প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বিয়েতে হ্যাঁ বলতে অনেক অস্বস্তি কাজ করেছে সুচরিতার। একে তো বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। এ বয়সে আষ্টেপিষ্টে কাউকে জড়িয়ে ফেলা বেশ মুশকিল। কোথায় যেন একটু হাঁফ ধরে। একটা খোলা জায়গা লাগে। শ্বাস নিতে। বিয়ে করলে ঘরগুলো কেমন জানি জানলা দরজাহীন গারদ হয়ে যায়। তার ওপর আছে অতীত। সেই কুড়ি বছর বয়সের ভুলটা না হয় কাটাছেঁড়া হয়ে গেছে বহুদিন। কিন্তু এত বছর পরেও যে দাগগুলো একেবারে মিলিয়ে গেছে তা জোরগলায় সুচরিতা বলতে পারে কই? আবার বিয়ে! ভাবতে গেলেই একটা ঠাণ্ডা চোরা স্রোত বয় পায়ের নিচে। আর অতীত মানে তো শুধু বিয়ে নয়, আছে তার পরের জীবনটাও। নেহাত নিরিমিষ জীবন তো কোনোদিনই কাটায়নি সুচরিতা। ভুল শুধরে নতুন খেলোয়াড়ের মতো মাঠে নেমে পড়েছিল। কতগুলো মানুষ এসেছিল জীবনে? নামগুলো জানি কি কি ছিল? মাঝেমাঝে সব হিসেবই গুলিয়ে যায়। অনিকেত অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে নেহাতই নারাজ। ‘আরে ধুর, আমিই বা কি এমন ধোয়া তুলসীপাতা? সুপর্ণার সাথে বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর রাখী, মালবিকা, ঈপ্সিতা…অমন কতজনই তো এসেছিল। সত্যি বলছি, প্রতিবারই ভাবতাম, এই শেষ। আর প্রতিবারই কয়েক বছর পর সেই এক গান। ধান্দা ধান্দা! স্রেফ ধান্দায় এসেছিল সব, বুঝলে?’
সুচরিতার অবশ্য সবাইকে এক কথায় ধান্দাবাজ বলে দিতে একটু বাধো বাধো লাগে। সত্যি বলতে কি, সে অর্থে ল্যাং তো একবারই খেয়েছে। সেই কুড়ি বছর বয়সে। বাকি তো সব কেমন প্রতিশোধস্পৃহায় ও নিজেই ডেকে এনেছিল জীবনে। উদ্দাম যাপনের পর ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া জন্ম নিরোধকের মতোই তাদের দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকানোর প্রবৃত্তি হয়নি। সুচরিতার মাঝে মাঝে মনে হয়, ভালোবাসা, প্রেম, টান…এ সব আসলে শোভনতার মোড়কমাত্র। ভিতরে রাখা সেই আদি অকৃত্রিম শরীর। চল্লিশে পৌঁছে যখন শরীর আর সহজে সাড়া দেয়না, তখনই বোধহয় ভবিষ্যতের চিন্তা ছায়া ফেলে চোখের পাতায়। বুড়ো বয়সে কে থাকবে পাশে? তাই শেষ পর্যন্ত নাছোড়বান্দা অনিকেতকেই হ্যাঁ বলে দেয় ও। আরে বাবা, এটাও তো ভাবতে হবে, যে অনিকেত ছাড়া আর কেউ সেভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি। সবারই ছিল ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না’ গোছের কথাবার্তা। সুচরিতা জানে, সবাই ওকে ছাড়া দিব্যি বেঁচে বর্তে আছে, সংসারের শাঁসটুকু চেটেপুটে খাচ্ছে সুখী দাম্পত্যের খোলসে। তাহলে ওই খামোখা বাদ পড়ে কেন?
সেই ছোটবেলার বান্ধবী রিনি আর দিদি-জামাইবাবু সাক্ষী দিল। আর অনিকেতের বন্ধু প্রিয়জিত। কেউ ফুলের মালাটালা আনার আদিখ্যেতা দেখায়নি, এই বাঁচোয়া। সিঁদুরে সুচরিতার অ্যালার্জি আছে। কেবল একটা নতুন পিওর সিল্ক পরেছিল। তারপর দল বেঁধে রেস্তোরাঁ। সেখানে পার্টি অবশ্য নিরিমিষ হয়নি। অনিকেত-সুচরিতার খুব ঘনিষ্ট কয়েকজনকে বললেও তা প্রায় কুড়ি ছুঁইছুঁই। টানা তিনটে টেবিল জুড়ে রাখা হয়েছিল আগের থেকেই। সেখানেই সবাই উল্লাস জানিয়ে ওদের যৌথ জীবন সূচনাকে সেলিব্রেট করল। খাওয়াটা বেশ জমল। হাসি ঠাট্টার মাঝেমাঝে কখনো অতীতও এলো স্মৃতিচারণের ঢঙে। কিন্তু ওদের বিচক্ষণ বন্ধু বান্ধবীরা বেশ সতর্কভাবেই এড়িয়ে গেল দুজনের জীবনের একটা বিশেষ পর্বের কথা। অনিকেত খেয়াল করল কিনা কে জানে, সুচরিতা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অন্তত আজকের দিনটায় ওসব কথা নাহয় থাক।
শেষকালে বেশ রাত করেই ট্যাক্সি থেকে নামল ওরা অনিকেতের এক কামরার ফ্ল্যাটের সামনে। বাঁচোয়া যে কারো মনোরঞ্জন করতে হবে না। বাপ-মা মরা অনিকেতের দাদা সেই নর্থ বেঙ্গলে। ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজন কেউ নেই যে এসে সুচরিতাকে বরণ করে তুলবে। ‘ভাগ্যিস!’ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও। কুড়ি বছর আগের সেই রুমাল দিয়ে জ্যান্ত মাছ ধরার আতঙ্ক আজও ভোলেনি ও। আর দুনিয়ার খুড়শাশুড়ি পিসশাশুড়িদের গয়না নেড়েচেড়ে দেখা! যতই ভুলতে চেষ্টা করুক, আজও সইসাবুদের সময় হাতটা কেঁপে উঠেছিল একটু। তারপর অনিকেতের আত্মবিশ্বাসী সইটাই ওকে সাহস যোগায়। এ যে জীবনকে রীতিমতো রিস্টার্ট করা!
এ ফ্ল্যাটটাও অচেনা নয় সুচরিতার। তবে এবার একেবারে নিজের অধিকারে প্রবেশ। আগে কোথাও একটু কিন্তু কিন্তু লাগত। পাশের ফ্ল্যাটের বৌটা কি দরজার আড়াল দিয়ে উঁকি মারছে? নিচের সিকিউরিটিটা কি ভ্রূ কোঁচকাল? আর এবার একটু বেশি আত্মবিশ্বাস দেখাতে গিয়ে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে ফেলল ও।
‘উফ!’ ভ্রূ কুঁচকে ওঠে অনিকেতের।
‘সরি, সরি!’
‘তোমার আবার এই দুমদাম আওয়াজ করে দরজা বন্ধ করার স্বভাব আছে নাকি? সুপর্না যে কতবার…’
মনে মনে জিভ কেটেই বোধহয় কথাটাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয় অনিকেত। না না, সুপর্না এ ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করত না। সে তো ছিল শ্রীমানি বাজারের সাবেক বাড়ি।
শোবার ঘরে ঢুকে শাড়ি জামার হাঁসফাঁশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে সুচরিতা। ঝুটো মুক্তোর সেটটা রাখে শোকেসের ওপর। অনিকেত বাথরুমে ঢুকেছে। ক্লান্ত লাগছে একটু। তার ওপর তিন পেগ ভডকা মাথার ভেতর আলতো একটা রিনিঝিনি বাজিয়ে চলেছে। আজ বোধহয় শুলেই ঘুমিয়ে পড়বে ও।
শিল্পী: রিয়া দাস
হঠাত বেডসাইড টেবিলে চোখ পড়তেই একটা ধাক্কা খায় সুচরিতা। ফুলদানিতে যত্ন করে রাখা তিনটে জারবেরা। আলাদা আলাদা রঙের। জারবেরা! গোলাপ না, জুঁই না, ফুলশয্যার পেটেন্ট রজনীগন্ধা না… অনিকেত হঠাত এই ফুলটাই আনল কেন ঘর সাজাতে! অফিসে ফ্লাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট কমপিটিশনের দিনটা ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ভেসে উঠল চোখের সামনে। সঞ্জয় আর ও একই টিমে ছিল। শুধু জারবেরাই বেছে নিয়েছিল ওরা। আর কিছু লতাপাতা, সঞ্জয়ের বাগানের। অনেকের বড় বড় ইকাবেনার মধ্যে ওদের ডেকরেশন ভারী ছিমছাম হয়েছিল, প্রাইজ পেয়েছিল ওরাই। ক্যাশ অ্যাওয়ার্ড। সে রাতেই টাকাটা উড়ে গেছিল আউট্রাম ঘাটে নৌকা চড়ে, আইসক্রিম খেয়ে। আইস্ক্রিমের শেষটুকু জিভ দিয়ে ওর ঠোঁট থেকে চেটে নিয়েছিল সঞ্জয়।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনিকেত ঘরে ঢুকতেই এক ঝটকায় বাস্তবে ফেরে সুচরিতা। ভাগ্য ভালো লোকটা ওর মুখের দিকে তাকায় নি। বারমুডা আর টি শার্ট পরে রাতের জন্য তৈরি হয়ে এসেছে অনিকেত। ওর এই মাঝ চল্লিশের পেটানো চেহারাটা এক মুহূর্তের জন্য সুচরিতাকে অতীত ভুলিয়ে দিল। ও বলতে ভুলে গেল ফুলদানিটা সরিয়ে দেওয়ার কথা।
কিন্তু ভালোলাগার আবেশটা ছিঁড়ে গেল এক নিমেষেই।
‘ওফ! শোবার ঘরের বিছানার ওপর এ সব বাইরের শাড়ি জামা ছেড়ে রাখো কেন বলো তো? যত রাজ্যের রাস্তার ধুলো!’
‘বেডকভারটা তো তোলাই হবে।’
‘তা হোক না। দেখতে বিশ্রী লাগে। ওয়ারড্রোবটা আছে কী করতে? সব এক স্বভাব তোমাদের!’
‘তোমাদের মানে?’
হুঁশ ফেরে অনিকেতের। আর একটিও কথা না বাড়িয়ে লাগোয়া বারান্দায় বেরিয়ে যায়। বিছানার ওপর শাড়ি জামা ছেড়ে রাখা কার অভ্যাস ছিল? রাখীর? মালবিকার? গলার কাছটা ব্যথা করে ওঠে সুচরিতার। চল্লিশ বছর বয়সের চোখের জল লুকোনোর জন্য চটপট ওয়ারড্রোব খুলে শাড়ি ভাঁজ করে ঢুকিয়ে ফেলে। তারপর নাইট ড্রেস নিয়ে পা বাড়ায় বাথরুমের দিকে। অনিকেত তখনো বারান্দায়, অন্ধকারে।
বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করতেই গা-টা কেমন গুলিয়ে ওঠে সুচরিতার। সাড়ে চারশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে টয়লেট তো পায়রার খোপ। সেটা ভরে আছে বিড়ির গন্ধে। দম আটকে আসে সুচরিতার। জানলার ওপর অ্যাশট্রে। কমোডে তখনো ভাসছে আধ পোড়া বিড়ির টুকরো। কুড়ি বছর আগে এই গন্ধটা একটা বিশাল অ্যাজেন্ডা হয়ে গিয়েছিল না সম্পর্কটায়?
‘তুমি জানো, কত লোক রোজ লাং ক্যানসারে মরে?’
‘তুমি জানো, তার মধ্যে কত জন বিড়ি সিগারেট খায় না?’
‘প্যাসিভ স্মোকারদেরও ক্যান্সার হয়।’
‘আমি তোমার সামনে খাচ্ছি না।’
‘বাথরুমে খাও কেন? কী দুর্গন্ধ হয়ে যায়! তোমার পরে ঢুকলে আমার গা গুলোয়।’
‘উঁ… নবাবজাদী এক্কেবারে! তোর বাপকে বলিস, একটা একজস্ট ফ্যান যেন লাগিয়ে দিয়ে যায়।’
আইলাইনার কাজল মাস্কারা সব ধুয়ে একরাশ জল গড়িয়ে নামতে থাকে সুচরিতার গালের ওপর। একটু পরেই বাইরে থেকে টোকা পড়ে দরজায়। অনিকেত।
‘এই, এতক্ষণ কী করছ? বেশি জল ঘেঁটো না, ঠান্ডা লেগে যাবে!’
চটপট চোখ মুখ ধুয়ে ব্লাউজ সায়া খুলে নাইট ড্রেস গলিয়ে বাইরে আসে সুচরিতা। না, আর ভাববে না। সব কিছু মুছে ফেলেই তো এখানে পা রেখেছে! কোন মানুষটা নিখুঁত হয়? ওর দোষেরই কি শেষ আছে?
ঘরটা নীলাভ আলোয় মোহময় হয়ে আছে। বড় যত্ন করে বিছানা সাজিয়েছে অনিকেত। দুটো বালিশ, পায়ের কাছে কম্বল, মাথার কাছে জানলার ওপর চমৎকার ঢাকনা দেওয়া কাচের গ্লাসে জল। ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলের ক্যাম্প খাট আর কুটকুটে কম্বলটা যেন মুহূর্তে ভ্যানিশ হয়ে গেল মাথা থেকে। আহ! কতদিন পর এমন একটা চমৎকার বিছানায় ঘুমোবে ও! দিদির বাড়ি গিয়ে থাকলেও আরাম হয় বটে, তবে সে তো আর নিজের বিছানা নয় ঠিক, ঝুনুর সঙ্গে শেয়ার করে। এখানেও বিছানা শেয়ারড হবে, কিন্তু সে করবে শুধু তার নিজের পুরুষটি। আইনত এবং হৃদয়ত।
ভদকার ঝিম ধরা ভাবটা বালিসে মাথা রাখতেই আরেকবার ফিরে আসে। অনিকেতও ক্লান্ত। শরীর…সে ওদের খুব চেনা…আর এখন কোনো তাড়াও নেই। কোথাও ফিরতে হবে না। সুচরিতা নির্ভাবনার মাথা রাখে অনিকেতের বুকে। ‘সব ভুলে যাবো আমি, দেখো। নতুন করে বাঁচব তোমায় নিয়ে।’ বিড়বিড় করে ও। অনিকেতের আঙুল ওর চুলে বিলি কেটে চলে।
আচমকাই ঘুম ভেঙে যায় সুচরিতার। কীসের শব্দ? যেন এক ধাক্কায় ফিরে যাওয়া সেই কুড়ি বছর আগে! এ আওয়াজ তো অপরিচিত নয়। কত রাত নির্ঘুম কেটেছে! কতবার পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিতে হয়েছে ঠেলেঠুলে! কতবার বালিশে কান চেপে…
হ্যাঁ, ঠিক তাই। চিত হয়ে মড়ার মতো শুয়ে অনিকেত। বুকের ওপর হাত। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক হয়ে আছে। কশ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। আর নিঃশ্বাসের তালে তালে একটা আদিম বন্য জন্তু যেন গর্জে উঠছে ওর নাকের ভেতর! হুবহু সেই কুড়ি বছর আগের…
নীলাভ আলোয় ঘুমহীন সুচরিতা কাঁদতেও ভুলে যায়!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..