প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
দোকানটা প্রায় সবটাই খুঁজে ফেলেছি| কিন্তু না‚ নেই| যেটা আমি খুঁজছি সেটা এখানেও নেই| কে যেন বলেছিল আর কোথাও না পাওয়া গেলেও এখানে পাওয়া যাবেই যাবে| তাই তো এসেছিলাম এই দোকানটায়| কিন্তু আমি হতাশ এখানেও পেলাম না| একটু একটু মনখারাপও|
কি ম্যাডাম পেলেন না আপনার পছন্দের ব্যাগটা?
দুদিকে নেতিবাচক মাথা নেড়ে জানাই‚ না পেলাম না|
দোকানদার ভদ্রলোক বেশ ভালো‚ না হলে আমার মত একজন অদ্ভুত ক্রেতার অত্যাচার সহ্য করছেন| দোকানে তো ভিড় কম না‚ বিক্রিও বেশ ভালো| তবু যে এতক্ষণ ধরে আমায় ওরা সময় দিলেন‚ সুযোগ দিলেন আজকালকার দিনে কম কি?
কি আর করা যাবে ম্যাডাম| একখানা ফটো পেলে না হয় বানিয়েও দিতে পারতাম| দোকানদার ভদ্রলোক হেসে বলেন|
এই প্রথম আমি সরাসরি ভদ্রলোকের দিকে তাকাই| আসলে এতক্ষণ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম| ঈপ্সিত জিনিস পাব জানলে একটা যেমন ঘোরের সৃষ্টি হয়‚ তেমন একটা ঘোর| তাকিয়েছি হয়ত অনেকবার তবু মন দিয়ে দেখিনি| তাই হয়ত এতক্ষণ খেয়াল হয়নি| ভদ্রলোকের চোখে যেন একপ্রকার কৌতুক| চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দী বাঘকে দেখে যেমন একটা কৌতুক জাগে অনেকটা সেরম| আমায় কি মানসিক ভারসাম্যহীন ভাবছে নাকি? ভাবতেও পারে| আর ভাবলে কি বা এসে যায়|
ফটো সে কোথায় পাব? তখন তো আমি নিজেই অনেক ছোট| আর সেসময় তো ফটো তোলার ক্রেজটাই এত ছিল না|আর তখন তো মোবাইলও ছিল না যে ফটো তুলে রাখবে| আর ছিল না ফেসবুক বা ট্যুইটার যে ফটো আপলোড করে রাখলেই খুঁজে ঠিক পাওয়া যাবে|
এতগুলো কথা কি আমি রেগে বললাম? আমার কথার সুরে আমি টের পেয়েছি একটা ব্যঙ্গের আভাস ছিল| তাই হয়ত দোকানদার ভদ্রলোক নিজেকে সামলে নিলেন| আর হেঁকে বললেন পল্টু মালগুলো তুলেছিস? ছড়ানো না থাকে যেন|
এটাও আমাকেই যেন পরোক্ষে বলা| আমাকেই তো দেখাচ্ছিল পল্টু নামের ছেলেটা| ব্যাগের পর ব্যাগ নামিয়ে পুরো ছোটখাটো একটা স্তুপ বানিয়ে ফেলেছিল| মায়া হচ্ছে ছেলেটার জন্য| কটা টাকাই বা মাইনে দেয়‚ কিন্তু গাধার খাটুনি খাটিয়ে নেয়| আমার বোঝা উচিত ছিল ঐ ব্যাগটা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না|
আচ্ছা ম্যাডাম তবে আপনি এবার দোকানী কথা শেষ করে না|
বেশ অপমানিত বোধ হচ্ছে| না না দোকানীর কথাতে নয়‚ নিজের নির্বুদ্ধিতায়| আমারই তো বেড়িয়ে আসার কথা অনেক আগেই| জিনিস যখন পেলামই না‚ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না|
শুধু শুধু আপনাদের খাটালাম| কিছু মনে করবেন না‚ বলে ঝট করে বেড়িয়ে এলাম দোকানটা থেকে|
কানে এলো পিছন থেকে দোকানীর বিরক্ত গলা যত্তসব পাগল ছাগল আমার দোকানেই এসে জোটে| দিনটা পুরো ঘেঁটে দিয়ে গেল|
পাগল ছাগল ! হয়ত তাই| এমন কথা নতুন তো শুনলাম না| তবে সত্যি দিনটা ওদের ঘেঁটে দিলাম| এটার জন্য একটা আফশোষ হচ্ছে| দুটো পয়সা কারও ইনকাম আমার দ্বারা হবে ভালো লাগে| সেটা হল না| বিরক্তি তো স্বাভাবিক| গায়ে মাখি না দোকানদারের বিরক্ত হয়ে বলা কথাগুলো| হয়ত আমি ওঁনার জায়গায় থাকলেও ঠিক এইভাবেই রি-অ্যাক্ট করতাম| |হাঁটতে থকি | এরা কেউ বুঝবে না‚ একটা ব্যাগ কেন আমি খুঁজছি? আসলে ঐ ব্যাগটা একটা শুধুমাত্র ব্যাগ নয়‚ আমার গ্লানি‚ আমার কষ্টের‚ আমার অপমানের প্রতীক|
বললে হয়ত ঐ দোকানদার বিশ্বাসই করত না যে এখন আমার কত যে ব্যাগ আমি নিজেই তার সঠিক সংখ্যা জানি না| প্রত্যেকটা শাড়ির সাথে ম্যাচ করে এক একটা ব্যাগ| আর প্রত্যেকটা ব্যাগই বেশ দামী| তবু কেন যে আমার মন ওঠে না| থেকে থেকে আমি শুধু সেই ব্যাগটার কথা ভাবি| আমার চেতনে‚ অবচেতনে ঐ ব্যাগটা এমনভাবে রয়েছে যে মনে হয় ওটা না পেলে আমি যেন ঠিক শান্তি পাচ্ছি না| আমি কি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি?
তখন আমার কতই বা বয়স হবে‚ ঐ সাত কি আট‚ একদিন তুতুলদি আমাদের বাড়িতে এসেছিল কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা নিয়ে| কচিকলাপাতা রঙের ভারি সুন্দর দেখতে ব্যাগটা রেখেছিল ছোট টেবলটার ওপরে| আমি ঘুরে ফিরে দেখছিলাম ব্যাগটাকে| তুতুলদি বলল ব্যাগটা সুন্দর না?
খুব সুন্দর| আমি তখন ব্যাগের সৌন্দর্যে মোহিত| আমি কিন্তু হাড় হাভাতে ছিলাম না| লোভীও নয়| তবু ঐ ব্যাগটা কি করে যেন আমায় মোহিত করেছিল|
দেখ সোনা কতগুলো চেন আর কতগুলো পকেট এর| বলে তুতুলদি খুলে খুলে একটা একটা করে চেন দেখাচ্ছিল| তারপর বলল দেখ কি নরম|
আমি হাত বাড়িয়ে দেখতে যেতেই তুতুলদি ছোঁ মেরে সরিয়ে নিল ব্যাগটাকে| যেন আমি হাত লাগালে ব্যাগটা নষ্ট হয়ে যাবে|
হাত দিচ্ছিস যে বড়‚ আমি কি তোকে হাত দিতে বলেছি?
বারে তুতুলদি‚ এইমাত্র তো তুই বললি দেখ কি নরম‚ তাই তো আমি হাত দিয়ে দেখতে যাচ্ছিলাম|
ওটা কথার কথা|
একটু দেখতে দে না ?
মামুকে বল না‚ তোকে একটা এইরকম ব্যাগ কিনে দিতে‚ তারপর যত ইচ্ছে দেখিস| শেষের শব্দগুলোতে শ্লেষ ছিল| এখন বুঝি কিন্তু তখন বুঝিনি| কিন্তু শব্দগুলো খারাপ লেগেছিল| তুতুলদি জানত খুব ভালো করেই তার মামু‚ মানে আর কি আমার বাবা আমাকে ব্যাগটা কিনে দেবে না| ব্যাগটা বেশ দামী ছিল তখনকার হিসাবে|
সেই প্রথম আমি বাবার কাছে পাবো বা জেনেও অহেতুক বায়না ধরেছিলাম ঐরকম একটা ব্যাগ আমায় কিনে দিতেই হবে| কিন্তু বাবা দেয় নি| বাবা বুঝিয়েছিল‚ পরের দেখে লোভ করতে নেই| কিন্তু আমি শুনিনি| আসলে ব্যাগটার প্রতি আমি এতটাই অবসেসড ছিলাম যে একদিন তুতুলদি যখন বাড়ি ছিল না ব্যাগটা চুরি করেছিলাম তুতুলদির বাড়ি থেকে| চুরি করা যে খুব গর্হিত অপরাধ সেটা আমি জানতাম আর জেনেই করেছিলাম| ধরা যে পড়ে যাব এই বোধটা ভেতরে ভেতরে ছিল তবু নিজেকে বিরত করতে পারিনি|
তুতুলদি এসেছিল পিসাইকে নিয়ে| আর পিসাই আর তুতুলদি মিলে এত কথা এত কথা মাকে আর বাবাকে শুনিয়েছিল যে‚ বাবা আমায় প্রায় মারতে মারতে আধমরা করে দিয়েছিল| লুকিয়ে রেখেছিলাম ব্যাগটাকে ঠাম্মার ঘরে| বাবা তুলে দিয়েছিল তুতুলদির হাতে ব্যাগটাকে| আর তারপর থেকে আমি আর কোনদিন তুতুলদির বাড়ি যায়নি‚ কথাও বলিনি তুতুলদির সাথে| কিন্তু ব্যাগটাকে ভুলতে পারিনি| একটা জেদ চেপেছিল একদিন ঠিক ঐ রকম দেখতে একটা ব্যাগ আমি কিনবই| হয়ত সেই কারণেই ঐ ব্যাগটা আমি খুঁজছি| খুঁজেই চলেছি|
আমার চেতনে‚ অবচেতনে সবসময় ঐ ব্যাগটা রয়ে গেছে| পুরোনো দোকানেও খুঁজেছি‚ যদি ঐরকম ব্যাগ পাওয়া যায়‚ কিন্তু না পাওয়া যায়নি| সময়ের সাথে সাথে তো রুচি পাল্টায় আর তার সাথেই সামঞ্জস্য রেখে আর চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই বাজারে প্রোডাক্ট আসে| এসব যে আমি জানি না তা নয়‚ তবু খুঁজছি আমি|
আচ্ছা আমি কি ব্যাগটাকে খুঁজছি নাকি সেদিনের সেই জ্বালাটাকে মেটানোর চেষ্টা করছি‚ হয়ত সেই কষ্টটাকে মুছে দেবার চেষ্টা করছি নাকি সেই যে চুরিটা করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করছি? ঠিক কোনটা| দিশাহীন লাগে নিজেকে নিজের কাছে| এই যেমন এখন লাগছে|
মাঝে মাঝে আমি ভাবি আচ্ছা ঐরকম যদি একটা ব্যাগ আমি পাই‚ তাহলে ঠিক কি করব? কিনব কিম্বা হয়ত কিনবই না‚ হয়ত আজ আর দেখে সেদিনের মত ভালোলাগা তৈরিই হবে না‚ তবু খুঁজে চলেছি আমি ব্যাগটাকে| আমি জানি কোনদিন খুঁজে পাব না‚ হয়ত পেতেও চাই না| আসলে আমি বুঝি আমার শৈশবকে খুঁজে চলেছি| মুছে দিতে চাইছি সেদিনের সেই অপমানকে ? কিম্বা সেদিনের সেই অপ্রাপ্তিকে আজ আমি মুছে দিতে চাইছি ঐ ব্যাগটা খোঁজার মাধ্যমে| আচ্ছা আমি আসলে ঠিক কি চাইছি?
হেঁটে চলি সামনের দিকে| চোখে কোন ব্যাগের দোকান পড়লে আমার চোখ চিরুণি তল্লাশী চালায় রোজকার মত সেই ব্যাগটার খোঁজে| এ যেন আমার নিরন্তর খোঁজা |
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..