কলিম খান: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক অত্যাশ্চর্য্য রাজপুত্রের রূপকথা

নারায়ণচন্দ্র দাস
সৌরভ মিত্র-এর প্রবন্ধ
কলিম খান: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক অত্যাশ্চর্য্য রাজপুত্রের রূপকথা

কলিম খান: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক অত্যাশ্চর্য্য রাজপুত্রের রূপকথা

[ কলিম খানের অকাল প্রয়াণ উপলক্ষে এক আংশিক স্মৃতিচারণা ]

কে এই কলিম খান? কেন তার প্রয়াণে আমাদের স্মৃতিচারণা করতে হবে? কেন ভাবীকালের বাঙালীসমাজ শ্রীময় রবি চক্রবর্ত্তীসহ কলিম খানের নাম স্মরণে রাখবে? বাঙালী তথা ভারতসহ বিশ্বের ভাষিক সমাজের কাছে এই স্মৃতিচারণার যৌক্তিকতা ও সম্পর্ক কোথায়? তার আগে সমসাময়িক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রীপার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে’ গ্রন্থ সম্পর্কে কী বলেছিলেন তার পূনর্লোকন করা যাক –

“ভারতের প্রাচীন সভ্যতার রিনিউয়াল বা পুনর্ণবিকরণের প্রক্রিয়া এ দেশে হয়নি। আরবীয় জ্ঞানের বিস্তারও তুর্কী বা মুঘল আমলে দেখা যায় না। আর ভারত জয়ে ওই নবীকরণের সব সম্ভাবনাই লুপ্ত হয়। এক ভয়াবহ ব্রেক বা বিচ্ছিন্নতা এসে যায়। ফলে প্রতীচ্যই হয় ওঠে সব কিছুর মানদণ্ড – আমাদের আধুনিকতাও প্রতীচ্যের আদলেই তৈরী করার চেষ্টা হয় – অথচ প্রতীচ্যের আধুনিকতা বুদ্ধি জিজ্ঞাসা যুক্তিবাদ মানবতাবাদই আমাদের এখানকার ঔপনিবেশিক বাস্তবের স্রষ্টা। ওই সভ্যতার নবীকরণের অভাবে, আমরা আধুনিককে খুঁজি প্রতীচ্যে, আমাদের আধুনিকতা নির্ম্মিত হয় না। কলিম খানের এই গ্রন্থ সেই বিকল্প আধুনিকের সন্ধান।

ভাষা ও চিহ্ন এবং আইডিওলজি বা ভাবাদর্শ পরস্পর সংলগ্ন, ভাষার সূত্রেই ভাবাদর্শ সংজ্ঞায়িত হয়। কলিম খান-এর ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির পাঠ তাই আসলে সভ্যতার পাঠ। এ পাঠ প্রতীচ্য-নির্ভর শিক্ষিত মধ্যবিত্তর কাছে দুরূহ, আবার শুধু সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ মৌলবাদীর কাছেও অগম্য। কারণ এ পাঠ ওই দ্বৈরাজ্যিক বিশুদ্ধিবাদের। এ এক আধুনিক পাঠ, তবে এদেশের আধুনিক।”

এই আধুনিকের সন্ধান ও আধুনিকতার পাঠাস্বাদ গ্রহণের জন্যই কলিম খান এবং তার সহযোগী শ্রীরবি চক্রবর্ত্তী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, আবশ্যিক ও অবিস্মরণীয়।

আর স্বয়ং রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান, ঁ ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’- এর মত অভিনব ও বৈপ্লবিক শব্দার্থকোষের স্রষ্টা, – তাঁদের একটি বয়ানের উদ্ধৃতির দিকেও আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই –

“যাঁরা বিশ্বের প্রথম রেলযাত্রার ঘটনাটি জানেন না, তাঁদের জানাই – প্রথম রেলযাত্রার দিন ঘোড়াগাড়ীর সঙ্গে রেলের প্রতিযোগিতা হয়েছিল এবং রেলগাড়ী হেরে গিয়েছিল; গন্তব্যে আগে পৌঁছেছিল ঘোড়াগাড়ী। উপযোগিতার বিচারে প্রচলিত অভিধানগুলির তুলনায় আমাদের এই শব্দার্থকোষ এই মুহূর্ত্তে অকার্য্যকর মনে হলেও হতে পারে, কিন্তু আমরা নিশ্চিত, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের এই শব্দার্থকোষের প্রদর্শিত রীতি ও পন্থাই সকল ভাষাচর্চ্চাকারীদের কার্য্যকরী সহায়ক হয়ে উঠবে। কিন্তু তা হয়ে উঠবে কীভাবে? সবাই হাত লাগান, এই আমাদের প্রার্থণা।

কলিম খান (১লা জান্যারী ১৯৫০ – ১১ই জুন ২০১৮) এর অকাল প্রয়াণ কত বড় ক্ষতি্‌, আরও কত কাজ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম – তা বলতে গেলেও আরেকটা মহাভারত লিখতে হয়। এই ক্ষতি বাংলার ও বাংলাভাষারই শুধু নয়, বাঙালীসহ আবিশ্বের সকল ভাষা ও ভাষিক সমাজের ক্ষতি।

আজ কলিম খানের স্মৃতিচারণায় সব কথা বলা যাবে না। আমি শুধু কলিম খানের সংস্পর্শে আসার সূচনাপর্ব্বের কথাই আপনাদের জানাতে চাই।

১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে হঠাৎই হাতে এল বারাসত থেকে প্রকাশিত একটি লিটল ম্যাগাজিন “ছন্নছাড়া-২”। সেদিন আমি বা্রাসত নিবাসী ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু,কবি, চিত্রকর, চলচ্চিত্র-পরিচালক শ্রীশঙ্কর কর্ম্মকারের বাড়ীতে আড্ডার আসরে বসে। ঐ বছরই কলিকাতা পুস্তক মেলা উপলক্ষ্যে ছন্নছাড়া’-২ প্রকাশিত হয় আর তার প্রতিটি গদ্য রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল “যৌনতা”। লেখক তালিকায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রবিশঙ্কর বল, পথিক গুহ, মলয় রায়চৌধুরী, সুবিমল বসাক ইত্যাদি অনেকেই এবং অবশ্যই কলিম খান। শঙ্করই কলিম খানের লেখাটিকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ার জন্য অনুরোধ জানায়। একুশ পাতার নিবন্ধটি পড়ে ফেলার পর কলিম খানের বাড়ীর ঠিকানা ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করে কলিম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চাইলে তিনি তা তৎক্ষণাৎ মঞ্জুরও করেন। আমার আর তর সয় নি। ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮ সালের কত তারিখ সেটা আজ আমার মনে নেই, কিন্তু ফোনে কথা বলার দুই-এক দিনের মধ্যেই যে দেখা করেছিলাম সেটা স্পষ্ট মনে আছে।

যৌনতা বিষয়ক ছন্নছাড়ায় সেই আশ্চর্য্য প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল “যোজনগন্ধবিাকার ঃ ‘সিষ্টেম* ডিজাইনিং’-এর একটি সমস্যা” যার নীচে লেখা ছিল লেখকের নাম – না-শোনা অচেনা অখ্যাত একটি নাম – ‘কলিম খান’।

নিবন্ধটি শুরু হচ্ছে গীতা’র একটি উক্তি দিয়ে, – “শ্রীভগবান কহিলেন – হে ভারত। মহৎ ব্রহ্মই আমার যোনি। তাহাতেই আমি গর্ভ নিক্ষেপ করি। তাহা হইতেই সর্বভূতের উৎপত্তি হয়।” – ১৪’৩।

নিবন্ধটি চারটি অধ্যায়ে বিস্তৃত আছে – আর অধ্যায়গুলির শিরোনামগুলি আক্ষরিক অর্থেও চোখ ধাঁধানো – ১। অমৃতলিঙ্গম ও ব্রহ্মযোনী কথা [ The Story of Software & Hardware ]; ২। যোগসাধনা ও তন্ত্রসাধনা [ Coupling & System Designing ]; ৩। যোজনগন্ধ ( প্রকৃত যৌনতা ) [ Real Information ]; ৪। যোজনগন্ধ সঙ্কোচ ও যোজনগন্ধ বিকার [ Information Hiding & Misinformation ].

পাঠক এই পর্য্যন্ত পড়ে হয়তো ভাবছেন – একধরণের অগভীর লেখক আছেন যারা ভারী ভারী ভাবনাসমৃদ্ধ শিরোনাম দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করার ছলে যা পরিবেশন করেন তা শূন্যগর্ভযুক্ত কলসীর ফাঁকা আওয়াজের মত ব্যাপার! না, তেমন আমার মনে হয় নি কলিম খানের এই প্রবন্ধটি পড়ার পর। পড়ার পর কারও তেমন অভিজ্ঞতা হয় নি বলেই জানি।

এক নিঃশ্বাসে পঠন সমাপ্ত করে তৃপ্তি মেটে নি, তার পর কতবার যে পড়েছি এই নিবন্ধটি তার ইয়ত্তা নেই। যতবার পড়ি ততবারই নতুন করে পড়ার আগ্রহ এবং নতুন নতুন রূপে ও আস্বাদে আজও তা উপভোগ করে চলেছি। সেদিনের সেই অনুভূতি সত্যিই অনির্ব্বচনীয় ছিল। কলিম খানের এই প্রবন্ধ পাঠের আগে পর্য্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছাড়া যে প্রাবন্ধিককে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে মেনেছিলুম সেই কার্ল মার্ক্স ও এঙ্গেলস্‌ প্রণীত “কম্যুনিষ্ট ম্যানিফেষ্টো” গদ্যে লেখা হলেও যাকে আসলে টান টান আবৃত্তি করে পড়ার যোগ্য ব’লে কবিতার মত করে পাঠাস্বাদ নেওয়া ছাড়াও বিষয়বস্তুর গভীরতায় পরিপূর্ণ একটি রচনা বলে মেনে নিয়েছিলাম। কলিম খানের এই নিবন্ধটি পড়ার পর আমার মনে হল রবীন্দ্রনাথের পরে এমন প্রাবন্ধিকের এই নিবন্ধটির আস্বাদ আগে কোথাও পাই নি। ভারতীয় দর্শনচিন্তার প্রতিফলন সমৃদ্ধ এমন নিবন্ধ আস্বাদনের আগে ‘কম্যুনিষ্ট ম্যানিফেষ্টো’র আন্তর্জ্জাতিকতাবোধের সঙ্গে একাত্ম হতে পারলেও এবং শ্রমজীবী মানুষদের সংগ্রামের ঘনসংবদ্ধ রসোত্তীর্ণ দ্বন্দমূলক দলিলটি কালোপযোগী মনে হলেও, “যোজনগন্ধবিকার”-এর মত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে একাত্মতার উন্মেষ ঘটানোর মত বাণী কিংবা দ্বৈতাদ্বৈতের প্রেমমূলক অখণ্ডের স্পর্শ অনুভব করার মত শাশ্বত ও কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠার বাণী সেখানে ছিল না। এখানে বলে রাখা ভালো, তখনও কলিম খান প্রণীত প্রথম গ্রন্থ “মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে” পড়ার সৌভাগ্য আমার হয় নি।

তারপর শুরু হল লেখক চিন্তাবিদ, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক কলিম খানের খোঁজ – এই অসাধারণ মানুষটি কে, কেমন মানুষ, কোথায় থাকেন, কী তার পরিচয়?

দক্ষিণ কলিকাতার ‘মাষ্টারদা’ মেট্রো ষ্টেশনে নেমে অথবা বাসে এসে অটোতে চড়ে অথবা বাঁশদ্রোণী ও নাকতলার মধ্যবর্ত্তী বাস-ষ্টপ ‘ঊষা’-তে নেমে টালি নালা পার হয়ে অটোতে চড়ে বর্ত্তমানে নিভা পার্ক ফেজ-২ তে নামতে হয়। তবে ১৯৯৮ সাল থেকে সবচেয়ে বেশী সময় যে বাড়ীতে কলিম খানকে থাকতে দেখেছি সেই বাড়ীটা বর্ত্তমান বাড়ীর চেয়ে আরও কিছুটা দূরে দক্ষিণ দিকে একটি ভাড়া করা বাড়ীতে যেতে হত। সেই বাড়ীর নীচতলায় বাড়ীর মালিক তার পরিবার নিয়ে থাকতেন। ৫০ টাকা ভাড়ায় দোতলায় মাথার উপরে অ্যাসবেষ্টসের ছাদ এবং পাকা মেঝের একটা ছোট বাড়ীতে কোনরকমে এক পুত্র, দুই কন্যা এবং স্ত্রী ক্লারা খান সহ কলিম খান বাস করতেন। এক চিলতে বারান্দাও ছিল, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বারান্দার যে অংশে পা রাখা যায় সেটা বারান্দার পূর্ব্ব দিক, পশ্চিম প্রান্তে অপ্রশস্ত একটি রান্নাঘর এবং অপরটি টয়লেট-কাম-বাথ্রুম। মাঝেখানের জায়গাটা শ্রীময় ক্লারা খানের জন্য; সারাদিন সংসারের জোয়াল টানার পর বিকেল হতে না হতেই পাঁচ ছয় জন কচিকাঁচাদের প্রাথমিক শিক্ষার ভার সামালাতেন ক্লারা খান। স্বামীর সারস্বত সাধনাকে সার্থক করার জন্য সারা জীবনভর যেভাবে স্বামীর পাশে থেকে সমর্থন উৎসাহ দিয়েছেন তারই একটি টুকরো ছবি আমার মত অনেকেই যাঁরা কলিম খানের ভাড়া করা আবাসে গিয়েছেন তারাই চাক্ষুষ করেছেন। দোতালায় ওঠার পর ডানদিকের প্রথম ঘরটিই কলিম খানের পড়ালেখার ঘর, যেখানে বসেই একটি সাধারণ মানের কম্পিউটার ও প্রিণ্টারের সহায়তায় ডিটিপি’র কাজ করতেন; যাকে তাঁর জ্ঞানচর্চ্চার ঘর ও তাঁর আবিষ্কারের ‘আঁতুড়ঘর’ও বলা যায়। এই ঘরেই বিভিন্ন সময়ে আমার পরিচয় ঘটে আরও কিছু কলিম খানের অনুরাগী ও কিছু লিটল্‌ ম্যাগাজিনের সম্পাদকের সাথে – যেমন বন্ধুবর শ্রীঅরিন্দম চক্রবর্ত্তী, শ্রীরাজু দেবনাথ (কবি ও চিত্রকর), বারীন ঘোষাল (কৌরব), আরিফ ফুয়াদ (দিবা রাত্রির কাব্য) সহ আরও অনেকের সাথে। ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও আরও অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের যুগ্ম রচয়িতা ভাষাতাত্ত্বিক শ্রীরবি চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে তখনও আমার পরিচয় হয় নি।

প্রথম সাক্ষাৎকারেই আমি ‘যোজনগন্ধবিকার – “সিষ্টেম ডিজাইনিং-এর সমস্যা” শীর্ষক নিবন্ধ পড়ার অভিজ্ঞতা ও বিস্ময়ের কথা এবং আমার ভালো লাগার কথা, লেখা ও লেখকের প্রতি শ্রদ্ধার কথা জানাই। “মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্পণে এবং “দিশা থেকে বিদিশা – নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশবার্ত্তা” এই দুটো বইয়ের একাধিক কপি কিনে নিই শুধু নিজের জন্যই নয়, প্রিয় বন্ধুবান্ধবদের পড়ানোর জন্যও। প্রথম সাক্ষাতেই পারস্পরিক পরিচয় এবং ভাবের আদানপ্রদান ইত্যাদি সারার ফাঁকেই বাড়ীর পরিবেশ দেখে এটা বেশ বুঝতে পারি জ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে কতটা অবর্ণনীয় দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পাঁচ সদস্যের একটা পূর্ণ পরিবারকে নিতান্ত সাধারণ জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। অথচ এরই বিপ্রতীপে এক অসাধারণ প্রাবন্ধিক, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও ভাষাবিজ্ঞানীর আত্মপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি।

এরপর বছর খানেক শিলিগুড়ি থেকে কলিকাতায় বেশ কয়েকবার যাতায়াত করি কলিম খান এবং তার লেখালেখির আকর্যণে। নিরাপত্তাহীনতার কথা আগেই বলেছি – আমাদের মত মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীদের জীবনে মাসমাইনে কমবেশী যাই পাই না কেন তার একটা নিশ্চিত যোগান থাকে প্রত্যেক মাসান্তের পর। এই নিশ্চয়তা কলিম খানের পরিবারে ছিল না। যখন যেমন কাজ মেলে অথবা মেলে না এই ছিল তাঁর ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তাহীনতা। একবেলা রান্না হলে আরেকবেলা সন্তানসন্ততি কী খাবেন তার নিশ্চয়তাও স্বভাবতই ছিল না। সারস্বত সাধনা বাদ দিলে সংসার সচল হবার পথ খুলে যায়; বিপরীতে সারস্বত সাধনা চালিয়ে গেলে সংসার চলতে চায় না। এই টানাপোড়েন, বঞ্চনা, অভাব-অভিযোগ, জীবনযন্ত্রনা ইত্যদি ছিল তার নিত্যসঙ্গী। আমি যেদিন থেকে তাঁর সংস্পর্শে আসি তখন থেকে দেখেছি লিটল্‌ ম্যাগাজিনের ডিটিপি করাই ছিল তার একমাত্র সম্বল এবং সেটাও এতই অনিয়মিত ছিল যে তা দিয়ে পাঁচ সদস্যদের একবেলা অন্নসংস্থান করাও কষ্টকর ছিল। তবে দারিদ্র‌্যের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে আহাজারি করে প্রতিবেদনের আয়তন বাড়ানোর উদ্দেশ্য আমার নয়।

যেটা না বললেই নয়, তা হল এমন ছন্নছাড়া অসহায় জীবনের মুখে দাঁড়িয়েও কলিম খান মানসিকভাবে বিপর্য্যস্ত হন নি এবং ভারত-ইতিহসের খোঁজে প্রাচীন ভাণ্ডার ঘেঁটে চলেছেন ভারত ইতিহাসের উদ্ধারকার্য্য চালিয়ে গেছেন। কারও কাছে কোন প্রত্যাশা ছিল না, ছিল আরও কত কিছু না করতে পারার বেদনার। মাঝে মাঝেই বলতেন কোন প্রতিষ্ঠান কোন সরকারী বিভাগ পাশে দাঁড়ালে ভারতের কিংবা বিশ্বের বেশ কিছু ভাষার গবেষককে পাশে পেলে রবিবাবুর ( বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ও শ্রীরামপুর কলেজের ফিললজি সহ ইংরেজীর অধ্যাপক শ্রীরবি চক্রবর্ত্তী’র ) সমর্থনে তাকে সাথে নিয়ে উভয়ে মিলে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির দৌলতে সেই সব ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক অভিধানও রচনা করে দিতে পারতেন। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষের অবয়ব বৃদ্ধি কিংবা আরও শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রিয়াভিত্তিক রচনা করে সর্ব্ববৃহৎ শব্দার্থকোষও রচনা করে যেতে পারতেন সেক্ষেত্রে শব্দার্থকোষের কলেবর হত বিশাল, আরও কয়েক খণ্ড বেড়ে যেত। সেই আশা হয়ত পূরণ হয়নি, কিন্তু যা দিয়ে গেছেন তার পরিমাণও তো বিপুল। এদিকে, ‘দিশা থেকে বিদিশায়’ গ্রন্থটি প্রকাশ করতে গিয়ে কলিম খানকে বিক্রী করতে হয়েছিল কাঁসাই তীরবর্ত্তী ডেবরা থানার অন্তর্গত মামুদাবাদ গ্রামের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সামান্য পৈতৃক জন্মভিটের জমিটুকুও। এতসবের মধ্যেও কলিম খান ছিলেন এক অক্লান্ত হার-না-মানা মননশক্তির অধিকারী, যার জোরে তিনি চালিয়ে যেতে পেরেছেন তাঁর লেখনী সমস্ত রকমের প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়েও। এরই মাঝে অন্য অনেকের মত আমার কৌতুহলকেও ঠাণ্ডা মাথায়, হাসিমুখে সামলে নিচ্ছেন, বলে চলেছেন তাঁর অভিযানের কথা, তাঁর ভাষাচর্চ্চার কথা, তাঁর ইউরেকা-মুহূর্ত্তগুলির কথা! এককথায় আমাদের জিজ্ঞাসার কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য ধৈর্য্য ধরে বুঝিয়েছেন। তবে সে প্রসঙ্গ বারান্তরে বলা যাবে, আজ নয়।

প্রথম সাক্ষাতের আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি দুটি গ্রন্থ যার কথা আগেই বলেছি। বিশেষ করে “মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে”র কথা। মৌলবাদের বিভিন্ন রূপের কথা যেমন – গোঁড়ামী, জাতিবাদ, জাতীয়তাবাদ, গোষ্ঠীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ফ্যাসিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, ইত্যাদি শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচয় তো ছিলই এবং সারা জীবন ধরেই এইসব শব্দবন্ধ শুনে এসেছি। ধর্ম্মীয় গোঁড়ামীর কারণেই তো দেশভাগের অবর্ণনীয় দুঃখদায়ক পরিণতি; সে পরিণতি সহস্র লক্ষ মানুষের মত আমারও। আর এইসব শব্দবন্ধ সম্পর্কিত ধারণা বিষয়ে প্রচুর লেখালেখিও পড়েছি। কিন্তু মৌলবাদ নিয়ে এত ভালো তাত্ত্বিক নিবন্ধ দ্বিতীয় আর পাই নি।

এই গ্রন্থটির চারটি অধ্যায় – (১) মৌলবাদ – তত্ত্ব; (২) মৌলবাদ – তথ্য; (৩) মৌলবাদ – প্রেক্ষাপট; (৪) উপসংহার। প্রতিটি অধ্যায়ের বিভিন্ন অংশের নাম। প্রথম অধ্যায়ের বিভিন্ন বিভাগগুলি হল – অর্থাপত্তি, উৎপত্তি, প্রতিপত্তি, সম্পত্তি, বিপত্তি, নিষ্পত্তি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিভাগগুলি – পরিভব, আদিভব, উদ্ভব, সম্ভব (এক), সম্ভব (২), বিভব (এক), বিভব (দুই), অভিভব (এক) অভিভব (দুই), বৈভব, পরাভব। তৃতীয় অধ্যায়ের বিভাগগুলি যথাক্রমে – কলন, সঙ্কলন – ( বেদে পাষণ্ড, নিষাদ, যবন), নিষ্কলন, অবিকলন ( ব্রহ্মবিহার, বায়ু, অগ্নি, নগদ-নারায়ণ, জগৎসৃষ্টি, সপ্তর্ষি )।

এই গ্রন্থের প্রতিটি অংশের প্রতিটি লাইন এতই সুচিন্তিত, এতটাই সংহত, এতটাই বক্তব্যের গভীরতার অতলস্পর্শী ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ – হে পাঠক, এই স্বল্প পরিসরে তার বর্ণনা করা অসম্ভব! পাঠক নিজেই পঠন-পাঠনের মাধ্যমে তার আস্বাদ নিতে এগিয়ে আসুন। “মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে” – গ্রন্থটিকে বিশ্বের সর্ব্বকালের শ্রেষ্ঠ মুষ্টিমেয় গ্রন্থগুলির অন্যতম বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।

“দিশা থেকে বিদিশা – নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশ বার্ত্তা” গ্রন্থটিও বৌদ্ধিক উজ্জ্বলতায় ও জ্ঞান-শলাকায় সমৃদ্ধ। নিবন্ধের অধ্যায়-তালিকাগুলি যা আসলে কিছু কিছু শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের ফলিত প্রয়োগের ফসল। অর্থোদ্ধারের মাধ্যমে শব্দগুলির ভিতরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি, অথ্যাত্মতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, জীবন দর্শন ইত্যাদিকে তুলে ধরে কলিম খান দেখিয়েছেন – আমাদের ভাবসম্পদ কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আত্মবিস্মৃতির কারণে এবং প্রতীচ্যের ভাষাতত্ত্বের অন্ধ অনুসরণের ফলে।

দ্বিতীয় গ্রন্থ *দিশা থেকে বিদিশা”র নিবন্ধগুলির শিরোনাম ও বিষয়বস্তু কলিম খানের অভিনবত্ব, আধুনিকতা ও জ্ঞানচর্চ্চার ক্ষেত্রে তিনি যে গোকুলনিবাসী তা আরও একবার তুলে ধরেছিলেন। নামগুলি কারও কানের কাছে একবার উচ্চারিত হ’লে এই নিবন্ধসমূহের পঠন-পাঠন সমাপন না হওয়া পর্য্যন্ত তাঁর নিষ্কৃতি নেই। নিবন্ধগুলির নাম –

১। জগৎস্রষ্টার জন্মমৃত্যু – শতাব্দীশেষের ঈশ্বরভাবনা; ২। বেনীসহার বৃত্তান্ত; ৩। যোজনগন্ধবিকার – ‘সিষ্টেম ডিজাইনিং’-এর একটি সমস্যা; ৪। কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন; ৫। দর্শনের পালাবদল – দিশা থেকে বিদিশায়; ৬। লক্ষ্মীর পাঁচালী – ওয়েলফেয়ার ইকনমির ভূত ভবিষ্যৎ; ৭। নগদ-নারায়ণ – ভারতের ‘ডাস্‌ ক্যাপিটাল’ ও পুঁজির বিশ্বরূপ দর্শন; ৮। ভাষার ঔপনিবেশিকতা – প্রাচীন ভারতে ম্যানেজমেণ্ট ও বাৎস্যায়নের কামসূত্র; ৯। বিশুদ্ধিবাদ ও পোষ্টমডার্নিজম; ১০। প্রাগাধুনিকতা আধুনিকতা ও অধুনান্তিকতা; ১১। মামদো ভূত; ১২। জ্ঞানবৃক্ষের ফলমূল; ১৩। অর্থ থেকে পরমার্থ – আর্থিক উদারীকরণের উত্তরাধুনিক সমস্যা; ১৪। পরমাপ্রকৃতিতত্ত্ব – গ্র্যাণ্ড ইকোফেমিনিজম; ১৫। নরকদর্শন – ‘বেঙ্গল এক্সপিরিয়েন্স’-এর আল্‌টারনেটিভ প্যাকেজ ট্যুর; ১৬। সাংস্কৃতিক মহাবিস্ফোরণের অশনিসঙ্কেত; ১৭।
পরিক্রমা – সারোদ্ধার ও অতিক্রম; ১৮। শব্দসূচী।

মৌলবাদ আজ এক সর্ব্বগ্রাসী বাস্তব অভিজ্ঞতা। ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, গোষ্ঠী কিংবা দল কিংবা সম্প্রদায়ের জীবনে, সামাজিক জাতীয় ও রাষ্ট্রিক জীবনসহ ধর্ম্ম-ইতিহাস-দর্শন-সমাজতত্ত্ব- শিক্ষা-মতাদর্শ ইত্যাদি এমন কোন ক্ষেত্র অবশিষ্ট নেই যেখানে মৌলবাদের অশুভ উপস্থিতির ছোঁয়া লাগেনি। বর্ত্তমান সভ্যতার সঙ্কট ও সার্ব্বিক অহিতের মূলেও এই মৌলবাদের বিষময় প্রভাব। করপোরেট পুঁজি ( মহাবিভূতি বা মহাকুবের ) কবলিত ও নিয়ন্ত্রিত দেশের কর্ম্মযজ্ঞ, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং জ্ঞানচর্চ্চাসহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাতাই আজ কলুষিত। বহুরৈখিক ক্রিয়াভিত্তিক ভাষাদর্শন ধনতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক তাই পরিত্যক্ত, এবং একমাত্র একরৈখিক প্রতীকী লোগোসেণ্ট্রিক ভাষা ও ভাষাতত্ত্বই পারে জ্ঞানশক্তিকে মুক্তচৈতন্যের কিংবা শ্রীচৈতন্যের পরিমণ্ডল থেকে বের করে এনে বদ্ধ-চৈতন্যের সূচনা করতে। জ্ঞানশক্তি এবং তার ধারক-বাহক স্বাধীনচেতা জ্ঞানজীবীদের পায়ে শেকল পরিয়ে করপোরেটের ভৃতক-কর্ম্মচারীতে রূপান্তরিত করতে না পারলে মহাকুবের করপোরেট-পুঁজি নিয়ন্ত্রিত লুঠেরাতন্ত্রের মৃত্যু অনিবার্য্য। তাই কেনারাম-বেচারামের ইতিহাসবোধ থাকলে চলে না। ভোগবাদী দর্শন, পণ্যসম্ভারের মাদকতা এবং সমাজ-পরিবার থেকে সবধরণের যৌথতাবোধবিমুক্ত বিশ্ববাজারের প্রত্যেক ভোক্তাকে নিখুঁত এক আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য করে, তার সমস্ত স্বাধীনতা হরণ করে। আর, এভাবেই মৌলবাদ এবং পুঁজিবাদ তার অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ‘মৌলবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে’ তাই একটি বিপজ্জনক গ্রন্থ এবং মৌলবাদের মৃত্যুবান লুকিয়ে আছে এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। এবং অবশ্যই কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তীর যুগলবন্দীতে রচিত পরবর্ত্তীকালের অন্যান্য রচনাবলীতেও।

আজ অনেকেই কলিম খানের গ্রন্থা্দি’র খোঁজ করছেন, তাঁদের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেউ কেউ হয়তো মাঝের বা শেষের গ্রন্থগুলি সংগ্রহ করতে পেরেছেন, অনেকে তাও পারেন নি। গ্রন্থগুলির পুনঃপ্রকাশ ছাড়া এগুলি সংগ্রহের সুযোগও কম। আজ আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি – কারণ, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, সরল শব্দার্থকোষসহ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির যৎসামান্য যেটুকু আমি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছি যদি শুরুতে এই দুটি মহামূল্যবান গ্রন্থপাঠ করার সুযোগ আমি না পেতাম, তাহলে তা সম্পূর্ণ হত না। এই বই দুটি না পরে কলিম খানের তত্ত্বকে তার সামগ্রিকতায় ধরতে পারা অনেকটা কঠিন বলেই আমার মনে হয়।

“মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে” এবং “দিশা থেকে বিদিশায় – নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশ বার্ত্তা”র মত দুটি অনন্য গ্রন্থের রচয়িতা কলিম খান-এর অকাল প্রয়াণে আমি আমার বিশ্ববীক্ষার গুরু, অভিভাবক, বিদিশার অগ্রদূত এবং এক অত্যাশ্চর্য্য রূপকথার মানসলোকের রাজপুত্রকে হারালাম।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

পূর্ব বাঙলার অসংস্কৃত জনসমাজের আবশ্যিকতা হোসেন মিয়া

পূর্ব বাঙলার অসংস্কৃত জনসমাজের আবশ্যিকতা হোসেন মিয়া

ভূমিকা: লেখাটি পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের একটি চরিত্রের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে উপন্যাসটির শিল্পমান, উপন্যাস…..