সাদা ঘোড়ার দৌড়

মোস্তফা মঈন
কবিতা
Bengali
সাদা ঘোড়ার দৌড়

কবিতার কনিষ্ঠ সন্তান

কেউ তুলসীতলায় গিয়ে স্বাস্থ্যকর শ্বাস নেয়। কেউ চৌদ্দতলা বাড়িতে সেক্সোয়াল ফ্রাই বানায়।
আমি নিজের বিম্বে নাক ঘষে শব্দ খুঁড়ে জীবন উৎরাই। নিজের গায়ের চামড়া খসিয়ে তাতে
আসন পেতে শব্দফুলে শ্বাস নেই কবিতায়।

আমি অন্য কারো ক্ষতি করিনি তো। কদিনের জন্য জীবন নিয়ে এটুকুই বেঁচে থাকার স্বার্থপরতা।

কিন্তু এতটুকু শ্বাস নিতে গিয়েও কতো কী হাঙ্গামা! সুহৃদ শত্রু হয়ে যাচ্ছে! বন্ধু সরে যেতে যেতে
আরো আরো দূরে… শুধু কবিতাই আমাকে ছেড়ে যায় না কোথায়ও।

হ্যাঁ কবিতাই তো! মাটি জল আগুন বাতাস মিলে এই সবুজ গ্রহে আমি ছিলাম কবিতার কনিষ্ঠ সন্তান।

 

আমার সামনে সমুদ্র

জন্মেই মা-মরা ছেলে। দুধফল দেখিনি।
স্তনবৃন্তের স্বাদ আমি জানি না।
ঘন দুধের মতো
সর পড়া কবিতা আমি পান করিনি।

মাটি খেয়ে বড় হয়েছি।
একটা কাকের সাথে দোস্তি হয়েছিলো কড়ইতলার মাঠে
তার ডানায় ভর করে উড়াল শিখেছি।

আমাকে উড়াল শিখিয়ে
সে-ই একদিন শ্মশানে গিয়ে নিজের মুখাগ্নি করলো!
সেদিনই জেনেছি
জীবন
একটা সস্তা ভাগাড়।

আমি তখন একা হয়ে খামচে ধরি নিজের ছায়া।
আমার হাতে ওঠে আসে সোঁদা গন্ধময় একদলা
কাদামাটি।
এ মাটিতে আমি বানাতে চাইলাম আমার মায়ের মুখ।
আহ্! মা
আমার সামনে সমুদ্র
পেছনে লকলক করছে আগুনের জিহ্বা, কুণ্ডলী পাকিয়ে ধেয়ে আসছে
আগুন!

 

সাদা ঘোড়ার দৌড়

রাত্রির শিকড়ে আমার ঢুলুঢুলু ঘোর। ঘোর একটা আকর গ্রন্থ। তার চিরল পাতা
পৃষ্ঠায় ছাই। জীবনের কয়লাখনিতে জমা হয় ছাইয়ের স্তুপ। স্তুপে শোয়ে থাকে
চকচকে নক্ষত্র। আমার নক্ষত্র ধোয়া রাত একনিষ্ঠ হই আকর গ্রন্থে।

প্রতিটি আকরিক নক্ষত্র আমার ছেলেবেলার কুড়ানো পাথর। পাথর দিয়ে আমি
আকাশ ছোঁয়া ইমারত বানাই। আকাশচুম্বী ইমারতটা নৈশ আলোক।

আমি আলোর চাতালে এসে দাঁড়াই। পান করি আলো। পাঠ করি জীবন।
এই পানশালায় পানরত সবাই প্রতি মুহূর্তে হয়ে ওঠে এক একটি তেজী ঘোড়া।
চারদিকে দৃপ্ত দাপট। ছড়িয়ে পড়ে আলোক হ্রেষা খুর। জন্ম নেয় অখণ্ড হীরক।
কুণ্ডলী পাকায় হীরক জোছনা।

আমার ঢুলুঢুলু ঘোর। ঘোর একটা সাদা ঘোড়ার দৌড়। দ্যোতিমান ঘোড়ার লেজে
ঝুলে যায় আমার চোখ। ওর রেশমি লেজ ছড়িয়ে দেয় সবুজ শস্য ভরা ধান নদী
দারুচিনি গ্রাম। মসলা ঘ্রাণ সচিত্র পাতা বৃক্ষ সবুজ ডাল। ডালের দিকে ওড়ে যায়
পাখি বনঘুঘু।

গ্রাম বালিকা হাসে। আলোর উৎস মুখে লাল শাড়ি বউ কলসী ডুবায়। আমরা পান
করি আলোর মধু।

 

গৌরী

প্রতিদিন গৌরীর সাথে জীবন বদল করি। সমস্ত জঙ্গল চষে
আমি যখন গৌরীর ডেরায়।
তার কুলুঙ্গিতেই ঘোর নিদ্রা, নিশিযাপন।

শুনেছি মানুষের প্রেমে শরীর থেকে চিলিক দিয়ে রক্ত উঠে মাথায়।
খুন পর্যন্ত গড়ায় জেনেও
মদ আর মরণের লোভে
চাঙ্গা দেয়া কাঠের টুলবাক্সে বসে
আমি গৌরীকেই প্রশ্ন করি, তুমি গৌরীকে চেনো ?
সে বলে, তোমার মুখেই তো কতো শোনেছি তার নাম।

আমি তখন তার কণ্ঠে ঠোঁট চেপে নিজের জীবন দিতে দিতে বলি,
আমিই সেই গৌরাঙ্গ মোহন
পূর্বজন্মে তুমি যার অগ্নিতে বিসর্জন ছিলে।

 

সাকার

জন্মসূত্রে এই দেহঘরে আমি আমার সাকার পেয়েছিলাম। এই ঘরে ঠাঁই-
ঠিকানা হয়েছিল আমার। যখন সেই পরম সত্তার প্রদীপ্ত আলো থেকে সহসা
ভ্রমণে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি।

ইতোমধ্যেই আমি জেনে গেছি, পৃথিবীর ছায়া-সবুজ আলো-ঝলমল এই
মনোমুগ্ধকর বাড়িতে আমার আর বেশিদিন থাকা চলবে না।

রহস্যঘেরা এই গ্রহের বাসিন্দাদের প্রতিটি মুখে আমি তাকিয়ে দেখেছি
কারো দেহকোঠাতেই আমার দ্বিতীয় ঠিকানা নেই।

মোস্তফা মঈন। কবি। জন্ম, ৩ মে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ। বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার গৃদান টেংগা গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'কালের সেঁওতি মাপে জল' (২০০১), 'শ্বাস পতনের শব্দ' (২০০৩), 'রক্ত মাংসের শ্লোক' (২০০৮), 'হাড়ের পিয়ানো' (২০১৫), 'গন্ধকুমারী ও পাপচিহ্ন' (২০১৭), 'বাম হাতে সমুদ্র ঠেলছি' (২০১৯)। লেখালিখির...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..