কবিশেখর কালিদাস রায়ের চাঁদ সদাগর কবিতার একটা পংক্তি ছিল, ‘মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে, করে দেবমহিমা নির্ভর’। জোয়ান অব আর্কের কথা মনে এসে যায়। এক মে মাসে তাকে চার্চের বিচারে ধর্মদ্রোহিতার দায়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আবার সেই মৃত্যুর পাঁচশো বছর পুরতে যায় যায়, এমন সময় আবার সেই চার্চ জোয়ানকে সন্ত হিসেবে ঘোষণা করল।
১৪৩১ সাল। মে মাসের ত্রিশ তারিখ। ঊনিশ বছরের একটা মেয়েকে থামে বেঁধে পুড়িয়ে মারছে সভ্যতা। পুড়িয়ে মারছে চার্চের ক্ষমতা। মেয়ে অবিচল। মরণের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে ধর্মীয় বিচারকদের নির্দেশ দিচ্ছে, আমার সামনে পবিত্র ক্রশ রাখো।
মেয়েটাকে পোড়ানোর দায়িত্ব যার কাঁধে ছিল, সেই জিওফ্রয় থেরেজ ভীষণ রকম ভয় পেয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেক হাহুতাশ করেছিল, আমি একটা পবিত্র মানুষকে পুড়িয়ে মারলাম গো!
ফ্রান্সের ডমরেমি গাঁয়ের ঊনিশ বছরের চাষি মেয়ে জোয়ান যেন দৈবাদেশ পেয়েছিল, তোমাকে স্বদেশভূমির তরে যুদ্ধযাত্রা করতে হবে। মাতৃভূমি করে আহবান।
ইংল্যাণ্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। সংঘাত বেধেছিল ফ্রান্সের রাজমুকুট কার মাথায় থাকবে, সেই নিয়ে। উত্তরাধিকারী কে? যুদ্ধ বেধেছিল ১৩৩৭ সালে। ইতিহাসে তার নাম শতবর্ষের যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর পঁচাত্তর বছর পরে ১৪১২ সালে ডমরেমি গ্রামের মণ্ডল মশায়ের মেয়ে জোয়ানের জন্ম। গেঁয়ো নিরক্ষর মেয়ের মনে হয়েছিল তাকেই যুদ্ধ করে দেশ বাঁচাতে হবে। কেননা তার স্বপ্নে এসে কথা কয়ে গিয়েছিলেন আর্ক অ্যাঞ্জেল সেন্ট মাইকেল, সেন্ট মার্গারেট, আর আলেকজান্দ্রিয়ার সেন্ট ক্যাথারিন। তেরো বছরের মেয়ে বাপের বাগানে বসে দিব্যদৃষ্টিতে আকাশমার্গে সন্তদর্শন করে নির্দেশ পেয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে লোকের মুখে মুখে ভেসে বেড়াত একটাই কথা। দূর অজ পাড়া গাঁ থেকে একটা মেয়ে উঠে আসবে। সেই বাঁচাবে ফ্রান্সকে। জোয়ানের মনে হল, আমি সেই মেয়ে। সে কাছের মানুষদের বলল, নিয়ে চলো আমাকে রাজার কাছে। সন্তরা আমাকে বলে গেছেন রাজা সপ্তম চার্লসের পাশে দাঁড়াতে।
দিনের পর দিন মাতৃভূমি ফ্রান্সের ভূখণ্ড হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে। প্যারিস হাতছাড়া হয়ে গেছে। রুঁয়ে হাতছাড়া হয়ে গেছে। গেঁয়ো মেয়ে জোয়ান ভাবে কবে তার সঙ্গে রাজার দেখা হবে। রাজার হয়ে সে যুদ্ধে যাবে। দেশমাতৃকার হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার করবে।
এক আত্মীয়কে ধরে করে কোনোমতে কাছের শহরটায় পৌঁছতে পেরেছিল জোয়ান। তখন সে ষোড়শী বালিকা। শহরে ছিল একটি দুর্গ। জোয়ান দুর্গাধিপের কাছে আবেদন করল, তাকে যেন রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সে নিজে রাজাকে বাঁচাতে যুদ্ধে না নামলে রাজার আর কোনো আশা নেই। ষোলো বছরের মেয়ের মুখে এমন বাগবিন্যাস শুনে দুর্গের অধিপতি ফুঃ ফুঃ করে উড়িয়ে দিলেন। তবুও জোয়ান আশা ছাড়ল না। শেষ পর্যন্ত সতেরো বছর বয়সে রাজার বাড়ি ঢুকতে পেল জোয়ান। ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস তখন শিনন শহরে রাজদরবার করেন। রাজ দরবারে পৌঁছে জোয়ান রাজাকে বলল, আমি আপনার সাথে একান্তে একটু কথা বলতে চাই। একান্তে তার সাথে কথা বলে রাজা প্রসন্ন হলে। চলল মেয়ে রণে চলল।
জোয়ানের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল রুয়েঁতে। ফ্রান্সের যে অংশটা ইংল্যাণ্ড দখল করে নিয়েছিল, সেই অংশের শাসনকেন্দ্র ছিল রুয়েঁ। ১৪৩১ সালের জানুয়ারির নয় তারিখে বিচার শুরু হল। সে যুগে ছিল ইনকুইজিশন। সে ছিল চার্চের পরিচালনায় আদালত। জোয়ানের বিরুদ্ধে হেরেসির অভিযোগ আনা হয়েছিল। হেরেসি মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মভাবনার পদ্ধতিতে আস্থা না রাখা। তুমি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে না হলে, যদি তোমার একটা নিজস্ব জীবনভাবনা রইল, তো বুঝবে ঠেলা। গাঁয়ের মেয়ে জোয়ানের সেই দশা হল। ফ্রান্সের ডমরেমি গাঁয়ের চাষার বেটি জোয়ান।
যা কিছু বলতে হবে, যুক্তি দিয়ে বুঝে তারপর বলতে হবে।
জোয়ানকে বিচারশালায় তোলা হলে সে ওই যুক্তির কথা তুলল। সে বলল, আপনারা ধর্মীয় বিচারকগণ দেখছি কেবল ইংল্যাণ্ড আর বার্গাণ্ডির লোকজন। ফ্রান্সের কোনো ধর্মনেতা আপনাদের মধ্যে নেই কেন? তেমন লোকেদের ডেকে পাঠান! বিচারকদের একটা ভারসাম্যপূর্ণ বেঞ্চ হোক!
বিচারের মধ্যে আরো গোলমাল ছিল। প্রথমতঃ চার্চের আইন, যাকে এক্লাসিয়াসটিক্যাল ল বলা হত, তাতে প্রধান বিচারকদের এলাকা ভাগ করা থাকত। জোয়ানের ক্ষেত্রে যিনি বিশপ অর্থাৎ প্রধান বিচারকের কাজ করলেন, ওই এলাকাটি তাঁর বিচারের আওতাতেই পড়ে না। জোয়ানের বিরুদ্ধে বিচারের নামে যে যাত্রাপালা সাজানো হয়েছিল, তাতে পয়সা ঢেলেছিল ইংরেজরা। আর ইংরেজরা নিজেদের তাঁবেদার এক বিশপকে বিচার প্রক্রিয়ার মাথায় বসিয়ে নিয়েছিল।
জোয়ানের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ার গোড়ায় আরো একটা গুরুতর গলদ ছিল। কারো বিরুদ্ধে ইনকুইজিশনের মামলা আনতে গেলে তার কাজ যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় ভাবধারার পরিপন্থী, তা যথেষ্ট প্রমাণ সহকারে দেখাতে হয়। চার্চের তরফে যে ধর্মীয় আইনজীবীর উপরে এই মামলা দাঁড় করাবার জন্য প্রাথমিক প্রমাণ খুঁজে বের করার দায়িত্ব ছিল, সেই নিকোলাস বেইলি জোয়ানের বিরুদ্ধে বলার মতো কোনো প্রমাণ খুঁজে পান নি।
কোনো প্রাথমিক প্রমাণ ছাড়াই স্রেফ গায়ের জোরে, ন্যক্কারজনক ভাবে নিজেদের গড়া এক্লাসিয়াসটিক্যাল আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জোয়ানের বিরুদ্ধে মামলা চালু করে দিল চার্চ।
চার্চের আরও একটা জঘন্য ত্রুটি ছিল। আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য জোয়ানকে কোনো আইনজীবীর সাহায্য নিতে অনুমতি দেয় নি চার্চ।
অথচ জোয়ান, মাত্র ঊনিশ বছর বয়সের চাষির বেটি জোয়ান, নিজে নিজে মাথা খাটিয়ে একটা ভয়ঙ্কর একচোখো গুণ্ডামির বিরুদ্ধে কথা বলে গিয়েছে। ভয়ে কুঁকড়ে যায় নি। মনের স্থৈর্য হারায় নি। সে দেশকে বাঁচাতে চেয়েছিল। বিচারশালায় অন্যায় আক্রমণের হাত থেকেও বাঁচতে চেয়েছিল। এই বাঁচতে চেষ্টা করাটা একটা বড় সদগুণ।
চার্চের আয়োজনে মামলায় ঊনিশ বছরের মেয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, সে ধর্মদ্রোহী। আসলে চার্চের বকলমে ইংল্যাণ্ড সদ্যোতরুণী মেয়েটির মৃত্যু নিশ্চিত করতে চাইছে। ও মেয়ে যে ইংলিশ অহমিকার মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছে। দিনের পর দিন ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে গিয়েছে অজ পাড়াগাঁ থেকে একটা মেয়ে উঠে আসবে। সেই বাঁচাবে ফ্রান্সকে। বুড়োরা ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নওজোয়ানদের বুকে সেই স্বপ্ন বুনে দিয়েছে। আর গেঁয়ো মেয়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের বাহিনীর সাথে রাজার দেওয়া বর্ম আর অস্ত্র নিয়ে যেই না এসে সাধারণ সেনানীদের সামনে এসে দাঁড়ালো, অমনি বুড়োদের মুখে মুখে শোনা প্রাচীন গল্প জেগে উঠল তরুণ প্রাণে। এই তো সেই দেবী, শক্তিস্বরূপিণী, শত্রুসংহারকারিণী, তেজোময়ী, বিঘ্নবিনাশিনী। ফ্রান্সের সেনানীরা গেয়ে উঠল, মাতা, তোমাকে বন্দনা করি। নব উদ্দীপনায় দীপ্ত তারা। এরপর শুধু ইতিহাস। পূর্ব গগনে বাজে জয়ভেরী, জয়ডঙ্কা। নতুন প্রাণশক্তিতে জেগে উঠল ফ্রান্স। আর পেতে লাগল জয়। একের পর এক রণাঙ্গনে ইংল্যাণ্ড পড়ল বিপর্যয়ের মুখে। তাই ইংল্যাণ্ড তো এ মেয়েকে ছাড়বে না। তাকে যতো রকমে যতোদূর হেয় করা যায়, ততোদূর হেয় করে মৃত্যুদণ্ড দেবে। ইংল্যাণ্ড এই যুদ্ধবন্দীকে এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি দেবে যে চিরশত্রু ফ্রান্স জীবনে সেই অপমান ভুলতে পারবে না। আসলে জোয়ানের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করাটা ইংল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ মহলের পলিটিক্যাল দায়। যে করেই হোক, চার্চকে পকেটে পুরে নিয়ে জোয়ানের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করো। তার জন্য যা করতে হয় তাই করো। নিয়মকানুন মানার সময় এটা নয়। ইজ্জত রক্ষার জন্য সভ্য নিয়মকানুন ভুলতে ইংরেজদের বাধে না। ইংরেজরা রণাঙ্গনে মীরজাফর খুঁজে নিতে জানে। আর অনেক সময়েই অশক্ত অসুস্থ ভীত সন্ত্রস্ত নেতৃত্ব নিজের আর পরিবারের সদস্যদের বেঁচে থাকার তাগিদে আত্মসমর্পণের কথা ভাবে। আত্মসম্মানবোধ খুইয়ে জীবশরীরটুকুর বেঁচে থাকাকে প্রাধান্য দেয়।
যুদ্ধ জিততে জিততেও ফ্রান্সের একপক্ষের দোদুল্যমান অবস্থান লক্ষ্য করেছিল জোয়ান। কৌশলগত কারণ নাম দিয়ে ইংল্যাণ্ডের সাথে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। একা জোয়ানের কিছু করার ছিল না। তবুও সে ফুঁসে উঠতে চেয়েছিল। আবার শুরু হল যুদ্ধ। একজায়গায় তার পায়ে কঠিন আঘাত হয়েছিল। ট্রেঞ্চে অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর নিজের দলের লোকজন তাকে উদ্ধার করে। ১৪৩০ সালের তেইশে মে জোয়ানকে ঘিরে ফেলল একদল ইংরেজ তীরন্দাজ বাহিনী। তীর বিঁধল বর্ম পরা জোয়ানের ঘাড়ের কাছে। একটু কাবু হয়ে পড়া মেয়েটাকে ঘোড়া থেকে হিঁচড়ে টেনে নামাল এক তীরন্দাজ। শত্রুবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে চলল ।
বন্দিনী জোয়ান বেশ কয়েকবার পালাবার উদ্যোগ নিয়েছিল। একবার তো সে প্রায় সত্তর ফুট উঁচু থেকে জলার কাদায় ঝাঁপিয়ে ছিল। এরপর ইংরেজরা আর কোনো ঝুঁকি নেয় নি। রুয়েঁ শহরেতে , যেখানে ইংল্যাণ্ড অধিকৃত ফ্রান্সের শাসনকেন্দ্র, সেখানেই ১৪৩১ সালের ৯ জানুয়ারি বিচার অথবা অবিচার সাজানো হল জোয়ানের বিরুদ্ধে।
কতো রকম দ্বিচারিতা জানে ইংরেজরা। পোষা একটা বিশপ, একলেসিয়াসটিকাল আইন বা চার্চের আইনে যার সেই জায়গায় বিচারের একতিয়ারটাই নেই, তেমন একটা বিশপকে রাখা হল বিচারসভার শীর্ষে। এই লোকটা আসলে ইংরেজ শাসকের পায়ে তৈলমর্দন করে বিশপের চেয়ার বাগিয়েছিল।
বিচার যে করতে হবে, তার জন্য প্রাথমিক ভাবে একটা অপরাধ খুঁজে বের করা দরকার করে। জোয়ানের বিরুদ্ধে তেমন প্রাথমিক অপরাধটুকুই খুঁজে পেলেন না চার্চের নোটারি নিকোলাস বেইলি।
বিচারপতিদের মধ্যে বাছাই করে ইংল্যাণ্ডের আর বার্গাণ্ডির ধর্মনেতাদের রাখা হল। ফ্রান্সের ধর্মনেতারা জায়গাই পেলেন না। জোয়ানকে ইংরেজরা ভয়ঙ্করতম শত্রু হিসেবে গণ্য করেছিল। অথচ বাস্তবে ও মেয়ে অস্ত্র নিয়ে রণাঙ্গনে নেমেছিল কি না, সে নিয়ে ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করেন। এমনকি সে মেয়ে সৈন্যদল পরিচালনা করত, এমন দাবিও প্রশ্নাতীত নয়। জোয়ান নিজে বলেছে, সে যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈন্যকেও আঘাত করে নি, হত্যা তো দূরের কথা। জোয়ান আরো বলেছে, তার হাতে শুধুমাত্র পতাকাটুকুই ছিল, কেননা সে মনে করত, তার পতাকা চল্লিশখানা তরোয়ালের চাইতেও বেশি কার্যকরী। বাস্তবে সৈন্যদের পরিচালনা করতেন অভিজাতরা। কিন্তু পতাকা হাতে জোয়ানের উপস্থিতিই সেনাবাহিনীর মধ্যে মত্তহস্তীর বল যোগাত। অভিজাতরা জোয়ানের পরামর্শ নিতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, জোয়ানের মধ্য দিয়ে ঐশী শক্তি কথা বলে।
কিন্তু একটা ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে যে, জোয়ানের স্রেফ উপস্থিতিই সেনাবাহিনীকে দুর্মর সাহস যুগিয়ে দুর্ধর্ষ করে তুলত।
এহেন জোয়ানের বিরুদ্ধে ইংরেজের তর্জনীচালিত ধর্ম আদালত অভিযোগ আনল ধর্মদ্রোহিতার। অথচ মুশকিল ছিল যে শুধুমাত্র ধর্মদ্রোহিতার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। চার্চের আইনে তা বলে না। ধর্মদ্রোহিতার সাথে আরো কিছু অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারলে তবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়। ইংরেজের পোষা ধর্ম আদালত জোয়ানের বিরুদ্ধে পুরুষদের পোশাক পরার মতো অপরাধের মামলাও তুলল। মেয়ে হয়ে পুরুষের পোশাক পরা? ছি ছি, সে যে ভয়ানক ধর্মবিরোধী কাজ!
কেন জোয়ান মেয়েটা পুরুষের পোশাক পরেছিল। নারীর শরীর ভীষণ ভাবে লোভের শিকার। শত্রু এলাকার মধ্য দিয়ে যাবার সময় লোকজনের লালসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকে নিজের নারীশরীরের উচ্চাবচতা, পেলবতা আড়াল করার বাস্তবিক প্রয়োজন ছিল জোয়ানের। পুরুষের পোশাক, তার আঁটোসাঁটো বাঁধুনি, যে সুরক্ষা দিতে পারে, সে সব দিনের প্রথানুগত মেয়েলি পোশাকে তা নিশ্চিত করা শক্ত হত। বাস্তব অভিজ্ঞতাকে মাথায় নিয়ে জোয়ানের পরনে ছিল পুরুষালি পোশাক। ইংরেজের কারাগারে বন্দিত্বের সময়ে তার সমস্ত পোশাক কেড়ে নিয়ে তাকে বেআব্রু করে রেখেছিল রক্ষীরা।
তারিখটা ছিল ১৪৩১ সালের মে মাসের ত্রিশ তারিখ। জোয়ান মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারার হুকুম ছিল। রুয়েঁ শহরের একটা লম্বা থামে জোয়ানকে বাঁধা হয়েছিল। মেয়েটা পুড়ে মরলে ইংরেজরা কয়লাগুলো সরিয়ে তার আংরা হয়ে যাওয়া শরীরটা নেড়েচেড়ে বের করে দেখায়। যাতে কেউ বলতে না পারে যে সে মরে নি আর জ্যান্ত অবস্থায় পালিয়েছে।
ইংরেজরা জোয়ানের ওই আংরা হয়ে যাওয়া দেহটা আরো দুবার পোড়ায়, যাতে দেহটা পুরোপুরি ছাই হয়ে যায়, আর কেউ যাতে সে মেয়ের ভস্মাবশেষ সংগ্রহ করতে না পারে, তার জন্যও কড়াকড়ি ব্যবস্থা ছিল। তারপর জোয়ানের ছাইটুকু সীন নদীর জলে ফেলা হয়েছিল।
সেদিন বিচারের নামে পুরো মাত্রায় অবিচার হয়েছিল ঊনিশ বছরের মেয়েটার উপর। জোয়ানের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়াটি ছিল ভয়ঙ্কর ভাবে একচোখোমিতে ভরা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা ছিল যে জোয়ানকে যে কোনো ছলেই হোক মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। বিচারপতি র আসনে যে ধর্মনেতারা ছিলেন, তাঁরা সকলেই হয় ইংরেজ ছিলেন, নয় তো বার্গাণ্ডির লোক। জোয়ানের দেশ ফ্রান্সের কেউ ছিলেন না। অথচ সে যুগেও নিয়ম ছিল যে, কারো বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ উঠলে বিচারকের আসনে নিরপেক্ষ ধর্মনেতাদের রাখতে হবে। অন্ততপক্ষে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আশ্চর্যের বিষয় যে জোয়ান, তখন মোটে ঊনিশ বছরের একটা একলা মেয়ে, সে প্রশ্ন তুলেছিল, বিচারকদের মধ্যে ফ্রান্সের কেউ নেই কেন? আইনের শাসন বজায় রাখতে ফ্রান্সের তরফের বিচারক আনানো জরুরি। তার যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছিল।
জোয়ানের মতো একজন তেজস্বিনী নির্ভীক বন্দীর হাত থেকে দ্রুত রেহাই পেতে চেয়েছিল ইংরেজরা। আর চটপট কঠিনতম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যতদূর হৃদয়হীনতার সাথে সম্পন্ন করে ফ্রান্সের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে নিশ্চিত করা যায়, তা ভেবে রেখেছিল। জোয়ানকে যে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে, তা বিচারের আগেই ঠিক করে রাখা ছিল। একটা নাটকবাজি করবার জন্য বিচার প্রক্রিয়া সাজানো হয়েছিল।
তুখোড় বুদ্ধিমান ধর্মনেতারা জোয়ানকে ফাঁদে ফেলবার জন্য কূট প্রশ্ন সাজিয়েছিল। তারা জোয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, তুমি কি ঈশ্বরের করুণার ছত্রছায়ায় আছ?
এটা আসলে একটা জঘন্য ফাঁদ। সে যুগে চার্চের মত ছিল যে, কেউ স্থির নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না যে সে ঈশ্বরের ছত্রছায়ায় আছে। কেননা, তখনকার আইনে তেমন বলাটা ধর্মদ্রোহিতার নিদর্শন।
তাহলে জোয়ান যদি বলে, আমি ঈশ্বরের করুণার ছত্রছায়ায় আছি, তাহলেই ধর্মদ্রোহিতা প্রমাণিত হয়ে যায়।
আর যদি জোয়ান বলে যে, না, আমি ঈশ্বরের করুণার ছত্রছায়ায় নেই, তাহলে তার তরফে দোষ স্বীকার করা সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
তখন তেমন দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া সহজ হয়ে যায়।
চাষীঘর থেকে উঠে আসা নিরক্ষর মেয়ে জোয়ান এই কূট তার্কিক প্রশ্নের মোক্ষম জবাব দিয়েছিল। জোয়ান বলেছিল, আমি যদি ঈশ্বরের কৃপাবৃষ্টির নিচে না থেকে থাকি, তাহলে করুণাপূর্বক তিনি আমাকে সেখানে রাখুন। আর যদি ঘটনাচক্রে আমি সেখানে থেকে থাকি, তাহলে ঈশ্বর আমাকে সেখানেই রাখুন।
একটা নিরক্ষর মেয়ে অবলীলায় এই কূট ফাঁদ এড়িয়ে যেতে পারল দেখে বিচারকেরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
পুরুষের পোশাক পরেছে, এই অজুহাত দেখিয়ে ধর্মীয় আদালত জোয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেবার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ কারাগারে তার গা থেকে যারা কাপড় কেড়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে রেখে দিল, তাদের উপর দোষ বর্তাল না।
যে রাজপুরুষ তাকে একদিন টেনে নিয়ে গেলেন, তাঁর উপর কোনো দোষ বর্তাল না! বিচারের নামে ভয়াবহ অবিচার করা হল জোয়ানের উপর। অথচ ঊনিশ বছরের মেয়েটাকে নাকি যুদ্ধ যাত্রার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেন্ট মিকায়েল, সেন্ট মার্গারেট আর সেন্ট ক্যাথারিন। জোয়ানের সঙ্গে কথা বলবেন বলে তাঁরা আকাশ থেকে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু অবিচার যখন ঘটছে, তখন আর সন্তদের নেমে আসার ফুরসৎ হল না। শেষমেশ জোয়ানকে সন্ত বানিয়ে ফেলা হল। ১৯০৯ সালের এপ্রিলে বিটিফিকেশন হল তার। আর তারও এগারো বছর পর ১৯২০ সালের মে মাসে ক্যাননাইজড হল। মৃত্যুর পর পাঁচশো বছর পুরতে যায় যায়, জোয়ান হয়ে গেল পুরোদস্তুর সন্ত।