সহবাস

সৈয়দ মনির হেলাল
গল্প
Bengali
সহবাস

কিন্তু জের মেলে না কিছুতেই। উপর থেকে নিচ- নিচ  থেকে উপর, অগুনতি বিস্ফোরিত চোখ অস্থিরতার সীমা ছাড়িয়ে বেহদ দৌড়াতে থাকে। কেউ বা মগজসমেত চোখটাকে গেঁথে ধরে গভীর খাদ পর্যন্ত। কিন্তু ঘন নিকষ আন্ধারের ওড়াওড়ি ছাড়া কিছুরই দেখা মেলে না। পুনর্বার ডান থেকে বাম- বাম থেকে ডান- সঞ্চালিত করে চোখজোড়াকে। না, কিছুই আন্দাজ করা যায় না। এই ভরদুপুরে যে যার মত করে চোখ কচলায়। মাথা নুইয়ে মাটির সংলগ্ন হয়ে তালাস করে বিশেষ কিছু যদি পাওয়া যায়। নাসিকা খাড়া করে খুঁজতে থাকে কেউ কেউ। কেউ ভাজ করা হাটুজোড়ার ওপর ভর করে কোমর তুলে কোনমতে মস্তকটাকে খাড়া করে। শূন্য সফেদ আকাশের দিকে তাকায় কেউবা। কিন্তু সীমা-সরহদ ছুঁতে পারে না কেউই। অতএব অনিবার্য গতানুগতিকতায় পারিপার্শ্বিক চিত্রপট বদলে যেতে থাকে খুব দ্রুততার সাথে। আপাতঃঅতিলৌকিক ঘটনার অভিঘাতে ভীষণ তোলপাড় তোলা জনরব শেষপর্যন্ত বিচ্ছিন্ন গুঞ্জন হয়ে নিরুদ্দেশের পথ ধরে।

এবং পশ্চাতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে একটি মনুষ্যদেহ।

শক্ত-সামর্থ দৈহিক কাঠামো। কিন্তু  নিথর, প্রাণহীন। মাছিদের ভনভন শব্দ জটলার সাথে একাকার হয়ে দলা পাকাতে থাকে। কার বাপ, কার বা পুত অথবা কার স্বামী- সেই মামুলি তত্ত্ব-তালাস এখন পোষাকধারীদের কাজ হয়তো। কেউ বলে একটা নয় দুইটা দেহ পড়ে আছে, কেউ বলে ওই দূরে আরেকটা, আরো একজন আগবাড়িয়ে দিব্যচোখে নিশ্চিত বলে দেয়- আগামিকাল আরো একটা লাশ পড়ে থাকবে ওই কোনএকখানে।

অতঃপর, বুটের ধপ ধপ, ত্রাসসঞ্চারী হুইসেলের তারস্বর কিংবা যান্ত্রিক ত্রস্ততা মিইয়ে যেতে থাকবে, এবং খাঁকি পোষাকধারীরা ঐ কাঁঠালগাছটার তলায় আরামসে বসে জাবর কাটবে। কোন ভাব-বিকার নেই তাদের। সেকেন্ড অফিসারসাব ঘর থেকে বেরোলেই গাড়ি স্টার্ট দেবে,  নিশানা এমনই তাক করা থাকবে।

দুই

নানান ঘটনার শরীর রঙিন রাঙতামোড়া হয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় দুলতে দুলতে ডালপালা মেলে উড়তেই থাকে। কত কথা, কত রটনা।

কিন্তু কোনকিছুতেই রুখ মানে না মায়ারুন। মোহের চাঞ্চল্য ওই দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বরং বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় স্থির বিশ্বাসে। জারুলকান্ডের সমান  শক্ত পেশী আর খাড়া পর্বতের মতো বুকের পাটা মায়ারুনকে পিষে ফেলতে চায় এক লহমায়। মায়ারুন স্থির হয়ে বসে এবং জনক-জননীর সকল জরাগ্রস্ততা কিংবা শঙ্কাবৈকল্যকে উড়িয়ে দিয়ে দৃঢ়তার সাথে সশব্দে উচ্চারণ করে ‘কবুল’।

সোবান। এই একটাই পরিচয় তার। সোবান মানে সোবান ডাকাইত। ডাকাইত ছাড়া সোবান কারো নাম যেন হতেই পারে না। এবং এই সোবান ডাকাইতের নামের গুণে এই হরিনগর গাঁ-র ধুলোমাটি থেকে উত্তপ্ত জজবা টিকরে বেরোচ্ছে। সারা তল্লাটেই হরিনগর এক মূর্তিমান জ্বালামুখ- ‘ও সোবান ডাকাইতের গাও?’।  এই সোবান নামের জোরেই তটস্থ ছেলে-বুড়ো-মরদ-মাগি সব। শরীর তার তালগাছের মত খাড়া। কালো-পোড়া-শক্ত তক্তার মতো দেহাতি গড়ন। ‘চুপ শালা’ বলে যখন হুংকার ছাড়ে, তার তোড়ে উড়ে যেতে চায় গদিনসিন মইজুদ্দি বেপারির তক্তপোষ সমেত সব জারিজুরি।

গাঁও-গেরাম থেকে থানাবাজার, থানাবাজার থেকে জেলাশহর- সবখানে সকলে এমনই শুনছে, অত্র হামছায়ার প্রায় সকল দারোগা পুলিশের খাতায় লাল দাগ দেয়া প্রথম নামটাই- সোবান ডাকাত। থানার দেয়ালে দেয়ালে লাল হরফে লেখা একেবারে বায়ের প্রথম নামটাই সোবান ডাকাত। কিন্তু ছবির জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে সেই প্রত্নজমানার সাক্ষি হয়ে।

ডাকাতি বিদ্যায় সোবান ডাকাতের গুরু সম্পর্কে এইটুকু কেবল জানা যায় যে, লোকটা নাকি যাদু জানত এবং ঐপ্রকার যাদুর বলে তার দলে নাম লিখিয়েছিল বেশুমার জোয়ানপুরুষ। এমনকি মেয়েলোককে পর্যন্ত নাকি কথার যাদুতে সে বশ করে ফেলত খুব সহজে। সোবানের সেই গুরুকে অনেকেই সাক্ষাৎ দেখেছে বলে দাবি করে বটে, কিন্তু একআধটু জেরার মুখে প্রায় সকলকেই আমতা আমতা করে এন্তার কিচ্ছা-কাহিনি জুড়ে দিতে হয় শেষমেষ। এবং সেই গুরুর সাক্ষাৎ শিষ্য সোবানের কিভাবে ডাকাতিতে বিসমিল্লা হলো, তা কেউ ঠিক করে বলতে পারে নি আজ অব্দি। পুলিশের খাতায় নাম আছে বটে, কিন্তু কোথায়- কার সিন্ধুক ভেঙে সোনার বালা নাকি টাকার থলি লোপাট করে হ্রেসারবে অশ্ব ছুটিয়েছে- এতদসম্পর্কিত বিস্তারিত কোনকিছুই পুলিশ দারোগার কেসনথিতে লিপিবদ্ধ নাই একটাও। ব্যাপারটা ততটা তাজ্জবের নয় এই কারণে যে, এই তল্লাটে ডাকাতির ঘটনা ঘটলে অবশ্যম্ভাবীভাবে একনম্বর আসামি সোবান ডাকাত।

গেরামের মাথা সলিম মিয়ার মুখের উপর “না’ বলেই নাকি সে বে-তমিজের প্রথম পাঠ নেয়।

কেউ কেউ বলে, মোজফর মেম্বারের গলায় প্রথম যেদিন গামছা পেঁচিয়ে ধরেছিল সেদিন থেকেই সে পলাতক। তারপর প্রলম্বিত ফেরারিকালের এক মধ্যদুপুরে- যেদিন সে বিয়ের নওশা সাজছে, সেদিনই পানিউন্নয়ন স্যারকে গাঙপার পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল সোবান। পড়িমরি করে সেই শহুরে স্যার কচুরিপানার কল্যাণে মাথা রক্ষা করেছিলেন সেদিন।

তিন

মায়ারুন খিলখিল করে হাসতে থাকে। ‘ওগো অমন করে হাসিও না, ভূতের কু-নজর পড়ব’- বলে রঙ্গরস সমাপনান্তে পূব-বাড়ির ভাবী সতর্কতা জারি করে, অতঃপর দোয়ার ভেজিয়ে দিয়ে চোখ নাচিয়ে অন্তর্হিত হয়।

লাল সিল্কের শাড়িতে অপরূপ লাগছিল লজ্জা-আনত মায়ারুনকে। সোনার পানি দৌড়ানো ইমিটেসনের বালাসমেত গোলগাল হাতের কব্জির অংশটুকু অথবা নীল পাথর বসানো আঙুলগুলো ছাড়া সোবান আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। একবার কাছে বসে। নাহ, আবার উঠে পায়চারি করে খানিক। সামনাসামনি বসে। কিছু কি বলা উচিত হবে? নাকি গোমটাটা খুলে ফেলবে একটানে? মায়ারুনের বুকের নিশ্বাস শোঁ শোঁ করে সোবানের কানের কাছে আছড়ে পড়ে।

কিন্তু বহিরাঙ্গনে কোন তাড়া নেই, কোন সাড়া নেই কারো। যেনো পাঠোদ্ধার চলছে স্ব স্ব পরিভাষায়। সোবান বেড়া থেকে মুর্তার চাটি নামিয়ে পশ্চিমমুখো বিছায়।

অতঃপর, টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হারিকেনের সলতেটা একঝটকায় বাড়িয়ে দেয় সোবান। জড়োসড়ো হতে থাকে মায়ারুন। ‘মায়া এসো, এসো মায়া- আমি তোমার লাগি হেই কবে থেকে বসে আছি।’ মায়া? এ-যে নতুন জনম আমার! হে নাথ, তুমি আমাকে নিঃশেষ করে দাও! পেখম মেলতে থাকে লাল সিল্কের রূপ। কেরোসিনের নীল আলোর তেজ থেকে টিকরে বেরুচ্ছে আগুনের লাল জিহ্বা। সারা ঘর, ঘর থেকে উঠোন, উঠোন থেকে আকাশ- এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে কেবল লাল সিল্ক।  ‘আপনে বুলে আইজ বিহানে লাঠি দিয়ে ধাওয়া করছিলেন পানির সায়েবকে?’ থমকে যায় সোবান। না, মায়ারুনের চোখে ছড়িয়ে আছে প্রশ্রয়ের প্রসন্নতা। মিটিমিটি হাসে সোবান। কিন্তু কণ্ঠের সেই তেজ মিইয়ে যায় না এতটুকু। ‘হ, ওরে নাগালে পাইলে আইজ মাথাটা দুইভাগ কইরা দিতাম।’ দক্ষিণভিটা লাগোয়া ছাতিম গাছটার মত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে মায়ারুন। ছাতিমের রূপালি পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপতে থাকে।। ‘মায়া-’! শিউরে ওঠে মায়ারুনের সাড়ে তিনহাত দেহ। এই একজন ছাড়া আর কেউ তো এই নামে কোনোদিন ডাকে নি তাকে। নুয়ে যেতে থাকে মায়ারুন। কেমন শক্ত আর মোটা দুইটা পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে সোবান। হাত বাড়িয়ে দেয় মায়ারুনের দিকে।

চার

সকালের আলো ফুটবার আগেই মায়ারুন বেরিয়ে পড়ে। ঘর-বাইর করতে করতে ঝিম মেরে বসে থাকে মজাপুকুর পাড়ের ডুমুর গাছকে অবলম্বন করে। সোবানের উদ্দেশ পায় না কেউ।

তৃতীয় রাতটা শেষ হতে তখনো পাক্কা তিন ঘড়ি বাকি। কোনমতে উত্তর দিকের খিড়কিটা খুলে গহীন অন্ধকারে ঝাপ দিয়েছিল সোবান। অনবরত হুইসেল আর বুটের কঠিন শব্দে কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি মায়ারুন। সে কুঁকড়ে যেতে থাকে অনবরত। পুলিশ-দারোগার তোপের মুখে ফেলে রেখে এভাবে উদাও হওয়া সোবানকে বড় বেশি স্বার্থপর মনে হয় মায়ারুনের, আর সাদা চোখ মুখ নিয়ে ইতিউতি করতে থাকে কেবল। এবং মায়ারুনের কাঁচুলিশূন্য দেহটাকে হাতের খলুই বানিয়ে ডাকাতির মাল-সামানা কিংবা বন্দুক-কুড়ালের খোঁজে খানা-তল্লাসি চলে রাতজুড়ে। চলতে থাকে পোশাকি খিস্তি, তর্জন-গর্জন আর জেরা জিজ্ঞাসা। ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।আর যতই দিনের আলো ফুটে উঠতে থাকে ততই মায়ারুন হয়ে ওঠে আরো ঋজু এবং শক্তিমান। ঠিক কাজটাই করেছে তার স্বামী, যে মেম্বার এক বিধবার হক মেরে দিতে চায়, তাকে রুখে দিয়ে সোবান নেক কাজটাই করেছে।

তারপর কেবলই জড়িয়ে থাকা আন্ধার আর নিজের ছায়ার সাথে মায়ারুনের যা কিছু মহব্বত। আর অন্যদিকে তার সামনে দিনকে দিন বিস্তৃত হতে থাকে লড়বার ময়দান বেশুমার।

মেম্বার চেয়ারম্যান দারোগা পুলিশ- এক এক করে সামনে দাঁড়ায় মায়ারুনের, আর সেও এক এক করে শাড়ির আঁচলে প্যাঁচ দিতে থাকে শক্ত বাঁধনে। এগোতে থাকে ঘর থেকে উঠান, উঠান থেকে মাঠ ছাড়িয়ে সদর রাস্তা অব্দি। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা নতুন বৌয়ের আলতা রাঙা পা দুটি দ্রুততার সাথে অনাবৃত হতে থাকে আর ফলতঃ দেখা যায় পা নয়, মাটির রস শুষে নিয়ে ছুটে চলেছে কৃষ্ণবরণ লৌহদন্ড এক।

পাঁচ

ধান-চাতালের কাজটা মায়ারুনের পেটের ক্ষুধাকে সামাল দিতে বেশ একটা অবলম্বন হয়ে ওঠে। ফুরফুরে মেজাজেই বিহান থেকে সাইঞ্জা পর্যন্ত মায়ারুন লেপ্টে থাকে সোনারঙ ধানের সান্নিধ্যে। নিজের সমস্ত দরদ ঢেলে দেয় সদ্যজাত ধানগুলোকে মুক্তাদানা রূপান্তরে। যদিও উত্তপ্ত বয়লারের ভেতর লাফাতে লাফাতে কালো হয়ে ওঠা ধান্যগুলোর জন্য সে হিম হয়ে যায় কখনো কখনো।

ফোঁস করে জেগে ওঠে তন্দ্রাচ্ছন্ন মায়ারুন অতঃপর। দুই দাঁতাল শুয়োরের মাঝখানে পড়ে তড়পাতে থাকা মায়ারুন স্থির হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে চাতালের  ম্যানেজারের মিঠা কথাকে সে গ্রাহ্য করেছিল ভ্রাতৃরূপে আর মালিকের দাক্ষিণ্যকে সমঝে নিয়েছিল পিতৃজ্ঞানে, সেখানে সে অচিরেই দেখল ম্যানেজার-মালিকের চতুষ্পদ এগিয়ে আসছে লকলকে জিহ্বা বের করে। অকারণে এবং অসময়ে একান্ত দেউড়িতে ডেকে নেওয়া ম্যানেজার আর নানান ছল-ছুতায় গায়ে হাত দিতে থাকা  মালিক নামীয়  কথিত অন্নদাতার সমুহ মুখবরাবর থু থু ছিটিয়ে মায়ারুন অতঃপর বেরিয়ে পড়ে বৃক্ষছায়াহীন উদোম পথে।

এবং অনতিক্রান্ত এক দুর্ভেদ্য চক্রাবর্তে পড়ে উদ্দেশহীন পসিনায় জবজবা হতে হতে অবশেষে মায়ারুন আবারো লালসিল্ক শাড়িতে সজ্জিত করে নিজেকে। বৈশাখের ঝড়ো-ঝাপটায় সে গড়িয়ে পড়ে সীমাহীন ফসলের পদতলে। মায়ারুন অপলক চেয়ে থাকে ধানগাছের ফুলে ওঠা পেটের দিকে। আর তীব্র খরতাপকে মাথায় নিয়ে অমনি সে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে খেতের মধ্যিখানে। তার উষ্ণ আলিঙ্গনে ফুলে-ফসলে লুটোপুটি খায় বিরামহীন।

এবং লাঙলের চকচকে ফলার মাঝে মায়ারুন বেঁচে থাকবার সাহস খোঁজে দিনমান।

ছয়

কিন্তু মাংশাসী বুইড়াগুলো যন্ত্রণার একশেষ করে তোলে মায়ারুনের ঘর-বাইর। লিঙ্গসর্বস্ব খাটাসগুলো ঘোৎ ঘোৎ করতে থাকে ঘুমন্ত মায়ারুনের খিড়কি বরাবর।  সেদিন রাইতের শেষ প্রহরে আনা মিয়া তালুকদারের ঠ্যাংটা প্রায় ভেঙ্গে দিয়েছিল সড়কির ঘায়ে। তারপর লেজ তুলে পালাতে থাকা বুইড়াগুলো মায়ারুনের ললাটে ‘মাগী’র তিলক এঁকে দিতে যতই মরিয়া হয়ে ওঠে, ততই সমাজের তোয়াক্কা না-মানা মায়ারুনের একলা লড়াই থেকে ধোয়ার কুন্ডুলি উড়তে থাকে। এবং মায়ারুনের সামনে দাঁড়াতে নপুংশক সমাজের আত্মারাম কেঁপে ওঠে বারংবার। জোয়ান মরদগুলো আড়ালে-আবডালে বলাবলি করে রাইতের বেলা নাকি সোবানের ছায়া ঘিরে রাখে মায়ারুনের বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরটাকে। আর আছে গাঙ-পারের ছুকরিগুলো। ‘আমার কোলে-কাখে কে আসল না আসলো এ নিয়া তোদের এতো মাথা ব্যথা ক্যান?’ মায়ারুন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধানগাছগুলোর দিকে। উল্টা-পাল্টা বাতাসে বারেবারে কেমন আউলা হয়ে যাচ্ছে  ধানগাছগুলো, পেটগুলোকে দেখাচ্ছে বেঢপ সানকির মতন।

কেউ কেউ বলে দশ্যু অধিপতি সোবান। কেউ বলে মরে ভূত হয়ে গেছে সেই কোন কালে। কেউ বলে গোপন পাট্টিতে নাম লিখিয়েছে। রাত-বিরাতে মিটিং করে। রাইফেল-বন্দুকও নাকি চালায় মালকোচা মেরে। তবে গরিব-গুর্বা মানুষের ভয়ের কোন কারণ নেই- গর্বের সাথে ঘোষণা করে কেউ কেউ। কিন্তু ওসবের কিছুতেই যায় আসে না মায়ারুনের। কারণ দুইটা হাত, দুইটা পা আর বুকের বল ছাড়া আর কিছুই নেই তার কাছে। এবং এই দিয়ে দারোগা-পুলিশকেও সামাল দিতে হয় তাকে। রোজ রোজ এই খাকি খাটাশদেরকে নিয়ে খুব হয়রান মায়ারুন। এতোদিন সপ্তাহে এক-দুইদিন আসতো দিনের আলো থাকবার আগেই। কিন্তু নতুন আসা পেটমোটা দারোগাটার কাছে দিনের থেকে রাতই বেশী পছন্দ। মায়ারুনও এতোদিনে বুঝে গেছে যে সোবানের ওয়ারেন্ট-ধরা হাত আসলে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। মায়ারুন তাই নিজের আগ-পিছ সই-সাবুদ রেখে আলগা করে দিয়েছে ভেতর দরজার খিলসকল। এবং নিয়ম-অনিয়মে- কখনো সন্ধ্যারাতে, কখনো রাতদুপুরে আবার কখনো রাতের শেষপ্রহরে এসে দরজায় ঠোকা- ‘মায়ারুন বিবি, দরজা খোল।’

‘হু, ঠিক ঠিক সোবান মিয়ার গন্ধই নাকে আসছে।’

হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দেয় মায়ারুন। তার সামনে কুঁতকুঁতে একজোড়া শ্বাপদ চক্ষু ঝুলে পড়া একটা মাংশপিন্ড নিয়ে খয়েরি রঙের দাঁত কেলিয়ে থাকে।

‘বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া আসে কোত্থেকে মায়ারুন বিবি? ভালো, ভালো!’ মায়ারুনের শীরোস্ত্রাণ ভেদ করে ধোঁয়ার উদগীরণ চলতে থাকে অবিরাম।

‘নেও, ধরাও, আরে শরমের কী, আজ তোমার সাথে খোসগল্প করেই রাতটা পার করে দিমু ভাবছি। এসো-’

মায়ারুনের পেট আওলাতে থাকে। মনে করতে পারে না আজ খেয়েছে কিনা। কিংবা খেলেও ভাত নাকি জাউ নাকি মুড়ি- কি খেয়েছে। ওয়াক থু-! একদলা থু থু মুখে বিবমিষা জাগায়।

‘কি চিন্তা কর বিবি? আহ্হারে, এই জীবন-যৌবনটা একটা ডাকাতের জন্য নষ্ট কইরা দিবা? তুমি জানো না, সোবান মিয়া সেই কবে এই দুনিয়া থেকে নাই হইয়া গেছে! আসো, বিবি, কাছে আসো-’

মায়ারুনের দেহ পেঁচিয়ে ধরে অগনিত সরিসৃপ-মুখ। হলুদ, কালো, বাদামী- ধারালো জিহ্বা থেকে চুইয়ে পড়ছে বিষ-লালা।

মাথা তুলে দাঁড়ায় মায়ারুন। শক্ত মাটির ওপর পা-জোড়া গেঁথে রেখে সিনা টান টান করে, মুহূর্তের মাঝে ইস্পাত-উত্থিত হাত থেকে বিস্ফোরিত হয় রক্তের ফিনকি!

সকাল সকাল রাষ্ট্র হয়ে যায় সারা তল্লাটে। মায়ারুনের নিথর  লাশ পড়ে আছে ঘরের চৌকির উপর। সারা গা উদোম। কেউ বলে ভূতের মরা, কেউ বলে স্বেচ্ছামৃত্যু। ঠিক ঠিক, হয় ভূত না হয় সাপে কাটছে মায়ারুনকে। পুলিশের অফিসার রায় দিয়ে ইউডি কেস নথিভূক্ত করল।

আহারে, কে আছে বেচারির! স্বামীটা থেকেও নাই। কেউ একজন বলে ওঠে- একটা ছেলে-মেয়েও যদি থাকত তাহলে  দু’ফোটা চোখের জল ফেলত আজ।  এজন্যেই তো আওলাদ দরকার। শেষ পর্যন্ত গাঙপারের ঐ ছুকরিগুলাই সব দায়িত্ব নিল। গোসলের জন্য খাটিয়া টানাল ওরা নিজ হাতেই। সাবান, গরম জল, সব রেডি। কাফনের টাকাটা নাকি মোজফর মেম্বারই দিয়েছে।

সাত

হঠাৎ কেঁপে ওঠে চারিদিক। কাঁপে আকাশ, কাঁপে বাতাস-মাটি-গাছ-বৃক্ষ-নদী। তুফান উঠবে বুঝি। দৌড়াতে থাকে মানুষ। ধপ ধপ আওয়াজ কেবল- একটানা। যে যার মত করে প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। কোথায় যেতে চায় এরা। কেন? কী হল হঠাৎ? না, যেখানে কথা ছিল জনশূন্য হবে এইজনপদ, সেখানে লোকে লোকারণ্য এখন। কোথা থেকে- কেন এই এত এত মানুষ এক নিমিষে এসে জড়ো হলো, উদ্দেশ পায় না কেউ। এগিয়ে আসে এক সুঠামদেহী, টান দিয়ে খুলে ফেলে মশারির মত করে টানানো কাপড়ের দলাসব।

কে তুমি- কি করছ?

আমি সোবান, মায়ার স্বামী!

কি কও, কও কী মিয়া? কেউ বিশ্বাস কওে, কেউ আড় চোখে তাকায়- মাথা ঝাকায় অসম্মতিতে। ‘আরে মিয়া, মরা স্ত্রীর মুখ দেখা তো অনেক বড় গোনাহর কাম!’ সোবানের চোখে-মুখে তীব্র ঘৃণা। তারপর দ্বিধাহীন প্রশ্বাসে কোলে তুলে নেয় স্বেত-শুভ্র মায়ারুনকে। তার পিছে পিছে হাঁটে নিঃশব্দ কাফেলা। জানাজা সে নিজেই পড়াবে।

কিন্তু মুহূর্তেই পথ ঢেকে যায় খাঁকি আচ্ছাদনে। সকল মায়াবেষ্ঠিত শুভ্রতাকে বিদ্ধ করে তীরবেগে ছুটে আসে হুইসেলের ভয়-তরাস। বুটের ধপ ধপ ঘিরে ধরে আসমান-জমিন।। বিহ্বল জনরব থমকে যায়। এগিয়ে যায় সোবান। বুক সটান করে হুংকার ছাড়ে। জনতার মুষ্টিবদ্ধ চৈতন্য থেকে লুফে নেয় ধারালো সড়কি। বুটের ধপ ধপ এবার আরো বিস্তৃত হয়।

ছুটে যায় আগ্নেয়াস্ত্রের উত্তপ্ত সিসা।

নীরব, নিস্তব্ধ। জেগে থাকা ধানক্ষেতের সিথানে পাশাপাশি পড়ে থাকে একটি সড়কি আর দুটি মনুষ্যদেহ।

সৈয়দ মনির হেলাল। লেখক ও আইনজীবি। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের সিলেট।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..