সাঁকো

মাহরীন ফেরদৌস
গল্প
Bengali
সাঁকো

ফের চলে এসেছি এমন কিছুর মুখোমুখি; যা শত শত পোট্রেটের ভিড়ে নিদির্ষ্ট অবয়বের জালে, খুব প্রবল করে দিচ্ছে আমার নির্লিপ্ত দিনগুলো।

প্রায় অনেক বছর পর এমন কারও সাথে পরিচয়। পরিচয়টুকু পথে। ফুটপাথে। গলিতে। বাড়ির সামনের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে, ব্যাঙের ছাতার মতো সদ্য গজিয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁয়। টঙের দোকানে কারও ভীষণ শব্দ করে চায়ে চুমুক দেওয়ার শব্দে। ছাদের অলকানন্দা ফুলের পাশে কিংবা খুলনার ঝপঝপিয়া নদীর তীরে। এতবার পরিচয় কিভাবে হতে পারে ভাবতে পারে অনেকে। আসলে তোমার সাথে প্রথমবার দেখা হবার পর থেকেই বার বার নানা স্থানে পরিচয় হচ্ছে। আমরা দু’জন অবশ্য মুখবইতে বন্ধু নই।

ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট কিংবা টুইটারেও আমরা একে অন্যকে দেখি না। দেখি না কারণ, আমি খুঁজে দেখেছি তুমি এসব কিছুই ব্যবহার করো না। তারপরেও ক্যামন যেন অদ্ভুত জায়গায় আমাদের দেখা হয়ে যায়।

যেমন, মৌনতার ঘরের বারান্দা দিয়ে তোমার ঘর দেখা যায়। জনমানব শূন্য শহরের মতো সেই মস্ত ঘরে তুমি একা বই পড়ে কাটাও। সম্ভবত মৃদু শব্দে গানও শোনো। বই পড়ার সময় মাঝে মাঝে তোমাকে অল্প মাথা ঝাঁকাতে দেখা যায়। যেন গল্পকার ও পাঠক দুটো তুমি নিজেই। তারপর, ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা প্রায়শই হাঁটতে দেখা যায় তোমাকে। তোমার দেখাদেখি তাই আজকাল আমিও খুব হাঁটতে শুরু করেছি। বাড়ির ছাদে, ঘরের ভেতরে, রাস্তায় কিংবা গলিতে আমি রিকশা না ডেকে, গাড়িতে না চড়ে হাঁটতে থাকি। আমার কেবলই মনে হয় এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই আমাদের একদিন সত্যি সত্যি পরিচয় হয়ে যাবে। এ যুগে সামাজিক মাধ্যমে জুড়ে না থাকলে একে অন্যকে কাছ থেকে দেখার আর উপায় আছে কী? নেই। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি মৌনতার ঘরটায় ভাড়া নিয়ে থাকি, কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই ছুটির দিনগুলোতে খুব ভোরে আমি ওর বাসায় চলে যাই। মৌনতার বারান্দায় অনেক গাছ। বাড়ির নানা পরিত্যক্ত জিনিস এ বারান্দায় বস্তাবন্দী করে ফেলে রাখা। এছাড়াও বারান্দার উপরের গ্রিলের এপাশ থেকে ওপাশে তিন, চারটা লম্বা নাইলনের দড়ি টাঙ্গিয়ে দেওয়া। দিন রাত সেখানে শত শত রঙ বেরঙের কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়। একটা টুল নিয়েও বসার জায়গা নেই। নেই ঠেস দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য কোন দেয়াল। এমন এক জায়গা থেকে আমি তোমাকে দেখতে পাই। ভাবতে পারো? বারান্দা দিয়ে তোমার ঘরের দেয়ালে ক্রিকেট ব্যাট ঝুলতে দেখে মৌনতা বলেছিল হয়ত খেলার মাঠ নিয়ে তোমার অনেক স্মৃতি আছে। তুমি হয়ত ক্রিকেট খেলতে খুব পছন্দ করো। শুনে আমারও বলতে ইচ্ছা করল, আমার বাড়ির পাশে একটা মস্ত বড় খেলার মাঠ আছে। আর মাঠ পেরিয়েই একটা ঘন সবুজ পার্ক। সেই পার্কের একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসলে নাকি অকারণেই সবার মন খারাপ হয়ে যায়। আমার খুব ইচ্ছা করে খেলার মাঠের পাশের এই পার্কের গল্প আমি তোমাকে শোনাই। কিংবা তোমার ঘর থেকে একটা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে তোমাকে তুলে নিয়ে এসে বলি, চলো দেখে আসি স্টেশনের শেষ ট্রেনটা কোন গ্রামে যায়। কী আছে সেখানে? অনেক অনেক গাছ, শান্ত নদী, লেবু বাগান, বৃষ্টির পর রংধনু আর সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের ঘোরলাগা গান!

এসব ছাড়াও, আমি মনে মনে অনেকবার ভাবি তোমার সাথে হঠাৎ করে কোথাও দেখা হয়ে যাবে নাকি! হয়ত ব্যস্ত নগরীতে ভিড়ের মধ্যে তুমি হুট করে সামনে এসে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে ‘কেমন আছ’ বলে উঠবে। আমি জানি না তখন আমি কী উত্তর দেব। হয়ত পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করব বিব্রত ভঙ্গিতে। মুগ্ধতা কিংবা প্রেম যে নামই দাও আমাকে বিব্রত করে খুব। লুকাতে পারি না, আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতেও ইচ্ছে করে না।

আমি জানি আর অল্প কয়মাস পরেই মৌনতারা এই বাসা ছেড়ে দিবে। এরপর তোমার সাথে দেখা হবে কিভাবে? জানা নেই। তোমার প্লে লিস্টের গানগুলো যদি পেতাম হয়ত গানে গানে একটা সাঁকো তৈরি করে ফেলতাম দু’জনের মাঝে। সেখানে আমাদের দেখা হতে পারত। পারত কি? মৌনতা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে তোমাকে নিয়ে আমার পরিকল্পনা কী? আমি বিশেষভাবে কিছু বলতে পারি না। এই ভালোলাগা, ঘোরলাগা কিংবা ‘আমাদের মাঝে যেন কী মিল আছে’ ধরণের অনুভূতির পৃথক কোন সংজ্ঞা আমার কাছে নেই। শুধু জানি তোমার কথা না ভাবলে মনে হয় এবেলায় আকাশের দিকে তাকানো পাপ। আর মনে হয় সবকিছু এভাবেই থাক। মানিকমিয়া এভিনিউয়ের পার্ক থেকে গলা বাড়িয়ে দেওয়া ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ছুঁয়ে দিক তোমার চিবুক। টঙের দোকানের মস্ত বড় কেতলির বিকট হুইসেল আর বাষ্পগুলো ঝাপসা করি দিক তোমার কালো ফ্রেমের চশমা।

আমি শুধু ভুলতে চেষ্টা করে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে দেখি। এই যেমন কিছুদিন আগে এক রাতে দেখলাম, এক বিষাদ জাগানো ল্যাম্পপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছ তুমি। পেছনে তোমার চেনাজানা বহু মানুষ। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, যাওয়ার সময় অকপটে ছুঁয়ে দিলাম তোমার হাত। কেউ দেখল না, কেউ জানল না। এরপর আমি চলে গেলাম গেলাম। দূরে, বহুদূরে। মন্থর হয়ে এলো চারপাশ।

আবার স্বপ্নে দেখলাম কোন এক বইয়ের দোকানে দেখা হয়ে গিয়েছে আমাদের। শেলফের শত শত বইয়ের পাতাগুলোর ভেতর থেকে অনবরত পানি ঝরে একটা নদী হয়ে গিয়েছে। সেই নদীতে অল্প অল্প ঢেউ। অনেকগুলো বই ভাসছে। কিছু খোলা পাতার ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে কচুরিপানা ফুল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দুজনেই। হঠাৎ কী যেন একটা খুঁজতে চলে গেলে তুমি। আমি একলা দাঁড়িয়েই আছি। আমার পায়ে জড়তা বাড়ছে। মনে হচ্ছে, ডুবে যাচ্ছি আর আটকে যাচ্ছি কোথাও। মনে হচ্ছে, মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আলো ফুটে উঠবে। আর হারিয়ে যাবে সব। আমি প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে রাখতে চেষ্টা করতে থাকি। তারপর ভুলে যাই আমি কেন দাঁড়িয়ে আছি।

এমন সময় কোথা থেকে আসা এক অচেনা বাতাসে কচুরিপানা ফুলগুলো দুলতে থাকে। আর নিয়ম করে পুড়তে থাকে আমার স্বপ্নের তারাবাতিগুলো..

মাহরীন ফেরদৌস। গল্পকার। জন্ম বাংলাদেশ, বর্তমান নিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসে। সাহিত্য চর্চার সাথে জড়িত আছেন ২০১০ সাল থেকে। কয়েকবছর ‘একুয়া রেজিয়া’ নামের আড়ালে থেকেই প্রকাশ করেছেন নিজের গল্প, উপন্যাস। পেয়েছেন পাঠকপ্রিয়তা। ব্যবসায় শিক্ষা এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি নিয়ে পড়ালেখা করলেও বারবারই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..