আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে
আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে, আমি জানতাম না, অগাস্টকেও রাহুর মত গ্রাস…..
(২০১৫-র সেপ্টেম্বরে ইউরোপের নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরের বুকে সলিলসমাধি হওয়া তিন বছর বয়সী সিরিয়ান শরণার্থী, আলান কুর্দি-র ঘটনার অনুপ্রেরণায় খালেদ হুসেইনি‘র লেখা এই সমুদ্র প্রার্থনা। সেই বছরেই আলানের মৃত্যুর পরে আরও ৪১৭৬ জন ওই একইভাবে মারা যান বা নিখোঁজ হয়ে যান। যুদ্ধ এবং নিপীড়নের হাত থেকে বেঁচে পালাতে গিয়ে সমুদ্রে শেষ হয়ে যাওয়া সেই হাজার হাজার শরণার্থীদের উৎসর্গ করা হয়েছে এই বই। ভাষান্তর: পিনাকী ঘোষ)
আমার প্রিয় মারোয়ান,
আমাদের ছোটবেলার গ্রীষ্মের সেই লম্বা দিনগুলোয়,
যখন আমার তোর মতো বয়স,
তোর কাকারা আর আমি
হমস শহরের বাইরে
তোর ঠাকুর্দার খামারবাড়িটার ছাদে
জাজিম বিছিয়ে শুতাম।
সকালে আমাদের ঘুম ভাঙত
হাওয়ায় কেঁপে ওঠা জলপাই গাছের আওয়াজে,
তোর ঠাকুরমার ছাগলটার ব্যা ব্যা ডাকে,
হাঁড়িকুঁড়ির ঠুংঠাং শব্দে,
ঠাণ্ডা বাতাসে আর পূবের আকাশের
খেঁজুররঙা সূর্যটার আলোয়।
তুই যখন হাঁটতে শিখছিস তখন তোকে আমরা ওখানে নিয়ে গেছিলাম
আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে
সেদিন যাবার পথে তোর মা তোকে
বুনো ফুলে ভরে ওঠা একটা মাঠের মধ্যে
চরে বেড়ানো গাভীর দল দেখাচ্ছিল।
যদি তুই তখন অতো ছোট না হতিস।
সেই খামারবাড়িটার কথা তুই ভুলে যেতিস না,
সেই পাথরের দেওয়ালে লেগে থাকা ভুসোকালি,
সেই নালাটা যেখানে তোর কাকারা আর আমি
হাজার হাজার ছেলেমানুষির বাঁধ বানাতাম।
মারোয়ান, তোরও যদি আমার মতো হমসের কথা মনে থাকত।
ব্যস্ত শহরের মাঝে ছিল
আমাদের মুসলিমদের জন্যে একটা মসজিদ,
আমাদের খৃষ্টান ভাইদের জন্যে একটা গীর্জা,
আর আমাদের সবার জন্যে একটা বড়সড় বাজার
যেখানে দরদাম করে কেনা যেত সোনার দুল,
টাটকা জিনিসপত্র আর বিয়ের সাজ।
যদি তোর মনে থাকত
ভিড়ে ঠাসা রাস্তার ভাজা কিবের গন্ধ
আর তোর মাকে সাথে নিয়ে
ঘড়ি মিনারের আশেপাশে
আমাদের সেই সান্ধ্যভ্রমণ।
কিন্তু সেই জীবন, সেইসব দিন,
এখন যেন স্বপ্ন মনে হয়,
আমার কাছেও,
যেন মনে হয় প্রাচীন প্রবাদ।
প্রথমে প্রতিবাদ।
পরে অবরোধ।
আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ।
অনাহার।
সমাহিত দেহ।
এসব তো তুই জানিস।
তুই জানিস বোমা পড়ে তৈরি জ্বালামুখে
কীভাবে সাঁতারের খাদ গড়া যায়।
তুই শিখেছিস
জমাট বাঁধা রক্ত তাজা রক্তের চেয়ে
সুসংবাদ হয়।
তুই জেনেছিস মা আর
বোন আর সহপাঠীদের খুঁজে পাওয়া যায়
ইঁট, কংক্রিট আর
ভেঙে পড়া বীমের খাঁজে,
অন্ধকারে জ্বলে ওঠা
ছোট ছোট চামড়ার ফালি।
মারোয়ান, তোর মা আজ রাতে এখানেই আছে,
আমাদের সাথে, এই ঠাণ্ডা, জ্যোৎস্নালোকিত সাগরের পাড়ে,
কান্নার রোল তোলা বাচ্চা আর
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মহিলাদের মাঝে
যারা কথা ব’লে অন্য ভাষায়।
আফগান, সোমালিয়, ইরাকি,
এরিত্রিয় আর সিরিয়ান।
আমরা সকলে অধৈর্য সূর্যোদয়ের জন্যে,
আমরা সকলে আতঙ্কিত এর জন্যে।
আমরা সকলে আজ আস্তানার খোঁজে।
আমি শুনেছি বলাবলি হচ্ছে আমরা নাকি অনাহূত।
আমরা অবাঞ্ছিত।
আমাদের দূর্ভাগ্য বয়ে বেড়াতে হবে সর্বত্রই।
কিন্তু আমি তোর মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছি,
ঢেউয়ের আওয়াজ ছাপিয়ে,
ও যেন আমার কানে ফিসফিস করে বলছে,
‘ওহ, সোনা, ওরা যদি তোমাকে দেখত।
এমনকি তোমার অর্ধেকও।
যদি ওরা একবার অন্তত দেখত।
তাহলে নিশ্চয় ওরা ভালোকথাই বলত’।
দ্বাদশীর চাঁদের আলোয়
আমি তোকে দেখছি পাশ থেকে,
বাছা আমার, তোর অক্ষিপল্লব যেন সুন্দর হস্তাক্ষর,
বুজে আছে নিষ্পাপ ঘুমে।
আমি বলেছিলাম তোকে,
‘আমার হাত ধর।
ঘটবেনা কোনো অঘটন’।
সেগুলো শুধুই ছিল কথার কথা।
এক বাবার ছলনা।
বাবা বধ হয়,
ভেঙে যায় বাবার প্রতি সন্তানের বিশ্বাস।
কারণ এই রাতে আমি যা বুঝেছি তা হ’ল
কত গভীর এই সমুদ্র,
কত বিশাল, আর কত উদাসীন।
আমি কত অক্ষম এর থেকে তোকে বাঁচাতে।
আমি পারি শুধুমাত্র প্রার্থনা জানাতে।
প্রার্থনা জানাই ঈশ্বর এই তরী কুশলে তরাও,
যখন এই তট চলে যাবে দৃষ্টির বাইরে
আর আমরা একটা ক্ষুদ্র বালুকণার মতো
ফুঁসে ওঠা জলে, উথালপাতাল হয়ে,
ডুবে যাব অনায়াসে।
কারণ তুই,
মারোয়ান, তুই অমূল্য ধন,
সবচেয়ে মূল্যবান যা ছিল আমার।
আমি প্রার্থনা জানাই সাগর তা জানে।
ইনশাল্লাহ।
আমি কীভাবে প্রার্থনা জানাই সাগর তা জানে।
আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে, আমি জানতাম না, অগাস্টকেও রাহুর মত গ্রাস…..
অভিশাপ মেঘের ভেলায় নিঃশ্বাসে ক্লান্তির ছাপ সবুজের নীড়ে আপন ঠিকানার খোঁজ এক ফালি সুখের নেশায়…..
পাখি দম্পতি পাখি গিয়েছিল কতদূর বনে তা কারো নেই জানা। ঠোঁটে ধরা লাল টুকটুকে ফল…..
তারা যেমন বলে, চোখে ধুলো দিলে থেমে যাবে আমার কাব্যময়তা অথচ আমি প্রামান্য দলিলের নই…..