করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
বর্তমান সময়ে স্বল্পপঠিত লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সম্ভবত সর্বাধিকপঠিত রচনা ‘সংস্কৃতি-কথা’ শুরুতেই এই কথাটি জানিয়ে দেয় যে সাধারণ মানুষের কালচার তথা সাংস্কৃতিক বৈভব তার ধর্মসর্বস্ব। অন্যদিকে মার্জিত ব্যক্তির কাছে সংস্কৃতিটাই ধর্ম। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে সাধারণ মানুষ কে আর মার্জিত লোকই বা কে? আমরা সমাজবিজ্ঞানী, নৃ-বিজ্ঞানী ও ধর্মপ্রণেতাদের কাছ থেকে অনেক ধরনের সামাজিক-ব্যক্তিক মেরুকরণের সংবাদ জেনেছি। শোষক-শোষিত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মুসলিম-অমুসলিম, ধনী-নির্ধন, হিন্দু-অহিন্দু, আর্য-অনার্য, আস্তিক-নাস্তিক। কিন্তু মোতাহের হোসেন চৌধুরী সেগুলি পাশ কাটিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন ইউরোপিয় রেনেসাঁ-উদ্ভূত আরেকটি শ্রেণীবিভাগ। সাধারণ মানুষ এবং মার্জিত মানুষ। মনে রাখা দরকার যে, এই শ্রেণিবিভাগে মূল বিভাজক উপাদান ধর্ম নয়; বরং বিভাজকটি হচ্ছে কালচার বা সংস্কৃতি। তবু এই শ্রেণিকরণের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ধর্মচিন্তার সারাৎসার।
ধর্ম শব্দটির সমপর্যায়ের শব্দ অনেক। ধর্মত, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মজ্ঞান, দীন, শ্রেয়, পরমার্থ, পরমসত্য, আধ্যাত্মসত্য, আত্মবিদ্যা, ঈশ্বরবিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস, আকিদা, পন্থা, পথ, মার্গ, তরিকা, মতবাদ, ধর্মশিক্ষা, পাপপুণ্যবোধ। ধর্ম অর্থে আরো দেখা যায়- ঈশ্বরোপাসনা-পদ্ধতি, আচার-আচরণ ও পরকাল ইত্যাদি বিষয়ের নির্দেশ ও তত্ত্ব, পুণ্যকর্ম, সৎকর্ম, কর্তব্যকর্ম, শাস্ত্রবিধান, সুনীতি, সাধনার পথ, শ্রেণিবিশেষের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য, স্বভাব, শক্তি, গুণ, নৈতিক সততা, সতীত্ব (স্ত্রীলোকের ধর্ম), রাশিচক্রে লগ্ন হইতে নবম স্থান। উল্লেখ্য, সবগুলি শব্দ একই ব্যঞ্জনা ও গুরুত্ব বহন না করলেও অভিধানে এগুলি সমার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার কারণ এই যে যুগভেদে ও ব্যক্তিভেদে মানুষ ধর্মকে উক্ত বিভিন্ন শব্দনিহিত তাৎপর্য অনুসারেই বুঝেছে, বা বুঝে নিতে চেষ্টা করেছে।
মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী বলে পরিচিত হলেও সব মানুষের চিন্তাশীলতার পরিধি সমান নয়। অধিকাংশ মানুষ প্রচলিত নিয়মনীতি, বিধিব্যবস্থা, চিন্তাপদ্ধতির কোলে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রথাগত জীবনযাপন করে যায়। ধর্মপ্রসঙ্গেও প্রযোজ্য একই কথা। ধর্মকে সৃষ্টিকর্তা ও পাপ-পূণ্যাদিবিষয়ক বিশ্বাস এবং ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে অনুসৃত আচার-আচরণ, উপাসনাপদ্ধতি এবং সাংসারিক দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্পর্কিত কার্যাবলীর নামেই অধিকাংশ মানুষ চেনে ও পালন করে। প্রথার আনুগত্য বৃহত্তর সংখ্যক মানুষকে কেমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে, তার চরমতম দৃষ্টান্ত হিন্দুসমাজের বর্ণভেদ প্রথা চার হাজার বৎসর যাবৎ টিকে থাকা এবং প্রতিপালিত হওয়ার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকী বর্ণব্যবস্থার যারা নির্মম শিকার, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্রবর্ণের মানুষরাও এই বিধান মেনে চলেছেন চারহাজার বছর ধরে। তবে বিশ্বের ভাবুক ও দার্শনিকদের কাছে ধর্ম এখন পর্যন্ত অমিমাংসিত বিষয়। কেউই ধর্ম সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা ঘোষণা করতে পারেন নি। এমনকী যে কার্ল মার্ক্স গত দেড়শোবছর ধরে নাস্তিকতার প্রবক্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধিতাকারী হিসেবে বিশ্বজুড়ে সকল ধর্মব্যবসায়ীর নিন্দা ও অভিশম্পাত কুড়িয়ে আসছেন, তাঁকে পর্যন্ত এখন ধর্মের ব্যাপারে দোদুল্যমান একজন দার্শনিক হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে প্রবলভাবে। বলা হচ্ছে কার্ল মার্ক্স নাকী আসলে কখনোই ধর্মের বিরোধিতা করেননি। বরং মানুষ ও সমাজের জন্য তিনি ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গেছেন অকুণ্ঠভাবে। তাঁর বহুল প্রচলিত ‘ধর্ম জনসাধারণের আফিম’ বাণীটিরও নবতর ব্যাখ্যা উপস্থিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এটি মার্ক্স-এর একটি বাণীর খণ্ডিত অংশ। পূর্ণাঙ্গ বাক্যটি হচ্ছে- ‘ধর্ম নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতে পরম আশ্বাস, নিষ্প্রাণ অবস্থার প্রাণ, ধর্ম জনগণের আফিম।’ ব্যাখ্যা অন্যরকম হয়ে যায় যখন বলা হয় মার্ক্স ধর্মকে যন্ত্রণানিবারক ওষুধ হিসেবে আফিম বলেছেন, নেশা হিসাবে নয়। কেননা ১৮৪৪ সালে এই বাক্য লেখার সময় চিকিৎসাক্ষেত্রে আফিমের ব্যবহার ছিল যন্ত্রণানাশক ওষুধ হিসাবে। তখন আফিমের মলম ও আফিমের টিংচার ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হতো ব্যথা-নিবারক ওষুধ হিসাবে। আরও একধাপ এগিয়ে রবার্ট পেইন তাঁর ‘দি আননোন কার্ল মার্ক্স ইন জার্মান আইডিওলজি’ বইতে মার্ক্সকে দিয়ে একথাও বলিয়ে নিয়েছেন যে-
‘গড নীরবে কথা বলেন, কিন্তু সঠিক ও সুনিশ্চিতরূপে বলেন। মানুষকে পশু থেকে পৃথক করা যায় তার সচেতনতা দিয়ে এবং তার ধর্ম দিয়ে।’
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু শুধু রাজনীতিবিদই ছিলেন না, চিন্তাবিদ ও পণ্ডিত হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতিমান ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি কোনো ধর্মাচরণ করতেন না বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর সন্নিহিত মানুষরা। ধর্মনিরপেক্ষ এই রাষ্ট্রনেতা কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত যাতে প্রদর্শিত না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেছেন সবসময়। সেই নেহরুও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও শুভমূল্যবোধগুলির সম্পর্ক নিয়ে নিজের দ্বিধার কথা উল্লেখ করেছেন একাধিকবার। একটি ভালো সমাজের জন্য কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন তার উত্তরে তিনি বলেছেন-
‘আমি কিছু মাপকাঠির কথা বলব। আপনি এগুলিকে নৈতিক মাপকাঠি বলতে পারেন। প্রতিটি ব্যক্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীর জন্য এই মাপকাঠিগুলির প্রয়োজন। যদি এগুলির অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে যাবতীয় পার্থিব উন্নতি সত্ত্বেও আপনি কোনো মঙ্গলজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছুতে পারবেন না। এই মাপকাঠিগুলি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখা যাবে তা আমি জানি না। এ ক্ষেত্রে একটি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে। কিন্তু ধর্ম তার আচার-আচরণ ও নিয়ম-পদ্ধতিসহ আমার কাছে দূর্বোধ্য। ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন আত্মিক ও চারিত্রিক মাপকাঠিসমূহকে আমি খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিন্তু আমি জানি না, এগুলিকে কীভাবে আধুনিক জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানো যাবে। এটি একটি সমস্যাই বটে।’ (মাইকেল ব্রেচারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ১৯৫৬)
নেহরু এই মাপকাঠিগুলির মধ্যে স্থান দিয়েছিলেন আত্মসম্মানবোধ, কর্মউদ্দীপনা, শিষ্টাচার, বদান্যতা, উন্নত মনোবৃত্তি, পরমতসহিষ্ণুতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, শ্রমের মূল্য ইত্যাদিকে। তিনি এগুলিকে ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি করে দেখতে রাজি হন নি আরো অনেকের মতো। তিনি এগুলিকে ‘ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন চারিত্রিক ও আত্মিক মাপকাঠি’ বলেছেন। কিন্তু অন্যেরা, বিশেষ করে আমেরিকার একাডেমি অব সায়েন্স-এর প্রেসিডেন্ট ক্রেসি মরিসন তা মানতে রাজি নন। তাঁর মতে এইসব উচ্চ নৈতিকতা মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া আদৌ অর্জন করতে পারে না।
কাজেই সব দার্শনিক, ভাবুক ও সৃষ্টিশীল মানুষকে ধর্মের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হতে হয়। তবে অন্যদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের মতো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বা চাপিয়ে দেওয়া ধর্মব্যবস্থাকে তাঁরা বিনা প্রশ্নে সর্বাংশে মেনে না নিয়ে নিজেদের জন্য ধর্মের একটি সংশোধিত ও নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করে নেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতো সংবেদনশীল ও মননশীল মানুষের ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রেও এই কথাটি প্রয়োজ্য।
সৃষ্টিশীল মানুষের কোনো কিছুই যেমন একান্ত নিজের থাকে না, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ধর্মচিন্তাও তেমনই তাঁর একার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে তাঁর বিভিন্ন রচনায়, বক্তব্যে ও প্রতিবক্তব্যে।
সংস্কৃতিকে ধর্মের ওপরে, সংস্কৃতিবানকে ধার্মিকের ওপরে স্থান দিয়েছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দিকে অভিযোগের তর্জনি তুলেছেন বিভিন্ন সময়ে। কেননা তাঁর মতে ধর্মের কর্মপরিধি সীমিত। ধর্ম চায় ‘মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে, বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, বৃক্ষটিকে নিষ্কণ্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য।’ প্রথাগত ধার্মিক হচ্ছে সেই ব্যক্তি, ‘আল্লাহ যার থাকে আকাশে।’ আর সেই ব্যক্তির দ্বারা যে কোনো অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। ‘আল্লাকে যে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণির সিট রিজার্ভ করার আগ্রহে- অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ।’
প্রথাগত ধর্ম মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কাছে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়ায় আরও বেশকিছু কারণে। যেমন তাঁর একই প্রবন্ধে বলা হচ্ছে-
‘চিন্তা বা বিশ্বাসের ব্যাপারে সমতা স্থাপন করে মানুষের স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করতে চায় বলে ধর্ম অনেক সময়ে কালচারের পরিপন্থী।’
ধার্মিকের কাছে আল্লার হুকুম আর বেহেস্ত-দোজখই বড় হয়ে ওঠে, সূক্ষ্ম অনুভূতির কথা নয়। অপরপক্ষে ‘কালচার্ড’ বা সংস্কৃতিবান ব্যক্তি এই সমস্ত ত্রুটি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য সংস্কৃতিকেই নিজের বর্ম বানিয়ে রাখেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায়-
‘শকুনের মতো সে মরা গরুর সন্ধানে থাকে না, বুলবুলের মতো তার দৃষ্টি থাকে গোলাপকুঞ্জের দিকে। লোকটির মনে সৌন্দর্য্য ও প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় কীনা, তার বুকে মানুষ ও মনুষ্যত্বের জন্য সজীব দরদ আছে কীনা, নিষ্ঠুরতাকে সে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে কীনা, তা-ই সে দেখতে চায়, এবং দেখতে পেলে খুশী হয়ে সাতখুন মাফ করে দেয়। কেননা, সে জানে প্রেম ও সৌন্দর্য্যরে পূজারীদের জীবনে এখানে-সেখানে স্খলন-পতন থাকলেও যাকে বলা হয় ব্যাভিচার, তা কখনো থাকতে পারে না। লোভ ও লালসার হাতে ক্রীড়নক হতে চায় না বলে তারা সর্বদা পবিত্র।’
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রচনায় সংস্কৃতি ও ধর্মের তুল্যমূল্য বিচার আমাদের নিয়ে যায় ধর্মের উৎপত্তির কাছে। সমস্ত দর্শনের, বিশেষত আধুনিক দর্শনের সর্ববৃহৎ বুনিয়াদি প্রশ্ন হচ্ছে চিন্তা ও সত্তার সম্পর্ক সংক্রান্ত প্রশ্ন। খুব আদিমকাল থেকেই, মানুষ যখন নিজের শরীরের গঠন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তখন তার বিশ্বাস হয়েছে যে তার চিন্তা ও সংবেদন তার নিজস্ব দৈহিক প্রক্রিয়া নয়, বরং কোনো এক বিশিষ্ট আত্মার কাজ। সেই আত্মা বাস করে দেহের মধ্যে, এবং মৃত্যুর সময় পরিত্যাগ করে দেহকে। সেই প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষকে এই আত্মার সঙ্গে বহির্জগতের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করতে হয়েছে। এই আত্মা যদি মৃত্যুর পরে দেহকে পরিত্যাগ করেও বেঁচে থাকতে পারে, তাহলে তার আরও এক স্বতন্ত্র মৃত্যুর সম্ভাবনা আবিষ্কার করার কারণ থাকে না। এইভাবেই একসময় ধারণা জন্মায় যে আত্মা অমর। মনে রাখতে হবে মানব-মানস বিকাশের ওই পর্যায়ে এই অমরত্বের কথাটি মোটেও শান্তনা নয়, বরং এমন এক নিয়তি যার বিরুদ্ধে যুঝবার সমস্ত প্রক্রিয়া নিষ্ফল। এবং তাকে ধরা হতো রীতিমতো এক দূর্ভাগ্য বা গ্রেট ট্রাজেডি হিসেবে। ধর্মমূলক শান্তনার আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়, বরং আত্মার অস্তিত্ব একবার স্বীকার করার পরে দেহাবসানে আত্মা নিয়ে কী করা যাবে এ বিষয়ে সাধারণ সীমাবদ্ধতাপ্রসূত বিহ্বলতা থেকে উদ্ভূত হলো ব্যক্তির অমরত্ব সংক্রান্ত ধারণা। ঠিক এইভাবেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিতে নরত্ব আরোপ করে প্রথম দেবতাদের আবির্ভাব ঘটল এবং ধর্মের আরও বিকাশের পর্যায়ে এই দেবতারা ক্রমশই অপার্থিব রূপ লাভ করতে থাকলেন, এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যা দেখা দেয়, সেই বিমূর্তায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের মনে উদ্ভব হলো একেশ্বরবাদী ধর্মগুলির একক অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ধারণা।
কিন্তু রেনেসাঁ বা পূনর্জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই ধর্ম, আত্মা, প্রকৃতি, ঈশ্বরবিষয়ক প্রশ্নগুলি পূনর্বিবেচনার জন্য পুরোপুরি তীক্ষ্ণতার সঙ্গে উত্থাপিত হলো। উত্থাপিত হলো আরও কিছু প্রশ্ন। যেমন চিন্তার সঙ্গে সত্তার সম্পর্ক কী, চৈতন্য আর সত্তার মধ্যে কোনটি আদি, ঈশ্বর কি জগৎ সৃষ্টি করেছেন, নাকী চিরকালই জগতের অস্তিত্ব ছিল?
আমাদের দেশে, বিশেষত কলকাতাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত খণ্ডিত রেনেসাঁ এইসব মৌলিক প্রশ্নের কাছে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে নি। তবে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, জবরদস্তিমূলক প্রথা-শরিয়ত, ধর্মের সামাজিক ভূমিকা, বিভিন্ন ধর্মীয় চিন্তা ও প্রথার পূনর্নবায়ন- ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ঠিকই। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিওসহ ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেনসহ শিখা গোষ্ঠীর ভাবুকবৃন্দ এইসব প্রশ্ন ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন বিভিন্নসময়ে। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ধর্মচিন্তাও এই আলোকেই সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যাত হতে পারে।
নিজেকে ধর্মের বাইরে নিয়ে গিয়ে নয়, বরং ধর্মে আস্থাশীল ব্যক্তিদের মতোই একজন হয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন ধর্মীয় অচলায়তনের বিরুদ্ধে। জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখের মতো তিনিও মনে করতেন-
‘মানুষ যখন প্রকৃতিতে প্রথম উদ্ভূত হলো তখন সে নেহায়েতই প্রাকৃতিক জীব, মানুষ নয়; মানুষ হলো মানুষেরই সৃষ্টি, ইতিহাসের সৃষ্টি, সংস্কৃতির সৃষ্টি।’
এই কারণেই মোতাহের হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতিকে ধর্মের ওপরে স্থান দিতে পারেন। তিনি মনে করেন, ‘যখন ধর্ম হয়ে উঠতে পারে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত প্রেম আর সমস্ত বিশ্বব্যাপী অখণ্ড অদ্বৈতের অনুভূতি’ একমাত্র তখনই সে হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতির সমান। একমাত্র তখনই ধর্ম ও সংস্কৃতি বিবেচিত হতে পারে সমার্থক শব্দ হিসাবে। আর সেই অভাববোধ থেকেই তিনি বলতে পারেন, আমাদের জাতীয় মানসিক ও সামাজিক দৈন্যর প্রধানতম হচ্ছে- ‘আমাদের ধর্মবোধের দৈন্য…। শাস্ত্রের প্রতিটি শব্দ আমরা নির্বিচারে পালন করি, তার জন্য বিচার-বুদ্ধি যুক্তিতর্ক সমস্ত কিছুই সানন্দে বিসর্জন দেই… শাস্ত্র আর মহাপুরুষ অন্তর-বিকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের হৃদয়ের ওপর চেপে বসে আছে।’ অন্যদিকে সংস্কৃতিই হচ্ছে সেই নিরাময়-উপাদান যা মানুষকে দিতে পারে সামাজিক ও মানসিক মুক্তি।
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ধর্মচিন্তায় পূর্বসূরী একটি ইসলামি উপদলের চিন্তার প্রভাব কিছুটা পরিলক্ষিত হয়। সেটি হচ্ছে মুতাজিলাপন্থী ধারা ও তাদের পূর্বস%
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..