প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বিস্ফোরণটির প্রচণ্ডতা নিয়ে কারো দ্বিমত ছিল না, কেননা খারঘুলির রাস্তায় এর ফলে যে বিশাল গহ্বর তৈরি হয় সেটা সারাতে সরকারি পূর্ত বিভাগের লেগেছিল পুরো ছ-মাস, অবশ্য এর মধ্যে প্রথম পাঁচ মাস সরকারি তহবিলে টাকাই ছিল না, পনেরো দিন লেগে যায় মন্ত্রী, আমলা আর ঠিকাদারের ভেতর ভাগ-বাটোয়ারার সূক্ষ্ম হিসেবনিকেশে, আর রাস্তা সারাই হয় শেষ পনেরো দিন। সে প্রসঙ্গে আমি এ মুহূর্তে যাচ্ছি না, কেননা সে আর-এক রূপকথা। আমি আসতে চাই বিস্ফোরণটির প্রাসঙ্গিক বিবরণে, যার প্রচণ্ডতা নিয়ে কোনো সংশয় না থা-থাকলেও এটি যে প্রচণ্ডতম নয়, কোনো রকমেই নয়, সে ব্যাপারেও গুয়াহাটির মানুষের কোনো দ্বিমত ছিল না। বিস্ফোরণের পরদিনই স্থানীয় প্রভাবশালী দৈনিক ‘সীমান্ত’, যার সার্কুলেশন ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে উঠেছে, তাদের প্রথম পাতায় পাঠকদের কাছ থেকে তাদের মতে গুয়াহাটিতে সবচেয়ে বড় বোমা বিস্ফোরণ কোনটি জানতে চেয়ে এক সমীক্ষা চালায় তাতে দেখা যায়, যা ভাবা গিয়েছিল তাই, ১৯৮৪-র বিস্ফোরণ পেয়েছে সবচেয়ে বেশি ভোট, ৩৯.৫৬%, আর এই শেষতমটি ১২.৩২% পেয়ে সুদূর তৃতীয়। আপনি যদি এখন জানতে চান দ্বিতীয় কোনটি, আমাকে প্রশ্ন না-করে ‘সীমান্ত’-এর ৫ মার্চের সংখ্যাটি দেখে নিতে পারেন, যদিও এ জানায় কারো কিছু এসে যায় না। সম্পাদকীয় প্রবন্ধে যাকে জনচেতনা বলা হয়, সেই চেতনার সবচেয়ে ভালো বা খারাপ, সবচেয়ে সরল বা সবচেয়ে জটিল ঘটনাই বেঁচে থাকে, ১৯৪৬-এর দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বা বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বোম্বের রায়ট সবার মনে আছে, এর মাঝে যে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতে ঘটেছে, ঘটছে ও ঘটবে, কার এত সময় আছে সেসব আজেবাজে তথ্য মনে রাখায় !
১৯৮৪-র বিস্ফোরণ সবার মনে আছে, কেননা সেটি ছিল এ শহরে প্রথম, এবং এখন পর্যন্ত, প্রচণ্ডতম। বিস্ফোরণটি এখন একটি বেঞ্চমার্ক যার প্রেক্ষিতে পরবর্তী অন্য বিস্ফোরণগুলোকে মাপা হয়, গত দেড় দশকে অসংখ্য ডক্টরাল থিসিস, সম্পাদকীয়, সম্পাদকের কাছে চিঠি এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সন্ত্রাস বিরোধী সেমিনার ও কনভেনশনের ধাত্রী হিসেবে কাজ করেছে এই ঘটনাটি, আর এখন সামাজিক অবচেতনে এটির জায়গা শরাইঘাটের যুদ্ধ, ইয়ান্ডাবুর সন্ধি, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং অসম আন্দোলনের পাশাপাশি, কোমল স্মৃতিমেদুরতায় স্মরণযোগ্য, এবং হয়তো কিছুটা গর্বের সঙ্গেও, কেননা এ এক কীর্তি, অন্য কীর্তি কোথায় আমাদের এই পোড়া দেশে, লোকগাথার এক উপকরণ, এখন যখন বর্ষার জলে সব রক্ত-কান্না-চিৎকার ধুয়ে গিয়েছে, যে বর্ষা আমাদের এদেশে অঝোর ধারায় প্রতিবছর ভাঙে।
আপনি উশখুশ করছেন আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি জানতে চাইছেন ১৯৮৪-তে ঠিক কী ঘটেছিল? এবং যেহেতু জানার ইচ্ছে আর অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর ইচ্ছে মানুষের সহজাত, একটু পরেই ১৯৮৪-র গল্প শোনা হয়ে গেলে, আপনার পরবর্তী প্রশ্ন হবে এবারে, এই দুহাজার এক সালে, কী হয়েছিল? ধৈর্য রাখুন, যেমন আমাদের দার্শনিকেরা হাজার বছর ধরে বলে আসছেন, কেননা ভারতে আমরা সময়কে সেকেন্ড বা মিনিটে গুনি না, গুনি যুগের হিসেবে, আর আমাদের এই কলিযুগ, যখন ভালোকে ঢেকে আছে মন্দ, সত্যকে মিথ্যাচার, নীতিকে অনৈতিক, তাই সাবধান, সবার গল্পই একবাক্যে বিশ্বাস করবেন না, এমনকি আমারও নয়, কেননা আমি ও আপনি দুজনই এই কলিযুগে বেঁচে আছি।
এখন আমি যদি আপনাকে বলি যে ১৯৮৪-তে বোমায় এটা আস্ত বাস উড়ে গিয়েছিল, যে বোমা রাখা ছিল বাসের পেছনে একটি ব্রিফকেসে, এবং যে বিস্ফোরণে চল্লিশজন মারা যায়, আহত হয় আরো পঞ্চাশ, আর একশোর ওপরে মানুষ তাদের বাবা, মা, ভাই, ছেলে ও মেয়েকে হারায়, তাহলে সেই তথ্য আপনার খুব বেশি কাজে আসবে না, তথ্যই শুধু, স্মৃতিতে সাময়িকভাবে ধরে রাখার এবং তারপর ভুলে যাবার, যদি না আমি আপনাকে কৃপাপরবশ হয়ে আরও বলি, বলি যে কী ছিল সেই বিস্ফোরণের পেছনে, পটভূমি, ইতিহাস, সামাজিক কার্যকারণ, ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি, এবং আরও বলি কী ছিল পরবর্তী ঘটনাপর্যায়, এবং আপনার সুবিধের জন্যে, ঘটনাটিকে স্থাপিত করি সেই দশকের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে, এবং আপনাকে জানাই অসম ও ভারতের কাছে সেই বছর ও সেই দশকটির গুরুত্ব।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটি এত সরল নয়, যদিও মৃত্যু, যখন ঘটে, ঘটে সরলভাবে, কালাশনিকভের ট্রিগারে অন্যমনস্ক ছোঁয়ায় বা বোমার রিমোট কন্ট্রোল ইউনিটটিতে আলতো চাপে, এ এক গোলকধাঁধা, লূতাতন্তু এক, যার কেন্দ্রে ঘাপটি মেরে আছে সেই মহান ঊর্ণনাভ নিয়তি, আপনি যদি একে কর্মফল বলতে চান আমাদের প্রাচীন ঋষিরা সহাস্যে মাথা দোলাবেন। কেননা তাঁরাই তো রূপ দিয়েছিলেন ধারণাটিকে, যখন বিশ্বভুবনকে ব্যাখ্যা করার তাদের যাবতীয় ঋষিসুলভ চেষ্টা স্রেফ ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায়, এই জন্যে যে, বিশ্বভুবন ব্যাখ্যার অতীত, ফুটো পাইপ দিয়ে যেমন জল অবিরাম পড়ে যেতে থাকে, এই বিশ্ব আমাদের আঙুলের ফাঁকে ঠিক সেভাবেই গলে যায়, কর্মফল অতএব ঋষিদের মৌলিক ফরমুলার ভারতীয় উপাদানে আদ্যন্ত নির্মিত সেই সিল যা ফুটো পাইপ জুড়ে দেয়, আটকে দেয় অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোকে, যেমন কেন মানুষ এখানে অনাহারে মারা যায়, কেন প্রকৃতির এমন অকৃপণ দাক্ষিণ্য সত্ত্বেও অসমের বেকার সমস্যা এত তীব্র, কেন প্রধানমন্ত্রীরা উত্তর-পূর্ব সফরের পর পরই উন্নয়নের ব্যাপারে তাঁদের দেওয়া যাবতীয় প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে যান, কেন খারঘুলির রাস্তায় এক অলস বিকেলে বোমা ফাটে।
তাই এই নিয়তি বা সাহেবরা যাকে বলে কারমা, নিবিড় সূক্ষ্মতায় বোনা এই জাল এড়ানো যায় না, ছিঁড়তে চাইলেই ছেঁড়া যায় না, আপনাকে এর কাছে ভিক্ষা চেয়ে নতজানু হতে হবে, সন্তর্পণে, বিনয় ও তিতিক্ষার সঙ্গে, সংশয়ী হয়ে, তবেই কর্মের দয়া হবে আপনার ওপর, আপনার চোখের সামনে ক্রমে ক্রমে খুলে যাবে তার অন্ধকার প্রকোষ্ঠগুলি, তাদের যাবতীয় নারকীয় রহস্য সমেত, যেমন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মের রহস্য উন্মোচিত করেছিলেন সদা কৌতূহলী মৈত্রেয়ীর কাছে, একবারে নয়, ক্রমে ক্রমে, সমীকরণের অঙ্কের মতো, শেষ উত্তরটি যেখানে পূর্বগামী ধাপগুলোর যুক্তিশৃঙ্খল থেকে স্বভাবত বেরিয়ে আসে।
অতএব। আমি আপনাকে চুরাশির ঘটনাটি জানাব এখন, খবরের কাগজে যেমন বেরিয়েছিল, তথ্যই শুধু, সাংবাদিকদের পেশাদারি অতিশয়োক্তির স্নো পাউডার মাখা। ‘সীমান্ত’-এর ৮ অক্টোবর উনিশশো চুরাশি সংখ্যা থেকে নীচের উদ্ধৃতি:
নরকে রাতের বাস !
নাইট সুপারে বিস্ফেরাণ, চল্লিশজন নিহত। রাজ্য জুড়ে শোক।
পিটিআই। গতকাল সন্ধ্যায় শহরের পল্টনবাজার মোড়ে এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে চল্লিশজন মানুষ ঘটনাস্থলেই মারা যান। গভীর রাত্রে হাসপাতাল সূত্রের খবর অনুযায়ী পঞ্চাশের ওপর মানুষ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন, তার ভেতর দশজনের অবস্থা গুরুতর। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী স্থানীয় ব্রহ্মপুত্র ট্রাভেলসের তিনসুকিয়াগামী নাইট সুপারটি যখন যাত্রী বোঝাই হয়ে ডিপো থেকে রাস্তায় নামছিল, ঠিক তখনই এক প্রচণ্ড বোমা বিস্ফোরণে বাসটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়। পুলিশি সূত্রে জানানো হয়েছে, বোমাটি বাসের পেছনদিকে এক ব্রিফকেসে রাখা ছিল। উল্লেখ্য যে যদিও রাজ্যে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ বিগত কয়েক বছরে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, বোমা মেরে বাস উড়িয়ে দেওয়া ঘটনা এখানে এই প্রথম ঘটল। এই ঘটনায় রাজ্য জুডে শোকের ছায়া নেমেছে। মুখ্যমন্ত্রী এক বিবৃতিতে নিহত ও আহতদের পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেছেন যে এই ন্যক্কারজনক ঘটনাকে নিন্দা করার ভাষা তাঁর জানা নেই। বিরোধী দলনেতা শ্রী প্রদীপ গোহাঁ নাগরিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করায় ব্যর্থতার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। বিরোধী দলগুলি আগামীকাল এই ইস্যুতে চব্বিশ ঘণ্টা বন্ধের ডাক দিয়েছে।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির সংযোজন।
দৃশ্যটি যেন সটান বুনুয়েলের সিনেমা বা দালির ছবি থেকে বেরিয়ে এসেছে। পল্টনবাজারের ফুটপাথে আড়াআড়ি পড়ে আছে রক্তমাখা একটি ছিন্ন হাত, আঙুলে তখনও ধরে রাখা একটি চটের ব্যাগ। এরকম বীভৎস আরো দৃশ্যের সাক্ষী হতে হয়েছে আমাদের, গতকাল সন্ধ্যায় যখন আমরা বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছই। মজা দেখতে ভিড় করা কৌতূহলী জনতাকে দূরে রাখার জন্যে পুলিশ সমস্ত এলাকা কর্ডন করে রেখেছিল। কর্ডনের এপাশ থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম দুর্ভাগা নাইট সুপারটির দগ্ধ কঙ্কাল রাস্তার এক পাশে হেলে আছে, বাসটির একটা টায়ার তখনও ধিকিধিক জ্বলছে। কর্ডন পেরিয়ে এগোতে এগোতে আমাদের কানে আসছিল আহত মানুষের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ।
আহতদের সবাইকে তখনও হাসপাতালে পাঠানো যায়নি। ওদের দুজনেক পুলিশের পাহারায় একটা বন্ধ দোকানের সামনে খোলা আকাশের নীচে জড়ো করে রাখা হয়েছিল। ভরলুমুখের যতীন বরার বুকে একটা স্প্লিন্টার ঢুকে গিয়েছিল। আর দুইঞ্চি নামলেই বরার প্রাণ সংশয় ছিল। এই সুখবরে অবশ্য বরাকে খুব খুশি মনে হল না না, তিনি বারবার আমাদের তাঁর স্ত্রী প্রমীলার ব্যাপারে জিগ্যেস করছিলেন। আমরা তাঁকে বলতে পারিনি যে মৃতদের তালিকায় প্রমীলা বরার নামও রয়েছে। বাস সেদিন অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা দেরিতে ছাড়ে, জানায় সেলিম যার বাস-স্টেশনের সামনে একটা পানদোকান রয়েছে। সেলিম, যে বিস্ফোরণে সামান্য আহত হয়েছে, গোটা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তার রোমহর্ষক বিবরণে সে আমাদের জানায় যে বাসটি সবে স্টেশনচত্বর ছেড়ে রাস্তায় নামছিল, যখন চোখ ধাঁধানো আলোয় এবং কর্ণবিদারী শব্দে বাসটি দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।
সেলিম, আমাদের বলে যে তার সেই মুহূর্তে দিওয়ালির আতসবাজির কথা মনে পড়েছিল। বিস্ফোরণের ধাক্কায় সে ফুটপাথে আছড়ে পড়ে এবং সংজ্ঞা হারায়। জ্ঞান ফিরে পাবার পর সে দেখে তার চারদিকে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। বাসটির এক আহত যাত্রী, রবিন বোড়ো, আমাদের কাছে অভিযোগ করলেন যে পুলিশ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে এবং কোনো সহায়তাই করেনি। সত্যি বলতে কী, আমরা যতক্ষণ অকুস্থলে ছিলাম, মহানগরীর বা রাজ্য প্রশাসনের কাউকেই সেখানে রাখা যায়নি। ঘটনাস্থলে পুলিশি ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা, সিটি এসপি শ্রী কুশল নাথকে অত্যন্ত শ্রান্ত ও বিব্রত দেখাচ্ছিল। শ্রী নাথ আমাদের জানালেন যে তাঁরা কেবল দুটি অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, তার ভেতর একটি রাস্তায় ব্রেক ডাউন হয়ে পড়ে আছে। ‘ময় কী করিব পারো’, হাত অসহায়ভাবে ঝাঁকিয়ে শ্রী নাথ আমাদের বললেন। এই দুর্ঘটনার প্রতি প্রশাসনের দায়িত্ববোধ এই একটি মন্তব্যেই স্পষ্ট। গভীর রাতে ডাকা এক প্রেস কনফারেন্সে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন যে সরকার এই বিস্ফোরণের পেছনে একটি বিশেষ জঙ্গি গোষ্ঠীর হাত আছে বলে সন্দেহ করছে। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন যে এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে আইএসআই। তদন্ত চলছে, কয়েকদিনের মধ্যেই অপরাধীদের খুঁজে বের করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চুরাশির রিপোর্ট আপনি জানলেন, এখন আসুন বর্তমানে। এই উদ্ধৃতিটি সীমান্ত-এর ৩১ মার্চ, ২০০১ সংখ্যা থেকে :
শহরে আবার বোমা বিস্ফোরণ, দশজন নিহত!
শহরে আবার বোমা বিস্ফোরণের নবতম ঘটনায় আজ দশজন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। বোমাটি খারঘুলির রাস্তায় একটা কালভার্টের নীচে রাখা ছিল। এ পর্যন্ত কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী ঘটনাটির দায়িত্ব স্বীকার করেনি। সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি ডাকা এক প্রেস কনফারেন্সে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন যে এই ঘটনা তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের একটি অঙ্গ। তিনি ঘোষণা করেন যে তাঁর সরকার রাজ্য থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলকরণে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে। বিরোধী দলনেতা শ্রী সমীর ফুকন এক বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যর্থতার জন্যে রাজ্য সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। ঘটনার প্রতিবাদে বিরোধী দলগুলি একযোগে আগামীকাল বনধের ডাক দিয়েছে। পুলিশি সূত্রের মতে, বিস্ফোরণের পেছনে আইএসআই-এর হাত আছে। এখন পর্যন্ত কাউকে এ ব্যাপারে গ্রেফতার করা হয়নি।
এই তো ছিল সীমান্ত-এর দুটি রিপোর্ট। আপনি যদি ট্রিভিয়াতে আগ্রহী হন, তবে আপনার অবগতির জন্যে জানাই যে চুরাশিতে খবরটি ছাপা হয় প্রথম পাতায় ব্যানার হেডলাইনে, আর এই দুহাজার একেরটি জায়গা পায় তার প্রথম পাতার ডান কোনায় নীচের দিকে, অর্শের আশু আরোগ্য দাবি করে একটি ওষুধের বক্স বিজ্ঞাপনের ঠিক ওপরে। অবশ্য খবরের কাগজ কোথায় তার স্টোরি ছাপছে তাতে কীই-বা এমন এসে যায়, হয়তো এটুকুই বোঝা যায় যে কোথাও ক্লান্তি এসেছে, দুদশকের অবিরাম সন্ত্রাসের পর আত্মার শ্রান্তি, অথবা এটা হয়তো পাঠকের পছন্দ-অপছন্দ বোঝার সম্পাদকীয় কুশলতার একটি জলজ্যান্ত প্রমাণ, কেননা সংবাদপত্র পাঠকের মতিগতি বোঝা ভীষণ কঠিন, কাল যদি তারা বিস্ফোরণ এবং মৃত্যুর ঘটনা সম্বন্ধে পড়তে ভালোবেসে থাকে, আজ তবে হয়তো তারা চাইবে তাদের প্রিয় সংবাদপত্র তাদের জানাক ঐশ্বর্য রাইয়ের সাম্প্রতিকতম বয়ফ্রেন্ডটি কে।
খবর তাই, যা পাঠকরা পড়তে চায়। ভেবে দেখতে গেল, গতকালের কাগজ কী কাজে লাগে আমাদরে, বাচ্চার পাছা মোছা ছাড়া বা আপনি যদি গরিব হন, তবে চুলো জ্বালানোর কাজে। আমরা বাঁচি বর্তমানে, আমাদের ভাবনা Here and now ঘিরে, আর এ মুহূর্তে এখানে সবকিছুই ঠিকঠাক আছে, রাতের টিভির সাবান যাত্রাটির এইমাত্র কমার্শিয়াল ব্রেক হল, কন্ডোমের বিজ্ঞাপন চলছে, আমাদের ক্রিকেট টিম অস্ট্রেলিয়ান সিরিজ জিতেছে, এবং আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, কথা বলতে বলতে যিনি প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়েন, এবং তাঁর সেই আধো ঘুম আধো জাগরণ থেকে আমাদের জানান যে আমাদের দেশ বুদ্ধ ও গান্ধীর দেশ, যাঁরা খুবই গর্বিত হতেন এটা জেনে যে আমাদের দেশ আজ শান্তিপূর্ণ আণবিক অস্ত্রে বলীয়ান।
তাই দশজন মৃত মানুষ বা বিস্ফোরণের একটি ঘটনা, কিছুই নয় শেষ পর্যন্ত, ইতিহাসের ফুটনোট হবারও যোগ্য নয়, এসব খবরের চেয়ে ঢের বেশি সেক্স অ্যাপিল আছে ঐশ্বর্য রাইয়ের পুরুষ বন্ধুটির। আমরা এগিয়ে চলি, আমরা গতকালের কাগজ দিয়ে পোঁদ মুছি, এবং এগিয়ে চলি। কিন্তু সেই দশজন, যারা হঠাৎই নিজেদের থমকে যেতে দেখল, দেখল তারা পড়ে আছে কালের যাত্রাপথের একপাশে কেননা নিয়তি তাদের মার্চের সেই অলস বিকেলে খারঘুলির রাস্তায় দেখা করতে ডেকেছিল, কী হতে পারত তাদের প্রতিক্রিয়া যদি আমরা তাদের প্রশ্ন করতে পারতাম, যে প্রশ্ন আমরা মৃতদের করতে চাই। তাদের কি দুঃখ হয়েছিল, বা ক্রোধ? যখন তাদের শরীর থেকে ঝরে যাচ্ছিল হিয়ার অ্যান্ড নাউ, যখন আলো ঝলকে উঠেছিল, আর দিওয়ালির মতো শব্দ হয়েছিল আকাশ জুড়ে, তারা কি ঘটনাটির ভেতর লুকোনো আয়রনিটি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল, তাদের কি মনে পড়ে গিয়েছিল চুরাশির সেই বিকেলে তাদের জীবনযাত্রা কেমন স্বাভাবিক ছিল, যেমন এখন আছে আমাদরে, আমরা যারা বেঁচে আছি, নিজস্ব অমরত্বের ধারণায় নিশ্চিন্ত, নিশ্চিত এই জেনে যে দুর্ঘটনা যদি ঘটে তা ঘটবে অন্যদের জন্যে, কেননা এখন আমাদের সবকিছু ঠিকঠাক আছে।
মৃত্যুর সেই অমোঘ মুহূর্তে মনে পড়া ও ভুলে যাওয়া মিলে যায়, যেমন মেলে অতীত ও ভবিষ্যৎ, কেননা বর্তমান নেই, কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না। প্রশ্ন করা হলে লিজা লিংডো তার বিষণ্ণ চোখ মেলে আপনাকে জানাতে পারত সেই বিবরণের অতীত বেদনা ও উৎসবের অনুভূতির ব্যাপারে যখন স্মৃতির গুহামুখ খুলে যেতে থাকে আর আপনাকে ভাসিয়ে নেয় বহুদিন ভুলে যাওয়া কোনো ঘটনার স্বাদে, গন্ধে আর দৃশ্যে। ভুলে যাওয়া বা কুয়াশার ভেতরে আগলে রাখা, কেননা অনেক সময়ই আমরা ভুলে যাই বলেই বেঁচে থাকি। এটাই কি কারণ যে সেই বিকেলে লিজার দুমড়ে যাওয়া মুখের এক কোনায় লেগেছিল এক চিলতে হাসির আভাস, সে কি সেই মুহূর্তে তার ছ-বছরের ছেলেকে চুমু খাচ্ছিল, যে ছেলে বছর চারেক আগে বরপানি লেকে ডুবে মারা গিয়েছে?
অথবা অনন্ত দত্ত? তার প্রতিক্রিয়া কেমন হত? অসমের এক বাঙালি, চিরন্তন বহিরাগত, এমনকি অতিথিবাদের দিক থেকেও উড়ে এসে জুড়ে বসা এক আপদ, ঘৃণিত, লাথি খাওয়া একটি জীব, স্থির সেই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে কী ধরনের অশিব চিন্তা তার মাথার ভেতর ঘুণপোকার মতো কুরে খাচ্ছিল? আমি অনন্তকে বহুদিন ধরে জানি, এত নিবিড়ভাবে যতটা এক লেখক তার চরিত্রকে জানতে পারে, তাই আমার ধারণা প্রশ্ন করা হলে অনন্ত শান্তভাবে তার বিস্ফোরিত দেহের টুকরোগুলি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিত এবং তার সেই ধীর, ভাগ্যের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া গলায় আপনাকে সারাজীবন নো ম্যানস ল্যান্ডে বাঁচার বেদনা সম্পর্কে বলতো, বলতো একমুঠো মাটিকে নিজের মনে করে আঁকড়ে ধরার প্রবল ইচ্ছের কথা, আরও বলত সেই গ্রিক ছায়াছবিটির কথা, বিশেষ করে সেই দৃশ্যটি যেখানে মার্চেল্লো মাস্ত্রোয়ানি গ্রিস ও আলবানিয়ার সীমান্তের ব্রিজটিতে দাঁড়িয়ে, তার পা থমকে আছে সীমান্তরেখার ঠিক ওপরে, কেননা অনন্ত সেই লোকটি, এক চিরন্তন উদবাস্তু যার পদক্ষেপ সর্বদাই থমকে আছে সীমান্তরেখার ওপর – আকাশ ও পৃথিবীর সীমান্তে, জল ও ভূমির সীমান্তে, অতীত ও ভবিষ্যতের সীমান্তে, অস্তি ও নাস্তির সীমান্তে।
যেহেতু অনন্ত কবি, মাঝারি কবি কিন্তু তবু কবি, বোমা বিস্ফোরণের একটা সাধারণ ঘটনাকে অ্যামবিগুইটির ঘন কুয়াশায় মুড়ে দেয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু রজব আলি, সবুজ লুঙ্গি পরা মধ্যবয়সি রিকশাওয়ালাটি, যে সমানভাবে বহিরাগত, আর-এক চিরন্তন উদ্বাস্তু, প্রশ্নের উত্তরে সে কী বলতো? আমার ধারণা, সে মাটিতে এক দলা থুথু ফেলে এই কথাই বলত…
তর মারে চুদি, শুয়োরের বাচ্চা…
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..