
পাতার ধমণীর মধ্যে বয়ে যাওয়া রক্ত
দেখলাম এখানে জ্যোৎস্নার মতাে রােদ তার লাল হলুদ পশম নিয়ে মােড়ার ওপর বসে আলাে সেলাই করছে। ফুটফুটে আসমানি ফ্রকের তলায় পাহাড় কেমন ঘাড় নুইয়ে দিচ্ছে আর পাইন-সাইপ্রাস-ওক্ গাছের খোঁচ্ অনেক চাতল দূর পর্যন্ত চাঁদোয়া টাঙিয়ে চলেছে। সবুজ কোথাও খুব গাঢ়, খুব জটিল। কোথাও জলের ভেতরের রঙের মতো নীলাভ। কোথাও ঘাসের বুকের ক্ষত, নদীর ভেতরের কুশ। কবে, কোন্ আদিম পেল্লাই এক চুপতরঙ্গ এসে তাকে অহল্যা করে চলে গেছে; তারপর কোনদিন রােদ ভেঙে, পাথরের বুক থেকে সুর বাজেনি তার। নদী তার দু’চাকার লাল সাইকেল ফেলে কতদূর হেঁটে হেঁটে আসছে, ফুলের ছোট চৌকো খামারে সূর্যমুখীদের মধ্যে তাই শব্দহীন প্রপাত ফিরে আসে। ইন্সব্রুক থেকে এই রাস্তায় এসে গেলাম মিউনিখ শহরে। অক্টোবর উৎসবের শেষ রেশটুকু ঘ্রাণের মধ্যে নিয়ে বেরথস্ গ্যাডেনের বিরাট হ্রদের জােয়াবে, লঞ্চে চড়ে পোঁছলাম বার্থলােমিউ জনপদে। ক্ষীণ গন্ধ তুষার-ভেজা বাতাসের। পাহাড় ছাপিয়ে একদিকে সবুজ অভ্রের মতাে দীর্ঘ খামারে শান্ত ভেড়াদের দল। আমরা এই নিরিবিলি দুপুর পোহানাের ভেতরে দূরবীণের মতাে ঢুকে পড়লাম। ক্রমশ তীব্র বাতাস কমে এল, কান মাথা মােড়ানাে টুপিরা বিদায় নিল ব্যাগে – হ্রদের জলে মৃত পাতার টুপ্ টাপ্ গাছের থেকে গড়িয়ে কেমন সতেজ হয়ে যেতে লাগল আর রােদ তখন ঘােরানাে সিঁড়ি দিয়ে পা ফেলে উঠে যাচ্ছে কনিগসি-র ফুসফুসের মধ্যে। শ্বেত রাজহাঁসের পাশে তখন গলা নামিয়ে মাছের খোঁজে ময়ুরকন্ঠী হাঁসেরা – হ্রদের জলে নীল-কমলা মাছের ঝাঁক এগিয়ে এলে এক মূহূর্তে তুমি সত্যি আর মিথ্যে গুলিয়ে ফেলবেই, দেখাে। সেন্ট বার্থলােমিউ আলাে বুনতে বুনতে সেই ম্যাজিক দেখাতে পারে।

”আমি কোথাও যাবাে না, কোথাও যাওয়ার নেই”
ব্যাভারিয়া অঞ্চলের এই প্রাকৃতিক হ্রদের একদিকে পাহাড়শ্রেণী, গাছে মােড়া কম্বলের মতাে মসৃণ আর শান্ত। মধ্যে চলে গেছে খােয়া রাস্তা, ওপাশে সেন্ট বারলােমিউ গীর্জা, গীর্জার ঘড়িতে এইমাত্রো দুটোর ঘণ্টা বাজলাে। কখনাে দূরের অরণ্য থেকে হরিণের দল নেমে আসে, সরু লম্বা গাছের ছালে উদাসীন গা ঘসে আবার বিকেলে ফিরে চলে যায়। তােমার ঘুমন্ত মুখে তখন হ্রদের রং জমে ওঠে, আমি দেখি চামড়ার মতাে খয়ের পাথরের ওপর জল এসে একটু করে তার কপাল ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে।

বােটিং শুরু হতেই সরাই-এর আলাে জ্বলে উঠলাে। একতলায় একটি রাশভারি দেওয়ালের কোণে বিরাট আয়নার তলায় তখন কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর চাঁদ উঠেছে। স্মোক্ড্ স্যামন এবং ট্রাউট্, ছড়ানাে মরিচ আর ব্রকোলি – এই আমাদের সন্ধ্যাভােজ। স্বাদে গন্ধে আমােদিত হলাম। নৌকা নিয়ে কেউ চলে যাচ্ছে সূর্যাস্ত দেখবে বলে। পাহাড় চূড়া থেকে হিমাদ্র বাতাস গাছের কমলা রঙের পাতা উড়িয়ে নিয়ে চললাে। এমন কোনাে মিস্টিক মন্ত্র জানে এই দেশ, এই গােলাপি আলাের ফোঁড়, যেন ওপিঠে সুতো খুলে গিয়ে সব গাছের পায়ে এলােমেলাে ডাঁই-করা সুতাে-লাল, কমলা, অল্প গেরুয়া, হলুদ, ক্রোম হলদে, ধূসর বর্ণ। রঙের বন্যায় প্রতিটি গাছতলার কী সমারােহ! বিরহী সব গাছেদের আমার পুরুষ মনে হচ্ছিল কেবলি। সাড়া নেই, মুগ্ধতার অন্ধকূপে নিজেকে এককভাবে হত্যা করতে করতে আকাশ তার মূর্ধা স্পর্শ করলাে। অমনি বৃষ্টি। মাটির তালু ছুঁয়ে ছােট্ট দ্বীপের সমস্ত গাছের দগ্ধ পাতা উড়ে ছুটে চললাে তৃষ্ণার্ত। ওদের মুখ জলের দিকে। মীনকন্যার দেশে রাজপুত্র পাতারা তাদের গেরুয়া পিঠ যদি সামান্য ছুঁয়ে দিতে পারে – মহাভারতের সেই সুবর্ণ নেউলের মতাে? যদি কোন এক শৈলশহরের উপত্যকায় একদিন নাম-না-জানা ফোন নম্বর ভেসে ওঠে সাগরতীরের গাঁয়ে, পেছনে ফেলে সমস্ত রুমাল উপত্যকা – কত হাজার ফিট, প্রায় ৪১০০ হবে, বা তারও সামান্য বেশি, তখন নদীরাও সখীর মতাে দুটো বেণী বেঁধে নেয় ঘুঙুর বাজানাে পায়ে। সেই টেলিফোন আগুন শিখার মতাে। আমাকে কাঁদায়, গভীরতর কোনাে লিপ্ততার মানে বুঝিয়ে বলবার জন্য অপর প্রান্তে তুমি রাত্রিভর হাতের ব্যথায় মাথা তুলতে পারে না, তবু চুপ করে থাকো। কোনাে সাড়া নেই। তারপর মিউনিখ থেকে ছুটে যাই সল্সবের্গ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপারে আলাে তখন ঝিলমিলি এঁকে দিচ্ছে ভাসমান সীগালের পাখনায়। এক চিলতে সাঁকো, আমাদের দুজনের মধ্যে যেন দুই দ্বীপের মতাে। তার মধ্যে কত কোটি তালা। ব্রিজের প্রতিটি গ্রিডে বাঁধা অজস্র বন্ধ তালা। নাম লেখা। একদিন ঐ দ্বীপে আমাদের মত কেউ আসবে, দুজনে বেঁধে দেবে একটি হৃদয়ের ঘর, মিলনবন্দি দু’জন মানুষ জানবে একটাই চাবি। একটাই মুখরিত আনন্দমূহূর্ত। সল্সবের্গ – এর কোটি কোটি অবুঝ হৃদয় তার মর্মে বেজে উঠবে। গীর্জায় বাজবে সন্ধ্যারতির গান। সেই ব্রিজ পেরনাে জলের শব্দে তখন আমাদের সন্যাস। আমাদের প্রাণবৃন্দাবন। যে নক্ষত্র তোমাকে আচম্বিত কাছে এনেছিল, আজ তার আলাে কোথায় কত দূর আলােকবর্ষ পেরিয়ে অন্যপৃথিবীর তা কেউ জানে না। আমিও তোমার মুখে আমার আয়না স্থাপন করি। মেঘ বলে সে যাবেই, রাত বলছে ‘যাই’, এভাবেই কোথাও ফিরে যাওয়া পথ, পথমার্ক, রােডম্যাপ, গুগুল্ এর মানচিত্রকাঁটা ভেঙে ফেলে আবার নতুন করে রাস্তার বালিতে আমাদের বৈরাগ্য শেখা। কতযুগ কথা না বলেও এরকম বেঁচে থাকা যায়। সল্সবের্গ এর তালাসারাই ভিখারির কাছে এরকম কত মঞ্জুশ্রী ফুল এসে পড়তাে গােধূলির পায়ে। টুক্ করে হিমাভ শ্বাস যেন এ্যলপ্স এর শীতলতা যাপনের শেষে একটু মৃদু টোকা দিয়ে উড়ে যেতাে স্ক্রুসের অরণ্যডানায়, ব্ল্যাকফরেস্ট্ – এর বাঁক বদল তখন আর আলােরশ্মি নিয়ে কোনাে ঝগড়া করবে না বলছে। রােদের খােলা চুলে দূরে কফির গন্ধ, পানিনি – চিকেন র্যাপ – হট্ ডগ্ নিয়ে এইমাত্র দূরপাল্লা ট্রেন ছেড়ে দিল। পুরুষটি তার সচেতন চুমু রােদের গালে ছোঁয়ামাত্র সূর্য ডুবল। অন্ধকার এখন সব গড়ানাে চোখের জল একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে। বাতার ভার হয়ে আছে। ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছে লাইব্রেরী ফেরত মেয়েটি। না, আজো সে খুঁজে পায়নি তার শৌহরকে। রাতকানা বাদুরে মতাে সারাদিন সে বিয়ার আর মদের উদ্দীপনায় অপেক্ষা করেছে নর্ডসী-র আলুভাজা, লাভাজা-র কফি বা আইসক্রিম, না কোনাে তুক্ এরই সামর্থ্য নেই তাকে খুঁজে দেবার। বিষন্ন ব্রিগেজ, লাল ক্রিমসন পাতাঝরা নদী ও জলপ্রপাতের দিব্বি – উচ্চতায় সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পর শহরের চামড়ায় আগুন জ্বলে ওঠে। সে আলাে নিশ্ৰুপ ডেসিবেলের। ভাের হবার আগের সময়ে তা কোথায় হারিয়ে যায়! জোনাকিদের বিস্ফারিত আলুলায়িত চুলে তখন কত বছরের পুরনাে সাইকেলের ঘন্টি রিবন হয়ে বাঁধা আছে; মরাল উপত্যকায় গাছের ফুটফুটে পায়রা গােলাপি। প্রবাহ কেবল একা হয়ে আসে। প্রবাহ কেবল একা ফিরে যায়।

‘অনামিকা সাইকেল ও হাঁটুবল’
ইন্সব্রুক থেকে বাসে পৌঁছে গেলাম ইগল্স্ নামের একটা ফুটফুটে জনপদে। প্রতিটি বাগানের পাশে কুলুকুলু প্রপাতের শব্দ। ফুল আর আপেলের সঙ্গে নাশপাতি কমলালেবুর গন্ধ। শান্ত নিরবিচ্ছন্ন সাইকেলের সারি। রাস্তার পাশে ছােট্ট খােলা রেস্তোরাঁ। সরাই বলাই ভালাে। আমরা কফি, পর্ক গােলাশ সুপ আর স্যান্ডউইচ অর্ডার দিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত – দেখি রাস্তার ওপারে হেঁশেলে রান্না চাপিয়ে এপারে এসে মেয়েটি আমাদের জন্য কফি করছে। এইভাবে এদিক ওদিক করবার পর প্রায় মিনিট ২৫ পর প্লেটে সাজিয়ে দিল মধ্যাহ্নভােজ। কলকাতায় তখন আলাে জ্বলবে ঘরে ঘরে। কোজাগরী চাঁদ আমাদের সঙ্গে চললাে নৌকা বিহারে। বড় শহরের বিলিতি গন্ধ ছড়িয়ে ইগল্স এর বাতাসে, গােলাপের চন্দ্রমল্লিকার ডালিয়ার সঙ্গে চকোলেটের তীব্র ঘ্রাণ মিশে যাচ্ছে ক্রমশ। ক্যাটি তার ছােট্ট হাতে গবলেটে যখন সার দেওয়া সুরা ঢেলে দিচ্ছে, লাল টালির ছাদে এসে বসেছে বাহারি কোনাে ফিঞ্চ্, একঝাঁক পায়রা এসে তিনবছরি সিনামন্ এর কাছ থেকে পাঁউরুটির টুকরাে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে না, কেবল তার গােড়ালির কাছে আরাে এগিয়ে আসছে। পাহাড়ের, জমাট ঠান্ডা শীতল কার্পেটে মােড়া সবুজের মধ্যে নানা রঙের ফুল ফল বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে সেরকমই। ক্যাটির কর্ণার কাফে এখন ফ্রেঞ্চ ম্যাডােলিন, পিনাট কুকিজে ভরপুর। এবার সে মনের সুখে কাপ কেক আর ম্যাকারুন্স্ আভেনে বসাবে। আজ টিমথি-র আসবার একটা প্রতীক্ষা তার মনে ঘােরাফেরা করছে। টিমথি- তার ছেলেবেলার খেলার সাথী। প্রায় দশ বছর আগের ইগল্স্ গীর্জায় তারা মেপল পাতায় আংটি মুড়ে রেখেছিল, হয়ত কোনােদিন আবার দেখা হবে এই আশায়। সাইকেলের ঘন্টি নয়, গীর্জায় ঘড়ির শব্দ কেবল সময়কে নামতার মতাে পড়ে। ক্যাটির মাতাল স্বামী দরজা ধরে ডাকলে সাড়া মেলে না।

মাখন ময়দা ভ্যানিলা আর ডিম একসঙ্গে মিশিয়ে ক্যাটি যখন ব্রাউনি বানাতে ব্যস্ত, মেশিনের সঙ্গে তার কেমন একটা আঁতাত তৈরি হয়। মেশিনকে সে তার প্রিয়নামগুলাে ধরে ডাকে আর ভাবে কেক তৈরি হলেই জিবুকে সে সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে বুঝি। সাদার ওপর নীল কালাে চেকার্ড হাফ্ শার্টে কী ভালাে যে মানায় ওকে। বিয়ের পর একটিবার দেখা হয়েছিল তাদের। লুগানােতে। দিনটি রবিবার। সাগরবরণা নীল জলের ওপর উমনাে ঝুমনাে পাতাদের আলাপ গােল হয়ে ঘুরছে আর ধুলাে উড়ছে পশমরঙা, সেই ধুলােয় উল্টো দিকে তরঙ্গে স্নান করছিল ছেলেটি। একটি বৃহদাকার উদ্দাম মীনের মতাে তার গােলাপি দেহের চামড়া কি সমৃণ আর জলে হাস্যে লাস্যময়। টিমথি এসেছে মধুচন্দ্রিমায়। দুজনের কেউ তখনাে চিনতে পারছে না নিজেদের। ক্যাটি তার শিশুপুত্রের হাত আরাে জোরে চেপে ধরে আছে। মাছ ভাজছে চিনা সরাইখানায়, কোকের রঙের মতাে তার মণিবন্ধে সেই ঘড়ি যা একদিন লােফালুফি করতাে দুজনে। ব্লু ডায়ালে নেমে আসছে স্ট্রবেরি সন্ধ্যা। দূর পাহাড়ে ফেরি করছে আলাে বাওয়া ধানীলঙ্কারঙের নৌকা। বাতাসে উড়ছে দুষ্টু সিগাল, তারা কেবল খাদ্যলােভী। ক্যাটি চিনতে পেরেছে তার দিওয়ানা কে? মনে পড়ে যাচ্ছে লাল সুড়কি রাস্তায় এক সঙ্গে সাইকেল চালানাে? তখন শেষ লঞ্চ ছেড়ে চললাে তীর। ঝিরঝির পাতায় একটু বৃষ্টি পড়ছে দেখে ক্যাটিও ফিরে গেল তাদের দাম্পত্য কামরায়।

”আকাশপথে, কোনাে চেনা তারা-কে”
এভাবেই সম্পর্ক হল নদীর আর পাহাড়ের, লক্ষ চিরাগ জ্বেলে সাঁঝের চড়াই-এ নীল গড়ানে প্রপাতের ধারায় ঘুমন্ত শহরে এল বাতি। লন্ঠনের শিখায় পাহাড় যেমন সাড়াহীন খালি পায়ে গা উদাস করে উত্তরীয়খানা খুলে ভাসিয়ে দিল নীলে-তােমার কথামতাে আমার পথে ও ছায়া দীর্ঘ হতে লাগল। চরাচর যখন কেবল ‘নেই’ ‘নেই’ বলে কাঁপিয়ে তুলছে প্রহর, শীতরাতের প্রার্থনায় ঢং ঢং চার্চের শব্দে এই ‘না-থাকা’ যখন আরাে কঠিন সবল তার বাহ চেপে ধরছে কলিঙ্গহননের ক্ষতে-আরবসাগরের তীরে ভক্সওয়াগেনের দুরন্ত চলার পাশে অন্ধকার তখন কেবল চাঁপাফুলের সুবাস হয়ে নীরবে চোখের কানায় অশ্রু পেতে দাঁড়িয়ে আছে। জমাখরচ সমস্ত তার চেক শার্টের পকেটে কেমন এক বিন্দু নীল অপরাজিতার পূজার ফুল। ব্যথার বিপত্তারিণীসুতো- যা একদিন সেই গলায় পরিয়ে দিয়েছিল তােমাকে, পৃথিবীকে আরেকটু ভালাে রাখার জন্য।