সঙ্গীতের ভাষা, ভাষার সঙ্গীত

মুবিন খান
মুক্তগদ্য
Bengali
সঙ্গীতের ভাষা, ভাষার সঙ্গীত

আমার আপু ছুটিতে ড্রাইভে বেরিয়েছেন। আপুর গাড়িটি ইউরোপের একটা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। দেখে মনে হয় সে পথটা লোকালয়ের বাইরে। আমি যেহেতু ইউরোপের ও রাস্তায় কখনও যাই নি তাই মনে হওয়াটাই ভরসা। ইস্‌! এত্ত সুন্দর পথটা! দুপাশে বড় বড় গাছ, মাঝে মাঝে এদিক ওদিক জলাশয়, দূরে পাহাড়-পর্বতও আছে! অমন প্রকৃতি দেখলে পরিব্রাজক হতে ইচ্ছে করে। আপুর মতোই ও পথ ধরে চলতে ইচ্ছে করে। গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে করে, ‘আমার এ পথ চাওয়াতেই আনন্দ।’

এতক্ষণের ওই বর্ণনাটি আপু গাড়ির উইন্ডশিল্ডের পেছনে বসে তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন। বিপুল সৌন্দর্য মানুষ একলা উপভোগ করতে চায় না। পারেও না। প্রিয়জনদের দেখাতে চায়। প্রিয়জনেরা তার সঙ্গে দেখতে পেলেই সৌন্দর্য অবলোকন আর উপভোগ সার্থক হয়। তো ধারণ করা সে চলমান চিত্রটি আমিও দেখে ফেললাম। দেখে খুব মুগ্ধ হলাম। ফোনের ক্ষুদ্র পর্দায় দেখবার পরেও ওই মুগ্ধতা আমার অভ্যন্তরে গুনগুনিয়ে উঠল, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।’

আমি কখনও সশব্দে গান করি না। করলে অতি অবশ্যই মৃত রবীন্দ্রনাথ ঠিকই ফিরে এসে আমার নামে মামলা ঠুকে দিতেন। কিন্তু লিখে বললে তো করবার কথা না। আমি সেখানে গানটির কথা বলে দিলাম। বাইরের কোলাহলে শুরুতে তাই লক্ষ্যই করি নি গাড়িতে হিন্দি গান তার মূর্ছনা ছড়াচ্ছিল।

আপু তখন প্রশ্ন তুললেন, ‘মুবিন, সঙ্গীতের কি কোনও ভাষা থাকে?’

অতি যৌক্তিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নর সহজ ও সাবলীল উত্তর হলো, না, থাকে না। সঙ্গীতের আসলেই কোনও ভাষা থাকে না। সত্যিই কি থাকে না! থাকবার কথা তো নয়! কিন্তু আছে তো। সঙ্গীতের ভাষা তো সুর। যার বর্ণমালা সাতটি। সাতটি বর্ণেই সে সকল কথা বলতে থাকে। ঠিক রামধনুর মতো। রামধনু সাতটি রঙ নিয়েও যেমন সকল রঙ ধারণ করে!

কিন্তু এই যৌক্তিকতা মাথা থেকে আপুর প্রশ্নটি তাড়াতে পারল না। সরলীকরণের উত্তরটা তো ওই যে, সঙ্গীতের কোনও ভাষা থাকে না। সঙ্গীত খুব নিশ্চিতভাবেই দেশ কাল পাত্র আর স্থানের ঊর্ধ্বে। কিন্তু গানের তো ভাষা থাকে। ওই গাড়িতে বাজতে থাকা- হিন্দি গান, অথবা গাড়িতে বসে আপুর ধারণ করা চলমান চিত্রটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে গান, ‘আমার এ পথ চলাতেই আনন্দ’- একটা বাংলা গান। আবার হয়ত জন ডেনভার হলে গাইতে শুরু করে দিত, ‘কান্ট্রি রোড টেক মি হোম’-ইংরেজি গান। এখানে আমরা কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে বিশেষায়িত করেই সঙ্গীতকে আলাদা করলাম।

কিন্তু ধরুন আপনি মোজার্ট শুনছেন, কিংবা রবি শঙ্কর শুনছেন অথবা হালের ভেনেসা মায়ি শুনছেন, এঁরা পৃথিবীর তিন প্রান্ত আর সময়ের মানুষ, এঁদের ভাষাও আলাদা, কিন্তু এঁদের সঙ্গীতের ভাষাটা সঙ্গীতই, ওই সাতটি বর্ণ। সাতটি সুরের মেলবন্ধন। সার্বজনীন। বাণী নির্ভর নয়। কেবলই সুর। বর্ণ, শব্দ আর বাক্যভাষার ভাষার ঊর্ধ্বে সে সঙ্গীত। শুধুই সুর নির্ভর। কিন্তু সঙ্গীতের তাল, লয়, আর সুরের সঙ্গে যন্ত্রের যে র্মূছনা, সেটা ঠিকই সমানভাবে আন্দোলিত করে। কিন্তু ভাষাটা নেই। সেটা গানের বাণীর ভাষা।

আমাদের অনেক বন্ধু সঙ্গীত করত। কেবল গান করা নয়, যন্ত্রও বাজাত অনেকে। বেশির ভাগ গিটার নিয়ে মেতে থাকলেও কেউ কেউ বিভিন্ন যন্ত্রর দিকেও আগ্রহী থাকত। একবার সঙ্গীত করা পাগলা কিসিমের এক বন্ধুর বাসায় গেলে বন্ধুটি খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, এই পিসটা শুনে দেখ্‌, গিয়োরগে যামফিরের প্যান ফ্লুয়েট।’

আমার জীবনেও আমি গিয়োরগে যামফিরের নাম শুনি নি। এই পৃথিবীর কোন্‌ প্রান্তের মানুষ তিনি তাও জানি না। এমনকি প্যান ফ্লুয়টে কি দ্রব্য সেটিও চিনি না। ফ্লুয়েট মানে যে বাঁশি, কেবল সেটা জানি। ওটুকু জ্ঞান নিয়েই আমি প্রবল জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব করে, অভ্যন্তরের বিতৃষ্ণা লুকিয়ে, গিয়োরগে যামফিরের বিজাতীয় বাদ্যবাজনা প্যান ফ্লুয়েট শুনতে প্রস্তুত হলাম। বন্ধুটি একটা সিডি বের করে প্লেয়ারে ঢুকিয়ে চালু করতেই র্সবাঙ্গ চমকিত করে মধুমাখা মিষ্টি একটা মূর্ছনা কবিতার ছন্দোময়তায় ঘরময় তো বটেই, শরীর বেয়েও ঘোরাঘুরি করতে লাগল। পুরোটা সময় স্থবির হয়ে বসে বসে শুনতে হলো।

ও বাজনা আমাদের সকলের পরিচিত। ছোটবলো থেকে বিটিভির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন আর নাটকের আবহ সঙ্গীত হিসেবে অল্প ক’সেকেন্ড শুনেছি আমরা। ওই প্রথম পুরোটা শুনলাম। টাইটেলটাও মনে রাখি নি তখন। তাই এরপর আর খুঁজে পাই নি। কিছুদিন আগে এক বন্ধু ঠিক ওই বাজনাটিই তাঁর দেয়ালে শেয়ার করেছিলেন। তখনই টাইটেলটাও জানা গেল, একই সঙ্গে গিয়োরগে যামফিরকেও দেখা হলো। ধবধবে সাদা চুলের কালো স্যুট পরা বৃদ্ধ একজন মানুষ প্যান ফ্লুয়েট নামক সেই আশ্চর্য বাঁশি দিয়ে সেই বাজনা- ‘দ্য লোনলি শেপার্ড’ বাজাচ্ছেন। আমি আরও একবার বিমুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে শুনেছিলাম।

ইংরেজি ‘মিউজিক’ আর ‘সং’ শব্দ দুটো যে অর্থে, বাংলার ‘সঙ্গীত’ আর ‘গীত’ বোধহয় সেই একই অর্থে উৎসারিত। আমাদের উপমহাদেশের রাগ সঙ্গীতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সে সঙ্গীতও বাণী নির্ভর নয়, সুর নির্ভর। সুরের কারুকাজ। বাণী আছে বটে, যেমন ‘জোছনা করেছে আড়ি/ গলি দিয়ে চলে যায়/ আসে না আমার বাড়ি/ লুটিয়ে রূপোলী শাড়ি’- এই দুটি বাক্যই নানা সুর রাগ আর মাত্রায় গেয়ে বাজিয়ে কন্ঠশিল্পী আর বাদক ঘন্টা পার করে দেবেন। আমাদের মধ্যে যারা বাণী নির্ভর গানের ভক্ত, তারা আবার নিজেদের জন্যে আমাদের মতো একটা সংস্করণ করে নিয়েছি। সেখানে কণ্ঠশিল্পী অল্প ক’ মিনিটে পুরো গানটা গেয়ে ফেলেন।

বাংলা গানের শুরুটা তো হাজার বছরের, ভাষার মতোই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর আদি নিদর্শন চর্যাপদ। এই চর্যাপদ বস্তুত উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতেরই আদি রূপ। চর্যাপদের সুরারোপিত পরিবেশনা বাংলা গানে নিয়ে এসেছিল এক ধরণের ধ্রুপদী শৃঙ্খলা। তখন থেকে বাংলায় ধর্মীয় ভাবধারার গানই প্রাধান্য পেয়ে আসছিল। এমন কি প্রেম-ভালোবাসার যে গান, সেও চলে গেল রাধা-কৃষ্ণর দখলে। লোক সঙ্গীতও চলছিল। সে আমাদের আলোচ্য নয়। আমরা আধুনিক গানে আসি। আধুনিক বাংলা গানের প্রধান পুরুষ বলা হয় রামনিধি গুপ্তকে, যিনি নিধুবাবু নামেও পরিচিত। নিধুবাবুর টপ্পা। প্রথম যুগের আধুনিক গানের নির্মাণশিল্পী হিসেবে নিধুবাবুর সঙ্গে সঙ্গে কালিদাস চট্টোপাধ্যায় বা কালী মীর্জা, রঘুনাথ রায়, শ্রীধর কথক প্রমুখের নাম পাওয়া যায়। না, আমরা এ আলোচনাতেও যাব না।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যে যুগটাকে বাংলার নবজাগরণ বলা হয়, ও সময়টা অবধি আমাদের বাংলা গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর না আসা পর্যন্ত ওই রাগভিত্তিক সঙ্গীতকে নির্ভর করেই চলত। রবীন্দ্রনাথ এসে গানের ধারাটি দিলেন পাল্টে। রবীন্দ্রনাথ গানে বাণীকে প্রধান করে তুললেন। তারপর রজণীকান্ত সেন, দ্বীজেন্দ্রলাল রায় ও অতুল প্রসাদ সেন সে ধারায় যুক্ত হলেন। পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলামও বাণী নির্ভর সঙ্গীতকে ভিন্ন এক মাত্রায় পৌঁছে দিলেন।

তাহলে কি বাণী নির্ভর এই গানের ধারা বাংলা থেকে প্রবর্তিত? সম্ভাবনা প্রবল। শুরুতে নাটকে গানের ব্যবহার। পরে চলচ্চিত্রেও গান প্রাধান্য পেতে লাগল। বাংলা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হওয়ার ফলে সংস্কৃতি চর্চার মূল ধারাটি তখন বাংলাই নিয়ন্ত্রণ করত। পরবর্তীতে চলচ্চিত্র শিল্পর হাত ধরে ধীরে ধীরে সে নিয়ন্ত্রণ হিন্দির কাছে চলে গেল।

চলচ্চিত্র শিল্পে যন্ত্র থেকে গায়কী- সকল সঙ্গীত একটা বিশাল জায়গা দখল করে রেখেছে। সেটা কি পাশ্চাত্য, কি প্রাচ্য- সকল চলচ্চিত্র শিল্প মাধ্যমেই। এখন তো চলচ্চিত্র যতটা শিল্প তারচেয়ে বেশি পণ্য। ফলে এর নির্মাণের পেছনে বেচবার ভাবনাটি সবার আগে প্রাধান্য পায়। পাবেই। কেননা ব্যবসায়ী মুনাফা বোঝে, শিল্প বোঝে না। তো চলচ্চিত্রে গান ব্যবহারের সংস্কৃতি পশ্চিম থেকে এলেও গানের ওই চটুলতা মূলত হিন্দি থেকেই আগত। কি বাণীতে, কি সুরে। ওটা পণ্য বলেই। আর পণ্যকে হতে হয় চটকদার। ঝলমলে চটকদার আর আকর্ষণীয় না হলে ক্রেতা সে পণ্য কিনবেন কেন! ফলে ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ গান, রুচি আর ধারার সংস্কৃতি বিবর্তিত হতে হতে ‘এই পথে পথে আমি একা চলি’ হয়ে যায়। ধ্রুপদী হয়ে ওঠে চটুল। কেননা নিয়ন্ত্রণটা বাণিজ্যর। স্বার্থটাও বাণিজ্যরই।

শিল্প যখন পণ্য হয় তখন মৌলিকত্ব হারায়। আর পণ্য যখন মৌলিকত্ব হারায়, একই সঙ্গে তার গুণগত মানও হারায়। আর গুণগত মানের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রও হারায়। ফলে ‘জোছনা করেছে আড়ি’ যেভাবে প্রজন্মর পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকে, তেমনি ‘এই পথে পথে আমি একা চলি’ ধারার গান ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না। হারিয়ে যায় কদিনেই। শিল্পর যত মাধ্যম আছে তার মধ্যে সঙ্গীত মানুষের ইন্দ্রীয়তে সবচেয়ে দ্রুত জায়গা করে নেয়। কবিতার মতোই। ওই কাব্যে সঙ্গীতকে পরিয়ে দিলেই তো নির্মাণ হয় গান। আর গান করে গড়বার জন্যে যে কাব্য রচিত হয়, সেটাই গীত। তার সঙ্গে সুর, যন্ত্রাণুষঙ্গ আর গায়কী মিলে তবেই তো নির্মিত হয় গান।

গানের এ চটুলতায় বাংলা গানকে অতিক্রম করেছে হিন্দি গান। সুর বাদ্য বাজনা আর গায়কী- সবদিক দিয়েই খুব জমকালো। ফলে শ্রোতাকে আকর্ষণ করে খুব সহজে। এই চটকদার পণ্য এখন আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে আমাদের ছেলেমেয়েগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের প্রায় সকল সামাজিক অনুষ্ঠানেই এখন চলেছে হিন্দি গানের বিশাল আধিপত্য আর প্রতিপত্তি। চলে নাচও। এখনকার অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়ে দশ বারো বছর ধরে স্কুল কলেজে ইংরেজি অবশ্য পাঠ্য হিসেবে পড়ে-শিখেও ইংরেজিতে ঠিকমত একটা আবেদনপত্র, নিজের ভাষায় একটা চিঠি কিংবা রচনা লিখতে পারে না। অথচ জীবনে কারও কাছে হিন্দি ভাষা না শিখেও দিব্যি কি অবলীলায় হিন্দিতে কথোপকথন চালিয়ে যায়! কেউ কেউ তো লিখতে পড়তেও শিখে যায়! আমি নিজেই কারও কাছে না শিখেও হিন্দি ভাষাটা লিখতে পড়তে পারি।

এটাই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এ ধারা আজকের নয়। পাকিস্তান হওয়ার আগে থেকেই চলছিল। আগে এ আগ্রাসনটা হিন্দির সঙ্গে উর্দুরও ছিল। পাকিস্তান হওয়ার পড়ে উর্দুরটা প্রবল হলো বটে, রইল হিন্দিরটাও। সে আগ্রাসন এতটাই প্রবল ছিল যে বাংলাদেশ হওয়ার পরও এদেশের অনেক সিনেমা হলে উর্দু চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। বালক বেলায় আমরাও পরিবারের সকলের সঙ্গে ঢাকার পিলখানা সিনেমা হলে গিয়ে উর্দু সিনেমা দেখেছি। সিনেমার নাম মনে আছে, গল্প মনে নেই। সিনেমার নাম ‘আরমান।’ আরেকটা দেখেছিলাম, ‘ভাই ভাই।’ সিনেমা শেষে সকলে উর্দু গান গুনগুন করতে করতে হল থেকে বেরিয়েছিল। আরেকবার হলে গিয়ে টিকেট না পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। হাউজফুল ছিল ওদিন। সাংস্কৃতিক ওই আগ্রাসনে গানের ভূমিকা প্রধান হয়ত নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ। আগ্রাসনকে হেলেদুলে দুলকি চালে হেঁটে আসবার পথটা গানই তৈরি ও প্রশস্ত করে দিয়েছে।

হোটেলে রেস্তরাঁয় বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ার আর টুইন ওয়ানে বাজত উর্দু গান। আমার বড় ভাইয়ের প্রিয় ছিল মেহেদী হাসানের গান। মেহেদী হাসান শুনতে শুনতে, মেহেদী হাসানের সঙ্গে গুনগুন করতে করতে বড়ভাইয়ের কণ্ঠই হয়ে গিয়েছিল মেহেদী হাসানের মতো। তিনি যখন একলা ঘরে পায়চারী করতে করতে সুর ভাঁজতেন, মনে হতো মেহেদী হাসানই গুনগুনিয়ে রেওয়াজ করছেন। কৈশোরে আমারও গুলাম আলী ভালো লাগত। এখনও হয়ত ভালো লাগবে। কিন্তু এখন শুনি না। এঁদের ওপর আমার রাগ আছে। থাকুক, এটা ভিন্ন বিষয়।

তো আশির দশকের শুরুর দিক থেকে উর্দুর আধিপত্য কমতে থাকে। সে জায়গা নিতে শুরু করে হিন্দি গান আর তার সঙ্গে চলচ্চিত্ররা। তবে যেহেতু বাংলা চলচ্চিত্রর দর্শক তখনও মধ্যবিত্ত, বাংলা চলচ্চিত্র তখনও মেধাবী মানুষেরাই নির্মাণ করেন, ফলে বাংলা গানও শুনত লোকে। কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের আধিপত্যর প্রবহমানতা ধীরে ধীরে সকলের অজান্তেই আর সবকিছুর সঙ্গে বাংলা গানকেও কোণঠাসা করতে লাগল। হিন্দির সঙ্গে যুক্ত হতে লাগল মেধাহীনদের আধিপত্য।

আজকে বাংলা গান থেকে ভাষা হয়ে সংস্কৃতি পর্যন্ত সকলই কোণঠাসা। দেশের বাইরে অনেক ভারতীয়র সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। তাঁদের অনেকে কখনও কখনও গল্প করতে আসতেন। কাজের ফাঁকেই চলত আড্ডা। একবার তেমনই বন্ধু, তিনি পেশায় শিক্ষক, বলছিলেন, ভারতে ইংরেজির আধিপত্যর কথা। ইংরেজির আধিপত্যে হিন্দি ভাষার আজ দৈন দশার কথা বলছিলেন আক্ষেপে। ইংরেজি ভাষার দৌরাত্ম্য যে ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রাস করে ফেলছে, সেটাও বলছিলেন।

আমি হাসতে হাসতে তাঁকে বলছিলাম, ‘গ্রাস করে ফেলছে! এখনও করে নি বলছেন!’

ভদ্রলোক চমকে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তখনই তাঁর স্ত্রী তাঁকে ডেকে ইংরেজিতে বললেন, ‘ডার্লিং, দেখ তো কোনটা ভালো লাগে?’ ভদ্রলোক তখন আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।

না, আমাদের এখনকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার- ‘না শেখায় বাংলা, না শেখায় ইংরেজি’ আশঙ্কা হলেও আমাদের আতঙ্ক নয়। আমাদের এখনকার আতঙ্ক হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি। মাতৃভাষার চর্চা, সেটাও দেশপ্রেমের অংশ এবং নদীর মতো সংযোগ ও ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী। সেটা অচল যে হয়ে রয়েছে তা তো নয়, চলছে তো। এগুচ্ছে। উন্নতিও হচ্ছে। কেননা উন্নতির নিরিখ রয়েছে। সাক্ষরতার হার, শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু এগুচ্ছে যে সেটা কোন্‌ দিকে? গন্তব্যটা কি?’

আমাদের আজকের গান, চলচ্চিত্র, সংস্কৃতি, শিক্ষা সর্বোপরি রাজনীতি যে এগুচ্ছে সেটা কোন্‌ দিকে? গন্তব্য কোথায়?

মুবিন খান। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ