প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
দয়ারাম বাজারের শেষ মাথায় একসাথে সবকিছুর দোকান।
দামে একটু কম পায় বলে ভিড়টা একটু এদিকেই বেশি। সবজি আর মুরগির দোকানের মাঝখানে অত্যন্ত বেখাপ্পা ভাবে সুখেন দাসের দুই হাত-চার হাত মাপের দোকানটা। বাজার করতে গেলে ওদিকটায় আমারও যাওয়া হয়। ঢেঁকিশাক,কচুশাক আরো সব লতা পাতা পাওয়া যায় বলে। সুখেন দাস কাছিমের মত দোকান থেকে মাথা বাইরে বের করে রাখে আর অনেক মানুষের মধ্যে চেনা মুখ খোঁজে। আমি ইচ্ছে করেই সুখেন দাসের দোকানের দিকে তাকাইনা। লোকটা মানুষের সামনেই এমন সব কথা বলে বসেন যে কখনও কখনও বিব্রত হতে হয়। একদিন চোখাচোখি হয়ে যেতেই হাক ছেড়ে
ডাকে
দাদা…
ডাকটা কানে গেলেও না শোনার ভান করি। ও আবার ডাকে
দাদা…
এবার আমি তাকাই। অনিচ্ছা সত্বেও মুখটা হাসি হাসি ভাব করি।
দাদা … সবতো দেখা যাইতেছে ।
চমকে উঠে আমি সবার আগে জিপারে হাত দেই, কান গরম হয়ে ওঠে।
সুখেন দাস হাসতে হাসতে বলে
দাদা মনে হয় চমকাইয়া গেলেন ; কইতাছিলাম মাথার চুলের কথা। সব সাদা চুল দেখা যাইতেছে ।
ওহ…
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।
আরও একদিন বলে
দাদা কি করা বাদ দিছেন নাকি?
আজও আমার কান গরম হয়ে ওঠে। মনে মনে খুব রাগ হয়। কীসব বলে এ লোক। ভাবলাম আজ একটা ধমক লাগাবো আচ্ছা করে। সে নিয়ত করেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি মুখ খোলার আগেই সুখেন দাস দাঁত কেলিয়ে বলে “চুল কালা করার কাম কি বাদ দিয়া দিছেন নি”?
আমার রাগ কমে আসে সুখেন দাসের প্রতি।
সুখেন দাসের দোকানের সামনে যদিও “দাস সেলুন” নাম দিয়ে একটা রঙচটা সাইন বোর্ড লাগানো আছে তদুপরি সেভ করাতে কিংবা চুল কাটাতে এখানে খুব কম লোকই ঢোকে। যারা ঢোকে তারা সুখেনের ডাকাডাকি অথবা চক্ষুলজ্জায় ঢোকে।
সুখেনের হাতের চে মুখ চলে বেশি। পুরো দোকানে একটা কাঠের ভাঙ্গা চেয়ার একটা বেঞ্চ। সাধারণত বেঞ্চটা কোন দরকারেই লাগেনা। গালে ক্ষুর চালাতে চালাতে কমপক্ষে চারবার থুথু ফেলার ছলে দোকানের বাইরে মাথা বের করে, যদি কোন চেনা মুখ চোখে পড়ে এ আশায়।
কতবার বলেছি, সুখেনদা হোক ছোট দোকান কিন্তু একটু সাজিয়ে রাখবে তো। তোমার এমন নোংরা দোকানে কেউ আসতে চায়না সেটা কি বোঝ? সুখেন মন ভোলানো হাসিটা দিয়ে বলে“দেন তো দশটা টেকা,চুল কাটাইলে বিশ টেকা, তার আবার নোংরা পরিষ্কার খোঁজেন ?” আমি বলি “দাদা দাড়িতে চল্লিশ টাকা আর চুলে আশি টাকা নিও,তার আগে ডেকোরেশন,আফটার সেভ লোশন,ফেস ওয়াস,ভালো ক্ষুর কাঁচি আনো”। সুখেন দাস হাসে , মন খুলে হাসে। তারপর বলে “দাদা, আমি আপনেরে চিনি দয়ারাম বাজারের বেবাকতেরে চিনি। যেগুলানের কথা কইলেন হেগুলান লাগানোর পর আনোনের পর কইবেন, সুখেন দা এই গল্লির মইধ্যে এত টেকা দিয়া কেন কামাইতে আমু? একটু আলো বাতাসে যাও তখন দাম দিমু”
সুখেন কথা শেষ করেও হাসতেই থাকে। এটা তার একটা কৌশলও হতে পারে। অনেক খোঁচা মারা কথা হাসতে হাসতে অবলিলায় বলে ফেলে। কেউ রেগে যেতে পারেনা কারণ সুখেন হাসতে হাসতে কথাটা বলেছে। এসব নিয়ে বিচার আচার হলেও আমি নিশ্চিত সুখেন দাসেরই জিত হবে।
হঠাৎ করেই সুখেন দাসের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি। চোখাচোখি হলেও এখন আর ডাকেনা। দোকানের বাইরে কাউকে দেখবে বলে উঁকি মেরে মুখ বের করে রাখেনা। মুখের হাসিটা আগেই মতোই আছে,তবে ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায় মুখটা কেমন যেন নিস্প্রভ, মলিন। মনেই হয় জোর করে ও হাসছে। একদিন ইচ্ছে করেই ওর সেলুনে ঢুকি। সুখেন আমাকে বসতে বলেনা। আমার মুখের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে।মুখের হাসিটা কমতে কমতে এখন নেই বললেই চলে। আমি নিজেই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসি। সুখেন বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে বলে-
দাদা আপনে? এইখানে!
কেন, আগে কখনও আসিনি?
হ আইছেন তয় আমার হাক ডাকে। ইচ্ছায় তো আসেন নাই।
সুখেন আমাকে উঠিয়ে দিয়ে একটা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে চেয়ারটা মুছে দেয়। মুখে কোন কথা নেই।আমি অস্বস্থিতে পড়ে যাই।
সুখেন দা, তোমার কিছু হয়েছে?
না, কি হইবো আর।
তোমাকে কেমন যেন অসুস্থ্য মনে হচ্ছে।
হ অসুস্থ্য তো বটেই। গরিব মাইনষের একটাই রোগ, টেকার অভাব।
কেন ,রোজগার কি কমে গেছে?
রোজগার! হেইডা আবার কবে দেখলেন?
না মানে আগে তো ভালোই ছিলে।
না দাদা কোন দিনই ভালো ছিলাম না। আপনেরা দুই একজন দুই চাইর টেকা দিতেন তাই দিয়া চলতাম।ভিক্ষার লেইগ্যা হাত না পাইত্যা এইভাবে হাক ডাক কইরা চলতাম।
সেভাবেই চল ,অসুবিধা কোথায়?
না দাদা কয়দিন আর এইভাবে চলন যায়, মাইনষে বিরক্ত হইয়া যায়। এই যে আপনে কন তো দেখি কোনদিন নিজের ইচ্ছায় আইছেন আমার দোকানে?
আমি চুপ হয়ে যাই সুখেন দাসের কথা শুনে। আমার গালে ক্ষুর টান দিতে শুরু করেছে।সুখেন আবার কথা বলতে শুরু করে-
চল্লিশ বছর ধইরা সংসার করি, আপনের বৌদি একটা রাইত আমারে ছাড়া থাকেনাই। এহন এই বুড়া বয়সে হেও কয়“ আমি তোমার লগে আর সংসার করুম না”। আরে সংসার করবিনা যাবি কই? কার লগে যাবি ?বাবা মা ভাই বইন কেউ তো নাই। হে কি কয় জানেন ? কয় পথে পইড়া থাকুম তবু তোমার মতন অকম্মার লগে থাকুম না। হা হা হা হা …….
সেভ করা শেষ হয়। আমার গালে সুখেন একটা ছোট ফিটকারির টুকরা ঘষতে থাকে। আজ আমি কিছুই বলিনা, ওকে ওর ইচ্ছে মতো কাজ করতে দেই। কাজ শেষ করে টাকার জন্য হাত পাতেনা। আমি ইচ্ছে করেই ত্রিশ টাকা বের করে সুখেন দার হতে দেই। সুখেন হাসেনা,টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গলাটা নামিয়ে বলে-
দাদা এত টেকা কেন?
রাখ, ইচ্ছে করেই দিলাম।
এবার সুখেন হাসলো। সে হাসিতে কোন প্রাণ নেই।
দাদা, দশ টেকা আমার মজুরি। বাকি বিশ টেকা ভিক্ষা ? অহনও কাম করি , আপনে আমারে কামের মজুরি দেন। তয় ভিক্ষা ছাড়া দশা নাই। তহন বাকি বিশ টেকা দিয়েন।
আমি সুখেন দার মুখের দিয়ে তাকিয়ে থাকি। দশ টাকা নিজের পকেটে রেখে বাকি বিশ টাকা আমার হাতে গুঁজে দিল। আমি কিছু বলতে পারলাম না আবার বাধাও দিলাম না।
একদিন দেখি “দাস সেলুন”এর ঝাপ বন্ধ।
পর পর কয়েকদিন ধরেই সেটা বন্ধ দেখলাম।
মাসখানেক পরও সেটা বন্ধই দেখলাম।
একটা সময় ছিল যখন সুখেন দাস আমাকে খুঁজেছে। সত্যি কথা আমি বিরক্তই হতাম। বাজারে গেলে কামনা করতাম আজ যেন সুখেন দাস আমাকে না দেখে ফেলে। আজ আমি সুখেন দাসকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মনে মনে ভাবছি সুখেন দাসও কি আমার মতো করে ভাবছে যে আজ যেন তার সাথে না দেখা হয় ? আশে পাশে দোকানদারদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ওরা কেউ সুখেন দাসের খবর জানে কি না। কেউ কোন খবরই দিতে পারলোনা। একজন উল্টো আমাকেই জিজ্ঞেস করে বসলো“ টেকা পয়সা ধার দিছিলেন নাকি?”আমি লোকটাকে জবাব দেই “আমি টাকা পাবোনা, সুখেন দাস আমার কাছে পাবে”।
লোকটা কী বুঝলো জানিনা একটা হাসি দিয়ে মাথাটা ঝাকালো শুধু।
সুখেন দাসের সাথে একদিন আমার দেখা হয়ে যায়।
দেখা না হলেই ভালো ছিল। সুখেন দাসও নিশ্চয়ই এমনটি ভেবেছিলেন যেন আমার সাথে দেখা না হয়। নইলে সুখেন দাস কেন নিজ শহর ছেড়ে অনেক দূরে এক শহরে কাউকে না বলে চলে যাবে ? কেন সদাহাস্য সুখেন দাস মুখ কালো করে মাথা নিচু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত পাতবে। সুখেন বলেছিল বটে “ ভিক্ষে করলে বাকি বিশ টাকা দিতে”।
সুখেন দাস ভিক্ষে করছে , আমার কাছে তার পাওনাও আছে কিন্তু আমি তাকে সেটা দিতে পারিনি।
সেদিন আমি সুখেন দাসকে দেখেছিলাম,
সুখেন দাস আমাকে দেখেনি।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..