ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
সল্টলেক সেক্টর ফাইভ এর কলেজ মোড়ে এ.সি সাটল থেকে নামলো কণল। রাস্তাটা পেরিয়ে জোরে একটা শ্বাসনিলো সে।অফিসের এই গাড়িগুলোতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।তার মনে হয় যেন ঠান্ডা লাশের গাড়ি। কুড়ি জননারী পুরুষ চুপচাপ বসে আসে,প্রতিদিন দ্যাখা হচ্ছে তবু সবাই যেন ভিনগ্রহের প্রাণী।বন্ধ জানলার বেশির ভাগপর্দাগুলো টানা-গতরাতে ওয়েভ সিরিজ দেখে কেউ ঘুমাচ্ছে,কেউ কানে হেড ফোন গুজে গান শুনেই যাচ্ছে।পাশেবসে থাকা মানুষটি মারা গেলেও কিছু যায় আসে না।
কেউ আবার অনেকে অচেনা ফেসবুক বন্ধুর সাথে চ্যাট করে চলেছে।কণল ভাবে হয়তো তাদের কছে অন্তজ্বালেরঅচেনা মানুষটি, পাশে বসে থাকা রক্ত মাংসের অচেনা মানুষটির থেকে বেশী নিরাপদ।কিছুই মেলাতে পারে নাকণল,
ছোটবেলায় দেখেছে এই ডিসেম্বর মাসে বাবা ট্রেনের ডেইলি প্যাসেঞ্জার দের ফ্যামিলি পিকনিক।কত নাম না জানানতুন কাকু, কাকিমা,দাদা দিদি-কিন্তু বোকা বোকা লাগতোনা। পিকনিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হয়ে উঠতো একটাপরিবার।সকালের জলখাবারে পাউরুটি,ডিম,কলা মোয়া তারপর ক্রিকেট কিংবা ব্যাডমিন্টন।দুপুরে ক্ষিদে পেটেআধ সেদ্ধ পাঁঠার মাংস আর ভাত।মদকে তখনও বাঙালী বঙ্গ জীবনের অঙ্গের স্যাটাস দ্যায়নি-তাই ওইসব ছাইপাস খেয়ে ওলটালে আলোচোনা হতো খুব চাপা স্বরে।সব মিটলে ফেরার সময় একটা গিফ্ট নিয়ে বাবার কাধে মাথারেখে নিশ্চিন্তের ঘুম।
-কণল,এই কণল..চা খাবি?
অফিসের শংকরদার ডাকে চটকা কাটলো কণলের। তারপর কবজি ঘুরিয়ে হাত ঘড়িটা দেখলো – ন’টাদশ,শংকরদার রেগুলার অফিস ঢোকার টাইমিং সাড়ে দশটা।
-কি রে চা খাবি?
কণল হেসে বললো
-তুমি আজ তাড়াতাড়ি?
শংকর দু কাপ চা আর সিগারেটের অর্ডার দিলো,দেকানের বোয়াম থেকে একটা বাপুজি কেক বার করে চিবুতেচিবুতে বললো।
-বাল, জানিস না আজ এম ডি সাহেব আসবে।একটু থেমে বললো তোদের প্রোজেক্ট রিভিউ করতেই তো আসছে, জানিস না যেন?
-দুর সে তো দশটায়।
চায়ের ভাড়ে চুমুক দিতে দিতে শংকর বললো
-দশটা তো কি? দাসদা বললো উনি সাড়ে ন’টায় চলে আসবে।
-তা তুমি কি করবে?অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো কণল।
-এসব অফিস পলিটিক্স।আমি না আসলে কেউ ঠিক কাটি করবে।তুই তো এসব কিছুই বুঝবি না..
সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে শংকর বললো
-তোর এই কোম্পানিতে কত বছর হোলো?
কণল জানতো প্রশ্নটা আসবে এবং এর উত্তরটাও জানা,তবু সে বললো
-পাঁচ বছর।একটা বিজ্ঞের হাসি হেসে শংকর বললো
-তোর সাথে যে দুজন জয়েন করেছিলো তারা কতোটা এগিয়েছে দেখছিস?রণজয় কে তুই রিপোর্ট করিস আরতুলিকা মোটামুটি রণজয়ের লেবেলে..।প্রথমজন তেলিয়ে আর দ্বিতীয়জন বসের সাথে ট্যুরে গিয়ে গিয়ে প্রমোশনবাগালো।শোন ভাই
কণল শংকরের ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলো কিন্তু সে জানে এই সব কথার উত্তর নেই।রণজয়ের প্রমোশনটা হয়তোএকটু তাড়াতাড়ি হয়েছে তবে তুলিকা প্রমোশনটা ডিসার্ভ করে।কর্পোরেটে যেন দুভাবেই প্রমোশন হয়-ছেলেরাতেলিয়ে পায় আর মেয়েরা খাটে শুয়ে পায়।মানুষের স্বাভাবই মনে হয় অন্যকে ছোট দেখিয়ে নিজের মনে মনেপিশাচের হাসি হাসে-ও কোটার মাল,ও বাপের গোঁজ,ও বসের সাথে শুয়ে কিংবা তেলিয়ে..ইত্যাদি,ইত্যাদি।
-শোন কণল এখন ম্যাজেনমেন্টের কাছ জিনিস ছিনিয়ে নিতে হয়,বুঝলি?
কণল এসব কথা শুধু মাথা নাড়ে।
দুই
কণলের আট তলার অফিসে আজ সাজো সাজো রব।যারা প্রতিদিন দেরী করে অফিস আসে তারাও আজ বাধ্যছেলে-মেয়েদের মতন এসে হাজির।শীতের সময় -পাট ভাঙ্গা সোয়েটার কিংবা ব্লেজার এ সবাই কে অজানা লাগছে।ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়েই তুলিকার সামনে পড়ল কণল।
-সিগারেট খেয়েছিস?
কণল মাথা নাড়লো।তুলিকা একটু হতাশ হয়ে বললো
-জানিস না,এম ডি আমাদের প্রোজেক্টের কি মেম্বারদের সাথে দ্যাখা করবে?
-তো?
কণল কিছু বলার আগেই,তুলিকা হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পারফিউম বার করে লাগিয়ে দিতে দিতে বললো
-ভাগ্যিস ইউনিসেক্স পারফিউম টা ছিলো,না হলে..আমি জানতাম..নাউ ইটস্ বেটার।
পারফিউমের যে লিঙ্গ হয় সেটা কণল কলেজে পড়তে পড়তে জেনেছে।তার ছোটবেলাতে পুজোর সময় একটাপারফিউম বা সেন্ট কেনা হতো,পুজো আর বিয়ে বাড়ি ছাড়া তার ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিলো।কলেজ জীবন তাকে অনেককিছু শিখিয়েছে।মফস্বলের এক উচ্চাকাঙ্খী ছেলে ছিলো কণল।স্কুল জীবনে ক্লাসের ফার্স্ট বয় কলেজে গিয়ে জানতেপারলো পশ্চিমবঙ্গ প্রতিটি স্কুলেই একজন প্রথম হয়।প্রতি ক্লাসে প্রথম হবার গর্বটা মুছে গ্যালো কয়েকটি পরীক্ষাফলের পর।অনেক বেশী মাটির কাছাকাছি নিয়ে তাকে তার এই উপলব্ধি।তাই অন্যের উন্নতি প্রাথমিক ভাবে তারঈর্ষার কারণ হলেও পরে তার কাটা ছেড়া করে নিজের খামতি গুলো বুঝতে পারে সে।
যাই হোক এম ডি সাহেব এলেন পৌনে দশটায়।কণলদের প্রোজেক্ট রিভিউ শুরু হোলো এগারোটা নাগাদ।অ্যাজাইলমেথডোলজি নিয়ে তাদের এটা প্রথম বড় প্রোজেক্ট।ক্লায়েন্ট ব্রিটিশ অয়েল।প্রথম কয়েক মাস কাজের হাল এতোখারাপ ছিলো যে ক্লায়েন্ট প্রোজেক্টটাই বাতিল করে দিতে যাচ্ছিলো।তারপর অনেক বুঝিয়ে ক্লায়েন্টকে তারা রাজিকরায়,অবশ্যই কিছু শর্তের বিনিময়।তবে এখন দারুন ভাবে চলছে প্রোজেক্টটি।বিশেষ করে কনসালটেন্ট নিয়োগেরপর কাজের গতি অনেক বেড়েছে।কাজের গতি নিয়ে ক্লায়েন্ট দারুন খুশী।ডিসেম্বের শেষে ফাইনাল ডেলিভারি নিয়েসবাই ভীষণ ভাবে আশাবাদী।
দেড় ঘন্টার মিটিং -এম ডি সাহেব রণজয় এবং তুলিকার প্রশংসায় ভরিয়ে দিলো,কণলের নাম উঠলো দু এক বার।মিটিং শেষে রাত্রির পান ভোজনের আমন্ত্রণ পেলো পুরো টিম-উইক এন্ড পার্টি..!
তিন
পরদিন সকালে তুলিকার ফোনে ঘুম ভাঙলো কণলের।ফোনের উল্টো দিকে তুলিকার কথা গুলো শুনে কণলেরপিঠ দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গ্যালো।
-কি বলছিস তুলি.. এই রিওয়ার্ক করতে এক মাস সময় লাগবে।
-কি হবে কণল আমার কিছু মাথায় আসছে না।
-রণজয় কে বলেছিস?
-দুর ওটা বাল..ও ফোনটাই ধরছে না..তোকেই প্রথম বললাম..আজ সকালে কাল রাতের টেস্ট রিপোর্ট দেখে আমারতো হাত পা ঠান্ডা হয়ে গ্যালো।
– অভিষেক দা কে তো জানাতেই হবে।
-আরো একটা ব্যাপার হয়েছে তোকে পরে বলছি..দাড়া ফোন করে অভিদাকে জানাই আগে।জানি না কি কপালেআছে।
অভিষেক কণলদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার,খুব ধূর্ত কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক। কণল চটপট বিছানা থেকে উঠে পড়লো।অফিস যাবার জন্য সে অভিষেক দার ফোনটাও চলে এলো যথা সময়ে।কিন্তু দ্যাখা করার স্থান অফিস নয়গড়িয়াহাটের ক্যাফে কফি ডে।
কণল পৌছে দেখলো অভিষেক, তুলিকা এলেও রণজয় তখনও পৌছায়নি।রণজয় এলো আরও পনের মিনিটপরে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গত রাতের নেশাটা এখনও কাটেনি।
-শোন,এই কথা এখনও অফিসের কাউকে বলার দরকার নেই।অভিষেক বললো।
কণল বুঝলো ক্যানো তাদের অফিসে ডাকা হয়নি।
-কনসালটেন্টকে টেসটিংএর ফাইল গুলো আমি পাঠিয়ে কথা বললাম।বলে দিয়েছি দেড় মাসের রিওয়ার্ক।বিশাললস্ হয়ে যাবে রে,সঙ্গে কোম্পানীর রেপুটেশন..কি করে সামলাবো বুঝতে পারছি না।এই কাজ দেখিয়ে আরো কিছুঅর্ডারও পাইপ লাইনে আছে..।হতাশ ভাবে বললো অভিষেক।
-ইস আমাদের এতো মাসের পরিশ্রম..কোনো উপায় নেই অভিদা?রণজয় কথা গুলো যেন গলায় আটকে গ্যালো।কণল চুপচাপ বসে ছিলো,তারপর হঠাৎ বলে উঠলো
-অভিদা একবার কনট্রাক্ট ডকুমেন্ট টা দেবে?একবার পড়ে দেখি।
অভিষেক একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-কি দেখবি?আমি দেখিনি ভাবছিস?তবু যখন বলছিস..।
মিটিং শেষ,কণল কনট্রাক্ট ডকুমেন্টের প্রিন্ট নিয়ে বসলো।পাক্কা তিন ঘন্টা একটানা পড়তেই থাকলো সব ডকুমেন্ট।প্রতিটি লাইনে হলুদ মার্কারের দাগ,কিছু জায়গায় পেনসিলের নোট।রাতে সে ফোন করলো অভিষেক কে,পরের দিনচললো শুধু আলোচোনা আর কন কল।
বিষ্ময়ের যেন আরও বাকি ছিলো সোমবার অফিসে গিয়ে কণল জানতে পারলো তুলিকা রণজয়ের বিরুদ্ধেসেক্সসুয়াল হ্যারাসমেন্টের কমপ্লেন লজ করেছে।শুক্রবার রাতে পার্টিতে তুলিকা সাথে অভব্য আচরণ করেছেরণজয়।যেকোনো কর্পোরেটে এখন এই ব্যাপারটা ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে দ্যাখা হয়।
চার
নতুন বছরটা কণলের জন্য সত্যি হয়তো পালটে গ্যাছে। রণজয়ের স্যাক হওয়া, প্রোজেক্টের চাপ, তুলিকার ছুটি সবমিলিয়ে কণল পুরো ঘেঁটে আছে।অনেক অনুরোধের পর তুলিকা রণজয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ কমপ্লেন করেনি।
অফিসে ঢুকতেই অভিষেক দার কেবিনে ডাক পড়লো কণলেরং
-তুই কোম্পানীকে দারুন ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছিস কণল।চেয়ারটাতে গা এলিয়ে বললো অভিষেক।
-প্রোজেক্ট ম্যানেজার স্যাক,সেক্সসুয়াল হ্যারাসমেন্ট এবং কর্মচারী অসন্তোষের কারণ দেখিয়ে প্রোজেক্ট ডেলিভারিএক্সটেনশন পেয়ে গেছি আমরা।তুই সেদিন এই বুদ্ধিটা না দিলে..অবশ্য তুলিকা রাজি না হলে..তোদের দুজনেরপ্রমোশন বাঁধা এবং দারুন ইনসেনটিভ পাবি।অভিষেক গদ গদ ভাবে বললো।
-কিন্তু রণজয়?মাথাটা নীচু করে বললো কণল।
-বাপরে ওর ও হবে,পরের মাসে ওর জয়েনিং,তবে অন্য কোম্পানী।মালটা জানলো না ও কি উপকার করলোআমাদের।তবে এম ডি সাহেব তোর উপর ফিদা।বলছিলো বুদ্ধিমান,ধূর্ত কিন্তু সঙ্গে একটা মানবিক মুখ ও আছে।অভিষেক হাসতে হাসতে বললো।
কণলের কানে কিছুই ঢুকছে না,এক প্রবল আত্মগ্লানি তাকে গ্রাস করেছে।
-অভিদা আমি একটু তাড়াতাড়ি বেরোবো।
বিকেলের চিংড়িহাটা ফাঁকা,শহরের নতুন বছরেরে এখনো কাটেনি।কণলের উবের ছুটছে বাইপাস ধরে গন্তব্যরাজপুর-রণজয়ের বাড়ি।
রুবি, ঢালাই ব্রীজ, কামালগাজী পেরিয়ে কণল পৌছালো রণজয়ের পাড়ায় তখন সন্ধ্যা। অনেক বছর রণজয়ের দিদিরবিয়ে এসেছিলো, কিছুই মনে নেই।গাড়িতে বসেই সামনের চায়ের দোকানে জিজ্ঞাস করলো
-দাদা রণজয় মিত্রের বাড়ি?
-কে রুণু?কি ব্যাপার বলুন তো?
-না এমনি…আমি ওর পুরানো বন্ধু..
-দাদা,রুণু গত পরশু সুইসাইড করেছে..সামনে গিয়ে..
আর কিছু কানে আসছে না কণলের,
গাড়ি টা ঘুরিয়ে নিতে বললো…,ফিরে চললো সে..
কান্না আসছে..
ভীষণ কান্না।
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..