সিরিয়াস রচনা এবং পণ্ডিতগণ

কাকন রেজা
প্রবন্ধ
Bengali
সিরিয়াস রচনা এবং পণ্ডিতগণ

ব্রাত্য রাইসু নামের মানুষটির সাথে আমার পরিচয় নেই। তবু তাকে আমি লিখিয়ে হিসেবে পছন্দ করি। না শুধু পছন্দও না। প্রতিটি পছন্দের উল্টো পিঠে অপছন্দ জুড়ে থাকে। রাইসুর প্রতি সে অপছন্দটিও রয়েছে। তবে আজকে পছন্দের কথা বলি। তিনি সম্প্রতি ফেসবুকে দেয়া তার এক পোস্টে লিখেছেন ‘সিরিয়াস সাহিত্য’ বিষয়ে। লিখাটি শেষ করেছেন এই বলে যে, ‘সিরিয়াস সাহিত্য’ একটি কালচারাল মনোবৈকল্যের নাম। – একদম। আর এ কারণেই কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমাদের স্বার্থক সাহিত্য রচিত হয়নি। রচনার পরিমণ্ডল গড়ে উঠেনি।

রাইসু থেকে আরেকটু উল্লেখ করি,

“সাহিত্যে সিরিয়াস হচ্ছে আপনি যা লিখতে চাইতেছেন, তা লিখতে পারতেছেন আপনি, এই হচ্ছে সিরিয়াস।“

কথাটি এখানেই। আপনি যা লিখতে চাইছেন তা লিখতে পারছেন কীনা সেটাই বড় কথা। এখানে কীভাবে লিখলেন, কেমন ভাষায় লিখলেন, আঞ্চলিকতা আছে কী নেই, সেটা কোনই অর্থ বহন করে না। আপনার লেখাটা মানুষ বুঝতে পারলো কীনা সেটাই বিবেচ্য। আপনি সাহিত্য করলেন, মানুষ বুঝলো না। অনেককে বুঝতে গিয়ে অভিধান বের করতে হলো। সেই সাহিত্যের মান উঁচু, আসমানমুখী হলেও তা ভূমিমুখ তথা মানুষমুখী নয়।

সম্প্রতি প্রবন্ধ নিয়ে আলাপ হলো একজনের সাথে। তার কথার মোদ্দা হলো, প্রবন্ধ অন্তত ‘ভারি’ হতে হবে। বললাম, কতটা ভারি, গাধার বহনযোগ্য তো? খেপে গেলেন আমার ওপর। অথচ তার ধারণা আমরা মূলত গাধা প্রজাতির। তিনি চান এই গাধা প্রজাতিরা তার লিখা পড়ুক। এই গাধারা যদি ভার বহনে অযোগ্য হয় তাহলে তেমন লিখা কার জন্যে? মঙ্গলগ্রহ থেকে এসে কেউ কি পড়ে যাবেন! আমাদের গণমাধ্যমে, মুদ্রিত কাগজে এমন ধরনের কিছু প্রবন্ধকার পাওয়া যায়। তাদের লিখা পড়তে গেলে দাঁত নড়ে যায়। লেখা আনন্দদায়ক না হয়ে বেদনাবহুল হয়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ পড়ে মানুষ আনন্দ পায় এই কারণে যে, তারা তা বুঝতে পারেন। কখনো তা তাদের নিজের কথা হয়ে উঠে। সে অর্থে রবীন্দ্রনাথও হাল্কা লিখিয়ে। কারণ তার লিখা পড়তে গেলে অভিধান হাতের কাছে রাখতে হয় না। অভিধানের পরিমাপে সেই রচনা হাল্কা!

এই ‘ভারি’ লিখার ধারণাটা কলকাতায় খুব চালু। সেখানের অনেকেই সাহিত্যমান বিচার করেন ওজন মেপে। আমাদের হুমায়ূন আহমেদকে তাদের অনেকেই বলেন ‘হাল্কা’ ধারার লিখিয়ে। মুশকিল হলো যারা বলেন, তাদের অনেকের লিখাই আমি পড়েছি, কিন্তু বুঝে উঠতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ‘ভারি’ শব্দ এবং তত্ত্বের সমন্বয় করতে গিয়ে তারা নিজ লিখার সাথে নিজের সংঘাত বাধিয়ে ফেলেছেন। ভয়াবহ সে সংঘাত। যা দিয়ে শুরু করেছেন, শেষ করেছেন তার উল্টো পথে। ভাষা ও শব্দতত্ত্বের হিসেব-নিকেশ করতে গিয়ে তাদের লিখাটাই গোলমেলে হয়ে উঠেছে। সহজ কথায় বলা হলে, তিনি যা লিখতে চেয়েছিলেন, বলতে চেয়েছিলেন, তার দুটোই হয়ে উঠতো। সাথে আমাদের গাধাদের জন্য তা সহজবোধ্য হতো।

আমাদের দেশেও একটা শ্রেণি রয়েছেন। যারা তাদের লিখায় নানা তত্ত্ব হাজির করেন। একজন সাধারণ মানুষের কথা বা দাবি বোঝাতে ফেঁদে বসেন জটিল মার্ক্সবাদ, অর্থনীতির জটিলসব তত্ত্বকথা। মানুষ ভড়কে যায়। ফলে সেই লেখা মানুষের পড়া হয়ে উঠে না। লিখার উদ্দেশ্য পণ্ডিতি ফলানো নয়, মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানো। এই শ্রেণির মনুষ্যগণ পণ্ডিত হয়ে উঠাটাকেই সফলতা বলে মনে করেন। লিখার বার্তা পৌঁছানোর মূল উদ্দেশ্যটি উপেক্ষিত হয়। ফলে তারা অবাস্তব আত্মতৃপ্তিতে ডুবে থাকেন। তাদের আর স্বার্থক হয়ে উঠা হয় না।

আবার সাহিত্যের কথায় ফিরি। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্র ছিলো বাকের ভাই। নাটকে যার ফাঁসির রায় হয়েছে। তাকে ফাঁসি দেয়া হবে। সারাদেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। রাস্তায় নেমে এলো মানুষ। বাকের ভাইকে ফাঁসি দেয়া যাবে না। ভেবে দেখুন, একটা নাটকের চরিত্র। সেই চরিত্রের জন্য পথে নেমে এসেছে হাজারও মানুষ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কোনো একটা চরিত্র সারাদেশের মানুষের হৃদয়কে এভাবে ছুঁয়ে গেছে কি? যায়নি। আপনি কাকে সিরিয়াস বলবেন। পণ্ডিত হলে ইলিয়াসকে। আর পাঠক হলে হুমায়ূনকে। সে অর্থে রাইসুর কথা একদম ঠিক, তথাকথিত ‘সিরিয়াস সাহিত্য’ একটি মনোবৈকল্য। জানি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিয়ে কথা বলায়, কেউ কেউ খেপে উঠবেন। আমাকে গাধা বলবেন। তাদের বলি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই গাধা পড়িয়ে মানুষ করতে পারেননি। ব্যর্থতাটা তাই ইলিয়াসদেরই। যারা বলেন, লেখকদের লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তাদের কথাটা ঠিক। তারা লেখকদেরই লেখক। পাঠকদের নয়।

হেলাল হাফিজ যখন বলেন, ‘আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি’, এই কথা মানুষকে যতটা ছুঁয়ে যায়, ততটাই ভারি শব্দের কবিতার পঙক্তি হয়ে উঠে অসূর্যস্পশ্যা। রফিক আজাদ বলেছিলেন, ‘কি স্যার এই ভিড়ের মধ্যে থেকে এবার সশব্দে একটা পাদ দিন তো, দিয়ে প্রমাণ করুন আপনিও একজন মানুষ!’ ‘সিরিয়াস সাহিত্য’ এর ‘স্যার’দেরও বলি, প্রমাণ করুন না আপনিও মানুষ। একটু সহজ করে লিখুন। গাধা নয় মানুষ ভেবেই লিখুন। আপনার লিখার স্বাদ আস্বাদন করতে দিন। কেনো কঠিনের যজ্ঞে আহুতি দিতে বলেন আমাদের মতন গাধামানবদের। যদি সম্ভব হয় ‘গাধামানব’ নামে একটি উপন্যাস লিখে ফেলুন।

‘সিরিয়াস রচনা’র ‘স্যার’দের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে শেষ করি। যেহেতু রবি ঠাকুরকে তারা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক নমস্য মানেন তাই তার ওপর সওয়ার হওয়া আর কী! রবি বাবু লিখেছিলেন,

‘লেখার কথা মাথায় যদি জোটে
তখন আমি লিখতে পারি হয়তো।
কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে,
যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো।’

পুনশ্চ: সফল ও স্বার্থকতার ব্যাখ্যাটা এ লেখায় দেয়া হয়নি। স্বার্থক সাহিত্য হলো প্রকাশ্য, বেশিরভাগ সফল সাহিত্য হলো গোপন। মানে স্বার্থক সাহিত্য প্রকাশ্যে পড়া যায়, সফল সাহিত্য পড়তে হয় গোপনে। এর আগে সাহিত্যটা কী তা এক লাইনে ব্যক্ত করার চেষ্টা করি। সাহিত্য হলো মানুষের জীবনাচরণ। মানুষের জীবনকে ঘিরেই সাহিত্য। জীবনের যেমন কিছু গোপনীয় অংশ রয়েছে, তারমধ্যে সঙ্গম একটি। এই কাজটি গোপনে করাই সভ্যতা। কদিন আগে, ব্যাংককে এক বাংলাভাষী নারী প্রকাশ্যে নগ্ন হয়ে একটি বৌদ্ধ উপাসনালয়ে উঠে গেলেন। ব্যাংকক মূলত বিখ্যাত যৌন বাণিজ্যের জন্য। সেখানেও এই নগ্ন হওয়া নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনা হলো। খবরের শিরোনাম হলো। যেখানে যৌনতা স্বীকৃত। সেখানেও প্রকাশ্যে নগ্ন হওয়ার বিষয়টি সমালোচিত হয়। সুতরাং জীবনাচরণের কিছুটা অংশ অবশ্যই গোপনীয়। সহজ কথায় বলি, রসময় গুপ্তের চটিকেও সাহিত্য বলা যায়। কারণ এসব জীবনাচরণেরই অংশ। স্বীকার করুন আর না করুন, জীবন এর বাইরে নয়। রসময় গুপ্তের চটির যতটা পাঠক রয়েছেন, তা অন্য কোনো সাহিত্যের নেই। এই সাহিত্য এক অর্থে ‘সফল’ সাহিত্য। বিপরীতে পাঠক রয়েছেন এবং সেই সাহিত্য প্রকাশ্য পাঠ্য, তা হলো ‘স্বার্থক’ সাহিত্য। রসময় গুপ্ত অপ্রকাশ্য হলেও, প্রকাশ্যেও কিছু ‘সফল’ সাহিত্য পঠিত হয়। আর সেই সব সাহিত্যকে প্রকাশ্য করতে তাকে নানা মোড়কে মোড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। কখনো সে মোড়ক ‘নারীবাদে’র নামে, কখনো বা ‘ধ্রুপদী’ আখ্যায়। সে দীর্ঘ আলোচনা তা না হয় অন্য সময়ের জন্য তোলা থাক।

কাকন রেজা। লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। জন্ম ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ, বাংলাদেশে, ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুরে। তারুণ্যের দিনগুলো পাড়ি দিয়েছেন লেখকের নিজ জেলাশহর শেরপুরে। তাঁর বাবা মরহুম আব্দুর রেজ্জাক ছিলেন, একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। মা জাহানারা রেজ্জাক এক সময়ে ছিলেন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..