করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
“অব হামরেমন কাঁহা যাব? কিতনা যুগ পহেলে আজা-আজিলোগ ছোটানাগপুরমে চালান হোয়েকে আই-রহলাক। জঙ্গল কাইটকে সাপ বাঘ গোঁজর ভাগাকে এহি আবাদ বানালাক…হামিনকের বাপদাদামনভি হিয়াই জন্মালক…বড়া হোলাক,উকার পিছে মরিওভি গেলাক।এহি চায়বুদাকে সাথ হামনিকের জান প্রাণ। হামনিকের দুসরা ঘরধুরাভি নাখে। এহি আস্তানামে রহেকে পড়ি। কাঁহা যাব? কেইছেন বাঁচব?”
“চা মাটির সাত কাহন”- কি আখ্যা দেওয়া যায় এই গ্রন্থটিকে? উপন্যাস? ডকুমেণ্টেশন? তলিয়ে যেতে থাকা কোন কৌমের জীবন আলেখ্য নাকি কম্পাইলেশন অব ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস অথবা গ্রন্থ পরিচিতিতে উল্লেখিত ‘উপন্যাসের চেনা গণ্ডীর বাইরে এক অলৌকিক অনুসন্ধান? বাস্তবিক এ গ্রন্থ চেনা ছকের বাইরে নিয়ে গিয়ে পাঠককে দাঁড় করায় এক আদ্যন্ত অপরিচিত জগতে, একটি নিরালম্ব চেতনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে পাঠকের মনোজগতে তৈরী হয়ে যায় জিজ্ঞাসার কোকুন, পাঠান্তে সে কোকুন ভেদ করাও যায় হয়ত বা, উত্তরনের স্বপ্নের তীক্ষতায়। পাঠকের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে বা গল্প করতে করতে এই অজানা জগতের আখ্যান শুনিয়ে যাওয়া খুব সহজ নয়, কিন্তু নির্মোহ মনন, সমাজবীক্ষণ এবং কঠোর পরিশ্রমে সুরঞ্জন প্রামাণিক মশাই সেটা সম্ভব করেছেন।
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং, তরাই এবং ডুয়ার্স মিলিয়ে মোটামুটি ৪৫০ টির মত চা বাগান রয়েছে। প্রায় ১২০-১৫০ বছর আগে বাংলায় এই বাগিচা চাষের প্রবর্তন; নীল চাষের যুগ শেষ আর ”গ্রীণ গোল্ড এস্টেটের পত্তন”…ঔপনিবেশিক শোষণের ভরকেন্দ্রের পরিবর্তন হল শুধুমাত্র। স্বাধীনতার পর টী প্ল্যাণ্টেশন অ্যাক্ট এল ১৯৫১য়, চালু হতে হতে ছাপান্ন। কিন্তু সে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলাটাই হয়ে উঠল রেওয়াজ।বন্ধ চা বাগান, চা বাগানের অনাহার ক্লিষ্ট মুমুর্ষু শ্রমিক, শ্রমিক সংঘর্ষ, নারী পাচার ইত্যাদি বিষয়গুলি খবরে এলেও,বড় তাড়াতাড়িই ধূসর হয়ে যায়। চা বাগানের উৎপত্তি, বিস্তার, চাবাগান কেন্দ্রিক শ্রমিক সংগ্রহ, তাদের জীবন সংগ্রামের কাহিনী এখন অবধি অন্ধকারেই আচ্ছন্ন। এ জায়গাতেই এ কাজের স্বার্থকতা,একটি অচেনা কৌমের জীবন যন্ত্রণার এবং সংগ্রামের ঐতিহাসিক পটভূমিকা ও বর্তমান প্রেক্ষিত পাঠকের কাছে উঠে আসে অনায়াস গতিতে।
ছোটনাগপুর থেকে একের পর এক আদিবাসী সম্প্রদায়কে শিকড়হীন করে এই চা বাগান কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনা করা হয়, সেই আক্ষেপ ধরা পড়ে উপন্যাসের একটি চরিত্র বাচ্চুর মুখে
”ইংরেজ যদি আমাদের দেশে না আসত তাহলে আমাদের আজকের বেঁচে থাকাটা কিরকম হত?”
“টী ট্রাইব” তৈরীর এই আসুরিক অপপ্রয়াসের এর মধ্যেও পরম আদরে উপজাতিরা বাঁচিয়ে রাখেন তাঁদের জনজীবনের নিজস্ব “সিরজামিথ” বা শিকড়ের গল্প…ধরা যাক ওঁরাও সম্প্রদায়ের কথাই…তাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের আদি পুরুষ ধরমেশ, সূর্যদেবের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে স্বাধীন জীবনের সৃষ্টি করেন পৃথিবীতে, মহেনজোদাড়ো থেকে উৎখাত হয়ে তাঁরা আশ্রয় পান রোটাসগড়ে…সেখান থেকে প্রতারিত হয়ে তাঁদের আবার ঠাঁইগাড়া ছোটনাগপুরে…আর অবশেষে এই উত্তরের চা বাগান…তাঁদের জানা নেই উৎখাত হতে হতে আরও কতদূর হাঁটতে হবে তাঁদের…তাঁরা স্বপ্ন দেখেন উলগুলানের…বিরসা আবার আসবেন…যাত্রা ওঁরাওএর(১৯১৪)সংগ্রামী নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে তাঁরা খুঁজে পেতে চান বিরসাকে…স্বপ্ন ভেঙে যায় আবার তৈরীও হয়…মুক্তিদাতা আসবেনই একদিন না একদিন, শোষণের হাত থেকে তাঁদের মুক্তি দিতে। এই শোষণের প্রকৃতি সম্বন্ধেও লেখকের বিশ্লেষণ অনবদ্য…
”১৯৫১ থেকে ১৯৭১ চা শিল্পের মালিকানায় পরিবর্তন এল বটে,কিন্তু মালিকদের শিল্পপতিসুলভ মানসিকতা ছিল না, দে অল আর ফাটকাবাজ… ইংরেজরা শোষক ছিল সন্দেহ নেই কিন্তু এই দেশী ফাটকাবাজরা…এরা প্রবঞ্চক, শ্রমিকের আইনসম্মত পাওনাটা এরা আত্মসাৎ করে।“
উঠে আসে চা বাগানের মেয়েদের ভিন রাজ্যে পাচারের মর্মান্তিক আখ্যান,অপুষ্টিতে ভোগা কঙ্কালসার দেহ,অন্ধকারের উৎস নির্মূল করতে গিয়ে ডাইন প্রথার নিগড় আদিম অন্ধকারে জড়িয়ে যাওয়া। আর্তনাদ শোনা যায় চাবাগানেরই ভূমিপুত্র আব্রাহামের(যে এখন বিডিও অফিসের কর্মচারী)কণ্ঠে
”হামনেরেকের দুশমন দুইটো,নম্বর ওয়ান অশিক্সা নম্বর টু নাশা আর ডাইন চারচা।“
এর মধ্যেই রয়েছে হঠাৎ হঠাৎ বাগান বন্ধের ঘটনা,কারন হিসেবে যা দেখানো হয়-শ্রমিকদের কাজে গাফিলতি,শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি, তৎপশ্চাৎ সাশপেনশনের নোটিশ- আর এ জিনিস শুরু হয় ঠিক দুর্গাপূজার আগে, চলতে থাকে হোলির সময় পর্যন্ত,অর্থাৎ পাওনা দাবী করলেই নিরাপত্তাহীনতার অসুখ… পাশাপাশি অনাহারক্লিষ্ট শ্রমিকের আত্মহত্যার মড়ক।অবধারিত ভাবেই এসে পড়ে অনভিপ্রেত ইউনিয়নবাজী, মাসল পাওয়ারের প্রদর্শন, ফাইটিং ফান্ডের বা সংঘটন চালানোর নামে চাঁদা তোলার জুলুমবাজি। বাগানে নতুন কাজের সুযোগ তৈরী হলে ভূমিপুত্রদের বঞ্চনা করে বাইরে থেকে অথবা ইউনিয়ন লিডার বা ম্যানেজমেন্ট ঘনিষ্ঠদের নিয়ো্গ, নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।দানা বাঁধতে থাকে ক্ষোভ..মাঝে মাঝে ঘটে যায় বিস্ফোরণ। দলগাঁও চা বাগানে উনিশ জন শ্রমিকের অগ্নিদগ্ধ হওয়া এরকমই একটি ঘটনা যা চিত্রিত হয় অনবদ্য দক্ষতায়।বর্ণিত হয় তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলির চরম উদাসীনতার কথাও,আঞ্চলিকতার রাজনীতি কিম্বা এলাকায় প্রভাব বিস্তারে তারা যতটা আগ্রহী ততটাই অনাগ্রহী তারা চা শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে,কিম্বা ক্ষমতায়নে তাদের শরিক করে নেবার ব্যাপারে। মৃত্যুর এই হাহাকার এর মধ্যে থেকে এই ভ্রষ্টাচারের এর খবর পৌঁছে দিতে চাওয়া তরুণ সাংবাদিক শুভ্রনীলের রহস্যময় মৃত্যু এই আখ্যানের আর একটি ভয়াবহ দিক, এ ঘটনা মনে করিয়ে দেয় আখ্যান শুরুর প্রথমেই উল্লেখিত রামকুমার বিদ্যারত্নের(বিগত শতাব্দীতে সঞ্জীবনী পত্রিকায় নিয়মিত তুলে ধরতেন চা শ্রমিকদের উপর নির্মম শোষণ ও অত্যাচারের কাহিনী)প্রতি টী প্ল্যাণ্টারদের নির্মম চেতাবনি”দ্যা কন্ট্রিবিউটর টু দ্যা সঞ্জীবনী উইল ফার্স্ট ভিকটিম টু দ্যা প্ল্যাণ্টারস গান।“
এই ইনফার্নোর মধ্যেও চা শ্রমিকরা তাদের উত্তর প্রজন্ম তৈরী করার জন্য প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী আখড়া তৈরীর পরিকল্পনা করেন, সমবায় প্রথায় চা বাগানগুলি সফল ভাবে পরিচালনা করার স্বপ্ন দেখেন, প্রাকৃতিক সাম্য বজায় রাখতে নিজেদের বহু প্রাচীন শখ পাখি শিকারের অবসান ঘটাতে চায় গিটিশ(গুলতি)পুড়িয়ে, ম্যানেজমেন্ট যখন টী ট্যুরিজমের আইডিয়া নিয়ে এগিয়ে আসে তাকে সফল করে তোলার জন্য পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে শিক্ষিত আদিবাসী যুবক।লোকায়ত ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই জনজীবনে, উত্তরণের স্বপ্নের কাজল মেখে আব্রাহাম ও সোমার কিম্বা মনোহর ও সোমারির পাশাপাশি পথ চলতে চাওয়ার মিষ্টি প্রেমকাহিনী এ আখ্যানকে অন্য মর্যাদা দেয়।
চা বাগানের এই অজানা আখ্যান,জীবন সংগ্রামের কাহিনী শ্রী প্রামাণিকের কলমের আশ্চর্য মুনশিয়ানায় পাঠককে পৌঁছে দেয় এক অন্য জগতে, যেখানে অপেক্ষা করে থাকে ইতিহাসের নতুন নির্মাণ। অসামান্য এই কাজটির জন্য শ্রী প্রামাণিক বাঙালী পাঠকের কাছে ধন্যবাদার্হ্য হয়ে রইলেন।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..