশিত হয় ৩০ জুলাই ২০০৬ সালে। প্রকাশ করেছে পালক পাবলিশার্স। এটি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয় নিয়ে লেখা একটি গদ্যসংকলন। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী সেই ব্রিটিশ আমল থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। ছিলেন দক্ষ সংগঠক। সে সময় থেকেই তিনি যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সঙ্গে। কিন্তু সে সময়ের কোন লেখা বইটিতে স্থান পায়নি। কেন পেলো না সে সম্পর্কে বইটির ভূমিকায় তিনি বলেছেন,
‘ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় এবং পশ্চিম বাংলার কলকাতায় আমার যেসব প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তার কোনো ফাইল আমার কাছে নেই। রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে একই মেল-বন্ধনে মিলিয়েছিলাম বলে তদানীন্তন সরকার আমাকে একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে বহুবার আমার আবাসস্থল আক্রমণ করেছে। শেষ আক্রমণ আসে একাত্তরে। তখন আমার ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট করে পোড়োবাড়িতে পরিণত করে পাক হানাদার বাহিনী। আমার সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত গ্রন্থ, নাটক, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং আমার দশবছরের রাজনৈতিক ডায়রি-যা ঐ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ছিল, বর্বর পাকবাহিনী তা পাউডার ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আমি নিঃসন্তান হয়ে যাই। ফলে এই বইতে আগের কোনো প্রবন্ধ ছাপা সম্ভব হয়নি। যেসব প্রবন্ধ এই গ্রন্থে ছাপা হলো তা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে লেখা।’
বইটিকে লেখক চার ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমভাগে প্রবন্ধ, দ্বিতীয় ভাগে প্রিয় কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা, তৃতীয়ভাগে সাক্ষাৎকার ও চতুর্থ কিংবা শেষভাগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত তার মূল্যবান কয়েকটি ভাষণ দিয়ে সাজিয়েছেন। ৪৩২টি পৃষ্ঠার বইটিতে তিনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি,রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, আন্তর্জাতিক নানা প্রসঙ্গ সহ দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে ও এদেশের মানুষ নিয়ে তাঁর দুরন্ত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কথা অকপটে তুলে ধরেছেন।
ছোট্ট ভৌগলিক সীমারেখা নিয়ে একাত্তরে যে রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটলো তার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। রয়েছে আবহমান সর্বমানবীয় সংস্কৃতির ধারা। এই উদার সাংস্কৃতিক সত্তার কারণে এ মাটিরই এক সন্তান উদাত্ত কণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন, ‘শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এ দেশের লোকপুরাণ আর লোকসাহিত্যের সর্বত্রই মানুষে মানুষে সম্পর্ক আর ভালোবাসার কথাই ধ্বনিত হয়েছে। ভালোবাসার এই ফল্গুধারায় সহজিয়া দর্শন হিসেবে মিশে গেছে বাউলের আধ্যাত্মচেতনা। মরমিয়া তত্ত্বে উঠে এসেছে মানুষ, মানুষের প্রেম, সংরাগ আর অমূল্য জীবনের কথা।
কিন্তু আজ? আজ কী ঘটছে স্বাধীন সোনার এই বাংলাদেশে? বাউলের আধ্যাত্মচেতনাকে উপহাস করে তাকে নির্দিষ্ট এক ধর্মীয় লেবাস দেয়ার চেষ্টা চলছে। বিস্তার ঘটছে উগ্র ধর্মান্ধতার। কর্তৃত্ববাদী কোন না কোন গোষ্ঠী ক্ষমতার লোল জিহ্বাকে সংবরণ করতে না পেরে সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদকে উস্কে দিচ্ছে। অখণ্ডিত চেতনাকে করছে খণ্ডিত। বাড়াচ্ছে বিচ্ছেদ আর বিভেদ। তৈরি করছে নানাবিধ বিচ্ছিন্নতা। বাড়ছে হিংস্রতা। বাড়ছে জীঘাংসা। অন্ধকার অতলে তলিয়ে যাবার সবধরনের পথ হচ্ছে উন্মুক্ত। অথচ এই দেশেই উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে শিখা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে হয়েছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন। এ কথা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানে না। প্রবীণরাও বিস্মৃত হচ্ছেন ক্রমশ। না হলে কেন দেশ আজ অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে উল্টো পথে হাঁটছে? এ দেশের সাধারণ জনগণ নানা ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও কুপমণ্ডুতায় ডুবে যাচ্ছে? যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ এদেশের মানুষের জীবনধারাকে করেছে তীব্র গতিশীল, সেখানে মনের ভুবনে কেন উঁকি দিচ্ছেনা আলোময় দিনের কোন সূর্য?
যে কোন সচেতন ব্যক্তির মনেই হরহামেশাই এ ধরনের জিজ্ঞাসা জাগতে পারে। জাগাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর এসবের উত্তর খোঁজার জন্য জিজ্ঞাসু ব্যক্তিমাত্রকেই ফিরতে হবে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বদের কাছে। যারা মানবতাবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে শুনিয়েছেন উদার মানবধর্মের কথা। শুনিয়েছেন মানুষের মুক্তি ও আকাঙ্ক্ষার কথা। বলেছেন গণতন্ত্রের কথা, শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কথা। বইটিতে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী বলেছেন একুশের চেতনার কথা, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও এর এগিয়ে চলার কথা। বলেছেন সংস্কৃতি ও জাতীয় সংহতির কথা। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন সংস্কৃতির ওপর। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন সংস্কৃতি একটি জাতির দর্পণ। দেশকে এগিয়ে নেয়ার অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। যে কোন দেশের অমূল্য ধন তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি দেশের প্রাণ, দেশের আত্মা।
বইটিতে তিনি আরো বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দুঃসময়ের কথা। এসেছে অপরিহার্য বিষয় ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের কথা। বলেছেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের কথা। এসব বলতে গিয়ে তিনি কোন রাখঢাকের চেষ্টা করেননি। তার বিশ্বাসের কথা, তাঁর ক্ষোভ ও যন্ত্রণার কথা অবলীলায় সরল ভাষায় ব্যক্ত করে গেছেন। কোন ধরনের চাতুর্যের আশ্রয় নেননি।
বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী বরাবরই সত্যপূজক ও সাহসী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর নানা প্রমাণের একটি বঙ্গবন্ধুর কাছে খোলা চিঠিতে ফুটে উঠেছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫ এপ্রিল ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বুদ্ধিজীবী সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী তখন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার সম্পাদক। পরদিন অর্থাৎ ৬ এপ্রিল তিনি তাঁর নিয়মিত কলামে লেখেন,
‘আপনার কাছে বিনীত নিবেদন, মুখোশপরা রাজাকারদের আপনি প্রশ্রয় দেবেন না। রাষ্ট্র আমাদের নতুন, দেশ আমাদের নতুন নয়। এই রাষ্ট্র চালাতে হলে যোগ্যতাসম্পন্ন দেশপ্রেমিক লোকদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করবেন।যারা স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি অথচ মুখে স্বাধীনতার পক্ষের লোক বলে আপনাকে খুশি করছে, দয়া করে তাদের প্রশ্রয় দেবেন না। …যে হাতে মানবতার ঘৃণ্য শত্রু এহিয়ার গলায় ওরা মালা পরিয়েছে, ঠিক একই হাতে যখন আপনার গলায় মালা পরাতে যায় তখন আমার অন্তর কেঁপে ওঠে। আমি ভাবি এর চেয়ে বেশ্যাবৃত্তি আর কী হতে পারে?’
(পৃষ্ঠা-৯০)।
অকপটে এ ধরনের সত্য উচ্চারণের সাহস আজ আর ক’জনের আছে আমার জানা নেই। কিন্তু তাঁর ছিল। আর ছিল বলেই তিনি লোভের ঊর্ধ্বে উঠে কেবলমাত্র দেশপ্রেমকে বাজি ধরে সবধরনের অন্ধকার আর অন্যায়ের প্রতিবাদে অটল সৈনিক হতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন মানুষকে ভালবাসতে। মমতায় মন সিক্ত করে বলতে পেরেছিলেন,
‘যুদ্ধের জন্য ব্যয় হয় কোটি কোটি ডলার, আর বন্ধুত্বের জন্য প্রয়োজন শুধু একমুঠো হাসি, এক বুক ভালোবাসা আর কিছু আন্তরিকতা।’
(পৃষ্ঠা-২০০)
মার্কিন কবি Carl Sandburg বলেছেন, Nothing happens unless first a dream। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন একজন স্বাপ্নিক পুরুষ। স্বপ্নই মানুষকে স্বপ্রণোদিত হয়ে মঙ্গলময় কাজে উদ্বুব্ধ হতে উৎসাহ যোগায়। স্বপ্নই মানুষকে বাঁচতে ও বাঁচাতে শেখায়। মানুষ আশান্বিত হয়। যেমনি আশা করেছিলেন তিনিও,
‘লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে আমরা পরষ্পর পরষ্পরকে ভালোবাসব। আমরা পরিশ্রমী হবো। আমরা বিনীত হবো, আমরা বিশুদ্ধ হবো প্রতিদিনের অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে। আমরা বাঙালি হবো-বাংলার প্রকৃতি, নদী, পাহাড় আর ষড়ঋতুর বিচিত্র প্রভাবে আমরা হবো নম্র, ভদ্র। আমাদের রুচি ও সংস্কৃতির পরিচয় হবে আমাদের অন্তরের সম্পদ।‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল যে মাটিতে, সে মাটির অপর নাম বাংলাদেশ। সবার উপরে আমরা মানুষ হবো এই মন্ত্রই হোক আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সংকল্প।’
(পৃষ্ঠা ১৯৩)।
সংস্কৃতি যেমন মানুষের ক্রমবিকাশমান উন্নততর জীবন ব্যবস্থার অভিব্যক্তি ঘটায় তেমনি বিস্তৃতভাবে যে কোন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার হাতিয়ারও হয়ে ওঠে। তার বড়ো প্রমাণ আমাদের একুশ। আমাদের ভাষা আন্দোলন। যার বিকাশমান ধারায় আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। পেয়েছি সার্বভৌম একটি দেশ। সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নাম। কীভাবে জড়ালো তা আমরা সকলেই জানি। তাঁর বয়ানেও শোনা যাক সেদিনের সে ম্মৃতির কথা,
‘৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আমাকে আহ্বায়ক এবং আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ আজিজ ও শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুণ-উর-রশিদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। …এসব কাজ করতে গিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে আমি ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থ অবস্থায় আমার গায়ে জলবসন্ত দেখা দেয়। আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন চট্টগ্রামে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমার বাড়িতে গিয়ে জানান যে, ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এর বিরুদ্ধে আমার কবিসত্তা জেগে ওঠে-‘আমি কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা শ্রুতলিখনের মাধ্যমে লিখে ফেলি।’
(পৃষ্ঠা-১৫৬)
সেই কবিতাই আমাদের একুশের প্রথম কবিতা। তৎকালীন সরকার সেটি বাজেয়াপ্ত করেছিল। হুলিয়া জারি করেছিল কবির বিরুদ্ধে। সে-সবই আজ জাতির এক মহার্ঘ্য ইতিহাস।
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি বলতে গেলে কিশোর বয়সেই। ৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দিয়ে তাঁর সংগ্রাম শুরু। এরপর যুক্ত হন সাম্যবাদী আন্দোলনের সঙ্গে। পঞ্চাশের দশকের সূচনালগ্নে বের করেন সীমান্ত পত্রিকা। প্রায় একই সময়ে প্রতিষ্ঠা করলেন প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। সে সময় থেকেই কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়ে তাদের মুক্তি চেতনায় উদ্ধুব্ধ হন। আর তাঁর এ চেতনায় যেমন ছিল উদার বৈশ্বিকতা তেমনি ছিল শৈল্পিক ঐতিহ্য। তিনি কেবল গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুুক্তিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন সমানতালে। তিনি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির মাধ্যমেই মিলবে মানুষের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুুক্তি।
সাম্যবাদী দর্শনে বিশ্বাসী কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী কর্তৃত্ববাদী কী ব্রিটিশ, কী পাকিস্তানী; সকল শাসকগোষ্ঠীকে অতিসহজেই শোষক হিসেবে চিহ্নিত করতে ভুল করেননি। আর তাই উভয় শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে কেবল তিনিই নন তাঁর সাহিত্যকীর্তিও পড়েছে একাধিকবার। যে গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, যে সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা কতোটুকু পূরণ হয়েছিল? শ্রেণী সচেতন কবি তাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই বলে,
‘আমরা যারা চিরকাল ড্রইং রুমে বসে চায়ের পেয়ালায় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নিয়ে তর্কের ঝড় তুলেছি আর গা বাঁচিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত, টিপ আর বাঙালিত্বের আন্দোলন করেছি-এই দুর্জয় সংগ্রামে জনতার কোন সারিতে আমরা ছিলাম, ইতিহাস একদিন তার বিচার করবে। কিন্তু যে বিচার অগ্নি পরীক্ষার ভেতর দিয়ে হয়ে গেছে তাতে দেখেছি এই সংগ্রামে সবচেয়ে উচ্চমূল্য দিতে হয়েছে নিচের তলার মানুষকে। বৌ ঝিয়ের সতীত্ব থেকে শুরু করে সবই তারা দিয়েছে-যারা রীবন্দ্র সঙ্গীত কিংবা টিপ নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায়নি। এ সবের অর্থ বুঝার মতো শিক্ষা যারা কোনোদিন পায়নি। বহু ত্যাগ, রক্তপাত ও অশ্রুর বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তা ব্যর্থ হবে যদি এ স্বাধীনতার দীপ্তিতে সেই নিচের তলার মানুষের মুখ উজ্জ্বল করতে না পারি।’
(পৃষ্ঠা ১৮৮)।
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর বইটিতে তাঁর যে গদ্যভঙ্গির সাক্ষাত পাই তা যেমন ঋজু তেমনি সংবেদনশীল, তথ্যবহুল, টানটান কিন্তু আবেগদীপ্ত। সর্বোপরি গদ্যগুলোতে বুদ্ধির ছাপ যথেষ্ট এবং এসবের সাহিত্যমূল্যও কম নয়। নানা বিষয়ে তার ব্যাপক ও গভীর পঠনপাঠনের ছাপ রয়েছে এসব গদ্যে। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটেছেন তিনি। কিন্তু শিল্প সৌকর্যকে দূরে ঠেলে দেননি কখনও। পরিমিতি বোধ বজায় রেখেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ফলে তথ্যের সমাহারেও লেখা ঝুলে যায়নি।
বইটিতে কবি তার প্রিয় কিছু মানুষদের নিয়েও লিখেছেন। সেসব লেখায় তার ব্যক্তি হৃদয়ের উন্মুক্ত প্রকাশ থাকায় তা তাকে জানতে ব্যাপক সহায়ক বলে আমার মনে হয়েছে। এসব লেখায় নির্মল আবেগের পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতিসহ নানা মাধ্যমের যারা তার কাছাকাছি ছিলেন তাদের প্রতি অপরিসীম দরদ মূর্ত হয়ে উঠেছে। এছাড়া গ্রন্থভুক্ত দশটি সাক্ষাতকারে নানাধরনের আলাপচারিতায় তাঁর সমগ্র জীবনের একটি ক্রমবিকাশ পাঠকের গোচরীভূত হয়েছে। এসব সাক্ষাতকারে তিনি যেমন ছিলেন অকপট তেমনি তার বিপুল পরিমাণ স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ ও বেদনার কথা বলতেও সামান্য দ্বিধা করেননি। এসব সাক্ষাতকারে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি, বাল্যের নানা স্মৃতি, কোন প্রেক্ষিত তাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বড়ো করে তুললো, দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে তার মূল্যবান মূল্যায়নধর্মী বক্তব্য সম্পর্কে পাঠক জানতে পারবেন।
বইটিতে আরো অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেয়া তার মূল্যবান সাতটি ভাষণ। যা তিনি লিখিত পাঠ করেছিলেন। প্রবন্ধ কিংবা সাক্ষাতকারগুলোতে যা পাওয়া যায়নি প্রদত্ত ভাষণগুলোতে তার যেন অনেকটাই তিনি পুষিয়ে দিয়েছেন। যেমন ‘অনোমা’র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন,
‘রাজনীতি এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আমি আমার সহযোদ্ধাদের নিয়ে দেয়াল ভাঙার কাজে হাত দিয়েছিলাম। দেয়াল সম্পূর্ণ না ভাঙলেও চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না, আন্তরিকতার অভাব ছিল না, অভাব ছিলনা সততার। তাই ঐ সময়ের কিছু কিছু কাজ ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যে সব দুঃসাহসিক কাজে আমরা ব্রতী হয়েছিলাম তার পেছনে কোনো লোভ-লালসা ছিল না, ইতিহাসে স্থান পাওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল না, যশ-খ্যাতির মোহ ছিল না। যা করেছি অন্তরের তাগিদে করেছি, যুগের প্রয়োজনে করেছি, সাম্যের স্বদেশ ভূমি গড়ার স্বপ্ন নিয়ে করেছি।’
(পৃষ্ঠা-৪১৪)
এ স্বপ্ন দেখে গেছেন তিনি আমৃত্যু। তিনি মানুষের মনুষ্যত্বকে বড়ো করে দেখেছেন। আর পূজারি ছিলেন সততা, সত্যবাদিতা ও রুচিস্নিগ্ধতার। মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব তার কাছে ছিল অপরিসীম। সাম্যবাদী দর্শনে উদ্ধুব্ধ কবি এদেশের হাজার বছরের সর্বমানবীয় সংস্কৃতির ধারাকে আত্মস্থ করেছিলেন। সকল মানুষের ন্যায্য হিস্যার দাবী জানিয়েছিলেন। সমবণ্টনের অধিকারকে অগ্রগণ্য ভেবেছিলেন। জাতীয় জীবনে তাঁর এ চাওয়ায় আর পাওয়ায় বিস্তর ব্যবধান ছিল। তবুও তিনি হতাশ হননি। আশার অগ্নিশিখাটি শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছিলেন।
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার স্মরণ নিয়ে লেখাটি শেষ করছি। তিনি ‘মৃত্যুরে কে মনে রাখে’ কবিতায় বলেছেন,
‘যে তারা জাগিয়া থাকে তারে লয়ে জীবনের খেলা
ভুবনের মেলা
যে-তারা হারালো দ্যুতি, যে পাখি ভুলিয়া গেল গান
যে শাখে শুখালো পাতা
এ ভুবনে কোথা তার স্থান?’
স্থান অবশ্যই আছে কবি। স্থান আছে। আর আছে বলেই গুণী মানুষের স্মরণ নিতে আমরা আয়োজনে মেতে উঠি। উদ্যোগ নিই তাঁকে আরো দীর্ঘজীবন বাঁচিয়ে রাখার। কারণ যোগ্যতমরাই বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকবেন অনাগতকাল।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..