সাহস

তৌহীদা ইয়াকুব
গল্প
Bengali
সাহস

লিলার বাবা সাদেক সাহেব। একটা সরকারি চাকুরি করেছেন সারা জীবন। সরকারি চাকুরিতে ঘুষ দুর্নীতির জায়গাতে থেকেও উনি ছাপোষা জীবন কাটিয়েছেন। এই বাড়িটা বাবার ভিটায় তোলা অনেক কষ্টের একমাত্র মাথা গুছার ঠাই। দুর্বল, ভীতু আথচ সৎ ভালোমানুষি আর আত্মসম্মান বোধ ই পুঁজি করে বেঁচে আছেন তিনি। এখন অবসরে আছেন। লিলা আর শিলা দুই বোন। শিলার বিয়ের পর ৩ বছরের মাথায় বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় শিলা এক্লেমশিয়া হয়ে গিয়েছিল বলে। এই শহরের অনিন্দ্য সুন্দর বলতে সবাই এই শিলাকেই বুঝাত। গায়ের রং , মুখের গড়ন চুল সব মিলিয়ে দারুণ দেখতে ছিল । শিলা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওদের বাবা সাদেক সাহেব অনেক টা ভেঙ্গে পড়েছেন। বয়সের আগেই যেন অনেক খানি বুড়ো হয়ে গেছেন। সরকারি চাকুরি থেকে অবসরের পর পেনশন এর টাকাই সংসারের সম্বল। তাতে কোন রকমে দিন চলছে।

সাদেক সাহেবের ছোট মেয়ে লিলা। এখন বয়স ২৬। বড় বোন শিলার মত দুধে আলতায় রং হয়নি তার বরং উল্টো শ্যামলা রং এর মাঝে লম্বা ঘন কালো চুল। তবে শিলার চেয়ে তার উচ্চতা অনেক খানি বেশী। সে সুন্দর না বলে কখনই সে সাজগোজ করতে চাইতো না। লিলা মেনেই নিয়েছিল যে লিলার মত সুন্দর সে কখনই হতে পারবে না তাই তার সাজগোজ এর প্রতি কোন আকর্ষণ কখনই ছিল না। শ্যামলা মুখ টাতে চোখ দুটো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একটা উঠতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করছিল দুই বছর ধরে নাম মাত্র বেতনে। বেতন এর চেয়ে লিলার কাছে সত্য উদ্ঘাটন এর নেশা টা আর তা টেনে নিয়ে এসে মানুষের বিবেকের কাছে মেলে ধরা টাই মুল বিষয় মনে হত সব সময়। পত্রিকার মালিক আশরাফ চৌধুরী লিলার কাজের সাহস আর নিষ্ঠা দেখে চমকে যেতেন। লিলার দুই বন্ধু সব সময় লিলা কে উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি সব রকম সহযোগিতা করে আসছে।

আজ কয়দিন যাবত অচেনা নাম্বার থেকে একটা ফোন আসছে লিলার কাছে। লিলা ধরছে কিন্তু ওপাশ থেকে কোন কথা বলছে না কেউ। লিলা ভাবছে নেটওয়ার্ক প্রবলেম। আজ সকালে ডাক পিয়ন তাকে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। ওটা পড়ে অসার হয়ে বসে ছিল এতক্ষণ। একটা অশুভ খেয়াল খুব সহজ ভাবেই এসে এবার ঠায় , অনড় দাঁড়িয়ে আছে লিলার সামনে। এটা যেন কোন চিঠি না একটা প্রস্তাব মোটামুটি এটাকে কু-প্রস্তাব ই বলা চলে অন্তত লিলা একজন মেয়ে মানুষ বলেই এমন ভাবা যায়। লিলা ও একরোখা , নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তবে এত বড় একজন মানুষের কাছ থেকে এই সময়ে এমন করে কোন প্রস্তাব পাবে সে কখনই তা ভাবে নি।সারা শহরে এই মানুষ টি অনেক বেশী সম্মানের। যেমন তার বৈভব তেমনি ব্যক্তিত্ব। সাহায্য সহযোগিতার হাত ও তার প্রসারিত অন্তত এমনি সবার মত লিলার ও তাই জানা। কোন ভাবেই হিসেব মিলছে না। এই কেসের দূর দূর থেকে এই মানুষ টাকে কখনই দেখে নি লিলা। তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অনেক বড় না হোলেও তার এত বড় ভুল হওয়ার কথা না।সত্যি অভাবনীয়। এভাবে বসে থাকলে হবে না। তাড়াতাড়ি রেজা আর পৃথা কে ব্যাপার টা জানানো দরকার। হাঁটে সময় খুব কম।

সাংবাদিক লিলা সাইফ , ডক্টর রেজা , এলাকার কলেজের সহকারি অধ্যাপক পৃথা ঘোষ তিন বন্ধু সারাদিন শেষে বসেছিল চায়ের স্টলে। লিলা ভীষণ অস্থির ভাবে কথা বলছে। রেজা তাকে বার বার শান্ত করার চেস্টা করছে। পৃথা কে উদবিঘ্ন দেখাচ্ছে।খুব সাবধানে ওদের ভিতর একটা প্ল্যান চলছে। নিচু স্বরে কথা বলছে ওরা। আগামি কাল ডিসি অফিস এ একটা অফিসারস ক্লাবের আয়োজনে নিমন্ত্রণ পেয়েছে ওরা তিনজনই। সেটা ছিল একটা সাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু গতকালের চিঠি আগামি কালের এই প্রোগ্রাম টাকে অন্য মানে এনে দিয়েছে লিলার সাথে বাকী দুই বন্ধুর জন্যও।এটা এখন লিলার একার না ওদের তিন জনেরই লড়াই। রেজা বার বার বলেছে লিলা তোর একটু সাহস আর সতর্কতা ই যথেষ্ট আমাদের জন্য। আমরা দু’জন তো আছি ই। আর আমরা যা ভাবছি তা নাও হতে পারে। তবে সতর্ক থাকা জরুরি। এবার তোকে এটুকু সাহসি হতেই হবে লিলা। এ ছাড়া অন্য কোন পথ দেখছি না।

বেশ কিছুদিন আগে ঘোটে যাওয়া এক ঘটনার স্টরি কাভার করেছিল লিলা। আশরাফ চৌধুরী সেই স্টোরি তার কাগজে ছাপাতে দেন নি। স্টোরি টার অনেক অংশ উনি বদলে দিতে বলেছেন যা কিনা মুল ঘটনাকে একেবারেই আড়াল করে দেবে এর বেশী বরং আরও লিলা কে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই কেসটা থেকে দূরে থাকতে। আজ জানা গেল ওই কেসটার প্রধান সাক্ষিকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লিলার জেদ আরো বেড়ে গেছে। ওকে কিছু একটা করতেই হবে এই কেসটা নিয়ে। এই লড়াই টা লড়া খুব প্রয়োজন। একটা আসহায় পরিবারেকে তাদের ন্যায্য অধিকার পাইয়ে দেয়ার একটা অদম্য বাসনা আর প্রভাব খাটিয়ে অন্যায় করার এই প্রবণতা কে ঝেটিয়ে নিজ এলাকা থেকে বের করে দেয়ার স্বপ্ন লিলা আর তার দুই বন্ধু কে নির্ঘুম জাগিয়ে রাখছে গত কয়টা দিন। লিলার বন্ধু রেজা আর পৃথা দু’জনই প্রভাব ও প্রতিপত্বিতে অগ্রগামী পারিবারিক ভাবে। লিলার পাশে ওরা আছে বলে অনেক ভাবেই লিলা তার কাজের সাহস পায়। তবে লিলার জন্য এবার এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তার কেরিয়ার , বাবার সংসারের হাল ধরার প্রাণপণ চেস্টা সব কিছু। সর্বোপরি একজন মেয়ে মানুষ হিসেবে নিজের মজবুত ও সম্মানের জায়গাটা ঠিক রাখার বরং বলা যায় অস্তিত্ব এর লড়াই। তিন বন্ধুর মধ্যে লিলার অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারেই ভাল না। মা কতদিন যাবত হাটুর ব্যথায় ভুগছে। ডাক্তার দেখিয়েছিল কিছু টেস্ট জরুরি, করাতেই হবে। আজকাল মা ডান পা টা একটু টেনে টেনে হাটেন। বাবার প্রেস্ক্রিপশানে জমা পরে আছে না কেনা ওষুধের অনেক নাম।

সন্ধ্যা ৭ টা। লিলাকে নিতে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে পার্ল হোয়াইট কালার মারসেদিস বেঞ্চ। লিলা আজ একটা কাল, লাল আর সাদা ব্লক প্রিন্টের রাজশাহী সিল্ক শাড়ি পড়েছে। লম্বা চুল ছেড়ে রেখেছে। শাড়ি আর হালকা প্রসাধনীতে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা লিলার সহজ লাবণ্যতার সাথে দৃঢ় ব্যক্তিত্ব লেপ্টে আছে।

লিলা দরোজা খুলে বেড়িয়ে আসে। সাথে সাথেই মনের ভিতর একটা অচেনা ভয় দু’মড়ে ভেঙ্গে ফেলতে চায় লিলা কে। সামনের রাস্তার অন্য পাশেই আরেক টা গাড়ি অপেক্ষা করছে। ওটাতে লিলার ভরসা আর নির্ভরতা। লিলা সামনের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে , লিলার মা ডান পা টা একটু টেনে টেনে দরোজার দিকে আসছে।

তৌহীদা ইয়াকুব। কবি। জন্ম- ১৫ই মে ১৯৬৯। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ভুঞাপুর উপজেলায়। বাবা ইয়াকুব আলি তালুকদার, সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা ছিলেন গৃহিনী। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি ৩য়। ছোট বেলা থেকেই লিখছেন। তবে প্রকাশে একেবারেই অনিচ্ছুক সবসময়। ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাস এ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..