সঞ্জু আর এলিজাবেথ

সায়ন্তনী নাগ
গল্প
সঞ্জু আর এলিজাবেথ

অ্যাদ্দিনে মালটাকে বাগে পাওয়া গেছে। উফ, গত বারো বছরে দাঁত ফোটানো যায়নি মাইরি। কতবার গেট অব্দি গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। জন্তুটা কি দিনে রাতে কখনো ঘুমোতো না? যতবার উঁকি মারার চেষ্টা করেছি, দেখি শালা জিভ বার করে সামনে বসে আছে। চেহারাখানা যা একটা ছিল না! গায়ে পুরো আলো পিছলে যায়! হবে নাই বা কেন? অমন তেলে জলে মানুষ! ধুর বে, মানুষ বলছি কেন? তবে মানুষের চেয়েও বেশি খাঁই ছিল ওর। বুড়ো তো রোজ জলিলের পাঁঠার দোকানে লাইন লাগাত। আরও কত কি! হলুদ প্যাকেটের খাবার, ভিটামিন ড্রপ, ইঞ্জেকশন। মাঝে মাঝে মনে হত, চারপেয়েটার পিছনে না ঢেলে বুড়ো তো একটু আধটু দরিদ্রনারায়ণ সেবাও করতে পারে। আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কুত্তার গু-মুতে ঘেন্না ছিল না বুড়োর, অথচ আমাদের দিকে এমন করে তাকাতো, যেন লোম ওঠা ঘিয়ে ভাজা নেড়ি!

অবশ্য তাই তো আমরা। ও বেটাচ্ছেলে নাকি ঠান্ডা মেশিন ছাড়া ঘুমোতে চাইত না। না না, আবার ভুল বললাম। ও বেটা ছেলে না, মাদী কুত্তা। কতবার বাচ্চাও পয়দা করেছে। তখন তো বাড়িতে ডাক্তার অব্দি এসেছে। ভাবা যায়! আমি তো নাকি মাতৃভবনের মেঝেতেই…! আয়ামাসি ছিল। ডাক্তার আসা পর্যন্ত মায়ের আর তর সয়নি। কচিবেলাতেই ছানাগুলোকে বিলিয়ে দিত বুড়ো। না, বিলিয়ে না, বেচত। পঞ্চা বলেছে একেকটার দাম নাকি দশ পনের হাজার টাকা! ক্লাস ফাইভে পড়া ছেড়েছি বলে আমি যেন বুঝি না কিছু! বিশু ওর খুড়তুতো বোনটাকে বিলেতে কোন বড়লোকের বাড়ি কাজে পাঠালো, আসলে স্রেফ বেচেই দিল, আর কোনোদিন নাকি বাড়ি আসতে দেবে না, তাও হাজার পাঁচেকের বেশি পায়নি। তবে পঞ্চা যদি খানিকটাও ঠিক বলে, তবে বুড়োর বাচ্চা পয়দা করিয়ে কত রোজগার রে শালা! প্রতিবারই তিন চারটে করে বিয়োয় কুত্তিটা। অন্তত পাঁচবার বিইয়েছে। ধুস, অত শূন্য টুন্য গুণতে গেলে গুলিয়ে যায় আমার!

বাড়িটায় মাইরি পুরো শ্মশানের শান্তি এখন। এমনি তো থাকার মধ্যে ছিল বুড়ো আর বুড়ি। একটাই ছেলে ওদের, কোথায় বাইরে যেন পড়তে গেছে। সে যখন ছিল, তখন সে শালাও কুত্তাটাকে এমনভাবে আগলে রাখত, দেখে গা জ্বলে যেত। ছোট থাকতে তো কোল থেকেই নামাতো না। কত আদরের ডাক…লিজ, লিজা, লিজি! ভালো নাম নাকি এলিজাবেথ। পারি না, পারি না! এতকাল জানতাম শুধু মানুষের বাচ্চারই ভালো নাম হয়। যেমন স্কুলের খাতায় আমাদের নাম ছিল পঞ্চানন, বিশ্বনাথ, সুদীপ, সঞ্জয়। এখন তো আমাদেরই আর সে সব নাম মনে নেই। সবাই পঞ্চা, বিশু, দীপু, সঞ্জু বলেই চেনে। এ তল্লাটের সবাই।

নাহ। সবাই কি আর চেনে! বস্তির সবাই চেনে, এই আর কি। ফ্ল্যাটবাড়ি বা বাগানঅলা গেটঅলা বাড়ির লোকেরা চিনতে চায়না। কেউ কেউ দেখলে সরে যায়, আর কেউ কেউ এমন ভাব করে যেন আমরা ধারেকাছে নেই-ই। যেমন বুড়োটা। মালটা যখন ওর লিজাকে চেন বেঁধে হাওয়া খাওয়াতে আর হিসি-হাগু করাতে বেরোতো, তখন ত্রিসীমানায় আর কেউ আছে কিনা, নজরে পড়ত না। হ্যাঁ, দেখার মত চেহারা বটে একটা! আর তেমন গলার জোর। যদিও আওয়াজ খুব কমই বের করত। কিন্তু ও যে একবার শুনেছে, তারই পেন্টুলুন হলুদ হবার জোগড়। সেবার সরস্বতী পুজোর আগের রাতে প্যান্ডেল সাজাতে টব কম পড়ায় পাঁচিল টপকে ঢুকেছিলাম। তখন শুনেছিলাম। পালাতে গিয়ে সেই যে একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম ডান হাঁটুতে, এখনও টনটনায় মাইরি! তাও নাকি বাঁধা ছিল। দীপু পরে বলেছে। ওর মা ও বাড়িতে বাসন মাজে কিনা, জানে অনেক! এই কুত্তারও নাকি আলাদা থালাবাটি আছে। দীপুর মা মাজতে বেশি পয়সা নেয়। কুত্তা বলে। কিম্বা কুত্তি বলে। দীপু বলেছে চেনে বাঁধা না থাকলে নাকি আমার জামার বোতাম কিম্বা হাওয়াই চটিটুকু পাওয়া যেত পরেরদিন!

হাঁটত যখন, এ তল্লাটের সব কটা নেড়ি দুপায়ের ফাঁকে ন্যাজ গুটিয়ে সরে থাকত। বুড়োর হাতে একটা বেঁটে লাঠি থাকত, কোনোদিন কাজে লাগাতে হয়নি, সবাই আগেই বেপাত্তা। আরও তো কত বাড়ির কুকুর লেকের ধারে চরতে আসে, এমন চেহারা আর একটারও ছিল না। ছোটবেলায় যেটাকে বুড়োবুড়ি কোল থেকে নামাতো না, এখন দুপায়ে দাঁড়ালে বোধহয় ওদের কাঁধের কাছে পৌঁছে যেত শালা! দীপু বলে পেডিগ্রির মাল। সেটা কি, জানতে চাওয়ায় আমায় খেঁকিয়ে উঠেছিল-‘আরে, তার মানে জন্মের ঠিক আছে। বাপের নাম সাট্টিফিকেটে লেখা আছে, তোর মত না!’ শুয়োরের বাচ্চা! সেবার পঞ্চা, বিশু, পাতা সবাই মিলে আমার হাত থেকে দীপুকে বাঁচিয়েছিল। নইলে হত এক কান্ড! আমায় বেজম্মা বলা? মা সেই কোন ছোটবেলায় ও পাড়ার ফাটা লেবুকে বাপ বলে চিনিয়েছিল…আজ সে বেঁচে থাকলে…যাক গে!

কতদিন…কতদিন শালা ব্যাগ হাতে সেলসম্যানগুলো গেট খুলতে সাহস পায়নি। ওই যে লটকে আছে না, ‘কুকুর হইতে সাবধান’! শেতলা পুজো, কাত্তিক পুজোর চাঁদা চাইতে পারিনি। ভিখিরিরা গেট পেরোতে পারেনি। ফুটপাথের, বস্তীর গেঁড়েগুলো ছুঁতে পারেনি ওদের গাছের একটা ফুল। আর এখন? কোন শালা বাঁচাবে বুড়োকে? শিষ দিয়ে গান গেয়ে উঠি আনন্দে। কতদিন…কতদিন মালটার চকচকে লোম আর ঠান্ডা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে পিছলে গেছি। শেষদিকটা অবশ্য খুব ভুগিয়েছে। বড়লোকের কুত্তা শালা, মরবেও রাজার মত। হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি, ওষুধ আনা…এ বয়সে সব করেছে বুড়ো। নাকি স্যালাইন দিতে হত হাত ফুঁড়ে। ধুর শালা, আবার ভুল বললাম। পা ফুঁড়ে। ওই বাঘের মত চেহারার অনেকটাই টসকে গেছিল। বুড়োর লাল গাড়ির পিছনের সীট জুড়ে যে মাল বসে থাকত বাজারহাট করার সময়, শেষদিকে নাকি বিছানাতেই হাগু-মুতু করে ফেলত। বাইরে থেকে ছেলেটাও চলে এল শেষ হপ্তায়। যেন বাপ মরছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছিল। বারো বছর নাকি ও জাতের তুলনায় অনেকখানি। শেষ দিনটায় খুব চিল্লিয়ে কেঁদেছিল। দীপুর মা বলেছে। বুড়ি নাকি কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। অন্য বাড়ির কুত্তা মরলে কবরখানায় নিয়ে যায়। বুড়ো শালা তাও দেয়নি। এই প্রথমবার ওর বাগানওলা বাড়িটায় ঢুকে পড়েছিলাম আমি, আমরা…পঞ্চা, বিশু, দীপু, শিবে, পাতা…সবাই। মাটি খুঁড়ে মালটাকে পুঁতে দিতে হয়েছিল ওদেরই বকুল গাছের নীচে। মাটি চাপা দেবার সময়েও মাইরি হেভি আনন্দ হচ্ছিল। যা শালা, কুত্তি জন্ম শেষ! বুড়ি-বুড়ো কাছাকাছি থাকেনি, শুধু ছেলেটা দুটো পাঁচশো টাকার নোট বার করে দিয়েছিল। রাতে হারুর ঠেকে লাল জল আর নাড়িভুঁড়ি ভাজা! জিভে জল এসে গেল মাইরি।

গেটটায় আজও ‘কুকুর হইতে সাবধান’ লটকানো। ঠেলে ঢুকে পড়ি সোজা। কেউ ডেকে ওঠে না। কেউ তেড়ে আসে না। বারান্দার এক কোণে শালার বকলস, চেন, কলার, জলের বাটি, কম্বল। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে আছে রবারের হাড্ডি, বল। ছেলেটা ফিরে গেছে জানি। বুড়ো কই? দেখি পিছনের উঠোনে সেই বকুল গাছের তলায় ধুলোর ওপর থেবড়ে বসে আছে বুড়ো। মালটার কবরের ওপর হাত রেখে বিড়বিড় করে ডেকে যাচ্ছে…’লিজি, লিজা, লিজ…!’ আর দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। ধুলো লাগছে গায়ে, জলে ভিজছে জামা, কলার। বুড়োর খেয়াল নেই।

রক্ষাকালীর চাঁদার বইটা পকেটে পুরে চুপচাপ বেরিয়ে আসি। জানি, পঞ্চা শিবেরা খিস্তি করবে। করুক গে। আমি শালা মা কালীর কাছে পরের জন্মে কুত্তি হতে চাইব!…মা মাগো!

সায়ন্তনী নাগ। কবি, লেখক ও প্রকৌশলী। জন্ম ১৯৭২, কোলকাতা। পেশায় ভারতীয় রেলের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। লিটল ম্যাগাজিন ও বাণিজ্যিক পত্রিকা দুইয়েই লেখালেখি। সাত বছর নতুনশতক মনকলম পত্রিকার সম্পাদনা, এখনো ওই পত্রিকার সাথেই যুক্ত। প্রকাশিত বই- 'চেনা গন্ধ চেনা অবিশ্বাস' (কাব্যগ্রন্থ), 'কাকে দেব শুদ্ধকল্যাণ'...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..