সুখের আগে অ

এইচ বি রিতা
উপন্যাস
Bengali
সুখের আগে অ

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

পর্ব ১

ফ্লাশিং এর লাস্টস্টপে এসে ট্রেনটা থেমে গেল। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি অসংখ্য মানুষ পরের যাত্রার অপেক্ষায়। ঝিমাতে ঝিমাতে রানু সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তড়িৎ বের হতে হবে। নয়তো ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সোমবার থেকে শুক্রবার এ সময়টা মানুষের কাজ থেকে ঘরে ফেরার সময়। রানুর মতো শতজন ফিরছে, আবার শতজন হয়তো ঘরে ফিরে যাবার তাড়ায় আছে। কিংবা রাতের শিফ্ট।

সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠার তিনটা এনট্রেন্স রয়েছে স্টেশনটিতে। দুটো রোজভেল্টের উপর, বাকি দুটো রোজভেল্ট ও মেইনস্ট্রিটের উপর। তারমধ্যে কিসেনামুখী রানুর বাড়ির দিকের এনট্রেন্সটি রয়েছে ঠিক রোজভেল্ট আর মেইনস্ট্রিটের কোনায়।

 

স্টেশন ছেড়ে উপরে উঠতেই স্বচ্ছ ঝকঝকা আকাশটি যেন রানুর সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিলো। শরৎ এর আকাশটা দেখতে ভারি সুন্দর। অগ্নিঝরা গ্রীষ্মের খরতাপ শেষে, বষার্র বিষণ্ণতায় ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতিকে প্রাণোচ্ছল করে তুলতে শরৎ যেন চলে আসে গুটি পা’য়ে প্রকৃতির বুকে। মাত্র কিছুদিন আগেও যে ধূমল, কালো মেঘে ছেয়ে থাকত আকাশ, শরতের আগমনে সেই আকাশের বুকেই ভেসে বেড়ায় পেঁজা-তুলো শুভ্র মেঘ।

একটা সময় শরৎ আর অটামের দৃশ্যগুলো মেলাতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যেত রানু। বাংলার শরৎ কে যদি এ দেশে অটাম বলা হয়, তবে দুই ঋতুর প্রকৃতির চিত্রগুলো তো একই হবার কথা-এমনটাই ভাবনায় আসতো তার। তারপর ধীরে ধীরে জেনে গেছে উত্তর গোলার্ধে অটাম হয়ে বাংলার শরৎ আসে সেপ্টেম্বর মাসে। আর দক্ষিণ গোলার্ধে শরৎ আসে মার্চ মাসে, গ্রীষ্ম ও শীতের মধ্যবর্তী ঋতু হয়ে।

 

দেশ ছেড়েছে রানু সেই কিশোরীকালে। তাই রঙ বদলে ঝরে পড়া পাতাদের অটাম-ই তাকে আজ মুগ্ধ করে ভীষণ। তবে, আকাশ, নীলের সাথে মেঘেদের উড়াউড়ি, শিউলির ঘ্রাণ, ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা, কোমর দোলানো কাশফুল, এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীরবুকে ডিঙি নাও-তে বৈঠা হাতে মাঝির ভাটিয়ালি গান….কিছু তো মিস করে ক্ষণে ক্ষণে।

 

কাঁধে ছোট লেদারের ব্যাগ আর এক হাতে লাঞ্চ ব্যাগটি ঝুলিয়ে রেখেই কিসেনার সুপার মার্কেটে ঢুকলো রানু। কিছু সবজি নিতে হবে। ঝুনঝুন বলে রেখেছে আজ নারকেলের আইসক্রিম নিতেই হবে। মেয়েটার বায়না বলতে আইসক্রিম, রঙ পেন্সিল আর স্কেচ বুক। আঁকাআঁকির প্রতি তার রয়েছে ভীষণ আসক্তি। সেদিন ক্লাসরুমে ‘স্ট্যাচু অফ আব্রাহাম লিঙ্কল’ চিত্রাঙ্কন করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় তৃতীয় শ্রেণির ঝুনঝুন। হলরুমের প্রদর্শনীতে যখন রানু উপস্থিত হয়, ক্লাস টিচার বোম্যারাটো দৌড়ে এসে হ্যান্ডশ্যাক করে বলেন, `মিস রানু! আই উইশ আফিয়া ইজ মাই ডটার।’

সেদিন কী যে খুশি হয়েছিল রানু!

ঝুনঝুনের পুরো নাম আফিয়া ফারজানা। রানুর মা জোবেদা খাতুন আদর করে ডাকতেন ঝুনঝুন। ছোটবেলা নাতনি তার নূপুর পায়ে সারাদিন ঝুনঝুন শব্দ তুলে হাঁটতো বলেই এই নামকরণ। সেই থেকে কেবল স্কুল ছাড়া বাইরের সবাই তাকে জানে ঝুনঝুন নামে। নামটা ঝুনঝুনেরও খুব পছন্দ।

 

 

সুপার মার্কেটে ঢুকলে বাটারফিশ নিতেই হবে। সাদা চকচকা বাটারফিশে তেমন আঁশ নেই, আছে ক্রিমি টেক্সচার এবং সূক্ষ্ম, সাদা মাংস। এই মাছটি ভাজা ও রান্না করা যেমন সহজ, খেতেও সুস্বাদু। রানুর মায়ের বেশ পছন্দ মাছটি। তবে খুব হিসাব করেই কেনাকাটা করে রানু। দেশের মতো দরদাম করা যায় না এদেশে। মূল্য যা সিল মারা তা দিয়েই কিনতে হবে। তাই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলিই কিনে নেয় সে। অহেতুক টাকা খরচ করে বিলাসী জীবনযাপন করা রানুর সামর্থ্য ও অভ্যাস-কোনটাতেই নেই। তাই প্রায় সময় রানু কয়েকটা দোকানে ঘুরে ঘুরে সামান্য ছাড় পেলেই সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি কিনে নেয়।

 

কী গো! রানু না?

চাইনিজ মার্কেটে হঠাৎ কারো মুখে নিজের নাম শুনতেই ঘুরে তাকালো রানু।

ওহ আপা আপনি! কেমন আছেন?

ভালো আছি গো। তুমি কেমন আছো? বহুদিন পর দেখা! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বুঝি নাজমা আপাকে চিনতেই পারবে না।

রানু ইতিমধ্যেই কিছু বাজার সেরে ফেলেছে। দুই হাত ভর্তি বাজার আর লাঞ্চ ব্যাগটি নিয়ে সামনে বাড়ে। নাজমা আপাও এগোয় তার সাথে।

কাজ থেকে ফিরেছো বুঝি?

হ্যাঁ আপা।

তো একা এতগুলো বাজার সদাই হাতে নিয়ে যাচ্ছো যে? তোমার তো এখন সুখের দিন। তিনি কই?

 

রানু জানতো, এমনই কিছু আলোচনা তুলবেন তিনি। তাই কেনাকাটা সম্পূর্ণ না করেই বাড়ির দিকে মোড় নিয়েছিল। তবু তার উৎসুক প্রশ্ন থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। রানু বলল,

নাজমা আপা! আমার একটু তাড়া আছে। মেয়ের জন্য আইসক্রিম নিয়েছি তো, বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে গলে যাবে।

তুমি এদিকেই থাকো থাকো বুঝি?

জ্বি।

বলো কি! আমিও তো পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে কিসেনাতে নতুন ফ্ল্যাট নিয়েছি। তোমার ঠিকানাটা দাও তো! মেয়ে আর মেয়ের জামাই কাজে চলে যায়। নাতি নাতনিরাও মিশে না তেমন। একা একা থাকি। দেখা হয়ে ভালই হলো, মাঝেমাঝে চলে আসব।

 

যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়! অগত্যা ঠিকানা দিতেই হলো রানুকে।

 

রানু হাঁটছে কিসেনার পথে বাড়ির দিকে। এক অস্থিরতা ভেতরে কাজ করছে। কেন বোকার মতো বাড়ির ঠিকানাটা তাকে দিলো-তাই নিয়ে এখন চরম মেজাজ খারাপ হচ্ছে রানুর।

মেজাজ খারাপ হলেই বৃদ্ধাঙ্গুলি আর কনিষ্ঠা আঙ্গুলে নাক চেপে ধরে নিঃশ্বাসের একটা ব্যায়াম করে রানু। এতে করে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে তড়িৎ। অ্যাবডোমিনাল ব্রিদিং অভ্যাসটাও বেশ কাজে দেয়। তবে এই মুহূর্তে কোনটাই করতে পারছে না সে।রানু হাঁটছে। তার দুই হাত বদ্ধ বাজারের প্লাস্টিক ব্যাগে। রানুর উদ্বেগ বাড়ছে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে! অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলি এখন শরীরকে স্ট্রেস হরমোনে প্লাবিত করতে শুরু করেছে।

 

 

রাত প্রায় দশটা। সাধারণত রাত আটটার মধ্যেই রাতের খাবার সেরে ফেলা হয়। আজ একটু দেরিতেই খাবার টেবিলে বসেছে মা মেয়ে। ঝুনঝুন ঘুমিয়ে পড়েছে, সকালে স্কুল আছে তার।

রানু আজ ভাতের সাথে করলা ভাজি, টমেটো ভর্তা, আর ডাল করেছে। তাতে-ই মা মেয়ের হয়ে যায়। ঝুনঝুনের জন্য কয়েক টুকরা চিকেন রোস্ট। রানু সাধারণত কাজ থেকে ফিরে বিকালেই রান্না চড়ায়। একসাথে দুইদিনের রান্না করে রাখে, যেন রাতে খেয়ে বাকিটা পরের দিন দুপুর পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া যায়। কর্মজীবী মানুষদের এভাবেই ম্যানেজ করতে হয় সবকিছু। বিশেষ করে বাইরের দেশগুলিতে।

 

জোবেদা খাতুনের ডায়াবেটিস বলেই করলা ভাজি নিয়মিত খান। এখনও থালায় ভাতের চেয়ে করলা ভাজির পরিমাণটাই বেশি। এক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিতে দিতে বললেন, কী রে! গাড়িটা কি ঠিক হলো?

নাহ মা। আরো এক সপ্তাহ লাগবে।

কত টাকা লাগবে?

ও নিয়ে ভেবো না। সময় মতো নিয়ে আসবো।

 

জোবেদা খাতুন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপর আবারো এক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিয়ে চিবাতে থাকেন। তিনি জানেন, মেয়েকে বলেও কিছু হবে না। তবু মেয়ের বিপদ-আপদের জন্য টোপায় লুকিয়ে লুকিয়ে জমা করেন সিঙ্গ্যেল ডলার, কোয়ার্টার, নিকল, ডাইম, পেনি। রানু ইচ্ছে করেই খুচরোগুলো মা’কে দেয়। সেও জানে, মা কার জন্য খুচরোগুলো জমায়।

শুধুমাত্র খাওয়ার সময়টাতেই জোবেদা খাতুন তার মেয়েকে খুব কাছ থেকে দেখতে পান। সারাদিন কাজ, সংসার, বাচ্চা ও মা’কে সামলানো,… নানা ব্যস্ততায় কাটে দিন। তাই রাতে খাওয়ার সময়টা একটু বেশিই নেন মা-মেয়ে। নিত্যদিনের আলোচনাগুলো এসময় সেরে নেন।

 

মা। সুগার পরীক্ষা করেছো?

জোবেদা খাতুনের ডায়াবেটিস নিযন্ত্রণে থাকলেও উঠা-নামা করে হুটহাট। তাই নিয়মিত সুগার পরীক্ষাটা করিয়ে নিতে বলে রানু। তিনি অবশ্যয় নিজের যত্নে খুব সচেতন। তবু প্রতিদিন একবার করে জিজ্ঞেস করে নেয় সে।

 

করেছি। সব ঠিকঠাক আছে, এতো ভাবিস না তো।

মা! নাজমা আপার সাথে দেখা হয়েছিল আজ। সুপার মার্কেটে।

নাজমা! সেই নাজমা?

হ্যাঁ।

সে না আপস্টেট চলে গিয়েছিল?

বলল তো এদিকেই ফিরেছে আবার। আমার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে গেল।

সে কি! তুই দিলি?

চাইলেন। এড়াতে পারিনি। তবে এপার্টমেন্ট নাম্বার ভুল দিয়েছি।

 

জোবেদা খাতুন থালা হাতে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলের ছিটেফোঁটা ভাতগুলো এক এক করে টুকিয়ে থালায় রাখলেন। ছোটবেলা জেনেছেন, অপচয় করা এক একটা ভাতের দানা মরার পর এক একটা সাপ হয়ে কামড় দেয়। সেই থেকে তিনি ভাত নষ্ট করেননা। মাঝেমাঝে ফ্লোরে পড়ে থাকা হাতের দানা তুলতে গিয়ে বিড়বিড় করেন-‘কত মানুষ না খেয়ে মরে রোজ! আর তোরা ভাত নষ্ট করিস! একবার ভাব তাদের কথা! একবার অভাবে পড়ে দেখ বাস্তবতা কী!’

 

জোবেদা খাতুনের চোখ টেবিলের মেটগুলোর দিকে যায়। বেশ পুরানো হয়েছে। কিছুটা চিটচিটে। বদলাতে হবে।

রানুরও খাওয়া প্রায় শেষ। মেয়েটার মুখের দিকে তাকান জোবেদা খাতুন। একদম বাবার আকৃতি। এ নিয়ে কত মন কষাকষি হতো তার বাবার সাথে। মেয়ে দেখতে বাবার মতো হয়েছে বলে রানুর বাবা প্রায় সময় ‘আমার মেয়ে আমার মেয়ে’ বলে ক্ষেপাত জোবেদা খাতুনকে।

ঝুনঝুনও পেয়েছে একদম মায়ের আকৃতি। গোলগোল ভরাট চোখ, ঘনকালো চুল, সেই টিকালো নাক, ত্বকের রঙ!
স্বভাবেও কিছুটা মিল পাওয়া যায়।

 

মা! থালা হাতে দাঁড়িয়ে আছো যে?

রানু টেবিল ছেড়ে উঠতে গিয়ে বলে। জোবেদা খাতুন শুকনো মুখ করে তাকায় রানুর দিকে। থালা হাতে দাঁড়িযে আছেন তিনি-একথা ভুলেই গিয়েছিলেন। আজকাল ছোটখাটো অনেক কিছুই ভুলতে শুরু করেছেন তিনি। সেদিন দুপুরে স্কুল শেষে বাসস্টপ থেকে ঝুনঝুনকে পিকাপ করতে ভুলে গেলেন। ভাগ্যিস, বাড়ির সামনেই বাসস্টপ। তাই ঝুনঝুন নিজেই চলে আসে।

রানুর কথায় জোবেদা খাতুনের একটু মন খারাপ হলো। ‘আচ্ছা! আমি হঠাৎ হঠাৎ এমন ভুলে যাই কেন রে রানু? এটা কী কোনসমস্যা?’

কোন সমস্যা না মা। আমিও প্রায় সময় গাড়ি কোথায় পার্ক করি সে কথা ভুলে যাই।

 

রানুর কথায় যেন জোবেদা খাতুন একটু স্বস্তি পেলেন।বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।

 

-চলবে।

 

এইচ বি রিতা। কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। জন্ম বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। বর্তমান নিবাস কুইন্স, নিউইয়র্ক। তিনি নিউইয়র্ক সিটি পাবলিক স্কুল শিক্ষকতায় জড়িত রয়েছেন দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে। পাশাপাশি কাজ করছেন দৈনিক প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা ভার্সনে। এছাড়াও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ